অনিমেষ যখন প্রথম কলকাতায় পা রেখেছিল তখন রাস্তায় ট্রাম জ্বলছে, গুলি চলছে। উত্তরবঙ্গ থেকে আসা এই তরুণটি সেদিন দুর্ঘটনার শিকার হয়েছিল। তারপর আর পাঁচটা মানুষের মতো গা ভাসিয়ে ভেসে যেতে যেতে হঠাৎ তার জীবনের মোড় পাল্টালো। ছাত্র-রাজনীতি তাকে নিয়ে গেল জটিল আবর্তে। এই দেশে আর দেশের মানুষের পাশে দাঁড়ানোর দুর্বার বাসনায় বিভক্ত কমিউনিস্ট পার্টির পতাকার নীচে গিয়ে দাঁড়াল। কিন্তু মনুষ্যত্ব এবং মানবিক মূল্যবোধ তাকে সরিয়ে নিয়ে এল উগ্র রাজনীতিতে। সত্তরের সেই আগুনে ঝাঁপ দিয়ে নিজেকে দগ্ধ করে সে দেখল, দাহ্যবস্তুর কোনও সৃষ্টিশীল ক্ষমতা নেই। পুলিশের নির্মম অত্যাচারে সে যখন বিকলাঙ্গ তখন বিপ্লবের শরিকরা হয় নিঃশেষ নয় গুছিয়ে নিয়েছে আখের। অনিমেষ অবাক হয়ে দেখল মাধবীলতাকে। মাধবীলতা কোনও রাজনীতি করেনি কখনও, শুধু তাকে ভালবেসে আলোকস্তম্ভের মতো একা মাথা তুলে দাঁড়িয়ে আছে। খরতপ্ত মধ্যাহ্নে যে এক গ্লাস শীতল জলের চেয়ে বেশি কিছু হতে চায় না। বাংলাদেশের এই মেয়ে যে কিনা শুধু ধূপের মতো নিজেকে পোড়ায় আগামীকালকে সুন্দর করতে। দেশ গড়ার জন্যে বিপ্লবের নিষ্ফল হতাশায় ডুবে যেতে যেতে অনিমেষ আবিষ্কার করেছিল বিপ্লবের আর এক নাম মাধবীলতা। দেশ পত্রিকায় ধারাবাহিক প্রকাশের সময় এই দুটি চরিত্র লক্ষ পাঠকের ভালবাসা পেয়েছিল। সুস্থ উপন্যাসের সেইখানেই সার্থকতা।
Samaresh Majumdar (Bangla: সমরেশ মজুমদার) was a well-known Bengali writer. He spent his childhood years in the tea gardens of Duars, Jalpaiguri, West Bengal, India. He was a student of the Jalpaiguri Zilla School, Jalpaiguri. He completed his bachelors in Bengali from Scottish Church College, Kolkata. His first story appeared in "Desh" (a Bengali magazine) in 1967. "Dour" (Run) was his first novel, which was published in "Desh" in 1976.
Author of novels, short stories and travelogues, Samaresh received the Indian government's coveted Sahitya Akademi award for the second book of the Animesh series, Kalbela.
Some of his famous characters are: 1. Animesh & Madhabilata of Animesh trilogy (Uttaradhikar, Kaalbela, and Kalpurush) 2. Arjun - the sleuth cum science fiction character 3. Dipaboli - main character of Saatkahon
পুরো গল্প জুড়ে রাজনীতি ও বিপ্লব থাকলেও পাঠকের মনে অনেক বড় জায়গা জুড়ে থাকবে মাধবিলতা। গল্পের শেষে সবাই যখন হারিয়ে গেলো, মাধবিলতায় পূর্ণতা পেলো অনিমেষ। ভালবাসার জন্য মাধবিলতার ত্যাগ বাকি সবকিছুকে ম্লান করে দেয়। পুরো গল্পটা এক নিঃশ্বাসে শেষ করেছি।
অনিমেষ মিত্র। জলপাইগুড়ি থেকে কলকাতা আসে উচ্চশিক্ষা লাভের জন্য। কলকাতায় পা রাখতেই পরে বিপদের মুখে। কলকাতায় তখন কারফিউ চলে। পুলিশ তাকে সন্দেহ করে গুলি ছোড়ে। থাইয়ের নিচে হাটুর উপরের অংশে গুলি লেগে হাসপাতালে পড়ে থাকে তিনমাস। সুস্থ হতে হতে একটা শিক্ষাবছর নষ্ট হয়ে যায় অনিমেষের। রাজনীতি সম্পর্কে বুঝ হবার পর থেকেই সে বামপন্থী মনোভাব ধারন করে। বিশ্ববিদ্যালয়ে পড়তে গিয়ে জড়িয়ে পরে বামপন্থী কমিউনিস্ট পার্টির সাথে। পুলিশের গুলিতে হওয়া ক্ষতচিহ্নটাকে 'সাধারন মানুষের উপর পুলিশি নির্যাতনের' প্রকৃত হিসেবে ব্যবহার করে ছাত্র ইউনিয়নে বিপুল ভোটে জয়লাভ করে। কিন্তু সে যেই আদর্শ নিয়ে বামপন্থী কমিউনিস্ট পার্টিতে যোগ দেয় কিছুদিন পরে বুঝতে পারে সবই ফাকি। সবাই ক্ষমতার গদিটাকে পাওয়ার জন্য বিভিন্ন আদর্শের দোহাই দেয়। ধীরেধীরে প্রেমের সম্পর্কে জড়িয়ে পড়ে তার সহপাঠিনী মাধবিলতার সাথে। মাধবিলতার ভাষ্য মতে লতার মতই অনিমেষের জীবনে জড়িয়ে পড়ে মাধবিলতা। অনিমেষ চায় সমাজ ব্যাবস্থার পরিবর্তন। কিন্তু এই পরিবর্তন কিভাবে আসবে! রাজনীতি করে পরিবর্তন আনা সম্ভব নয় সেটা খুব ভালভাবে বুঝতে পেরেছিলো অনিমেষ। যার হাত ধরে বামপন্থী কমিউনিস্ট পার্টিতে এসেছিলো; সেই সুভাসদাকে যখন পার্টি থেকে বের করে দেওয়া হলো তখন সুভাসদার পথ অনুসরণ করে বিপ্লবী হলো অনিমেষ। আর মাধবিলতা?? জানতে হলে যারা পড়েন নাই তারা ঝটপট পড়ে ফেলুন।
অসামান্য, অসাধারণ, অতুলনীয়। সাহিত্য একাডেমী পুরষ্কার - ১৯৮৪ পাওয়া এই উপন্যাস আমার পাঠকজীবনের একটা অন্যরকম অভিজ্ঞতা। অনিমেষ আর মাধবীলতাকে যেমন অসংখ্য পাঠক ভালোবেসেছেন, ভালোবেসেছি আমিও।
কালবেলা কে একটা জনরায় আবদ্ধ করা আমাদের সাহিত্যবোধ আর আত্মিক সীমাবদ্ধতা স্পষ্টভাবে। কালবেলা কোনো রাজনৈতিক উপন্যাস নয়। ভালোবাসার উপন্যাস, নিজেকে পদে পদে খুজে নেওয়ার উপন্যাস৷
রাজনীতি ছাপিয়ে প্রেমের গল্প 'কালবেলা'। সমরেশ মজুমদারের মোহিনী পড়েছেন ক'জনে! অনেকের ভাল লাগেনি, তাইতো! আমার বড্ড ভাল লেগেছিল, কারণ আমি গল্পের ভেতরে আরেক গল্প আবিস্কারের নেশায় বই পড়ি। কালবেলাকে মোহিনীর সাথে তুলনা করবো না, তবে আবিস্কারের নেশায় কালবেলা তেমনই এক উপন্যাস। গভীর রাজনীতির মাঝেও প্রেম খুঁজে পেয়েছি, মোহিনীতে পেয়েছিলাম এক মানুষ নারীকে, প্রাণবন্ত সে নারী। আসলে খুঁজতে হয়েছে, রাজনীতি পছন্দের নয় কিনা! বিশাল সাইজের চিত্রপট নিয়ে সিরিজ বইয়ের দ্বিতীয় এটি, এত বড় সিরিজ লিখতে গেলেই লেখকের ব্যক্তিসত্ত্বা এমনিতেই উঠে আসে। মানে সমরেশের ব্যক্তিজীবন। উনি অবশ্য কিঞ্চিৎ অস্বীকার করেছিলেন। সে করুক, সমরেশ মজুমদার যে অনিমেষের মাঝে আপন সত্ত্বার বীজ বপন করে কালবেলা লিখেছিলেন তা অস্বীকার করার উপায় এই। আসুন একটু হিন্ট দেই, উত্তরাধিকার লেখার পরে পশ্চিমবঙ্গে ক্ষমতার পালাবদল ঘটেছে, সদ্য ক্ষমতায় সিপিআই। আষ্টেপৃষ্ঠে মার্ক্সবাদী কমিউনিস্ট। এদেরই শাখাপ্রশাখা নকশাল আন্দোলন করেছিল। ক্ষমতায় আসার পরে রাজবন্দীদের মুক্তি, ফৌজদারী মামলা তুলে নেওয়ার সব কিছুই করেছিল সিপিআই। উদ্দেশ্য শুরুর আদর্শের সবাইকে আবার একভূত করা। ঠিক সেগুলো পরিষ্কারভাবে এসেছে কালবেলায়। যে কথা বলছিলাম, উত্তরাধিকার লেখার পরে সমরেশ মজুমদারকে সিপিআই মন্ত্রী বুদ্ধদেব ভট্টাচার্য বলেছিলেন উত্তরাধিকার বইটি কমিউনিস্ট পার্টির দলিল হিসাবে ঘোষণা দাও, লাখ কপি বিক্রি হবে। লেখক অবশ্য সেকথা শোনেননি যদিও তার ভেতরে কমিউনিজমের আদর্শই ছিল ঠিক একই জিনিস তিনি বইটির মুখ্য চরিত্র অনিমেষে দেখিয়েছিলেন। এখানে কথা আছে, অভিজ্ঞতা কথা বলে। হয়ত কিছুটা চিন্তাও কাজ করছিল, গতানুগতিক রাজনীতির বই তাও যদি শুধু কমিউনিস্টদের নিয়ে হয় তবে বইটি হয়ে যায় বিশেষ শ্রেণীর। সে সময়কার চরম জনপ্রিয় লেখক সমরেশ মজুমদার বেশ ডিপ্লোমেটিক ছিলেন বোঝা যায়, তিনি কালবেলায় নিয়ে এলেন প্রেম। আহা যেই সেই প্রেম নয়, মাধবীলতার লদকালদকি প্রেম। বিশ্বাস করুন, শুধু সামাজিক ও রাজনৈতিক উপন্যাস হলে মাধবীলতা চরিত্রের কোন দরকারই ছিল না। কিন্তু অভিজ্ঞ এই লেখক কেন বিশেষ গণ্ডিতে সীমাবদ্ধ থাকবেন! দেশ পত্রিকায় যখন উপন্যাসটি ধারাবাহিকভাবে প্রকাশ করে, উঠতি বয়সী রোম্যান্টিক পড়ুয়ারা দেদারছে কিনেছে পত্রিকা। তৎকালীন সাহিত্য সমালোচকরা বলেছিলেন গোপনে গোপনে সরকারপক্ষও বইটির প্রচারে সহায়তা করেছিল। ওই যে কারণ পটভূমিতে পশ্চিমবঙ্গের কমিউনিস্ট। আরেকটা জিনিস খেয়াল করবেন, উত্তরবঙের জলপাইগুড়ি থেকে কোলকাতায় এসেছিলেন অনিমেষ। লেখক নিজেই কিন্তু তাই! এটা অবশ্য সমস্যা না, লেখক তার চেনা পট, পরিবেশ নিয়ে লিখবেন এটা অন্যায় নয়।
