শবশিঙা প্রিভিউ (প্রথম পর্ব)
সতর্কীকরণ
ম্যাচিউর কন্টেন্ট | ভায়োলেন্স | PG 18+
শবখাদক
আমরা মৃতদেহ খুঁজে বেড়াই। খুঁজে পেলে মিলেমিশে খাই।
দলটা খুব একটা ভারী না। এগারোজন। চার দলে ভাগ হয়ে খুঁজি। তাতে মৃতদেহ পাওয়ার সম্ভাবনা বাড়ে। দলের নাম দিকের নামে—উত্তর, দক্ষিণ, পূর্ব, পশ্চিম। নাম আর কাজের দিক একই। মানে উত্তর দল কেবল উত্তরে খোঁজে, দক্ষিণ দল দক্ষিণে।
টাটকা মৃতদেহ আমাদের সবচেয়ে আরাধ্য। আর ওটাই জোটে সবচেয়ে কম। মাঝেমধ্যে পচাগলাও গিলতে হয়, তবে চেষ্টা করি না গিলতে। স্বাদই যদি না পেলাম তাহলে আর এত কষ্ট করার কী হলো!
একটা টাটকা লাশের খবর এনেছে দক্ষিণ দল। দ্রুতপদে সেদিকেই ছুটছি। দক্ষিণ দল সবচেয়ে ছোটো দল। অন্যদলগুলো তিনজন করে, এই দলে দুজন—আলাল আর মজিদ চাচা। আলাল দেখতে অনেকটা নিগ্রোদের মতো, বেঁটেখাটো, কুচকুচে কালো দেহ, ঝকঝকে দাঁত। অন্যদিকে মজিদ চাচার মধ্যে একটা সৌম্য ভাব আছে। গোলগাল চেহারা, শান্ত চোখ, ধীরস্থির মনোভাব।
দ্রুত যাওয়ার আরেকটা কারণও আছে—প্রতিপক্ষ। হ্যাঁ, আমাদের অনেকগুলো প্রতিপক্ষ আছে। সবচেয়ে বড়ো প্রতিপক্ষ হলো জালালের দল। “পাষণ্ড জালালের দল”-ও বলে অনেকে। ওরা মৃতদেহ না পেলে মৃতদেহ বানিয়ে নেয়। মানে খুন করে। খিদের জ্বালায় না পড়লে আমরা অন্যান্যরা পারতপক্ষে অতটা সহিংস হই না।
আমাদের দলটা কিছুটা গোঁড়া বলা যায়। খুনটুনে নেই আমরা। মৃতদেহের ওপর কোনোরকম অত্যাচার করি না। বিকৃত আচারও পালন করি না।
আমাদের দলনেতা হাশেম ভাই। দাঁড়ি পেকে সাদা হয়ে গেছে। অভিজ্ঞতার বলিরেখা সর্বত্র। তিনি পশ্চিম দলে থাকেন।
অনেকদিন হয়ে গেছে শেষ টাটকা মৃতদেহ খাওয়ার। তাই খবরটা পেয়ে দলের সবারই চোখ চকচক করছে। জিহ্বা টলটল করছে জলে। হাঁটার গতিও তাই স্বাভাবিকের চেয়ে দ্রুত।
যখন পৌঁছলাম তখন জ্যোৎস্নায় চারদিক ঝকঝক করছে। মৃতদেহটা পাওয়া গেছে নির্জন চরে। মাথা একদম বিচ্ছিন্ন করা। পুরো চরজুড়ে উঁচু উঁচু কাশের বন। বাতাসে প্রায়ই সরসর শব্দে দুলছে। এখনও কেউ মৃতদেহটার খবর পায়নি মনে হয়। অবশ্য আলাল আর মজিদ চাচা খোঁজ পেয়েই বালুচাপা দিয়ে গেছে। তাই খোঁজ পাওয়ার সম্ভাবনাও কম ছিল।
পূর্ব দলের মোটাসোটা জসিম বলল, “রক্ত দেইখা মনে হইতেছে খুনটা এখানেই করা হইছে। মাথাটা গেল কোথায় তাইলে? থাক গা যেখানে খুশি। আমার গোশত পাইলেই হইলো।”
পশ্চিম দল, মানে হাশেম ভাইয়ের দল এখনও আসেনি। তাই লাশ ধুয়ে নিয়ে বসে আছি। আমরা একসাথে খাই, মিলেমিশে—পরিবারের মতো।
হাশেম ভাই এসে স্বভাবমতো খানিকটা সময় নিয়ে মৃতদেহটা আগাগোড়া বারকয়েক দেখলেন। তারপর খানিকটা অস্ফুটস্বরে বললেন, “পালা সবাই।”
সবাই অদ্ভুতভাবে তাকালাম তার দিকে। পালাবো? কিন্তু কেন? এটা তো মাত্র একটা মৃতদেহ। আর চারদিকের পরিবেশও সুনসান, জনশূন্য।
আমাদের সবার দিকে তাকিয়ে আবার বললেন, “পালা রে পালা। এইটা তো জালালের লাশ। ওর দল খোঁজ পেলে আমাদের সবাইকে খাবে।”
☠
ঊর্ধ্বশ্বাসে দৌড়চ্ছি। পাশে কেবল একজন। মজিদ চাচা। আর কেউ সুযোগ পায়নি পালানোর। না, জালালের দলের কেউ আক্রমণ করেনি। আক্রমণ করেছে “বিষাণ”। বিষাণ মানে পশুর শিং দিয়ে বানানো শিঙা। ওদের মাথায় বাঁধা থাকে লাল কাপড়ের পট্টি। তাতে আঁকা সাদা রঙের শিঙা। আমাদের মতো শবখাদকদের নিধন করার কুখ্যাত দল।
টোপ দিয়ে ফাঁদে ফেলেছিল। জালালের দলেরও কি একই ভাগ্য বরণ করতে হয়েছে? ওর দলটাই সবচেয়ে বড়ো আর ভয়ংকর ছিল। তাদেরই যদি এই অবস্থা হয় তাহলে আমাদের মতো ছোটোখাটো দল কীভাবে টিকবে? আমাদের যাত্রার শেষ কি এখানেই?
দৌড়াতে দৌড়াতে চাঁদের আলোয় মজিদ চাচার দিকে আরেকবার তাকালাম, আগের মতোই শান্ত, সৌম্য, ধীরস্থির। যেন কিছুই ঘটেনি।
অথচ ঘটে গেছে...ঘটে গেছে অনেককিছু।
ইসরাফিলের শিঙা
“পালা রে পালা। এইটা তো জালালের লাশ। ওর দল খোঁজ পেলে আমাদের সবাইকে খাবে।” লাশের পাশে হাঁটু গেঁড়ে বসা অবস্থায় থেকে চিৎকার দিয়ে বললেন হাশেম ভাই। চরের ঝরঝরে বালুতে কিছুটা দেবে আছে হাঁটু।
আমরা সবাই স্থির হয়ে তাকিয়ে রইলাম তার দিকে। হতভম্ব অবস্থা। যেন হুট করে থামিয়ে দেওয়া হয়েছে চলমান কোনো দৌড় প্রতিযোগিতা।
উত্তর দিকের দলের আনোয়ার বলে উঠলো, “এইটা যে জালালের লাশ সেইটা কেমনে বুঝলেন? মাথা তো নাই।” নিজের মাথায় হাত বোলালো সে।
আনোয়ার মানুষ হিসাবে যুক্তিবাদী। যাই বলে না কেন তার পিছনে একটা যুক্তি লুকিয়ে থাকে। অদ্ভুত ব্যাপার, এই যুক্তিবাদী মানুষটাকে দীর্ঘসময় পাগলা গারদে থাকতে হয়েছিল। সেখান থেকে পালিয়ে এদিকওদিক ঘুরতে ঘুরতে কীভাবে যেন আমাদের মতো শবখাদক হয়ে গেছে। একসময় ভিড়ে গেছে আমাদের দলে। আমি তার অধীনে উত্তর দিকের দলে থাকি।
তার রুগ্ন শরীরের দিকে একপলক তাকিয়ে মোটাসোটা জসিম তাল মেলালো, “হ, হ, কেমন বুঝলেন? জালালের লাশ তো নাও হবার পারে।”
লাশের ডান হাত উঁচিয়ে ধরে হাশেম ভাই বললেন, “দেখ, তর্জনী আঙুল অর্ধেক নাই। পরিচিতদের মধ্যে এইটা কেবল জালালেরই নাই।”
আমি লাশের পাশে দাঁড়িয়ে ছিলাম। ভালোভাবে দেখার জন্য আমাকে সরিয়ে আনোয়ার কোমর বাঁকিয়ে দেখার চেষ্টা করল। থুতনি ঘষতে ঘষতে বলল, “জন্মগত কোনো ত্রুটি না এইটা, কোনো দুর্ঘটনায় হারাইছে। তাও বেশ আগেই হারাইছে। পনেরো-বিশ বছর আগের তো হবেই। হয়তো কোনো মারামারি করতে গিয়া কোপ খাইছে কিংবা অন্য কোনো...”
