'চার্বাকের খোঁজে ভারতীয় দর্শন' বইটি কেন পাঠ ও সংগ্রহযোগ্য মনে করি !

চার্বাকের খোঁজে ভারতীয় দর্শন by রণদীপম বসু / Ranadipam Basu

প্রাচীন ভারতীয় দর্শনে চার্বাক নিয়ে বরাবরই একটি বিভ্রান্তি ও অস্পষ্টতা ক্রিয়াশীল ছিলো এবং এখনো আছে। চার্বাক কে বা কী, এবং কেনই বা চার্বাকদের প্রতি বিভিন্ন প্রেক্ষাপটে বিভিন্ন দার্শনিক সম্প্রদায়ের দিক থেকে এতোটা রাগ, বিরাগ কিংবা ভিন্ন ক্ষেত্রে উচ্ছ্বাস বা অনুরাগও কার্যকর হতে দেখা যায়? কোন সংক্ষিপ্ত সূত্র দিয়ে এর অসম্পূর্ণ উত্তর দেয়া সম্ভব মনে হলেও তা আদৌ যথার্থ হবে বলে মনে হয় না। কারণ চার্বাক নামটি নিয়েই প্রাথমিক বিভ্রান্তির শুরু। প্রকৃতপক্ষে চার্বাক যে কোন ব্যক্তিবিশেষের নাম নয় বরং একটি বিশেষ মত-গোষ্ঠি, প্রাচীন সাহিত্যের বিভিন্ন প্রামাণিক তথ্য ও বিশ্লেষণ থেকে এ-ধারণাটিই অধিকতর গ্রহণযোগ্য বলে মনে হয়। কিন্তু হুট করে বলে ফেললেই তো হবে না, এরকম একটি সিদ্ধান্তে আসার জন্যে প্রয়োজনীয় তথ্যাবলি ও সাহিত্য-দৃষ্টান্ত উপস্থাপন এবং প্রাসঙ্গিক যুক্তি পর্যালোচনার প্রয়োজন রয়েছে বৈকি। বিভ্রান্তি মোচনের এই প্রচেষ্টাই করা হয়েছে ‘রণদীপম বসুচার্বাকের খোঁজে ভারতীয় দর্শন’ শিরোনামের পরিপুষ্ট গ্রন্থটিতে।

চার্বাক-মতবাদ নিয়ে দ্বিতীয় বিভ্রান্তির অনিবার্য হেতু হলো বহুকাল আগে থেকেই চার্বাকদের নিজস্ব সাহিত্যের বিলুপ্তি বা অনুপস্থিতি। এই ভয়ানক ঘাটতি নিয়ে কোনরূপ বিশুদ্ধ দর্শনচর্চা আদৌ কি সম্ভব! আর এই চর্চা যদি হয় প্রাচীন ভারতীয় দর্শনের জটিল কূটিল ভুবনের একমাত্র ব্যতিক্রমী মতবাদটি নিয়ে? কেন তা ব্যতিক্রম? কারণ, নিজেদের সমকালীন চিন্তাজগতে বদ্ধচিন্তা ও অন্ধবিশ্বাসের অচলায়তন ভেঙে অভূতপূর্ব মুক্তচিন্তার সাহসী অগ্রপথিকই নয়, ভারতীয় জড়বাদী তথা বস্তুবাদী দর্শনের একমাত্র প্রতিভূ বলতে চার্বাক দর্শন, যাকে কখনো কখনো বার্হস্পত্য বা ভিন্ন প্রেক্ষিতে লোকায়ত দর্শনও বলা হয়ে থাকে। এ-বিষয়ে প্রাচীন ও আদি সাহিত্য-নিদর্শন তথা প্রয়োজনীয় তথ্যাবলির উদ্ধৃতি ও উপস্থাপনের মাধ্যমে সাধারণের বোধগম্য করে প্রয়োজনীয় বিস্তৃত আলোচনা রয়েছে উল্লিখিত ‘চার্বাকের খোঁজে...’ গ্রন্থটিতে।