কি আছে 'কালবেলা'য়ঃ কী নেই বলুন! একটুতো বললামই, রাজনীতি আর প্রেম। হ্যাঁ ওটা মুখ্যা ওটা ছাড়াও রয়েছে। তার আগে গল্পে আলোকপাত করা যাক। জলপাইগুড়ি, কাঞ্চনজঙ্গার শীতল আবহাওয়া ছেড়ে উপন্যাসের নায়ক অনিমেষ চলে আসে কোলকাতায়। এটা অবশ্য উত্তরাধিকার ছিলো। কোলকাতায় আসার প্রথম দিনে পুলিশ ও মিছিলকারীদের মাঝে বুলেটবিদ্ধ হয় অনিমেষ। মিশনারী কলেজ স্কটিশ চার্চে ভর্তি হয়ে যে হোস্টেলে তার জায়গা হয়েছিলো সেখানে ছিল জামসেদপুরের ধনীর দুলাল তরুন কবি ত্রিদিব সেনগুপ্ত। ক্ষণে ক্ষণে কবিতা আর নেশার আভরণে ডুবে থাকা ত্রিদিবের সাথে ভাল সখ্যতা হয় অনিমেষের। বাংলায় এমএর ছাত্র অলক্ষ্যে জড়িয়ে পড়ে কমিউনিজমে, স্বপ্ন সাম্যের ভারতবর্ষ গড়ে তোলা। জলপাইগুড়ির মত পাহাড়ি এলাকা থেকে আসা অনিমেষ তখনো বুঝতে পারেনি রাজনীতির ভেতরেও গভীর বিষাক্ত নগ্নতা রয়েছে। চোখের সামনে ভাগ হতে দেখেছে আদর্শকে। রাজনীতিতে যখন গভীরভাবে অনিমেষ ডুববে তখনই তার জীবনে এলো সহপাঠিনী মাধবীলতা। ধনীর দুলালী মাধবীলতা রাজনীতিতে আকৃষ্ট না হলেও অনিমেষে সঁপে দিয়েছিল নিজেকে। একেবারে গভীরভাবে। একদিকে রাজনীতি অন্যদিকে প্রেম দুটোর মাঝে ব্যাল্যান্স করেছে অনিমেষ। মাধবীলতা তার জগৎজূড়ে থাকা অনিমেষকে নিয়ে ভালবাসাছাড়া বিশেষ ভাবনা ছিল না। এদিকে দলীয় কোন্দলে ভাগ হয়ে যায় সুভাষ এবং হয়ে ধীরে ধীরে গড়ে তোলে বিদ্রোহী গ্রুপ। আদর্শ বিবর্জিত নেতাদের ছেড়ে অনিমেষও ভিড়ে যায় সুভাষের সাথে সশস্ত্র আন্দোলনে, নকশালবাদ। একে একে হারিয়েছিল বন্ধু কবি ত্রিবিদ সেনগুপ্ত। সুভাষ'দাকেও।
দীর্ঘ এই পরিক্রমায় মাধবীলতা কখনো অনিমেষের উপরে বিশ্বাস হারায়নি। আন্দোলনে পাশে না থাকলেও ব্যক্তিজীবনে সুখ ছড়িয়েছে তারা। সুখ-প্রেমের সেই গভীর ভাবনা লেখক সজীব রেখেছিলেন কালবেলায়। গ্রেফতার হয়ে পুলিশি নির্যাতনের শিকার হয়ে পঙ্গু হয় অনিমেষ। অনিমেষ পঙ্গু হয়ে জে��� থেকে মুক্তি পেয়েছিল। এতদিনে মাধবীলতা নিজেকে বিকিয়ে দেয়নি। যে শরীর সে অনিমেষকে দিয়েছিল সেই শরীরের বয়েছে অনিমেষের রক্তও। একমাত্র প���ত্র সন্তানকে নিয়ে জীর্ণশীর্ণ সেই বাড়িতেই ওঠে অনিমেষ। তিনটে মানুষের সে ঘর। শারীরিক অক্ষমতা, দারিদ্র, মাথার ওপরে শীর্ণ চাল থাকলেও সেখানে মাধবীলতার ভালবাসা ছিল। আর ফলাফল স্বরূপ সন্তান। যে ভালবাসা হৃদয়ের সেখানে বিশ্বাসের বন্ধন ছিল, সামাজিক বিয়ের দরকার হয়নি তবুও সে মাধবীলতা মিত্র। অনিমেষ মিত্রের স্ত্রী।
নিখাদ রাজনৈতিক উপন্যাস 'কালবেলা' তবে রাজনীতি খুব বেশি পছন্দের নয় বলে আমি বইটিকে বলব অপরাজনীতির সুন্দর বিবরণ। অপরাজনীতি যে কতটা ভয়াবহ হতে পারে তার বাস্তব দৃশ্যপট পশ্চিমবঙ্গ। একই সময়ে যখন ভারতের অন্য প্রদেশগুলো সমৃদ্ধি করেছে পশ্চিমবঙ্গ খুইয়েছে ঐতিহ্য। অথচ কী ছিলনা তাদের। নকশালবাদ, বামরাজনীতি নিঃশেষ করে দিয়েছে। লেখক নিজে কমিউনিস্ট বলে একটা ভালোর শেষ দেখিয়েছেন। কিন্তু বইটি জুড়ে তিনি দেখিয়েছেন সেই অপরাজনীতির অবক্ষয়ের চিত্র, রক্তপাত হানাহানি। সেই রাজনীতির কথা বলতে গিয়ে এই জনপ্রিয় লেখক মুদ্রার অন্য পিঠের কোন চিত্রের শিক্ষা দেখাতে পারেননি। বাতলে দিতে পারেননি কেন ঘটলো। টাইটেল দিয়েছিলাম, রাজনীতিকে ছাপিয়ে প্রেমের গল্প 'কালবেলা'। ঠিক এখানে রেখেছেন দারুণ সব বার্তা, বলা চলে প্রেমের বার্তা। নারী ও ভালবাসার সংগ্রামের বার্তা। চরম বাস্তববাদী রাজনীতির সাথে সাথে প্রেম পছন্দ করেননা এমন পাঠকের উপন্যাস নয় 'কালবেলা'। তবে একটা মেয়ে ভালবাসার দায়বদ্ধতাকে ছাপিয়ে কীভাবে পরিপূর্ণ নারী হয়ে উঠতে পারে সেটার জীবন্ত উদাহরণ মাধবীলতা। লেখক হয়ত অনিমেষকে নেতা নয় বরং বিদ্রোহীই রাখতে চেয়েছিলেন বলে মাধবীলতাকে গণ্ডীতে আবদ্ধ রেখেছিলেন।
'কালবেলা' নকশাল আন্দোলনে জড়িয়ে যাওয়া এক অবিমৃষ্যকারী তরুণের সম্ভাবনাময় ভবিষ্যৎ ম্লান হয়ে যাওয়ার গল্প। ভুল মানুষের প্রেমে পড়া একজন জেদি তরুণীর জীবনের সকল সাধ আহ্লাদ ত্যাগ করে হাসিমুখে দুর্দশাগ্রস্ত জীবন বেছে নেওয়ার গল্প। কালবেলার প্রথমার্ধ খুব ধীরগতির, চমকবিহীন। বিরক্তিকর। তবে প্রথমার্ধের গুরুত্বপূর্ণ দিক হচ্ছে মস্কোপন্থী কমিউনিস্টদের ভণ্ডামি সম্পর্কে খুব পরিষ্কার ধারণা পাওয়া যায়। কালবেলা উপন্যাস জমতে শুরু করে অনিমেষ যখন মস্কোপন্থী থেকে চীনপন্থী হয়। বাস্তবতার নিরিখে আত্মঘাতী সিদ্ধান্ত, কিন্তু পাঠক হিসেবে সেটা রোমাঞ্চের আভাস। এবং সমরেশ মজুমদার হতাশ করেননি, শেষ অধ্যায়গুলিতে কিছু শ্বাসরুদ্ধকর উত্তেজনার উপাদান আছে। কিছু অপরিণত যুবক যারা নিজ নিজ পরিবারের দায়িত্ব নেওয়ার মত ম্যাচিউর না, তারা কোন প্রপার হোমওয়ার্ক ছাড়াই নেমে পড়ে দেশোদ্ধার করতে। ভারতের মত দেশ, যেখানে কোন যুদ্ধ-বিগ্রহ চলছে না, সেখানে বসে পকেটে পিস্তল নিয়ে "চীনের চেয়ারম্যান, আমাদের চেয়ারম্যান" স্লোগান দিয়ে, মাও সে তুংয়ের মত গ্রাম দিয়ে শহর ঘেরাওয়ের স্বপ্ন দেখা তরুণদের পরিণতি কী হতে পারে তা আঁচ করতে সমস্যা হওয়ার কথা নয়। কিন্তু তারপরও মাধবীলতা এমন অপরিণামদর্শী যুবককে ভালোবেসেছে, ব্যাপারটা বোকামি হলেও এই বোকামির একটা পোয়েটিক সৌন্দর্য আছে বৈকি, একটাই তো জীবন! ঝুঁকি না নিলে মজা কোথায়! ভালোবাসা থাকলে অনেক বড় কষ্টও কখনও কখনও ছোট কষ্ট মনে হয়, মাধবীলতার হয়ত তাই মনে হয়েছে। কালবেলায় বাকি প্রেমিকাদের পরিণতিও খুব একটা সুখের নয়, নীলা কিংবা শীলা সেন, সবাই ভালোবেসে দুর্বিষহ জীবনে পতিত হয়েছে। অসম প্রেমের পরিণতি করুণ হওয়াটাই স্বাভাবিক। অর্থাৎ কালবেলা উপন্যাসের একটা বড় সৌন্দর্য বলা যায় গল্পের বাস্তবতা। কালবেলার ঐতিহাসিক গুরুত্বটাও কম নয়, গত শতাব্দীর ষাট এবং সত্তরের দশকের পশ্চিমবাংলার উন্মাতাল তারুণ্য সফলভাবে উপস্থাপন করা হয়েছে এখানে, প্রেম কিংবা বিদ্রোহ- তখনকার তরুণ প্রজন্ম সবকিছুতেই কিঞ্চিত চরমপন্থী ছিল। সুকান্তের 'আঠারো বছর' এই তরুণদের মাঝে নেমে এসেছিল, তবে ট্র্যাজেডিরূপে। কমরেড সমরেশ মজুমদার, লাল সেলাম!