তাকে থামিয়ে এবার এগিয়ে এলেন মজিদ চাচা। শান্তভাবে হাঁটু ভাঁজ করে পায়ের আঙুলের ওপর ভর করে বসলেন লাশের পাশে। একটা চেক শার্ট পাশে ফেলে রাখা। ওটা লাশের গায়ে ছিল। চাঁদের আলোয় রংটা ঠিক বোঝা যাচ্ছে না। লাশ ধোঁয়ার সময় শার্টটা খুলে রাখা হয়েছিল। তিনি লাশের বুকের ঘন পশমের ভেতর তর্জনী আঙুল চালিয়ে ডান দিকে কিছু একটা খুঁজলেন। আঙুলটা এদিকওদিক এলোমেলোভাবে ঘুরে স্থির হলো একটা কাটা দাগে। ইঞ্চিখানেক দাগ। পুরোনো ক্ষত মনে হলো।
জসিমের দলের আরেক সদস্য রাজ্জাক তার স্বভাবমতো খেঁকিয়ে উঠে বলল, “বালের মতো মুখে ছিপি আইটা বইসা আছোস ক্যা?”
রাজ্জাক ভীষণ খিটখিটে স্বভাবের। কোনো কথাই স্বাভাবিকভাবে বলতে পারে না। সব কথাই বলে উচ্চস্বরে আর সাথে খিস্তি ফ্রি।
উঠে দাঁড়ালেন মজিদ চাচা। “হুম। জালালেরই মনে হইতেছে। তখন এত খেয়াল করি নাই। লাশ লুকাইতে ব্যস্ত আছিলাম।”
আমি এবার বললাম, “এখন কী করবো আমরা?”
আমার দিকে ফিরে তিনি বললেন, “যত দ্রুত সম্ভব এখান থেকে চইলা যাইতে হইবো। ঝুঁকি নেওয়া ঠিক হইবো না। জালাল কখনও একা একা ঘোরে না...মানে ঘুরত না। অন্তত পাঁচ-সাতজন তো থাকতোই সবসময়। যেহেতু তাদের দেখা যাইতেছে না। তাই হয় তারাও মারা পড়ছে, নয়তো বাকিদের ডাকতে গেছে। যদি ডাকতে যায়, আইসা পড়তে পারে যে-কোনো সময়।”
রাজ্জাক বলে উঠলো, “কী আর করার, আইজকাও উপাস থাকা লাগবে, বাল।” স্বর উঁচু করে বলল, “কে আনছে রে এই মড়ার খবর? কোন মাদারচোদ?” চোখ বুলালো সবার ওপর। স্থির হলো কুচকুচে কালো দেহের আলালের ঝকঝকে দাঁতের ওপর। এই অবস্থাতেও সে দাঁত বের করে হাসছে। তাকে বলল, “হালার পুত, আর কোনো লাশ পাইলি না? এইটাই জুটল?”
“আমার কী দুষ? মজিদ ভাই আগে পাইছে। আমি তার পিছন পিছন আসছি। লাশ দেইখা বালু চাপা দিয়াই খবর দিতে গেছি তোমাগো।”
জসিম তার বিশাল ভুঁড়িতে হাত বুলিয়ে বলল, “এইটা কোনো কথা? এমনিতেই খুনোখুনির লাশ খাওয়া অনেক ঝুঁকির। পুলিশি ঝামেলা থাকে। তারওপর যদি লাশ হয় দাগী আসামীর, আর পাষণ্ড জালালের, তাইলে তো যারে কয়, কী যেন কয়—মড়ার ওপর খাড়ার ঘা! মজিদ ভাই আপনে কেমন খোঁজ পাইলেন?”
মজিদ চাচা কিছু বলতে চাইলেন, কিন্তু তখন হাশেম ভাই বসা থেকে উঠে দাঁড়ানোর কারণে থেমে গেলেন। হাশেম ভাই আমাদের দলে সবচেয়ে প্রবীণ। চামড়ায় ভাঁজ পড়ে গেছে। দুশ্চিন্তায় এখন কপালেও ভাঁজের ভিড় দেখা যাচ্ছে। চিন্তিত স্বরে বললেন, “আজাইরা আলাপ পরে করিস। এক কাজ কর। লাশটা আবার চাপা দে। তারপর যাই। যদি অর দলের কেউ খোঁজ না পায় বা পুলিশি ঝামেলা না থাকে তাইলে এখানেই থাকবে। খাওয়ার সুযোগ থাকবে।”
আমাদের কোদাল, শাবল সবই আছে। কবর খুঁড়ে লাশ বের করতে সাথে রাখতে হয়। আমার শাবল আছে, তা দিয়ে খুঁড়তে শুরু করলাম। আলাল ভাই হাত লাগালেন কোদাল দিয়ে, সমানে কোপাতে লাগলেন। বালুমাটি হওয়ায় কিছুক্ষণের মধ্যেই পুঁতে ফেলার মতো গর্ত প্রায় হয়ে এলো।
এসময় হঠাৎ করে কানে এলো শিঙার তীক্ষ্ণ আওয়াজ। একটা বেজে উঠতেই পরপর আরও কয়েকটা চক্রাকারে বেজে উঠলো আমাদের চারপাশে। তারপর সব চুপচাপ। শোঁ শোঁ করে বাতাস বয়ে গেল কাশবনের ওপর দিয়ে। সরসর আওয়াজ হচ্ছে। লজ্জাবতীর মতো একে অপরের গায়ে লুটিয়ে পড়ছে কাশগুলো।
“কী হইলো এইটা?” জসিম অবাক হয়ে বলে উঠলো।
মজিদ চাচা চিৎকার দিয়ে বললেন, “সবাই মাটিতে শুইয়া পড়।”
উনি আর হাশেম ভাই ত্বরিত শুয়ে পড়লেন। আমি তখনও গর্তের তলায় শাবল হাতে শেষ পর্যায়ের খোঁড়াখুঁড়িতে ব্যস্ত। ওনাদের কথা শোনার পরেও বোকার মতো বসে আছি। কারণ চারপাশে কী হচ্ছে তা বোঝার উপায় নেই।
আমাকে কিছু বোঝাতে হলো না। আমাদের মধ্যে সবচেয়ে লম্বা আর উত্তর দলের অপরজন সদস্য ঝাঁকড়া চুলের সামাদ গর্তটার পাশে কাটা কলাগাছের মতো করে ধুপ করে মুখ থুবড়ে পড়ে গেল। যেন হাওয়ার তোড়ে পড়ে গেছে।
এবার হাশেম ভাই ফিসফিসিয়ে যেন নিজেকে বললেন, “বাইজা গেছে ইসরাফিলের শিঙা।”
হারাধনের এগারোটি ছেলে, রইলো বাকি...