কিন্তু প্রশ্ন হলো, অজ্ঞাত কারণে চার্বাকদের অক্ষত অবিকৃত মতবাদ প্রতিফলিত হয় এরকম নিজস্ব উৎস গ্রন্থ যদি অনেককাল আগেই দুর্ভাগ্যজনক বিলুপ্তির অন্ধকারে হারিয়ে গিয়ে থাকে তাহলে চার্বাক তথা চার্বাকী মতবাদ সম্পর্কে আমাদের প্রচলিত ধারণার উৎসগুলো কী? কোত্থেকে আমাদের জ্ঞানজগতে চার্বাক তাঁর দর্শন নিয়ে হাজির হলো? এর উত্তরের মধ্যে আসলে প্রাচীন ভারতীয় দর্শন সম্প্রদায়ের সঙ্গে পাশ্চাত্য দর্শনের প্রকৃতি ও বৈশিষ্ট্যের মৌলিক পার্থক্যটাও চিহ্নিত হয়ে যায়। ভারতীয় দর্শনের ক্রমবিকাশের ধারাকে অনুসরণ করলে দেখা যায় ভারতীয় দার্শনিকরা পরস্পর পরস্পরের দার্শনিক মতবাদের ব্যাখ্যা ও সমালোচনা করেন এবং একে অপরকে ভালোভাবে জানতে আগ্রহী হন। ফলে প্রতিটি দর্শন সম্প্রদায় নিজের মতকে প্রতিষ্ঠিত করার আগে সর্বপ্রথম বিরোধী পক্ষের মতবাদটি ব্যক্ত ও ব্যাখ্যা করেছেন। একে বলা হয় পূর্বপক্ষ। এরপর যুক্তির সাহায্যে পূর্বপক্ষকে সমালোচনা ও খণ্ডন করা হয়েছে। একে বলা হয় উত্তরপক্ষ বা সিদ্ধান্ত। এভাবেই পারস্পরিক ব্যাখ্যা ও সমালোচনার মাধ্যমে ভারতবর্ষে একটি পূর্ণাঙ্গ দর্শন-চিন্তার উদ্ভব হয়েছে। আর তাই আমরা ভারতীয় দর্শনের একটি বিশেষ মতবাদ জানতে গিয়ে অন্যান্য মতবাদগুলিরও পরিচয় পেয়ে যাই। এভাবেই বিভিন্ন দর্শন সম্প্রদায়ের সাহিত্য-নিদর্শন থেকে আমরা চার্বাক মতবাদ সম্পর্কে একধরনের ধারণা পেয়ে যাই, যদিও তা উপরিউল্লিখিত বিভ্রান্তি ও বিতর্কের উর্ধ্বে নয়। কী সেই বিতর্ক? প্রচলিত চার্বাক-বিরোধী অন্যান্য দর্শন-সাহিত্যের প্রাচীন গ্রন্থগুলোয় উপস্থাপিত চার্বাক-মতকে অন্ধের যষ্ঠি হিসেবে সম্বল করে চার্বাক-দর্শনের রূপরেখা তৈরির যে একপেশে ও স্ববিরোধী প্রবণতা পরবর্তীকালের দর্শনচর্চায় পরিলক্ষিত হয় তা কি আদৌ প্রশ্নের উর্ধ্বে? এই বিভ্রান্তিগুলো মাথায় রেখেই ‘চার্বাকের খোঁজে...’ গ্রন্থটিতে ব্যাপক তথ্য নিদর্শন উদ্ধৃত করে ধরে ধরে বিশ্লেষণ করে একটি যৌক্তিক সিদ্ধান্তে উপনীত হবার চেষ্টা করা হয়েছে।