"History is written by the victors, but literature tells the story of the defeated."
সমরেশ মজুমদার রচিত 'কালবেলা' বাংলা সাহিত্যের এক অনন্য সৃষ্টি, যা আমাদের এক প্রচণ্ড উত্তাল সময়ের দিকে নিয়ে যায়।
১৯৬০-এর দশকের শেষভাগ ও ১৯৭০-এর দশকের প্রথমার্ধের নকশাল আন্দোলন, যুবসমাজের স্বপ্ন, রাজনৈতিক টানাপোড়েন এবং সেই আবেগমথিত সময়ের ব্যক্তিগত ও সামাজিক টানাপোড়েন এই উপন্যাসের মূল চালিকা শক্তি।
"A revolution is not a bed of roses. A revolution is a struggle between the future and the past." – Fidel Castro
'কালবেলা'র কেন্দ্রীয় চরিত্র অনিমেষ, যার মধ্য দিয়ে আমরা এক বিপ্লবী মননের বিকাশ প্রত্যক্ষ করি। উত্তরবঙ্গের এক সাধারণ পরিবার থেকে উঠে আসা এই যুবক কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয়ে পড়তে এসে রাজনৈতিক অস্থিরতার সঙ্গে জড়িয়ে পড়ে।
সমাজ ও রাষ্ট্রব্যবস্থার অসঙ্গতিগুলো তার মনে এক বিক্ষোভের জন্ম দেয়, যা তাকে নকশাল আন্দোলনের দিকে ঠেলে দেয়। তবে এই বিপ্লবী পথ একমাত্রিক নয়; এটি তার অস্তিত্বের গভীরতম সংকটের বহিঃপ্রকাশ।
"Love in the time of chaos is like a flower blooming in a storm."
অনিমেষের জীবনে মাধবীলতা এক গুরুত্বপূর্ণ চরিত্র। রাজনৈতিক আন্দোলনের পাশাপাশি তার সঙ্গে প্রেমের যে রসায়ন গড়ে ওঠে, তা শুধুমাত্র রোমান্স নয়, বরং এক আশ্রয়, এক বিশ্বাস। মাধবীলতা একজন আত্মনির্ভরশীল নারী, যে অনিমেষের বিপ্লবী জীবনের সঙ্গী হলেও তার নিজস্ব পরিচয় ও আত্মসম্মানের সঙ্গে আপস করতে চায় না। তাদের সম্পর্ক একদিকে প্রেম, অন্যদিকে সংগ্রামের প্রতীক।
"The price of freedom is eternal vigilance." – Thomas Jefferson
সমরেশ মজুমদার উপন্যাসটিকে নিছক রাজনৈতিক প্রেক্ষাপটেই আবদ্ধ রাখেননি; বরং এই সময়ের সামাজিক ও সাংস্কৃতিক দিকও তিনি দক্ষতার সঙ্গে তুলে ধরেছেন।
১৯৭০-এর দশকের কলকাতার বিশৃঙ্খলতা, পুলিশের দমননীতি, নকশালদের কঠিন জীবন, মধ্যবিত্ত ও নিম্নবিত্ত পরিবারের সংকট—এই সব কিছুই নিখুঁতভাবে চিত্রিত হয়েছে। বিশেষ করে রাজনৈতিক বিশ্বাসের জন্য অনিমেষের যে মূল্য চোকাতে হয়, তা এক নির্মম বাস্তবতা।
"Victory has a hundred fathers, but defeat is an orphan." – John F. Kennedy
এই উপন্যাস আমাদের এক অমোঘ সত্যের সামনে দাঁড় করায়—বিপ্লব সবসময় সফল হয় না, কিন্তু বিপ্লবের প্রয়োজনীয়তা কখনো ফুরিয়ে যায় না। অনিমেষের সংগ্রাম ব্যক্তিগত ও রাজনৈতিক পরাজয়ে পর্যবসিত হয়, কিন্তু তার অভিজ্ঞতা ও যন্ত্রণা পাঠককে নাড়া দেয়। মাধবীলতা যেখানে জীবন ও বাস্তবতার মধ্যে এক সমঝোতার পথ খুঁজে নেয়, সেখানে অনিমেষের গল্প এক ট্র্যাজিক হিরোর পরিণতি পায়।
"Some books leave us free and some books make us free." – Ralph Waldo Emerson
'কালবেলা' শুধুমাত্র একটি উপন্যাস নয়, এটি এক প্রজন্মের স্বপ্নভঙ্গের কাহিনি। সমরেশ মজুমদারের লেখনশৈলী, বর্ণনার স্বাভাবিকতা, সংলাপের আন্তরিকতা, এবং বাস্তবসম্মত চরিত্রচিত্রণ এই উপন্যাসকে কালজয়ী করে তুলেছে।
যারা বাংলা সাহিত্যে রাজনৈতিক এবং ব্যক্তিগত সংকটের সংমিশ্রণ খুঁজছেন, তাদের জন্য এটি অবশ্যপাঠ্য।
বেশ সময় নিয়েই শেষ করলাম 'উত্তরাধিকার'-এর দ্বিতীয় পর্ব 'কালবেলা।' সময় লাগার মানে বইটা আমাকে টানেনি এমন মনে করা ভুল হবে। আসলে এর মুগ্ধতা এতটাই ���চ্ছন্ন করে রেখেছিল যে আমি এই জাল থেকে মুক্ত হতে চাচ্ছিলাম না। কিন্তু একসময় ঠিকই শেষ পৃষ্ঠায় যেয়ে একই সাথে দীর্ঘশ্বাস এবং নতুন দিনের আশায় বুক বাঁধা- দুটো অনুভূতি যখন একসাথে কাজ করে তখন সেই বই সম্পর্কে আর কিছু বলার প্রয়োজন পরে না।
তবুও দুটি কথা না বললেই নয়। উত্তরাধিকার পড়েছি তিন মাস হয়নি। বালক অনিমেষের রক্তে 'বন্দেমাতরম' উত্তেজনার ঢেউ বইয়ে দেয়। সে একটা সমাজতান্ত্রিক দেশের স্বপ্ন দেখতে দেখতে বড় হতে থাকে। কিন্তু ধীরে ধীরে সে বুঝতে পারে প্রতিটি রাজনৈতিক দল আদতে নাম বা গঠন ভিন্ন হলেও তাদের মেরুদণ্ড একই ধাঁচে গড়া। কলকাতায় প্রথম এসেই ঝঞ্ঝা-বিক্ষুব্ধ সময়ে পুলিসের কাছে গুলি খেয়ে একটি বছর নষ্ট হয় তার জীবন থেকে। কিন্তু পুরোনো অতীত ভুলে যেয়ে নতুন আশায়, নতুন দিনের স্বপ্নে ক্রমেই নিজেকে রাঙিয়ে নেয় সে। আর এসময় তার জীবনে আসে মাধবীলতা। মাধবীলতা- যে কোন ব্যাকরণ না মেনে একভাবে লড়ে যায়।
অনিমেষ, সুবাসদা, মহাদেবদা এরা বিপ্লবের আগুন জ্বালিয়ে দেয়। চারিদিকে 'নির্বাচন বয়কট করো' 'পার্লামেন্ট শুয়োয়ের খোয়ার' শ্লোগানে নিজেদের রক্তে আগুন জ্বালিয়ে দেয় তারা। কিন্তু তাদের ধারণা সম্পূর্ণ ভুল প্রমাণিত করে তার পরিণত হয় আতঙ্কবাদী রূপে। যাদের সমর্থন পাবে বলে বিপ্লবের শুরু তারাই যেন বাঁধা হয়ে দাঁড়ায়।
কিন্তু একজন মাধবীলতা। যে সারাটা সময় অনিমেষকে সমর্থন জুগিয়েছে, পরম নির্ভরতায় তাকে লতার নতো আঁকড়ে ধরেছে, আর অনিমেষ অবাক চোখে শুধু দেখেছে। তার এই নীরব বিপ্লব যা সমাজের বিরুদ্ধে, অনিমেষের জন্য তা বাকরুদ্ধ করে দেয় অনিমেষকে। বুঝতে পেরেও কোথায় যেন সুতোর টান ছিঁড়ে যায়।
বিপ্লব, রাজনীতি সব ছাপিয়ে এক মাধবীলতা সকলকে মোহের চাদরে বন্দী করে ফেলে। মাধবীলতায় মুগ্ধ আমি, আমার মতো আরো অনেক পাঠক। বিপ্লবের দাউদাউ করে জ্বলা আগুনে মাধবীলতা যেন পরম শান্তির পরশে জুড়িয়ে দেয় অনিমেষকে।
আমার পুরো লেখার মাঝেই মুগ্ধতা ছড়ানো। সম্পূর্ণরূপে তা প্রকাশ করা কখনোই সম্ভব না। তবে অনিমেষের আবিষ্কার করা সত্যগুলো কি পরিবর্তন হয়েছে? বা কেউ কি পারবে এই সম্পূর্ণ সিস্টেমকে নতুন করে ঢেলে সাজাতে?