ইসলাম ধর্মে বিশ্বাসীরা বিশ্বাস করেন, কিয়ামত বা মহাপ্রলয় শুরু হবে আল্লাহর আদেশে ইসরাফিল (আ.) নামের এক ফেরেশতা বা দেবদূতের শিঙার ফুঁৎকারের মাধ্যমে। তার শিঙার ধ্বনিতে ধ্বংস হয়ে যাবে পুরো সৃষ্টিজগত।
☠
সামাদ আমাদের দলে সবচেয়ে লম্বা সদস্য...ছিল। ছ’ ফিট তিন ইঞ্চি লম্বা। আমরা ডাকতাম তালগাছ বলে। উচ্চতা নিয়ে ছিল তার অনেক গর্ব। উচ্চতা মাপার যন্ত্র চোখে পড়লেই মাপতো আর আমাদের দেখিয়ে, খেপিয়ে, মাথা ঝাঁকিয়ে, ভাব নিতো। সেসময় তার মাথার ঝাঁকড়া চুল সেভাবে দুলতো যেভাবে হাওয়ায় ধানগাছ দোলে। বাঁশি বাজানোর খুব শখ ছিল। আহামরি বাজাতে পারতো না যদিও। চেষ্টা করতো আর বলতো, “ভাই, আমি কৃষ্ণ হমু, বাঁশির আওয়াজে রাধারে ডাকমু।”
সে আর কখনই রাধাকে ডাকতে পারবে না। বিষণ্ণ মনে উদ্বিগ্নচিত্তে রাধা অপেক্ষা করবে তার ঘরে। বাঁশির আওয়াজ আর কখনই তার কানে পৌঁছাবে না। কখনই না।
যখন সে গর্তটার পাশে কাটা কলাগাছের মতো করে ধুপ করে মুখ থুবড়ে পড়ে গেল, তার স্থির চোখগুলোর দিকে তাকিয়ে এসব কথাই ভাবছিলাম।
ঘাড় উঁচিয়ে গর্তটার বাইরে একবার তাকালাম। হাশেম ভাই মাটিতে শুয়ে পড়েছেন। তার পাশেই মজিদ চাচাও আছেন। হাশেম ভাই ফিসফিসিয়ে যেন নিজেকে বললেন, “বাইজা গেছে ইসরাফিলের শিঙা।”
আমি বললাম, “মানে?”
“বিষান্নাইরা হামলা চালাইছে। ওরা আমাদের সবাইকে মাইরা পুঁইতা ফেলবে। আমাদের আর বাঁচার আশা নাই।”
আমি উদ্বিগ্ন স্বরে বললাম, “উপায় তো একটা না একটা পাওয়া যাবেই।”
“যখন শিঙা বাজে তখন আর কেউ বাঁচে না। সবাইরে মাইরা ফেলায়। এইটা হইলো গিয়া ইসরাফিলের শিঙা।”
আমি উঠে দাঁড়াতে গেলেই মজিদ চাচা শোয়া অবস্থায় দাঁত খিঁচিয়ে বললেন, “মাথা উঁচা কইরো না। মইরা যাবা। গর্তে থাকো।”
গর্তের পাশে মজিদ চাচার কাছাকাছি শুয়ে পড়েছে পূর্ব দলের আরেক সদস্য পরিতোষদা। খুবই পরিপাটি একজন মানুষ। গলায় গামছা ঝুলিয়ে রাখেন একটা। ডানহাতে লাল সুতো বাঁধা। তাদের কোনো ধর্মীয় রীতির কারণে হয়তো। তিনি কথা বলেন শুদ্ধভাবে। মজিদ চাচার কথা শুনে বরাবরের মতো শুদ্ধভাষায় বললেন, “বুঝতে পারলাম না ব্যাপারটা। না পালিয়ে এভাবে শুয়ে থাকলে তো মারা পড়ার সুযোগ বেশি। আমাদের পালাতে...”
পরিতোষদা কথা শেষ করতে পারলেন না। আমার সাথে কোদাল হাতে গর্ত খুঁড়ছিলেন যে আলাল ভাই, উনি তার কোদালখানা উঁচিয়ে তলোয়ারের মতো করে ধরে, চিৎকার দিয়ে আক্রমণকারীদের উদ্দেশ্যে বলছিলেন, “আয়, কাছে আয়। দেখি কত সাহস! এই কোদাল দিয়ে তোদের ফালাফালা...”
তিনিও তার কথা শেষ করতে পারলেন না। বিস্ফারিত চোখ নিয়ে মাটিতে মুখ থুবড়ে পড়লেন।
রাজ্জাক ভাই তার পাশে হাঁটু গেঁড়ে বসে বললেন, “মাইরা ফেলাইছে রে, কুত্তাগুলা মাইরা ফেলাইছে সামাইদ্দা আর আলাইল্লারে। মাগিগুলাকে যদি আজকে আমি না চুদছি...”
“চুপ করে শুইয়া পড়...নইলে তোকেই চুইদা দেবে বিষান্নাইরা।” হাশেম ভাই দাঁতে দাঁত ঘষে বললেন। “শুইয়া পড় সবাই।”
“কিন্তু শুইতে হইবো কেন? কুত্তাগুলাকে গিয়ে শেষ করে দিলেই তো হয়। আমরা তো এখানে কম মানুষ নাই।” শুয়ে থাকা হাশেম ভাইয়ের দিকে তাকিয়ে বলল রাজ্জাক। সে এখনও কিছু বুঝে উঠতে পারছে না।
আনোয়ার তার মাথা চেপে ধরে শুইয়ে দিতে দিতে বলল, “এখনও বুঝোস নাই, বোকাচোদা? ওরা বিষ মাখা ডাঁট ছুড়ে মারতেছে। ভালো করে সামাদ আর আলালকে খেয়াল কর। সামাদের ঘাড়ে আর আলালের পিঠে বিঁইধা আছে ডাঁট। সামাদ সবচেয়ে লম্বা মানে উঁচা ছিল। তাই সে সবার আগে সহজ লক্ষ্যে পরিণত হইছে। আর আলাল নিজের মৃত্যু নিজেই ডেকে আনছে নিজেরে লক্ষ্য বানাইয়া। আমরা সবাই খুব দ্রুতই মারা পড়তাম, কিন্তু ঘন কাশবনের কারণে ওরা ডাঁট মাইরা সুবিধা করতে পারতেছে না। তাই যে-ই নিজের মাথা উঁচু করবে সে-ই মরবে। তাই, হাশেম ভাইয়ের কথা শোন, আর শুয়ে থাক।”
হাশেম ভাই সাথে যোগ করলেন, “হ, আনোয়ার ঠিক কইছে। আর বিষাইন্নারা আসে দল বাঁইধা। অগো মাথায় বাঁন্ধা থাকে লাল কাপড়ের ফিতা। সেই কাপড়ে শিঙা আঁকা থাকে। সাদা রঙের শিঙা মনে হয়। প্রথমে বাজায় অগো দলনেতা। সিগন্যাল দেয়। তারপরপরই বাকিরা চাইরদিক থাইকা বাজায়। ওরা কেবল তখনই শিঙা বাজায় যখন চাইরদিক থাইকা ঘিইরা ধরে। তাই শিঙা বাজানো মানে সবার কাহিনি শ্যাষ। খেল খতম। কেয়ামত। তাই আমাদের অনেকেই এইটারে কয় ইসরাফিলের শিঙা।”
“চারদিকে ঘিরে ধরছে মানে তো আমরা শ্যাষ। এখন তো বাঁচার কোনো উপায় নাই। আমার অনেক ভয় করতেছে।” আতঙ্কিত স্বরে বলে উঠলো হুমায়ূন। সে হাশেম ভাইয়ের দলে মানে পশ্চিম দলে। গোল ফ্রেমের চশমা পরে। মাথার চুল কাঁচাপাকা। তার বেশভূষা দেখে মনে হয় সে অনেক জ্ঞানী গোছের কেউ। কিন্তু আদতে সে গণ্ডমূর্খ আর ভীতু। শবখাদকদের দলে এমন একজন ভীতু কীভাবে ঢুকলো এটা একটা রহস্য। আমরা প্রায়ই তাকে ভয় দেখিয়ে মজা নিই।