পরবর্তীকালের উদার ও যুক্তিনির্ভর মুক্তচিন্তার আন্দোলনের চিরকালীন প্রেরণারূপ এই চার্বাক-মত তার সমকালীন প্রেক্ষাপটে কী অসাধারণ প্রভাব নিয়ে অসম্ভব বেগবান ছিল তার উৎকৃষ্ট নিদর্শন হলো তথাকথিত ধর্মের নামে প্রচারিত অধ্যাত্মবাদী বৈদিক সাহিত্য যথা বেদ, উপনিষদ, পুরাণ, মহাকাব্য, নাটক, গীতা, মনুসংহিতা ইত্যাদি প্রাচীন শ্রুতি ও স্মৃতিশাস্ত্র গ্রন্থগুলোর পরতে পরতে উপযাজক হয়ে চার্বাকদের প্রতি তীব্র ক্ষোভ, ঘৃণা ও বিরোধিতার আক্রমণাত্মক সাহিত্য-দৃষ্টান্তগুলোই। বৌদ্ধশাস্ত্র, মহাভারত, মনুস্মৃতি প্রভৃতির নজির থেকে অনায়াসেই অনুমান করা যায়, সম্প্রদায়টির ইতিহাস সুপ্রাচীন। কিন্তু এ-সম্প্রদায়ের নিজস্ব কোন রচনা আবিষ্কৃত হয়নি এবং হবার সম্ভাবনাও নেই বলে মনে হয়। অথচ এ-বিষয়েও কোনো সন্দেহ নেই যে এককালে এ-জাতীয় রচনা সত্যিই প্রচলিত ছিলো। পাশাপাশি তৎকালীন ব্রাত্য ও সাধারণ জনমানসে ছড়িয়ে ছিটিয়ে থাকা দার্শনিকচিন্তা-সম্মত বার্হস্পত্য শ্লোক, চার্বাক-ষষ্ঠি ও প্রাচীন লোকগাথাগুলোতে প্রচলিত ধর্মের নামে অপশাস্ত্রগুলোর প্রতি চার্বাকদের পক্ষ থেকে যে তীর্যক বিদ্রূপ ও শ্লেষের সমারোহ ঘটানো হয়েছে, এগুলো চার্বাকী চিন্তার প্রামাণ্য দলিল হিসেবে যে অমূল্যতার দাবি রাখে তাকে অস্বীকার করে আর যাই হোক চার্বাক চর্চা সম্ভব নয়। আর চিন্তা-প্রবণতার সাথে উপাদান-সাযুজ্যের মেল-বন্ধন না-ঘটালে দর্শন-চর্চা যে অর্থহীনতারই নামান্তর তা বলার অপেক্ষা রাখে না। এই বিশাল বিপুল সাহিত্য, দর্শন ও প্রামাণ্য নিদর্শনগুলোর যথার্থ যাচাই-বাছাই প্রক্রিয়ার মধ্য দিয়ে প্রয়োজনীয় উপাদানগুলো বের করে এনে ভারতীয় দর্শনের জটিল প্রপঞ্চ থেকে চার্বাক-দর্শনের এক চমৎকার রূপরেখা সাধারণের বোধগম্য করে উপস্থাপনের প্রয়াস নেয়া হয়েছে ‘চার্বাকের খোঁজে ভারতীয় দর্শন’ নামের বৃহৎ গ্রন্থটিতে।

প্রসঙ্গক্রমে এটাও মনে রাখতে হবে যে, প্রাচীন এই উৎসগ্রন্থগুলোর সবই তৎকালীন জ্ঞানচর্চার উপযোগী ভাষা সংস্কৃত কিংবা প্রাচীনতম বৈদিক ভাষায় রচিত। ফলে দূরতিক্রম্য এই ভাষাগত ব্যবধান ডিঙিয়ে প্রয়োজনীয় গ্রন্থসম্ভারের দীর্ঘকালীন অনুসন্ধান করে তা অধ্যয়ন, অনুশীলন ও যথার্থ চয়নের মাধ্যমে ব্যবহার উপযোগী করে বাংলায় দর্শনচর্চা যে মোটেও চাট্টিখানি কথা নয় তা বিজ্ঞজন মাত্রেই একবাক্যে স্বীকার করবেন। এটাই বাংলা ভাষায় প্রাচীন ভারতীয় দর্শনচর্চার জন্য সবচাইতে দুর্লঙ্ঘ্য বাধা। এই দুর্লঙ্ঘ্য বাধাকে মাথায় রেখেই বর্তমান গ্রন্থে প্রয়োজনীয় তত্ত্ব ও তথ্য উপস্থাপন এবং প্রযোজ্য ক্ষেত্রে বিভিন্ন বেদ, ব্রাহ্মণ, উপনিষদ, পুরাণ, রামায়ণ, মহাভারত, মনুসংহিতা, অর্থশাস্ত্র এবং বিভিন্ন দর্শন-সম্প্রদায়ের সাহিত্য সংগ্রহ প্রভৃতির প্রতিটি ক্ষেত্রে বাংলা তর্জমাসহ অজস্র নজির ও সাহিত্য নিদর্শনের মূল সংস্কৃত বা সংশ্লিষ্ট টেক্সট উপস্থাপন করা হয়েছে। অন্তত এটুকু চেষ্টা করা হয়েছে যাতে আগামীতে এসব বিষয়ের প্রামাণ্য দলিল হিসেবে গ্রন্থটিকে যেকোনো বিচারে পর্যাপ্ত রেফারেন্সের নির্ভরযোগ্য উৎস হিসেবে ব্যবহার করা যায়।