মাঝে মাঝে কখনো কিছু তুচ্ছ ঘটনাকে কেন্দ্র করে আমি অন্তর্ভেদী ফিলোসফি খুঁজে বেড়াই; জীবনের জটিল সমীকরণকে মেলাতে চেষ্টা করি।
একটা সুন্দর চিনামাটির কাপ-শোকেসের এককোণায় যত্নে সাজিয়ে রাখা।কাপটার বেশভূষা দেখে সহজেই অনুমেয়, উৎকৃষ্ট কাঁচামাল সহযোগে কি অসামান্য নিষ্ঠা আর পরিশ্রমে গড়ে তোলা সেই কাপখানা!যেই কাপে শোভা পাবে ধোঁয়া ওঠা গরম চায়ের আড়ালে এক বনেদি উচ্চবিলাসিতা,শোপিসে সাজানো-গোছানো এক পরম নিশ্চিন্ত জীবন।কিন্তু?হঠাৎ করে এক দুর্ঘটনায় হাত ফসকে পড়ে গেলো কাপখানা-খণ্ডবিখণ্ড হলো তার অখণ্ড অস্তিত্ব।এরপর?সেই কাপ ঠাঁই পেলো অতি অযত্নে এক দুর্গন্ধময় ভাগাড়ে,যেখানে তার থাকবার কথাই ছিল না।হয়তো কাপটার জন্য আমাদের সর্বোচ্চ এক সিম্প্যাথিক মায়া কাজ করবে,"আহারে!কাপটা কি দামী ছিল!"
অনিমেষের পুরো জীবনটাকে সেই সুন্দর কাপের ট্র্যাজিক পরিণতির সাথে নিছকই আমার অদ্ভুত মনের খেয়ালে আমি মিলিয়ে দেখি।
সেই স্বর্গছেঁড়ার চা-বাগানের কোলঘেঁষে উজ্জ্বল রবিকিরণের মতোন এক শৈশবকালের অধিকারী ছিল অনিমেষ।পরিবারের সহজাত স্নেহ-মমতার উষ্ণ চাদরে ওম নিতে নিতে,আর কিছুটা দুষ্টুমিষ্টি শাসনের বেড়াজালে ছুটতে ছুটতে কৈশোর থেকে যৌবনে পা দেয় অনিমেষ,সেই পদযাত্রা এসে থামে শহুরে কোলকাতার যান্ত্রিক কোলাহলময় রাস্তাঘাটে।সেই যন্ত্রমানব কোলকাতায় এসে সহসা এক কল্পনাতীত দুর্ঘটনায় সেই জীবনের পথচলা মোড় ঘুরে নানা ঘটনার জঞ্জাল পেরিয়ে সহসা এসে দাঁড়ায় এক নোংরা দুর্গন্ধময় অন্ধকার ম্যাসিভ ব্ল্যাকহোলের খাঁদে,যার নাম-রাজনীতি।
সেই থেকে সে এক পথহারা উন্মাদ ঝড়ে ডুবখাওয়া জাহাজের মতন এদিক-ওদিক ধাক্কা খেতে খেতে ক্ষয়ে যেতে থাকল;আদর্শের অজুহাতে হঠকারী উত্তেজনায় ভুলে শত ভুলের মাশুল গুনতে গুনতে তার জীবনে ফুলস্টপ পরে যায়,সেই হতভাগা জাহাজ এসে তীর ভেড়ায় বস্তিতে এক স্যাঁতসেঁতে ঘরের এককোণে বিছানায়-বিধ্বস্ত মনে পঙ্গু পায়ে শুয়েবসে শূন্য দৃষ্টি মেলে।
সে ঘরের চার দেয়ালে বাড়ি খেয়ে চারপাশে প্রতিধ্বনিত হতে থাকে এক আর্ত কণ্ঠস্বর-"আহারে জীবন!"
উপন্যাসের পাতার পর পাতাজুড়ে রগরগে রাজনীতির ভেগ আলাপচারিতা থাকা সত্ত্বেও সেই রাজনীতির পুরু মোড়কে যেন এক উজ্জ্বল সতেজ শ্বেতপদ্ম হয়ে ফুটে ছিল এক সুন্দর নির্মল শাশ্বত প্রেম-যার নাম "মাধবীলতা"!
এক বিশ্বস্ত ছায়ার মতোন প্রতি ক্ষণে ক্ষণে অনিমেষের সাথে পায়ে পা মিলিয়ে হেঁটেছিল সেই নারী;অকারণ অভিযোগে তাঁকে জর্জরিত না করে চোখ বন্ধ করে শুধু বিশ্বাস রেখেছিল,কাঁধে হাত রেখে ভরসা দিয়েছিল,বিষাক্ত ধোঁয়ায় আচ্ছাদিত পৃথিবীর বুকে এনে দিয়েছিল নিখাদ ভালবাসার অবিরাম ধারা।কখনো কখনো সেই ভালবাসা নিয়ে মনে বড্ড প্রশ্ন জাগে। ~ "সখী ভাবনা কাহারে বলে, সখী যাতনা কাহারে বলে তোমরা যে বলো দিবস রজনী ভালোবাসা,ভালোবাসা সখী ভালবাসা কারে কয়, সে কী কেবলই যাতনাময়?"
হোক কম্যুনিস্ট বনাম কংগ্রেস কিংবা মার্কসবাদ বা মাও সে তুং—সকল রাজনৈতিক মতবাদের ঘনঘটা ছাপিয়ে অঙ্গার হয়েও যে মানবিক প্রেম-ভালোবাসা আজো অমলিন হয়ে আছে,ভাবতেই কেমন যেন অবিশ্বাস জাগে!