“আমারও অনেক ভয় করতেছে। ভয়ে থাকলে আমার অনেক খিদা লাগে। আমি এইখানে শুইয়া থাকলে ভয় আর খিদায় মইরা যামু।” জসিম চিত হয়ে শুয়ে আকাশের দিকে তাকিয়ে বলল। তার বিশাল ভুঁড়িটা উঁচু ঢিবির মতো দেখাচ্ছে। “চল্ হুমায়ূন, পালাই। এদের কথা শুনলে এইখানে শুইয়া শুইয়া মরুম। তারচেয়ে পালানোর চেষ্টা করি।”
“কিন্তু কীভাবে? মাথা উঁচা করলেই তো বিষ মাখা ডাঁট আইসা মাইরা দিবে।” হুমায়ূন উদ্বিগ্ন স্বরে বলল।
আনোয়ার বলল, “এখানে শুইয়া থাকলে আসলেই বাঁচার আশা কইমা আসবে। আমরা হামাগুড়ি দিয়ে যতটা পারা যায় দূরে যাওয়ার চেষ্টা করতে পারি। ডাঁট খুব বেশি দূর যাইতে পারে না। একটা দূরত্বে চইলা গেলে বাঁচার সুযোগ বাড়বে। তখন দৌড়ায়ে পালানো যাবে।”
“বাল, তোরা বকবক করতে থাক। আমি মাগিদের ভয়ে আর শুইয়া থাকতে পারবো না। আমরা এইখানে বেশ্যার মতো শুয়ে থাকবো আর ওরা আইসা চুইদা দিয়া যাবে...এইটা আমি বাঁইচা থাকতে হইতে দিমু না। থাক তোরা...” বলেই রাজ্জাক যতটা পারা যায় মাথা নিচু করে দৌড় লাগালো। তাকে দেখে ভীত হুমায়ূনও পিছু নিলো।
বেশিদূর দৌড়াতে পারলো না। দুজনেই পড়ে গেল। ঘন কাশের ঝোপের কারণে কেবল দুটো ঝুপ ঝুপ মৃদু পতনের শব্দ শোনা গেল। রাজ্জাকের গালি আর শুনতে হবে না। জানা হবে না হুমায়ূনের মতো ভীত একটা লোক কীভাবে এই শবখাদকদের দলে ভিড়েছিল।
আনোয়ার বলল, “বিষাণের দল তাদের বৃত্ত ক্রমশ ছোটো করে আনতেছে। তাই এরা দ্রুত লক্ষ্যে পরিণত হইছে। আমরা যদি এইখানে শুইয়া থাকি, তাইলে আর খুব বেশিক্ষণ বাঁইচা থাকতে পারবো বলে মনে হয় না।”
এবার মজিদ চাচা মুখ খুললেন, “দলে ছিলাম এগারোজন। এখন আছি সাতজন। যদি একসাথে একদিকে যাই তাইলে বাঁচার সুযোগের চেয়ে মরার সুযোগই বাড়বে। সহজে লক্ষ্যে পরিণত হবো। আমাদের দলে ভাগ হইয়া চারদিকে ছড়াইয়া যাইতে হবে। এতে কেউ না কেউ কিংবা সবাই বাঁইচা যাইতে পারি।” গর্তে বসে থাকা আমার দিকে তাকিয়ে বললেন, “ও আর আমি একদলে, হাশেম ভাই আর জসিম একদলে, পরিতোষ আর আনোয়ার একদলে। আরেকজন হইলো জাফর...সে কই?”
জাফর ভদ্রগোছের এক ছেলে। পুরু গোঁফের কারণে তাকে বয়স্ক মনে হলেও, ত্রিশের কোটা পার করেছে বলে মনে হয় না। আমাদের দলে খুব বেশিদিন হয়নি যোগ দিয়েছে। নতুন সদস্যদের দৌড়াদৌড়ির কাজ বেশি দেওয়া হয়। মানে খবর আনা-নেওয়া, বাজার-সদাই করা এসব। মনে পড়লো, তাকে আমরা বাজার করতে পাঠিয়েছিলাম। তার একটা অন্যতম সমস্যা হলো, সে তোতলায়।
জসিম বলে উঠলো, “ওই তোতলাকে তো সদাই আনতে বাজারে পাঠাইছিলাম। বাঁইচা গেল হারামজাদা।” আফসোস ঝরে পড়লো তার কণ্ঠে।
মজিদ চাচা পরিতোষদাকে উদ্দেশ্য করে বললেন, “তোমার গামছাটা দেও। কাজ আছে।”
পরিতোষদা কিছু বললেন না। দিয়ে দিলেন। বাঁচার আশা ছেড়ে দিয়েছেন।
মজিদ চাচা গামছার এক মাথায় একটা ছোটো পাথর বেঁধে বললেন, “দেখা যাক কাজ করে কিনা।” তারপর আমাকে উদ্দেশ্য করে বললেন, “গর্ত থেকে বাইর হইবার সময় হইয়া গেছে। চলো, দেখি আমাদের ভাইগ্যে কী আছে। জ্যাতা নাকি মুর্দা!”
তিন দল তিন দিকে মাটিতে বুক ঘষে ঘষে এগুতে লাগলাম। নিজেকে সরীসৃপ মনে হচ্ছে। আমি মজিদ চাচার পিছু পিছু যাচ্ছি। বেঁচে থাকলে বাকিদের খবর নেওয়া যাবে। তবে মনে হচ্ছে আনোয়ারের আর্তচিৎকার শুনলাম। এর মানে হয়তো তার দল শেষ। শেষ হয়ে গেল পাগলাগারদ থেকে পালানো এক যুক্তিবাদীর আর পরিপাটি থাকা আর শুদ্ধ ভাষায় বলা পরিতোষদার। রইলাম কেবল আমরা দুজন, হাশেম ভাই আর পেটুক জসিম।
কিছুদূর গিয়ে মজিদ চাচা এবার একদিকে পাথর বাঁধা গামছাটা শূন্যে চরকির মতো এদিকওদিক কিছুক্ষণ ঘোরালেন। শিসের মতো কিছু শুনলাম। যখন থামিয়ে নামালেন তখন দেখলাম তিনি গামছা থেকে কাঠির মতো কিছু একটা খুলে ফেলে দিলেন। এগিয়ে যাওয়ার পর দেখে বুঝলাম ওটা একটা ডাঁট। কিন্তু মজিদ চাচা করলেনটা কী?
এবার তিনি যা বললেন তাতে ভয় পেয়ে গেলাম। উনি বললেন, “এইবার খিইচা দৌড় দিবা। যত জোরে দৌড়াবা বাঁচার সম্ভাবনা তত বেশি। আমাদের আশেপাশে একজনের বেশি বিষাইন্না নাই। থাকলে আরও ডাঁট পাইতাম। বুঝছো তো কি কইছি?”
ঢোক গিলে বললাম, “বুজছি।”
“এইদিকে যখন কেবল একজনই, তারমানে বাকি বিষাইন্নারা ওইদিকে চইলা গেছে। তারমানে...”
“তারমানে, হাশেম ভাইয়ের দলও শ্যাষ।”
“হ, হয়তো শ্যাষ। অত ভাবা লাগবে না। আরেকটু গিয়া দৌড় দিমু, তৈরি থাকো। ভাগ্য ভালো হলে বাঁইচা যাইতেও পারি...”
চাচার কথামতো দুজনে ঊর্ধ্বশ্বাসে দৌড়াচ্ছি। ভাবছি বিষাণের কথা। হয়তো টোপ দিয়ে ফাঁদে ফেলেছিল। জালালের দলেরও কি একই ভাগ্য বরণ করতে হয়েছে? আমাদের যাত্রার শেষ কি এখানেই?
দৌড়াতে দৌড়াতে চাঁদের আলোয় মজিদ চাচার দিকে আরেকবার তাকালাম, আগের মতোই শান্ত, সৌম্য, ধীরস্থির। যেন কিছুই ঘটেনি।
অথচ ঘটে গেছে...ঘটে গেছে অনেককিছু।
হারিয়েছি তালগাছ সামাদকে, ঝকঝকে দাঁতের আলালকে। হারিয়েছি খিস্তিরাজ রাজ্জাককে, ভীতু হুমায়ূনকে। আর দেখা হবে না হাশেম ভাইয়ের সাথে, পরিপাটি পরিতোষদার সাথে। আনোয়ার ভাইয়ের আর কোনো যুক্তি শোনা হবে না, পেটুক জসিমের খাবার নিয়ে হাহাকারও দেখা হবে না। জাফরের কী খবর কে জানে...