এখানে আরো বলা আবশ্যক যে, প্রাচীন ভারতীয় দর্শনের অন্য সম্প্রদায়গুলোর সাথে চার্বাক-সম্প্রদায়ের আরেকটি মহান ব্যতিক্রম রয়েছে। কেবল চার্বাক-মতের উৎস ও সামাজিক প্রেক্ষাপট আলোচনায় পূর্ণাঙ্গতা আনতে হলে আমাদেরকে শুধু যে প্রাচীনতম ঋগ্বেদ সাহিত্যের সাক্ষ্য সংবলিত বৈদিক যুগ এবং তার সমাজ ও চিন্তাধারার সামগ্রিক পর্যালোচনা করতে হয় তাই নয়, আরো বহু পেছনে গিয়ে উৎখননে প্রাপ্ত প্রত্নতাত্ত্বিক নিদর্শন সংবলিত সেই সুপ্রাচীন সিন্ধু সভ্যতার প্রেক্ষাপটে কৃষিভিত্তিক মাতৃতান্ত্রিক সমাজব্যবস্থায় প্রাচীন মানবগোষ্ঠির উর্বরতাকেন্দ্রিক আদিম জাদুবিশ্বাস, প্রকৃতি-উপাসনা, লিঙ্গ ও শক্তি-সাধনা, আদিম যৌথ সমাজের বিভিন্ন অনুষ্ঠানের ধারাবাহিকতার মধ্য দিয়ে লোকায়ত সমাজে প্রচলিত বামাচার, কামাচার ইত্যাদি তান্ত্রিক সাধনা সহ বর্তমান আচার-অনুষ্ঠানগুলোরও নৃতাত্ত্বিক ব্যাখ্যা ও পর্যালোচনা জরুরি হয়ে ওঠে। প্রয়োজনের প্রেক্ষিতে অধ্যায় বিভাগ করে এসব বিষয়েরও তথ্য উপাত্ত ও পর্যাপ্ত সাহিত্য-নিদর্শনসহ পূর্ণাঙ্গ আলোচনাই ওঠে এসেছে ‘চার্বাকের খোঁজে ভারতীয় দর্শন’ গ্রন্থটিতে। আরো কৌতুহলের বিষয় হলো, যে যৌনকেন্দ্রিক কিংবা দেহাত্মভিত্তিক চিন্তা ও চর্চার কারণে বৈদিক সংস্কৃতি আশ্রিত ভারতীয় অধ্যাত্ম দর্শনগুলো লোকায়ত চার্বাক-সম্প্রদায়কে অন্যদের সাথে গুলিয়ে ফেলে অসভ্য বর্বর ইত্যাদি অনাকাঙ্ক্ষিত বিশেষণে বিশেষিত করতে পিছপা হয়নি, সর্বদা সাধারণের আড়ালে রাখার প্রচেষ্টায় নিয়োজিত থেকে সেই একই যৌনাচারের উপাদান বৈদিক-সংস্কৃতির যজ্ঞানুষ্ঠানগুলিতেও যে কমতি ছিলো না তার সাহিত্য-নমুনা উপস্থাপন করতেও কার্পণ্য করা হয়নি।