কলেজে পড়ার উদ্দেশ্যে আসা হলো কলকাতায় অনিমেষের। এসেই কলকাতার শহরে গন্ডগোলের মধ্যে পড়ে গেল সে। ফলাফল গুলিবিদ্ধ হয়ে হাস্পাতালের বেডে।
এতটুকুই যতেষ্ট বাকি গল্পের জন্য। কেননা এখান থেকেই শুরু অনিমেষের অশান্ত জীবনের। যদি এই ঘটনা না ঘটত তাহলে কালবেলা এখানেই শেষ হয়ে যেতে পারত। যেমনটা নেড স্টার্ক যদি সাউথে না যেত তাহলে হইতো গেম অব থ্রোনসে বাকি সিজনগুলোও আর আসত না।
আদর্শ, আন্দোলন,পুলিশের রাজনৈতিক অত্যাচার এতকিছুর মধ্যে ভালো লেগেছে অনিমেষ আর মাধবীলতার প্রেম। পরিচয় থেকে শুরু হয়ে শেষ পর্যন্ত তাদের অটুট ভালোবাসা। মাধবীলতার ত্যাগ আর অনিমেষের অনিশ্চিত ভবিষ্যতের পাশে দাড়িয়ে তাকে সমর্থন দিয়ে যাওয়া।
কালবেলা" উপন্যাসটি নিয়ে নতুন করে বলার কিছু নেই। সমরেশ মজুমদার এর "উত্তরাধিকার" সিরিজের দ্বিতীয় বই এটি এবং সম্ভবত সবচেয়ে জনপ্রিয়ও। বইটি যখন প্রথম পড়েছিলাম তখন নক্সাল,কমিউনিজম,রাজনীতি এসব নিয়ে কিছুই বুঝতামই না বলা চলে।আজ অনেক বছর পরিণত বয়সে এসে বইটি পড়ে অনেক ভাবছি।৭০ দশকের উত্তাল রাজনীতির দৃশ্যপট হচ্ছে উপন্যাসটি। কিন্তু ২০২০ এসেও কি সেই দৃশ্যপট কি একটু বদলেছে? শুধু আধুনিকতার ছোঁয়া লেগেছে এই। "কালবেলা" কি শুধু রাজনীতি,বিপ্লবের গল্প? নাকি রাজনীতি কে ছাপিয়ে প্রেমের গল্প? উপন্যাসটি যেন এক গল্পের ভেতর আরেক গল্প। সেই গল্পের নায়িকা হচ্ছে মাধবীলতা। এখন বুঝতে পারছি স্কুলে থাকাকালীন সময়ে আমি হয়ত বইটির অর্ধেক ব্যাপারই বুঝে উঠতে পারি নিই,পারলে হয়ত দীপাবলি (সাতকাহন) হতে না চেয়ে মাধবীলতাই হতে চাইতাম। বাংলা সাহিত্যে এত শক্তিশালী আধুনিক চরিত্র আর দ্বিতীয় কোনটি আছে বলে মনে পড়ছে না। উত্তরাধিকার পড়ে মা ম���া অনিমেষ এত প্রতি মায়া জন্মালেও, কালবেলা পড়ে অনিমেষ কে একজন আবেগের বশবর্তী বোকা মানুষ মনে হচ্ছে।যে নিজেই নিজের সম্পর্কে জানে না। আসল বিপ্লবী তো মাধবীলতা,যার নিজের সম্পর্কে, জীবন সম্পর্কে এমনকি রাজনীতি সম্পর্কেও অনিমেষের চেয়ে অনেক বেশী জ্ঞান রয়েছে। যে প্রতিনিয়ত তার নিজের সত্তার সাথে বিপ্লব করে গেছে,কোন কিছুর বিনিময় ছাড়া।মাধবীলতার চারিত্রিক দৃঢ়তা সবকিছু কেই ছাপিয়া ��ায়।
আরেকজন এর কথা না বললেই নয় তিনি হচ্ছেন সরিৎশেখর,লোকটা শুধু দিয়েই গেল বিনিময়ে কিছুই পেলো না। তার প্রতি উদাসীনতার কারণে কেন জানি অনিমেষ কে অকৃতজ্ঞও মনে হচ্ছিল।সিরিল,শীলা,বারীন এই চরিত্রগুলো ছোট হলেও বেশ শক্তিশালী এমন কি অনিমেষের চেয়ে বেশ দৃঢ় মনে হয়েছে আমার। তবে সবকিছুর উর্ধ্বে হচ্ছে মাধবীলতা।লতাই আষ্টেপৃষ্টে জড়িয়ে আছে অনিমেষ কে। গল্পের শেষে সবাই যখন হারিয়ে যায় মাধবীলতাতেই পূর্ণতা পায় অনিমেষ। ভালোবাসার জন্য মাধবীলতার ত্যাগ সবকিছুকেই ম্লান করে দেয়। আসলেই কি এভাবে সবছেড়ে ছুড়ে কাউকে ভালোবাসা যায়?
উত্তরাধিকার শুরু করারও আগে থেকে আমাকে আমার বন্ধুরা কালবেলা নিয়েই একরকম পাগল করে মেরেছিল। পরে খোঁজ নিয়ে জেনেছিলাম কালবেলা আসলে সিরিজের দ্বিতীয় বই। মাঝখান থেকে শুরু করার কোনোরকম ইচ্ছা ছিল না, তাই উত্তরাধিকার দিয়েই শুরু করি এই সিরিজ পড়া। উত্তরাধিকার শেষের পর, একরকম পাগল হয়ে উঠেছিলাম কালবেলা পড়ার জন্য আসলে শেষটা এমন যে কৌতূহল দমন করে রাখা বেশ কষ্টের ব্যাপার। অবশেষে কালবেলা শেষ করলাম কিছুদিন আগে। বেশ সময় নিয়েই পড়লাম। মোহে আচ্ছন্ন হয়ে সময় কাটিয়ে দিতে মন্দ লাগে না।
যাঁরা পড়েছেন তাঁরা জানেন। তবু যারা এখনও পড়েননি, তাদের জন্য সংক্ষেপে বলি। 'উত্তরাধিকার' এর জলপাইগুড়ি ও স্বর্গছেড়ায় বড় হয়ে ওঠা কিশোর অনিমেষ 'কালবেলা'য় কলকাতার আদর্শ প্রাপ্তবয়স্ক নিবাসী হয়ে ওঠে। কারফিউ এর দিন কলকাতা পৌঁছে, পুলিশের গুলিতে জখম হয়ে তার পড়াশোনার একটা সম্পূর্ণ বছর নষ্ট হয়ে যায়। দুর্দান্ত সেই ক্ষতের চিহ্ন বয়ে নিয়ে বেড়াতে বেড়াতে সে ক্রমে এগিয়ে যেতে থাকে রাজনীতির অগ্ন্যুৎপাতের দিকে। কম্যুনিজম তাকে আকৃষ্ট করে। ক্রমে এই অগ্ন্যুৎপাতকেই নিজের জীবন করে তোলে অনিমেষ, যে জীবনেই শীতল বারিধারা হয়ে নেমে আসে মাধবীলতা। শীতলতা দরকার হলে সে যেমন ভিজিয়ে দিতে পারে অনিমেষকে তেমনই প্রয়োজনে প্রচন্ড তেজে হাজার গুণ বাড়িয়ে দিতে পারে অগ্ন্যুৎপাত। রাজনীতির উত্তপ্ত দাবদাহ, কম্যুনিস্ট পার্টির ভাগ, স্বার্থান্বেষী মানুষের লোভ, নকশাল আন্দোলনের জোয়ার, পুলিশের নির্মমতার মধ্যে ডুবে থাকতে থাকতে যেটা অনিমেষ কোনোদিন আবিষ্কার করতে পারেনি, তা ক্রমে পঙ্গুত্বের মাধ্যমে সে পরিষ্কার দেখতে পায়, যে বিপ্লব সে চিরকাল বাইরে খুঁজেছে, সেই "বিপ্লবেরই অপর নাম মাধবীলতা"। যে মেয়ে রাজনীতি না করেও অনিমেষের রাজনৈতিক সত্তার বাধা হয়ে দাঁড়ায় না, নিজের জন্য কিচ্ছুই আশা করে না, অনায়াসে নিজের সুখ আহ্লাদ সব ছেড়ে আসে, শুধু ভালোবাসে, সবটুকু দিয়ে ভালোবাসে। খরতপ্ত মধ্যাহ্নে যে শুধুই এক গ্লাস জল ছাড়া আর কিছুই হতে চায় না, সে মাধবীলতা। অনিমেষ বুঝতে পারে, যে দেশ গড়ার বিপ্লবে সে নেমেছিল তা বিফল হয়েছে কিন্তু তাকে জড়িয়ে ধরে যে লতা ডালপালা মেলেছিল, যে মাধবীলতা নিঃশব্দে বিপ্লব শুরু করেছিল তা প্রতি ক্ষেত্রে সফল।
কালবেলা সাহিত্য আকাদেমী পুরস্কারপ্রাপ্ত একটি বই। প্রথমে এটি ধারাবাহিক ভাবে প্রকাশিত হয় দেশ পত্রিকায়। রাজনৈতিক কার্যকলাপের পাশাপাশি একটি মানুষের ব্যক্তিগত ও সামাজিক জীবন লেখক বর্ণনা করেছেন অত্যন্ত নিপুণভাবে এবং যথেষ্ট যত্ন নিয়ে। মাধবীলতা ও অনিমেষ এই দুটি চরিত্রের জন্যই বেশিরভাগ বাঙালী এই সিরিজ মনে রেখেছেন, অথবা রাখবেন। তবে কেবল মাধবীলতার জন্যই 'কালবেলা' কে ভালোবেসেছেন অগুন্তি মানুষজন। মাধবীলতার মতো চরিত্রকে শ্রদ্ধা করেন, এমন মানুষের সংখ্যাটা নেহাত কম নয়।
যদিও আমি ব্যক্তিগতভাবে 'কালবেলা' মনে রাখবো, নীলা, শীলা সেন, অনিমেষের ছোট মা, একরাতের জন্য বস্তির ঘরে ঠাঁই দেওয়া মাতাল ছেলের মা, সুবাস সেন, সিরিল, মহাদেবদা এবং দীপকের জন্য। মাধবীলতার মতো চরিত্র হয় না, একথা আমিও মানি, কিন্তু এই হয় না বলেই মাধবীলতার মতো চরিত্র অবাস্তবিক। অন্তত 2020 সালে দাঁড়িয়ে মাধবীলতার মতো আত্মত্যাগী, নিঃস্বার্থ ভালোবাসার প্রতীক চরিত্রের যে কোনোরকম কোনো বাস্তবতা নেই তা আমি নির্ভয়ে হাজারবার চেঁচিয়ে বলতে রাজি আছি। কারণ এটা সত্যি। আজকের যুগে একটা মাধবীলতা খুঁজতে যাওয়া বোকামির থেকেও বেশি বোকামি। হয়তো এজন্যই মাধবীলতার আদর্শ, নিষ্ঠা ও ত্যাগকে জাপটে ধরে ভালোবেসেছেন এত মানুষ কারণ বাস্তবে এমনটা হয় না।