হারাধনের এগারোটি ছেলে, রইলো বাকি...দুই কিংবা তিন।
কাঠের ঘোড়া
মজিদের গল্প
মজিদ মিয়া দৌড়াচ্ছে। তবে প্রাণপণে নয়, আতঙ্কেও নয়, অনেকটা নিশ্চিন্তে আর কিছুটা দ্বিধায়। তবে তার পাশে ছেলেটা দৌড়াচ্ছে প্রাণপণে, আতঙ্কে, অনিশ্চয়তায়। মজিদ মিয়া ঠিক করে ফেলেছে তাদের এই দৌড় কোথায় গিয়ে থামবে। থামবে সেখানে, যেখানে গিয়ে থামলে আর কোনো ভয় থাকবে না।
তাই সে যখন মাত্র দুটো গ্রাম পেরিয়েই থেমে গেল, তখন সেই ছেলেটা তার প্রচণ্ড ভয়টা লুকাতে পারলো না। অনেকবার বলল আরও দূরে গিয়ে লুকাতে, কিন্তু মজিদ মিয়া জানে, সবচেয়ে নিরাপদ আশ্রয় এই গ্রামটাতেই। কারণ এই গ্রামেই আছে তার বাড়ি, তার পরিবার।
শবখাদকরা সারাক্ষণ একসাথে দল বেঁধে কাটায় না। তাদেরও নিজস্ব জীবন আছে, পরিবার আছে। প্রতি মাসের কিংবা সপ্তাহের নির্দিষ্ট কিছু দিন তারা দল বেঁধে শব খোঁজে আর খেয়ে বেড়ায়। বাকিটা সময় একেবারে স্বাভাবিক জীবন কাটায়। তবে কিছু কিছু দল যেমন, পাষণ্ড জালালের দলের মতো কিছু দল সবসময় দল বেঁধে কাটায়, শব খায় কিংবা খুনখারাপি, লুটতরাজ করে কাটায়। বলা যায় তারা একধরনের নরমাংসাশী ডাকাত।
বেশিরভাগ ক্ষেত্রে এক শবখাদক অন্য শবখাদকের পরিবার সম্বন্ধে তেমন কিছুই জানে না। কারণ, এটা অনেকটা অলিখিত নিয়ম যে, অন্য শবখাদকের ব্যক্তিগত জীবন নিয়ে ঘাঁটাঘাঁটি করা যাবে না। যখন তারা দলের বাইরে তখন তারা সভ্য জগতের মানুষ, একেঅপরের অপরিচিত। যখন তারা দলে তখন তারা একেঅপরের খুব পরিচিত, শবখাদক—মৃতদেহের মাংসই যাদের আহার্য।
বাড়ির কাছাকাছি আসতেই ছেলেটা প্রকৃতির ডাকে সাড়া দেওয়ার কথা বললে মজিদ মিয়া তাকে বাড়ির ঠিকানা বুঝিয়ে বাড়ির পথ ধরে। উঠানে এসেই বুঝতে পারে কিছু একটা ঠিক নেই। কী ঠিক নেই তা বুঝতে তার একটু সময় লাগলো। তার ঘরের দরজার তালাটা ভাঙা আর ভেজানো; অথচ তা তালাবন্ধ থাকার কথা। কারণ তার পরিবারে সদস্য একজনই, আর সেই একজন হলো সে নিজে। চোর নাকি বিষাণ হানা দিয়েছে তার বাসায়?
দ্বিধানিত্ব অবস্থায় দরজাটা ধীরেধীরে খোলে। ভেতরে আবছায়া অন্ধকার। সেই অন্ধকারেই ঘরের চারপাশে তাকায়, নাহ কেউ নেই। আন্দাজ করে বুঝতে পারে সব জিনিসপত্র সেভাবেই পড়ে আছে যেভাবে পড়ে ছিল। খোয়া যায়নি কিছুই। তার মানে চোরও হানা দেয়নি। তাহলে তালা ভাঙলো কে? কেন?
টের পায় কেমন একটা বোটকা গন্ধ ঘরজুড়ে। যেন কিছু মরে পচে আছে। আশেপাশে কিছু বদমাশ বিড়াল আছে, যেগুলো ইঁদুর ধরে মেরে খায় আর যারতার ঘরে সেগুলোর অবশিষ্ঠাংশ ফেলে যায়। তেমনি কিছু হতে পারে।
বাঁহাতের আঙুল দিয়ে চিমটার মতো করে নাক চেপে ঘরের এক কোণে থাকা বাতির সুইচটা টিপে ঘুরে দাঁড়াতেই চমকে ওঠে মজিদ মিয়া। তার শ্বাস ভারী হয়ে আসে। হৃদপিণ্ডে যেন কেউ জোরে জোরে হাঁপর চালাচ্ছে, ফুসফুস ভরিয়ে দিয়েছে পাথরে। পেন্ডুলামের মতো দুলতে থাকে চারপাশের পরিবেশ। কোনোমতে পাশে থাকা খাটের হাতল ধরে নিজের ভারসাম্য রক্ষা করে আর বিস্ফারিত চোখে তাকিয়ে থাকে ফ্যানের দিকে। সেখানে ঝুলে আছে একটা মুণ্ডু...বিচ্ছিন্ন একটা মুণ্ডু। একটা দড়ি মুখের ভেতর দিয়ে ঢুকিয়ে নাক দিয়ে বের করে ফ্যানের সাথে দড়ি বেঁধে ঝুলিয়ে রাখা হয়েছে।
মুণ্ডুটার চোখ উপড়ে ফেলা হয়েছে, কেটে নেওয়া হয়েছে জিহ্বা, দুটো কানেরই অস্তিত্ব নেই, ঠোঁটও কেটে ফেলা হয়েছে। আর তাতে উন্মুক্ত হয়েছে দাঁতের পাটি। সেইসাথে উন্মুক্ত হয়েছে আরেকটা ব্যাপার। আর তা হলো দাঁতগুলোও রেহাই পায়নি নৃশংসতা থেকে; ভারি কিছু দিয়ে ভেঙে ফেলা হয়েছে, এবড়োখেবড়ো আকার নিয়েছে সেগুলো। নাকটাও রেহাই পায়নি। এটা যে কী বীভৎস ব্যাপার তা সামনাসামনি না দেখলে কেউ অনুধাবন করতে পারবে না। মজিদ মিয়ার পেটের ভেতরে কেউ যেন একদল প্রজাপতি ছেড়ে দিয়েছে, আর তা উড়ছে মাতালের মতো। বের হয়ে আসতে চাচ্ছে সব।
এরকম অসুস্থ অবস্থাতেও দুয়ে দুয়ে চারের হিসাব মেলাতে তার কোনো অসুবিধাই হলো না। জালালের মৃতদেহে সব অঙ্গই পাওয়া গিয়েছিল, কেবল পাওয়া যায়নি তার মুণ্ডু। আর তার হিসাব মেলানো আরও সহজ করে দিয়েছে কপালে লেখা একটা নাম। ছুরির তীক্ষ্ণ ফলা দিয়ে লেখা—জালাল।
“কিন্তু কে করলো এই কাজ? বিষাণরা কখনই এরকম কিছু করে না। তাদের হিসাব সহজ। ডাঁট ছুড়ে মারো, এরপর পুঁতে ফেলো কিংবা...” আর কিছু ভাবার আগেই সে শুনতে পায় তাকে কেউ “মজিদ চাচা, মজিদ চাচা” বলে ডাকছে। তারমানে ছেলেটা এসে গেছে। “যদি সে এসে এটা দেখে তাহলে আমার চেয়েও বেশি ভয় পেয়ে যাবে। তাই এটাকে লুকাতে হবে।” এই কথা মনে মনে আওড়াতে আওড়াতে বিছানার তোষকের নিচে রাখা একটা চটের বস্তা বের করে। একটা চেয়ার ফ্যানের নিচে রাখাই ছিল। মনে হয় মুণ্ডুটা ফ্যানের সাথে বাঁধার সময় খুনি ব্যবহার করেছিল।
মজিদ মিয়া একটা চাকু খুঁজে চেয়ারটায় চড়ে দড়িটা কেটে দ্রুত মুণ্ডুটা বস্তায় ভরে ফেলে। দড়ি কাটার সময় বুঝতে পারে, ওটা আসলে পাটের দড়ি না, গামছা ছিঁড়ে বানানো হয়েছে। জানালা খুলে চালিয়ে দেয় ফ্যানটা, যাতে বোটকা গন্ধটা যতটা সম্ভব কমে আসে। একটা ন্যাকড়া দিয়ে মুণ্ডু থেকে মেঝেতে পড়া রক্ত মোছার চেষ্টা করে। শুকনো রক্ত, তাই সহজে ওঠে না। যতটা পারে ততটা তুলে বস্তাটা হাতে নিয়ে বাইরে আসে। ছেলেটাকে দেখে যতটা সম্ভব স্বাভাবিক গলায় বলে, “ঘর চিইনা বের করতে পারছো তাহলে।”
“হ, একটু কষ্ট হইছে বাইর করতে। তাই সময় লাগলো।” মজিদ মিয়ার বস্তার দিকে ইশারা করে বলল, “ওইটা কী চাচা? দুর্গন্ধ বাইর হইতেছে।”
মজিদ মিয়া নিজেকে সামলে নিয়ে বলে, “আর কইয়ো না, মুরগি মাইরা বাঘডাশা ঘরটাকে একদম পাখনা, নাড়ীভুঁড়ি দিয়া ভরায়ে ফেলছিল। ঘরও গন্ধ কইরা ফালাইছে। তুমি ততক্ষণ বাইরে বসো, চাইরপাশ ঘুইরা দেখতে থাকো। আমি এগুলা ফালায় আসতেছি।”
মজিদ মিয়া যেতে ধরতেই ছেলেটা তাকে থামিয়ে জিজ্ঞাসা করে, “এইটা কি আসলেই আপনার বাড়ি?”