এই গ্রন্থে একদিকে চার্বাকমত এবং তার লোকায়তিক উৎস ও উপাদানের অনুসন্ধান, অন্যদিকে অধ্যাত্মবাদী ধ্যান-ধারণাগুলোর পর্যায়ক্রমিক পরিপুষ্টির ক্রমবিবর্তন আলোচনা করতে গিয়ে উঠে এসেছে আত্মার ধারণার আগমন, তাকে প্রতিষ্ঠিত করতে একে একে পরলোক, কর্মফল, জন্মান্তরবাদ, ঈশ্বর ইত্যাদি অতীন্দ্রিয় ধারণা সৃষ্টির বৈদিক ও ঔপনিষদিক পটভূমি এবং এসবকিছুকে দার্শনিক প্রতিষ্ঠা দানের লক্ষ্যে দর্শনশাস্ত্রে প্রমাণমিতির উপযোগিতা তৈরির প্রচেষ্টায় প্রত্যক্ষের পাশাপাশি অনুমান, উপমান, শব্দ বা আপ্তবাক্য ইত্যাদিকে প্রমাণ হিসেবে প্রতিষ্ঠা করার উদ্যোগ। চার্বাকেরা প্রত্যক্ষ-সংশ্লিষ্টতা বিহীন অন্য কোন প্রমাণকে অস্বীকারের মাধ্যমে যেকোনো অতীন্দ্রিয় বিশ্বাসকে প্রতিরোধকল্পে যে লৌকিক ও দার্শনিক দৃঢ়তার পরিচয় দিয়েছেন তা দর্শনের ইতিহাসে বিরল ব্যতিক্রম। ধর্মের নামে ভণ্ড-প্রতারকগোষ্ঠির লোক-ঠকানোর প্রতিবাদ ও প্রতিরোধ করাই যে তাঁদের প্রধান লক্ষ্য ছিলো তা বলার অপেক্ষা রাখে না। ফলে সেই প্রাচীনকাল থেকে অতীন্দ্রিয় অধ্যাত্মবাদের বিরুদ্ধে চার্বাকেরা ইহলৌকিক যুক্তিবাদের যে দ্বন্দ্বযুদ্ধের সূচনা করেছিলেন তারই বিভিন্ন পর্যায়ের যুযুধানে পর্যায়ক্রমে সমৃদ্ধ ও পরিপুষ্ট হয়েছে গোটা ভারতীয় দর্শনই। তার রূপরেখা এই গ্রন্থটিতে উৎকীর্ণ করার যথাসাধ্য চেষ্টা করা হয়েছে। সেই দার্শনিক যুদ্ধের সামাজিক প্রেক্ষাপটে ধর্মের নামে বর্ণবাদের উত্থান ও উন্মত্ত ধর্মান্ধতাকে কতোটা ঠেকিয়ে রাখা গেছে এ আলোচনা ভিন্নতর। কিন্তু মানব-সভ্যতায় ধর্ম ও দর্শন সৃষ্টির ইতিহাসে ইহলৌকিক বস্তুবাদী যুক্তি-দর্শন এবং মুক্তচিন্তক মানবমনে বিজ্ঞানমনস্ক দৃষ্টিভঙ্গি প্রসারে চার্বাক-সম্প্রদায়ের যে পর্যায়ক্রমিক অবদান এখনো যুক্তিবাদী মননে প্রেরণার কেন্দ্রবিন্দু হয়ে আছে তার পূর্বাপর বিস্তৃত আলোচনা-পর্যালোচনা রয়েছে ‘চার্বাকের খোঁজে ভারতীয় দর্শন’ গ্রন্থটিতে। এতোসব প্রসঙ্গের বিচার বিশ্লেষণ ও প্রায় অধুনা-বিরল প্রাচীন সাহিত্য-নিদর্শনের পর্যাপ্ত মণি-মুক্তোয় সমৃদ্ধ করার যথাসাধ্য প্রয়াস নেয়ায় খুব স্বাভাবিক কারণেই গ্রন্থটির পরিসর বা কলেবরও যথানিয়মে বৃদ্ধি পেয়েছে। তাই লাজ-লজ্জার মাথা খেয়ে নিজের ঢোল নিজে পেটানোর মতোই বলতে হয়, অমূল্য সম্পদকে যেমন মূল্যের সীমাবদ্ধতায় বিচার করা চলে না, তেমনি সাধারণের বোধগম্য করে লেখার প্রয়াস এই পুষ্ট গ্রন্থ যেকোন আগ্রহী ও কৌতুহলি পাঠকের জ্ঞানতৃষ্ণা পরিতৃপ্তির জন্য হয়তোবা অবশ্য-সংগ্রহের বিকল্প নেই।

দর্শন-চর্চা জ্ঞান-চর্চারই নামান্তর। প্রাচীন ভারতীয় দর্শন আমাদের বিশুদ্ধ জ্ঞানচর্চার প্রাচীনতম নিদর্শন। কিন্তু বিশুদ্ধ দর্শনচর্চায় বাংলাদেশের বর্তমান অবস্থা হতাশাব্যঞ্জকতার কোন্ পর্যায়ে তা বোধকরি বলার অপেক্ষা রাখে না। সেক্ষেত্রে শুদ্ধস্বর থেকে প্রকাশিত ভারতীয় দর্শন সিরিজের অন্যতম প্রয়াস ‘চার্বাকের খোঁজে ভারতীয় দর্শন’ শিরোনামের বৃহদাকার এই গ্রন্থটি এ অপবাদ মোচনে বাংলাদেশের দর্শনচর্চায় আদৌ কোন প্রভাব ও কার্যকর গতিশীলতা আনতে সক্ষম হবে কিনা তা বলা না-গেলেও গ্রন্থটি সংগ্রহ করে আগ্রহী পাঠক যে ঠকবেন না, লেখক হিসেবে অন্তত এটুকু বলতে পারি হয়তো।
...
রণদীপম বসু
1 like ·   •  0 comments  •  flag
Share on Twitter
Published on February 07, 2015 09:35 Tags: carvaka, ranadipam, চ-র-ব-ক, দর-শন
No comments have been added yet.