তুলনামূলক ভাবে শীলা সেন বা নীলা বা বস্তির মাতাল ছেলের মা এই চরিত্রগুলি যুগের সাথে পাল্লা দিয়ে আজও একইভাবে ভীষণ বাস্তব। এরকম কতো শীলা সেনকে অ্যাসিড ঢেলে শেষ করে দিয়েছে তাদের স্বামী আমরা খবর রাখিনা। যদিও অ্যাসিড আক্রমণের বিরুদ্ধে আজকাল অনেক কিছু হচ্ছে, কতটুকু কি হচ্ছে তা তো ভীষণই স্পষ্ট। একইভাবে এরকম কত নীলা আজও স্পষ্ট কথা বলতে ভয় পায় না, আবার ভালোবাসার স্বার্থে নিজের সুখসমৃদ্ধ বৈভবে পরিপূর্ণ বাড়ি ছেড়ে আসতেও ভয় পায় না কিন্তু আদৌ সুখী হয় কিনা আমরা খবর নিই না। আবার এরকম কত বস্তির মা জানেন না এখনও যে আজ রাতে তার নিজের ছেলে বাড়ি ফিরবে কিনা কিন্তু জায়গা দিয়ে আগলে রাখছেন অন্য কারুর ছেলেকে পরম যত্নে।
কালবেলা নিয়ে আরেকটা জিনিস আমায় ভাবিয়েছে, তা হল, এর শেষ দৃশ্য। এই শেষটা পড়ার পর কালপুরুষ পড়ার কোনো খিদে আসে না। অন্তত আমার আসেনি। উত্তরাধিকার শেষ করার পর যে খিদের চোটে পাগল হয়ে যাচ্ছিলাম কালবেলা পড়ার জন্য সেটা কালবেলা শেষের পর আর অনুভব করলাম না। শেষটা একটা অধ্যায় শেষ হওয়ার মতোই। সুন্দর, আদর্শ, এবং মন ছুঁয়ে যাওয়া শেষ যার পরের অধ্যায় না বলা থেকে গেলেও কারুর কোনো ক্ষোভ থাকে না। অবশ্যই কালপুরুষ পড়ব কারণ সিরিজটা শেষ করবো, এমন একটা প্রতিশ্রুতি নিজের কাছেই নিজে নিয়েছি, তবে পাগলামোটা নেই পড়ার।
অবশেষে বলি, নকশাল আন্দোলন নিয়ে এটাই আমার প্রথম বই। আন্দোলনের প্রত্যেকটি মুহূর্তের বর্ণনা, কার্যকলাপ, রীতিমতো গায়ে কাঁটা দিয়ে গেছে। মাও সে তুং এর নেতৃত্বে চীনের মুক্তি আন্দোলনের একটি বর্ণনা আছে এই বইতে যেটা আমি অনবরত কয়েকবার পড়েছি, যতবার পড়েছি ততবার শিহরিত হয়েছি। আবেগ, মানুষকে কি পরিমাণ শক্তিশালী ও অপরাজেয় করে তুলতে পারে তা সেই ঘটনা থেকেই পরিষ্কার হয়েছিল সমগ্র বিশ্বের সামনে। নকশাল আন্দোলন কেন্দ্রিক বই আরো পড়ার ইচ্ছে রইল ভবিষ্যতে।
শুধু একটা লাইনেই পুরো বই এর সারাংশ তুলে ধরা যায়ঃ মাধবীলতায়ে পূর্ণতা পেল অনিমেষ।
সমগ্র বই জুড়ে রাজনীতি (পড়ুন অপ-রাজনীতি) ছড়িয়ে ছিটিয়ে ছিল। এক্টুকরো স্বস্তির মত মাধবীলতা আর অনিমেষ এর প্রেম পাঠক হৃদয়ে প্রশান্তি বয়ে আনে। উত্তরাধিকার আর কালপুরুষ আগেই পড়ে ফেলেছিলাম তাই অনিমেষ এর প্রতি দূর্বলতা সেভাবে গড়ে ওঠে নি। উত্তরাধিকার এর কিশোর অনিমেষ মনে স্নেহের দাগ কাটলেও নায়ক হিসেবে অর্ক অনেক এগিয়ে থাকবে। কিন্তু কালবেলা পড়ে মনে হল মাধবীলতা এক অন্য আবেগের নাম। দেশ-মাতৃকার জন্য বিপ্লব করেছে অনিমেষ; কিন্তু নিজের সমস্ত সত্ত্বার সাথে প্রতিনিয়ত বিপ্লব করেছে মাধবীলতা- তাও কিচ্ছু না পাওয়ার শতাধিক নিশ্চয়তায়ে।
ছোটবেলায়ে সাতকাহন পড়ে দীপাবলী হতে চাওয়া সেই মেয়েটি আজ মাধবীলতা হবার আকাঙ্ক্ষা এ মত্ত। যুগে যুগে কালে কালে অনিমেষ দের ছাপিয়ে যেনো মাধবীলতা রা বিপ্লবের সমার্থক শব্দ হিসেবে সমাদৃত হয়।
এটা সে সময়ে পড়া বই যখন আমি সামাজিক বই পড়তাম। বইটা বাসায় ছিল, তাই পড়েছি। ভাল লেগেছিলো বেশ। লেখকের লেখার মুন্সিয়ানা ব্যাপক। একটা উত্তাল সময়, কিছু সম্পর্কের পরিণতি আর মানুষের মূল্যবোধ নিয়ে লেখা চমৎকার একটা বই। যদিও এ বইয়ে অনিমেষ নায়ক কিন্তু বাস্তব জগতের হেরে যাওয়া অনিমেষ আর তাকে ভালোবাসার মুল্য চোকানো মাধবীলতাদের জন্য আমার মায়া হয়না, কেবল করুনা হয়।
সাতকাহন পড়ার পরে এই বই পড়ে মনে হচ্ছিল যে আমি নিজেই জল্পাইগুরি,শিলিগুরি,কফি হাউজ,স্কটিশ চার্চ ,প্রেসিডেন্সি ,সোনাগাছি,বসন্ত কেবিন সব ঘুরে এসেছি । এর কৃতিত্ব অবশ্যই লেখকের জীবন্ত বর্ণনার ।The story has a good pace which I usually prefer. অনিমেষ সিরিজের এই বইটি ই আমার সবচেয়ে বেশি ভাল লেগেছে।
ভীষন পছন্দের একটা বই, দারুন লেখ।একটা সময়কাল...তখনকার রাজনীতি,সাথে কলেজ জীবনের একটা প্রেম মিলেমিশে উপন্যাসটার প্রতি একটা অদ্ভুত ভালোবাসা তৈরী হয় বইটা পড়ে।তবে শেষমেশ সব ভালোবাসাকে ছাপিয়ে যায় সেই একটাই নাম মাধবীলতা।❤️
জুলাই বিপ্লবের পর এমন একটা বই পড়া আকস্মিক ধাক্কা খাওয়ার মতোই। আমরা যদি স্বৈরাচারের পতন না ঘটাতে পারতাম নিসন্দেহে অনিমেষের মত অন্ধকার কুঠরিতে দিনের পর দিন কাটাতে হতো। আমাদের হাজারখানেক ভাইয়েরা পঙ্গুত্ব বরণ করেও যে বিজয়ের হাসি হাসছে তা শতযুগ ম্লান হয়ে যেতো।
উত্তরাধিকার এর পরে কালবেলা একটি অনবদ্য সৃষ্টি বলতেই হয়। সমরেশ বাবু বেশ ভালোই তদানীন্তকালীন রাজনৈতিক প্রেক্ষাপট তুলে ধরতে পেরেছেন এই উপন্যাসে। অনিমেষ,মাধবীলতা,মহীতোষ,সরিৎশেখর,ত্রিদিব,থম্বোটো,সুদীপ,মহাদেবদা,বারীণ,বিমান,নীলা,দেবব্রতবাবু,সিরিল,শীলা,পরমহংস কিংবা ত্রিলোক সিং চরিত্রগুলো অন্য লেভেলের ছিলো। গল্পের শুরুতেই অনিমেষের গুলি খাওয়াকে কেন্দ্র করে বিমান কিংবা সুবাসদা সেটির উত্তম ব্যবহার করে ছাত্ররাজনীতির অপব্যাখ্যা দিয়েছেন। অনেকদিন যাবত সময় নিয়ে পড়ে বুঝতে পারলাম মাধবীলতা মেয়েটা অসাধারণ। যে মেয়েটা অনেক জেদী ছিলো, কিন্তু ভালোবাসার জন্যে সে বস্তিতে থাকতেও দ্বিধা করেনি। "নেতা বিপ্লব তৈরি করে না, বিপ্লবই নেতার জন্ম দেয়" অনিমেষের এই চিন্তাটাই সময়ের সাথে সত্যি হয়। দমদম স্টেশানে পোস্টারিং করতে গিয়ে পুলিশ থেকে ধাওয়া খেয়ে শীলা সেনের বাসায় টেলিফোন অপারেটর সেজে প্রবেশ করা; কিংবা শীলার উপরে মিঃ সেন এর এ্যাসিড নিক্ষিপ্ত করা; মাধবীলতাকে বিবস্ত্রীকরণের মুহূর্তে অনিমেষকে মুখ খুলতে না বলা, কিংবা অনিমেষের ডাকে দীপকের সাড়া দেয়া; প্রতি অাধা ঘন্টা পরে যে মেয়েটা চায়ের কাপে চুমুক দিতো অাজ সেই মেয়েটি পুরোটা দিন মিলিয়ে সবেমাত্র এক কাপ চায়ে চুমুক দেয়; কিংবা সফলতা ভিক্ষা না করে অাদায় করতে পেরেছে বিধায় লতা তার নামের পাশে মিত্র লাগাতে পারে এসব মিলিয়ে উপন্যাসটা অসাধারণ ছিলো। উপন্যাসটি অামাদের সমসাময়িক রাজনীতির দর্পণ কিংবা অায়না বলা যেতে পারে। কাউকে ব্যবহার করে রাজনৈতিক নেতৃবৃন্দ যে ফায়দা লুটছে তার জন্যে ব্যবহৃত মানুষগুলোর পরিণতি হুবহু অনিমেষের মতনই বটে।
১৭ টা দিন সময় নিয়েছি বইটি পড়তে। অবশেষে সমাপ্ত করে পাঁচ তারা প্রদান করিলাম পক্ষ হইতে।
সমরেশের অনিমেষ সিরিজের বাকি দুটা বই আমি পড়ি নি। এটা পড়লাম।
বইটার প্রেক্ষাপট স্বাধীনতাপরবর্তী ভারতবর্ষ। প্রথমদিকে ছাত্ররাজনীতিতে অন্ধভাবে লেজুড়বৃত্তি করার কুফল লেখক যেভাবে ফুটিয়ে তুলেছেন তা একেবারে বাস্তব। আর পরে নকশাল আন্দোলন যেভাবে পশ্চিমবঙ্গকে আষ্টেপৃষ্ঠে জড়িয়ে ধরে তাও লেখক খুব ভালভাবে ফুটিয়ে তুলেছেন। আদর্শের রাজনীতিতে জড়িয়ে পড়ে কত ছেলের জীবন নষ্ট হয়েছে সেটার একটা নকশা হচ্ছে এই বইটা।
অতিকথন মনে হলেও মাধবীলতা চরিত্রটির মত এত শক্তিশালী নারী চরিত্রের সন্ধান আদৌ পাওয়া যাবে বলে মনে হয়না। নকশালবাড়ি আন্দোলন নিয়ে আগ্রহের কারণে বইটা ধরা। অনিমেষদের হঠকারিতা কিংবা তার করুণ পরিণতিকেও মাধবীলতা গৌণ করে তার চারিত্রিক দৃঢ়তায়। বিশাল ভালোলাগা আর সম্মান মাধবীলতাদের জন্য ...