“হ, আমার বাড়িই তো, আর কার হইবো?”
“না, মানে বাড়িতে আর কেউ নাই যে...”
“আমি একলা মানুষ। আমার আর কেউ নাই।”
“অহন থাইকা আমি আছি।” বলেই একটা সরলমনা হাসি দিল। “তাড়াতাড়ি আসেন, খিদা লাগছে।”
“আইচ্চা, আইতেছি ফালায় দিয়ে...ওহ চাইল-ডাইল তো নাই। কিইন্যা একেবারে আইতেছি।”
মজিদ মিয়া ছেলেটাকে পিছনে ফেলে এগিয়ে যায়। হাঁটতে থাকে একটা জঙ্গলের দিকে। একটা বড়ো গাছ পেরিয়ে যেতেই শিস শুনতে পায়...কান খাড়া করলে বুঝতে পারে শিস বাজছে একটা ছন্দে...তিন...দুই...তিন...
বস্তাটা আস্তে করে নামিয়ে এগিয়ে যায় শিসের উৎসের দিকে। উৎস থেকেও একজন বের হয়ে আসতে থাকে তার দিকে...একজন চল্লিশোর্ধ্ব বয়স্ক লোক। সবুজ রঙের শার্ট আর ঘাড়ে গামছা, খাকি রঙের প্যান্ট, সুন্দর করে বাঁদিকে সিঁথি করে আঁচড়ানো চুল। মুচকি হাসতে হাসতে এগিয়ে আসে মজিদ মিয়ার দিকে। দৃষ্টি ধূর্ততায় ভরা।
মজিদ মিয়া হাঁটার গতি চকিত বাড়িয়ে এগিয়ে গিয়ে লোকটার গামছা চেপে ধরে বলে, “আরেকটু হইলেই মাইরা ফেলতে ধরছিলি।”
জবাবে লোকটা কিছু না বলে ফিক করে হেসে ফেলে। তার খাকি রঙের প্যান্টের পকেট দিয়ে উঁকি দিচ্ছে একটা লাল কাপড়, ভালোভাবে লক্ষ করলে দেখা যাবে, তাতে আঁকা আছে সাদা শিঙা।
কাঠের ঘোড়ায় বজ্রাঘাত
মজিদের গল্প
ট্রয় নগরীর দুর্ভেদ্য প্রাচীর দশ বছরেও ভেদ করতে না পেরে নিশ্চিত পরাজয়ের মুখে সম্মুখীন গ্রিকরা। বিজয় ছিনিয়ে নিতে তারা আশ্রয় নিলো এক ছলের। বিশাল এক কাঠের ঘোড়ার মূর্তি বানিয়ে অপরাজয়ের প্রতীক হিসেবে উপহার দিয়ে তারা চলে যায়। গ্রিকদের চলে যাওয়া দেখে ট্রয়বাসীরা ভেতরে নিয়ে আসে উপহার। গভীররাত পর্যন্ত চলে তাদের বিজয়োৎসব। এরপর সবাই ঘুমিয়ে পড়লে কাঠের ঘোড়া থেকে সন্তর্পণে বেরিয়ে আসে কিছু স্পার্টান, খুলে দেয় নগরতোরণ। ঢুকে পড়ে চলে যাওয়ার ভান করে লুকিয়ে থাকা গ্রিক সৈন্যদল। চলে নারকীয় হত্যাযজ্ঞ। ধ্বংস হয় ট্রয় নগরীর। ইতিহাসে তাই কাঠের ঘোড়া লিপিবদ্ধ হয়ে যায় বিশ্বাসঘাতকতার প্রতীকরূপে...
☠
বাঁদিকে সিঁথি করে সুন্দর করে আঁচড়ানো চুলের লোকটার নাম ছাদেক দফাদার। হাসার পর সে বলে ওঠে, “আর ভাই কইয়েন না, মিসটেক হয়ে গেছে।” ডান হাতের বুড়ো আর তর্জনী আঙুল দিয়ে চিমটি দেখিয়ে বলে, “ছোটি সি মিসটেক।”
ছাদেক নিজেকে স্মার্ট দেখাতে তিনভাষা মিলিয়ে কথা বলতে ভালোবাসে। এটা নিয়ে পরিচিতরা বিরক্ত হলেও, এব্যাপারে তার কোনো ভ্রূক্ষেপ নেই।
গামছার ফাঁসটা আরেকটু শক্তভাবে চেপে ধরে মজিদ মিয়া বলে, “আমার জান চইলা যাইতে ধরছিল, আর এইটা হইয়া গেল ‘ছোটো ভুল’?”
“আরে ভাই, মাইন্ড কইরেন না, বললাম তো মিসআন্ডারস্ট্যান্ডিং হইছে। কুইক অপারেশন চালাইতে গিয়ে মিসটেকটা হইছে।”
এবার গামছা ছেড়ে দিয়ে মজিদ মিয়া বলে, “আমাকে না বলে এই ‘কুইক অপারেশন’ চালাতে হলো কেন?”
“আর ভাই কইয়েন না, সব শালা ওই জাফরের দোষ, হিজ ফল্ট।”
“জাফর? তোতলা জাফর?”