স্কুলজীবনের মাঝামাঝি সময়ে কৈশোরে যখন সদ্য পা দিয়েছি তখন বই পড়ার নেশাটা প্রথম মাথাচাড়া দেয়, বই কেনার কথা তখন প্রশ্নাতীত তাই লাইব্রেরির দ্বারস্থ হয়েই পড়েছি একের পর এক কালজয়ী বাংলা গল্প উপন্যাস। 'কালবেলা'ও পড়েছিলাম সেই সময়েই এবং এতদিন মনে করেছিলাম সে পড়া অর্থাৎ কাহিনী এবং তার চরিত্রদের জানা বুঝি সমাপ্ত। নতুন করে এ বই উপহার না পেলে হয়তো দ্বিতীয় বার পড়ার কথা ভাবতাম না। তবে দীর্ঘ সময় ধরে পড়ে বইখানা শেষ করার পর কেবলই মনে হচ্ছে ভাগ্যিস পড়া হলো আর এমন আরও অনেক বইই হয়তো পুনর্বার পড়া উচিত।
কৈশোরে রাজনৈতিক সচেতনতা ছিল নিতান্তই অপ্রতুল। এমন পরিবেশে বেড়ে ওঠা যেখানে রাজনীতি দৈনন্দিন আলোচনা বা সমালোচনার বিষয় হিসাবে থাকলেও তার সাথে সরাসরি সংযোগের কথা কখনও ভাবার অবকাশ হয়নি। বাড়ির বড়দের রাজনৈতিক মতাদর্শকে বরাবর যুক্তির থেকে বেশি আবেগ আর পরম্পরা দ্বারা চালিত হতেই দেখেছি তাই উপন্যাসের প্রথম ভাগে অনিমেষের দ্বিধা উৎকণ্ঠা খুব প্রত্যক্ষ ভাবে স্পর্শ করেছে বারবার। আগাগোড়া রাজনৈতিক একটি উপন্যাস যেখানে অনিমেষের জীবনের শত অস্থিরতা আর অনিশ্চয়তার মাঝে একমাত্র স্বস্তির আশ্রয় হয়ে রয়ে যায় মাধবীলতা চরিত্রটি, হয়তো বা পাঠকের কাছেও। উপন্যাসের পটভূমি নিয়ে নতুন করে কিছু বলার অবকাশ নেই, ষাট -সত্তরের দশকের রাজনীতির জ্বলন্ত প্রতিচ্ছবি সমরেশ মজুমদারের 'কালবেলা' কিন্তু সব কিছু ছাপিয়ে মাধবীলতার ভালোবাসা, অনিমেষের জন্য তার আত্মত্যাগ এবং তাদের সম্পর্ক উপন্যাসের ���কটি অন���যতম সেরা আঙ্গিক বইকি। সিরিজের পরের দুটো বই খুব শীঘ্রই পড়ে ফেলব আশা রাখি।
আমার মতে ক্লাসিককে কখনো রেটিং দিয়ে বিচার করতে হয় না। এগুলো সবার পড়া উচিত। পড়ে এক্সপেরিয়েন্স নেওয়া উচিত। তারপর সেটা নিয়ে নিজের মত চিন্তাভাবনা করা উচিত।
আমার স্যাটা ভাঙা বিপ্লবী অনিমেষ। যে বিপ্লবে চুরি ডাকাতি করতে হয়, মানুষ মারতে হয়, মানুষ সাপোর্ট দেয়ার বদলে বিপ্লবীদের ভয় পায় সে বিপ্লবকে স্যাটা ভাঙ্গা বিপ্লব-ই বলব আমি। মানুষকে যদি এক করতে না পার, মানুষের মনে যদি তোমাদের পন্থা ভয়ের উদ্রেক ঘটায় তাহলে সে বিপ্লবে দেশের কতদিন পরিবর্তন হবে না। যদিও শেষ দিকে এসব বিষয় অনিমেষ ভাল করে বুঝতে পারে সেটা একটা ভালো বিষয়। অন���মেষের কাউকে ডিসার্ব করে না। না তার দাদুকে, না বাবাকে, না তার ছোট মাকে৷ আর মাধবীলতাকে তো নয়-ই। মাধবীলতা হচ্ছে একজন পুরুষের স্বপ্নের নারী। প্রত্যেকটা পুরুষ তার জীবন সঙ্গী হিসেবে প্রেমিকা হিসেবে স্ত্রী হিসেবে গার্লফ্রেন্ড হিসেবে এরকম নারীকেই চায়। কিন্তু তা হবার নয়। বাস্তবে কোন নারীই এরকম নয়। সম্ভবই নয়। সেজন্যই মাধবীলতা স্বপ্নের নারী যে শুধু স্বপ্ন কল্পনায় থাকে।
সারাংশঃ মফস্বলের ছেলে অনিমেষ মিত্র। জলপাইগুড়ি থেকে কলকাতা আসে উচ্চশিক্ষা লাভের জন্য। কলকাতায় পা রাখতেই পরে বিপদের মুখে। কলকাতায় তখন কারফিউ চলে। পুলিশ তাকে সন্দেহ করে গুলি ছোড়ে। থাইয়ের নিচে হাটুর উপরের অংশে গুলি লেগে হাসপাতালে পড়ে থাকে তিনমাস। সুস্থ হতে হতে একটা শিক্ষাবছর নষ্ট হয়ে যায় অনিমেষের। রাজনীতি সম্পর্কে বুঝ হবার পর থেকেই সে বামপন্থী মনোভাব ধারন করে। বিশ্ববিদ্যালয়ে পড়তে গিয়ে জড়িয়ে পরে বামপন্থী কমিউনিস্ট পার্টির সাথে। পুলিশের গুলিতে হওয়া ক্ষতচিহ্নটাকে 'সাধারন মানুষের উপর পুলিশি নির্যাতনের' প্রকৃত হিসেবে ব্যবহার করে ছাত্র ইউনিয়নে বিপুল ভোটে জয়লাভ করে। কিন্তু সে যেই আদর্শ নিয়ে বামপন্থী কমিউনিস্ট পার্টিতে যোগ দেয় কিছুদিন পরে বুঝতে পারে সবই ফাকি। সবাই ক্ষমতার গদিটাকে পাওয়ার জন্য বিভিন্ন আদর্শের দোহাই দেয়। ধীরেধীরে প্রেমের সম্পর্কে জড়িয়ে পড়ে তার সহপাঠিনী মাধবিলতার সাথে। মাধবিলতার ভাষ্য মতে লতার মতই অনিমেষের জীবনে জড়িয়ে পড়ে মাধবিলতা। অনিমেষ চায় সমাজ ব্যাবস্থার পরিবর্তন। কিন্তু এই পরিবর্তন কিভাবে আসবে! রাজনীতি করে পরিবর্তন আনা সম্ভব নয় সেটা খুব ভালভাবে বুঝতে পেরেছিলো অনিমেষ। যার হাত ধরে বামপন্থী কমিউনিস্ট পার্টিতে এসেছিলো; সেই সুভাসদাকে যখন পার্টি থেকে বের করে দেওয়া হলো তখন সুভাসদার পথ অনুসরণ করে বিপ্লবী হলো অনিমেষ। আর মাধবিলতা?? জানতে হলে যারা পড়েন নাই তারা ঝটপট পড়ে ফেলুন।
পাঠপ্রতিক্রিয়াঃ সমরেশ মজুমদারের পড়ে দ্বিতীয় বই এটা। প্রথম বই 'আট কুঠুরি নয় দরজা' পড়ার সময়ও যেমন হয়েছে; শুরুতে বিরক্ত লাগছিলো। শেষে এসে খুব ভাল লাগলো। বিরক্ত লাগার কারন ছিলো স্বয়ং অনিমেষ। রাজনীতি সম্পর্কে তার ভ্রান্ত ধারনা দেখে বিরক্ত হইছি। সে যখন কলকাতায় আসে সে ছিলো মানসিক দিক থেকে একটি শিশু। গল্পের মধ্যেই ধীরেধীরে তার মানসিকতা সাবালক হলো। সেখান থেকে রাজনীতির বাস্তবতা বুঝতে শিখলো। পুরো গল্প জুড়ে রাজনীতি ও বিপ্লব থাকলেও পাঠকের মনে অনেক বড় জায়গা জুড়ে থাকবে মাধবিলতা। গল্পের শেষে সবাই যখন হারিয়ে গেলো, মাধবিলতায় পূর্ণতা পেলো অনিমেষ। ভালবাসার জন্য মাধবিলতার ত্যাগ বাকি সবকিছুকে ম্লান করে দেয়। পুরো গল্পটা এক নিঃশ্বাসে শেষ করেছি। ফেসবুকেও খুব কম ছিলাম। সবশেষে মনে হলো "যাহ! বইটা শেষ হয়ে গেলো!!"