“হ ভাই। ও আমাদের নতুন স্পাই মানে টিকটিকি ছিল। আর আমি জানতামও না আপনি ওই শবখাদকের দলে ছিলেন। জাফরও আপনাকে চেনে না। ছাগলটা অল্প ক’মাসেই অধৈর্য হয়ে গেছিল। প্রোমোশনের আশায় একটু তাড়াহুড়া কইরা দলটাকে কোপ খাওয়াইছে। তাছাড়া বসের কাছ থেকে ‘আর্জেন্ট কল’ নিয়া আসছিল। আপনি তো আপনার মতিগতি সমন্ধে আমাদের কিছু বলেনও না। তাই মিস্টেকটা হয়ে গেছে।”
“নতুনদের নিয়ে এই এক সমস্যা। ধৈর্য ধরতে চায় না। সাফল্যকে মনে করে লিফট। বাটন চাপবে আর সুড়ুৎ করে ওপরে উঠে যাবে। সাফল্য হইলো গিয়া সিঁড়ির মতন। ধাপে ধাপে আগাইতে হয়। মাথার ঘাম পায়ে ফালাইতে হয়। সব কিছু কি আর এত সস্তা?” হতাশা ঝরে পড়ে মজিদ মিয়ার কণ্ঠে।
“কী আর করবেন ভাই, ইয়াং জেনারেশন তো। মাঘের শীতেও রক্ত গরম থাকে। অপারেশনেও তো ঝামেলা করছে।”
মজিদ মিয়া ভ্রু কুঁচকে বলে, “কী সমস্যা হইছিল?”
“ঠিকভাবে পুরাপুরি ঘিরে ধরার আগেই লম্বুটাকে ফালায় দিয়ে ঝামেলা বাঁধায় ফেলছিল। একদম ধৈর্য নাই।”
“সেই কারণে বাঁচছি মনে হয়। নইলে তো ঠিকভাবে টের পাওয়ার আগেই মরতাম। ভাগ্য ভালো ছি...”
“ভাই, চান্দের আলোয় আপনার সংকেতটা ধরতে একটু টাইম লাগছিল।”
মজিদ মিয়ার মনে পড়ে গেল গামছা বেঁধে শূন্যে ঘোরানোর কথা। তার সাথের ছেলেটা ভেবেছে সেটা ছিল প্রতিরক্ষা কৌশল, কিন্তু আসলে তা ছিল বিষাণদের কাছে পাঠানো গুপ্তসংকেত। নিয়ম করে ঘড়ির কাঁটার দিকে আর বিপরীত দিতে ঘোরাতে হয়। ঘোরানোর জন্য যে-কোনো কিছু হলেই হয়। দূর থেকে বোঝা গেলেই হলো।
“বুঝছিলাম যখন একটা ডাঁট এসে লাগছিল।”
ছাদেক মুখটা চোরের মতো করে বলে, “ওইটাও জাফর মারছিল। চান্দের আলোর কারণে মনে হয় সে সিগন্যালটা ভালোভাবে ধরতে পারে নাই। ভাগ্য ভালো আমি পাশে ছিলাম। দেইখা বুইঝাই ওরে মানা করে দিছি। নইলে আরও মারতো।”
“কোথায় তোমার এই জাফর? ওরে কয়টা থাপ্পড় দেওয়া দরকার।”
“আপনের কাছে যাওয়ার কথা। মাফ চাইতে যাইতে কইছি। আপনি হইলেন গিয়া লেজেন্ডারি বিষাণ, আমাগো ওস্তাদ, সেকেন্ড বস...”
আর কিছু বিশেষণ যুক্ত করার আগেই তাকে থামিয়ে মজিদ মিয়া বলল, “আমার সাথে দলের একটা পোলা আছে। তাই এখন আমার সাথে আপাতত কোনো যোগাযোগ রাখবা না।”
ছাদেক অবাক হয়ে বলে ওঠে, “শবখাদক লইয়া ঘুরতেছেন ক্যান?”
“এইজন্য তোগো উন্নতি নাই। আমাদের কাজ কী?”
ভ্রু কুঁচকে ছাদেক বলে, “শবখাদকদের ফিনিশ করা।”
“কেমনে করবা?”
“খুঁইজা খুঁইজা বাইর কইরা।”
“খুঁইজা খুঁইজা একটা-দুইটা পাবা, কোনো দলকে পাবা না, পুরা নেটওয়ার্ক পাবা না। এইজন্য কোনো না কোনো শবখাদকের দলে লুকাইয়া থাকতে হইবো।”
“ওই জাফরের মতো টিকটিকি হইয়া...”
“টিকটিকি হইয়া না, শবখাদক হইয়া।”
“কী কন?” অবাক হয়ে বলে ছাদেক।
“যদি পুরা নেটওয়ার্কটাকে ধ্বংস করতে হয়, তাহলে ওদের মতো কেউ হইয়া যাইতে হইবো।” দীর্ঘশ্বাস ফেলে মজিদ মিয়া বলল, “দলটায় বহুত দিন ধইরা ছিলাম। হাশেম ভাইয়ের সাথে অনেক খাতির ছিল। নেটওয়ার্কটাও কব্জায় আসতেছিল। তোরা ভেজাল করে দিলি। আবার শুরু থেকে শুরু করা লাগবে। একটা নতুন দলে সবার আস্থা অর্জন করা অনেক সময়ের ব্যাপার। কী যে করস না তোরা!”
অপরাধী ভঙ্গিতে ছাদেক দফাদার বলে, “মিস্টেক ভাই, মিস্টেক হয়ে গেছে। তা ওই পোলাকে দিয়া কী করবেন?”
“নতুন কোনো দলে ঢুকতে ওই ছেলেটাকে আমার লাগবে। ও আমার অ্যালিবাই হিসেবে কাজ করবে, বুঝছো?”
বিজ্ঞের মতো মাথা ঝাঁকিয়ে ছাদেক বলে, “ও আচ্ছা। আপনার ব্রেইন অনেক শার্প। আমি বসকে এ টু জেড সব বলবো। আপনি টেনশন নিয়েন না। তয় নতুন কোন দলে ঢুকলেন সেইটা জানায়ে রাইখেন। নয়তো...আচ্ছা আপনার হাতে কী জানি ছিল?”
পরের পর্ব : ক্লিক করুন
ম্যাচিউর কন্টেন্ট | ভায়োলেন্স | PG 18+
শবখাদক
আমরা মৃতদেহ খুঁজে বেড়াই। খুঁজে পেলে মিলেমিশে খাই।
দলটা খুব একটা ভারী না। এগারোজন। চার দলে ভাগ হয়ে খুঁজি। তাতে মৃতদেহ পাওয়ার সম্ভাবনা বাড়ে। দলের নাম দিকের নামে—উত্তর, দক্ষিণ, পূর্ব, পশ্চিম। নাম আর কাজের দিক একই। মানে উত্তর দল কেবল উত্তরে খোঁজে, দক্ষিণ দল দক্ষিণে।
টাটকা মৃতদেহ আমাদের সবচেয়ে আরাধ্য। আর ওটাই জোটে সবচেয়ে কম। মাঝেমধ্যে পচাগলাও গিলতে হয়, তবে চেষ্টা করি না গিলতে। স্বাদই যদি না পেলাম তাহলে আর এত কষ্ট করার কী হলো!