উত্তরাধিকার' বইটা এমন জায়গায় শেষ হয়েছিলো যে পরবর্তীতে কি ঘটে তা জানার আগ্রহ স্বাভাবিকভাবেই দ্বিগুণ হয়ে গিয়েছিলো।সে অনুপাতে সিরিজের দ্বিতীয় বই 'কালবেলা' বেশ সাদামাটা।
অনিমেষ সিরিজ নকশালবাড়ি আন্দোলন এবং তৎকালীন রাজনৈতিক প্রেক্ষাপটে লিখা তা আমাদের সবার জানা।কিন্তু 'কালবেলা'য় সমরেশ বিপ্লব বলতে যা দেখিয়েছেন তাকে অতিনাটকীয় বিপ্লব বললেও ভুল হবে না।'উত্তরাধিকার' এর অনিমেষ এখানে যেন এক দিকভ্রান্ত পথিক।যার না আছে স্পেসিফিক রাজনৈতিক আইডিওলজি না আছে স্পেসিফিক কোন আদর্শ।
মাধবীলতাকে নিয়ে বাংলা সাহিত্যপ্রেমিকদের মনে অনেক ফ্যাসিনেশন কাজ করে।মাধবীলতা চরিত্রের শুরুর অংশটুকু দারুণ।মাঝখানে গল্পের মূল চরিত্র অনিমেষকে বড় করে দেখাতে গিয়ে মাধবীলতার মাধুর্য কেড়ে নেয়াতে মাধবীলতা ম্লান হয়ে যান।তবুও বেশ মনে রাখার মতো একটা চরিত্র মাধবীলতা।
'উত্তরাধিকার' উপন্যাসের স্বার্থকতা ছিলো এই যে পাঠক মাঝখানে হারিয়ে যায়নি,আগ্রহটা ধরে রাখতে পেরেছে পুরোটা সময় জুড়ে।'কালবেলা' এখানে চরমভাবে ব্যর্থ।তাই শেষ করার পরে কি হবে তা নিয়ে আর আগ্রহ বজায় থাকেনা।
অনেক দিন পর একটা মেয়ে চরিত্রকে বেশ ভালো লাগলো। মাধবীলতা। ব্যক্তিত্বসম্পন্না, সাহসী, সমাজকে বুড়ো আঙুল দেখানো কিন্তু গভীর ভালোবাসায় পূর্ণ এক নারী। সম্ভবত এই উপন্যাসটিই সমরেশের সেরা কাজ হয়ে থাকবে আমার কাছে।
Kaalbela (English: The Time of Tomorrow Or The Time of the Catastrophe) is the second volume of The Animesh Quartetby Samaresh Majumdar, who is one of the few living legends of modern Bengali literature. The book starts with Animesh Mitra coming to Kolkata (then Calcutta) from Jalpaiguri to study B.A in Scottish Church College. But unfortunately, Kolkata was not a really calm place then; trams and buses would burn due to protests by young minds who wanted change. And Animesh got mixed in one such event and got shot as a suspect. From there, the story just went on, increasing its pace and tension like a classic thriller. The 70's world of Kolkata, the people, the society - all came out rather vividly. I was reading with eyes open wide, not for wonder, but due the sheer clarity of it all. I felt youth of Kolkata then was in the phase of transition, people are thinking up new slangs and using them openly, girls hanging out with boys late -- how such changes were affecting the people. Fascinating.
Animesh never wanted to get himself involved in politics, but somehow, rather inevitably he went ahead on the uncertain road of changing the world. I could see how the university students wanted to take an active part in politics. And it was natural. Because, even after the Raj was gone, the structure remained, the sucking and looting went on. And it was normal for people to get angry, people who lost so much to get the much awaited independence. So thus, frustrated by the Communist Party's double faced attitude, Animesh, like many others, started preparing for an armed movement, inspired from the methods of Mao Zedong, that led to the liberation of Vietnam. They started an armed revolution in the villages, dethroning the landlords and freeing the lands to the farmers. The first such an encounter happened in Naxalbari, a village in north Bengal, quite close to the international borders. As India is a huge country with so much diversity, the ideology couldn't spread as fast as in Vietnam, and the movement simply came to be known as The Naxalite Movement. A lot of young students from well-to-do family happily sacrificed themselves in the cause. But due to lack of no single leader with concrete manifesto, the movement fell apart soon. Though, the idea remained.
But this novel is not only the story of Naxals. It is a love story. An idyllic one. And you'd be crying at the bittersweet ending. It is a book that needs to be translated immediately, for it deserves a broader readership.
“মাধবীলতা আমি, আমি কাননবালা—” ছোটোবেলায় শোনা প্রিয় গানগুলির একটি কণিকার গাওয়া এই গান। কালবেলা উপন্যাসের রাজনৈতিক জটিলতা, বামপন্থী-মার্ক্সবাদী আদর্শ কিংবা নকশালের তীব্র বিষয়গুলো ছাপিয়ে একসময় মাধবীলতা চরিত্রটিকেই উপন্যাসের প্রধান এক অংশ জুড়ে আছে বলে মনে হয়, মাধবীলতাই যেন উপন্যাসের প্রাণ-রস সঞ্চয় করেছে।
অনিমেষ চতুষ্ক এর দ্বিতীয় উপন্যাস কালবেলা। উপন্যাসের শুরুতেই দেখা যায় প্রধান চরিত্র অনিমেষ জীবনে প্রথমবারের মতো কলকাতায় পা দিয়েই জড়িয়ে পরে 'বিশ্রি' পুলিশি ঝামেলায়। কলকাতায় পড়াশোনার স্বপ্ন নিয়ে আসা অনিমেষের জীবনের একটি বছর ঝরে পুলিশের গুলিতে পায়ে জীবনভর জখম নিয়ে তিন মাস হাসপাতালের বেডে শুয়ে থেকে। হাসপাতালেই তার সাথে পরিচয় হয় বামপন্থী নেতা সুভাষের, আর এভাবেই একসময় বামপন্থী রাজনীতিতে জড়িয়ে পরে অনিমেষ।
গল্পের এক পর্যায়ে অনিমেষের পরিচয় হয় মাধবীলতার সাথে, যার চোখ প্রথমবার দেখেই অনিমেষের মনে ঝড় বয়ে গেয়েছিল। একসময় মাধবীলতা আর অনিমেষের জীবনে প্রণয়ের জোয়ার নামে। কিন্তু বিপ্লবী অনিমেষ কি পারবে, তার প্রেমকে ধরে রাখতে? না-কি বাকি সবার মতো মাধবীলতাও হারিয়ে যাবে অনিমেষের জীবন থেকে?
কালবেলা উপন্যাসে রাজনৈতিক অপব্যাখ্যা দেওয়া হয়েছে, এ বিষয়ে অনেক তর্ক বিতর্ক আছে। তবে সেই অপব্যাখ্যার রাজনৈতিক প্লটের সাথে একেকটি জীবন কীভাবে জড়িয়ে থাকে, তার সুস্পষ্ট উদাহরণ পাওয়া যায় এই উপন্যাসে। তথ্যগত বা নৈতিক দিক থেকে সফল না হলেও, পাঠকের মনকে নাড়িয়ে দেওয়ার সক্ষমতা আছে এই উপন্যাসের। আর সেটিই হয়তো একটি উপন্যাসের মূল উদ্দেশ্য।
আজ কাল কি হয় যারা ইতিহাস ভিত্তিক বই লেখেন তারা তাদের গল্প ও ইতিহাস র মধ্যে ঠিক খেই রেখে চলতে পারেন না এবং গল্পের উপর ইতিহাস চেপে বসে মনে হয়। কিন্তু এই উপন্যাস পড়ে সেই কথা মনে হয়নি ইতিহাস গল্প শেষ পর্যন্ত এক অন্য তাল এ নিজেদের মহান অবস্থান টিকিয়ে রেখেছে। নকশাল ভিত্তিক গল্প ছোটো কিছু পড়েছি কিন্তু উপন্যাস বলতে পূর্ব পশ্চিম অবধি আমার দৌড়। আর এইটা পড়লাম। অত্যন্ত সুন্দর,গল্পের ছক,গল্পের ভাষা খুবই সুন্দর। লেখার মধ্যে কোনো জড়তা বা হঠকারিতা আমার চোখে পড়েনি। এবং অতিরিক্ত emotion দিয়েও লেখক ভরিয়ে তোলার চেষ্টা করেননি। সুন্দর ভাবে এগিয়ে নিয়ে গেছেন গল্পের তালে গল্পকে। অবশ্যই পড়ুন বাংলা সাহিত্যের যেই অসম্ভব মাধুর্য সেটা হারিয়ে না যায় এই ইচ্ছেই রাখি।
পুনশ্চ : পূর্ব পশ্চিম আর কালবেলা র মূল চরিত্র পুরুষ হলেও গল্প র শেষে কিন্তু জয়ী হয়ে ওঠেন দুই মহিলা ই। এখানেই লেখক র ও জিতে যাওয়া।
One of the finest novel ever written based on North Bengal. It is based on political scenario of Jalpaiguri, Siliguri and nearby districts few decades after independence. The political commentary also extends to Kolkata, where Animesh, the protagonist, experiences seemingly tragic events. May not be suitable for somebody who politically allergic. I thoroughly enjoyed it.