একটা টাটকা লাশের খবর এনেছে দক্ষিণ দল। দ্রুতপদে সেদিকেই ছুটছি। দক্ষিণ দল সবচেয়ে ছোটো দল। অন্যদলগুলো তিনজন করে, এই দলে দুজন—আলাল আর মজিদ চাচা। আলাল দেখতে অনেকটা নিগ্রোদের মতো, বেঁটেখাটো, কুচকুচে কালো দেহ, ঝকঝকে দাঁত। অন্যদিকে মজিদ চাচার মধ্যে একটা সৌম্য ভাব আছে। গোলগাল চেহারা, শান্ত চোখ, ধীরস্থির মনোভাব।
দ্রুত যাওয়ার আরেকটা কারণও আছে—প্রতিপক্ষ। হ্যাঁ, আমাদের অনেকগুলো প্রতিপক্ষ আছে। সবচেয়ে বড়ো প্রতিপক্ষ হলো জালালের দল। “পাষণ্ড জালালের দল”-ও বলে অনেকে। ওরা মৃতদেহ না পেলে মৃতদেহ বানিয়ে নেয়। মানে খুন করে। খিদের জ্বালায় না পড়লে আমরা অন্যান্যরা পারতপক্ষে অতটা সহিংস হই না।
আমাদের দলটা কিছুটা গোঁড়া বলা যায়। খুনটুনে নেই আমরা। মৃতদেহের ওপর কোনোরকম অত্যাচার করি না। বিকৃত আচারও পালন করি না।
আমাদের দলনেতা হাশেম ভাই। দাঁড়ি পেকে সাদা হয়ে গেছে। অভিজ্ঞতার বলিরেখা সর্বত্র। তিনি পশ্চিম দলে থাকেন।
অনেকদিন হয়ে গেছে শেষ টাটকা মৃতদেহ খাওয়ার। তাই খবরটা পেয়ে দলের সবারই চোখ চকচক করছে। জিহ্বা টলটল করছে জলে। হাঁটার গতিও তাই স্বাভাবিকের চেয়ে দ্রুত।
যখন পৌঁছলাম তখন জ্যোৎস্নায় চারদিক ঝকঝক করছে। মৃতদেহটা পাওয়া গেছে নির্জন চরে। মাথা একদম বিচ্ছিন্ন করা। পুরো চরজুড়ে উঁচু উঁচু কাশের বন। বাতাসে প্রায়ই সরসর শব্দে দুলছে। এখনও কেউ মৃতদেহটার খবর পায়নি মনে হয়। অবশ্য আলাল আর মজিদ চাচা খোঁজ পেয়েই বালুচাপা দিয়ে গেছে। তাই খোঁজ পাওয়ার সম্ভাবনাও কম ছিল।
পূর্ব দলের মোটাসোটা জসিম বলল, “রক্ত দেইখা মনে হইতেছে খুনটা এখানেই করা হইছে। মাথাটা গেল কোথায় তাইলে? থাক গা যেখানে খুশি। আমার গোশত পাইলেই হইলো।”
পশ্চিম দল, মানে হাশেম ভাইয়ের দল এখনও আসেনি। তাই লাশ ধুয়ে নিয়ে বসে আছি। আমরা একসাথে খাই, মিলেমিশে—পরিবারের মতো।
হাশেম ভাই এসে স্বভাবমতো খানিকটা সময় নিয়ে মৃতদেহটা আগাগোড়া বারকয়েক দেখলেন। তারপর খানিকটা অস্ফুটস্বরে বললেন, “পালা সবাই।”
সবাই অদ্ভুতভাবে তাকালাম তার দিকে। পালাবো? কিন্তু কেন? এটা তো মাত্র একটা মৃতদেহ। আর চারদিকের পরিবেশও সুনসান, জনশূন্য।
আমাদের সবার দিকে তাকিয়ে আবার বললেন, “পালা রে পালা। এইটা তো জালালের লাশ। ওর দল খোঁজ পেলে আমাদের সবাইকে খাবে।”
☠
ঊর্ধ্বশ্বাসে দৌড়চ্ছি। পাশে কেবল একজন। মজিদ চাচা। আর কেউ সুযোগ পায়নি পালানোর। না, জালালের দলের কেউ আক্রমণ করেনি। আক্রমণ করেছে “বিষাণ”। বিষাণ মানে পশুর শিং দিয়ে বানানো শিঙা। ওদের মাথায় বাঁধা থাকে লাল কাপড়ের পট্টি। তাতে আঁকা সাদা রঙের শিঙা। আমাদের মতো শবখাদকদের নিধন করার কুখ্যাত দল।
টোপ দিয়ে ফাঁদে ফেলেছিল। জালালের দলেরও কি একই ভাগ্য বরণ করতে হয়েছে? ওর দলটাই সবচেয়ে বড়ো আর ভয়ংকর ছিল। তাদেরই যদি এই অবস্থা হয় তাহলে আমাদের মতো ছোটোখাটো দল কীভাবে টিকবে? আমাদের যাত্রার শেষ কি এখানেই?
দৌড়াতে দৌড়াতে চাঁদের আলোয় মজিদ চাচার দিকে আরেকবার তাকালাম, আগের মতোই শান্ত, সৌম্য, ধীরস্থির। যেন কিছুই ঘটেনি।
অথচ ঘটে গেছে...ঘটে গেছে অনেককিছু।
ইসরাফিলের শিঙা
“পালা রে পালা। এইটা তো জালালের লাশ। ওর দল খোঁজ পেলে আমাদের সবাইকে খাবে।” লাশের পাশে হাঁটু গেঁড়ে বসা অবস্থায় থেকে চিৎকার দিয়ে বললেন হাশেম ভাই। চরের ঝরঝরে বালুতে কিছুটা দেবে আছে হাঁটু।
আমরা সবাই স্থির হয়ে তাকিয়ে রইলাম তার দিকে। হতভম্ব অবস্থা। যেন হুট করে থামিয়ে দেওয়া হয়েছে চলমান কোনো দৌড় প্রতিযোগিতা।
উত্তর দিকের দলের আনোয়ার বলে উঠলো, “এইটা যে জালালের লাশ সেইটা কেমনে বুঝলেন? মাথা তো নাই।” নিজের মাথায় হাত বোলালো সে।
আনোয়ার মানুষ হিসাবে যুক্তিবাদী। যাই বলে না কেন তার পিছনে একটা যুক্তি লুকিয়ে থাকে। অদ্ভুত ব্যাপার, এই যুক্তিবাদী মানুষটাকে দীর্ঘসময় পাগলা গারদে থাকতে হয়েছিল। সেখান থেকে পালিয়ে এদিকওদিক ঘুরতে ঘুরতে কীভাবে যেন আমাদের মতো শবখাদক হয়ে গেছে। একসময় ভিড়ে গেছে আমাদের দলে। আমি তার অধীনে উত্তর দিকের দলে থাকি।
তার রুগ্ন শরীরের দিকে একপলক তাকিয়ে মোটাসোটা জসিম তাল মেলালো, “হ, হ, কেমন বুঝলেন? জালালের লাশ তো নাও হবার পারে।”
লাশের ডান হাত উঁচিয়ে ধরে হাশেম ভাই বললেন, “দেখ, তর্জনী আঙুল অর্ধেক নাই। পরিচিতদের মধ্যে এইটা কেবল জালালেরই নাই।”
আমি লাশের পাশে দাঁড়িয়ে ছিলাম। ভালোভাবে দেখার জন্য আমাকে সরিয়ে আনোয়ার কোমর বাঁকিয়ে দেখার চেষ্টা করল। থুতনি ঘষতে ঘষতে বলল, “জন্মগত কোনো ত্রুটি না এইটা, কোনো দুর্ঘটনায় হারাইছে। তাও বেশ আগেই হারাইছে। পনেরো-বিশ বছর আগের তো হবেই। হয়তো কোনো মারামারি করতে গিয়া কোপ খাইছে কিংবা অন্য কোনো...”
তাকে থামিয়ে এবার এগিয়ে এলেন মজিদ চাচা। শান্তভাবে হাঁটু ভাঁজ করে পায়ের আঙুলের ওপর ভর করে বসলেন লাশের পাশে। একটা চেক শার্ট পাশে ফেলে রাখা। ওটা লাশের গায়ে ছিল। চাঁদের আলোয় রংটা ঠিক বোঝা যাচ্ছে না। লাশ ধোঁয়ার সময় শার্টটা খুলে রাখা হয়েছিল। তিনি লাশের বুকের ঘন পশমের ভেতর তর্জনী আঙুল চালিয়ে ডান দিকে কিছু একটা খুঁজলেন। আঙুলটা এদিকওদিক এলোমেলোভাবে ঘুরে স্থির হলো একটা কাটা দাগে। ইঞ্চিখানেক দাগ। পুরোনো ক্ষত মনে হলো।
জসিমের দলের আরেক সদস্য রাজ্জাক তার স্বভাবমতো খেঁকিয়ে উঠে বলল, “বালের মতো মুখে ছিপি আইটা বইসা আছোস ক্যা?”
রাজ্জাক ভীষণ খিটখিটে স্বভাবের। কোনো কথাই স্বাভাবিকভাবে বলতে পারে না। সব কথাই বলে উচ্চস্বরে আর সাথে খিস্তি ফ্রি।
উঠে দাঁড়ালেন মজিদ চাচা। “হুম। জালালেরই মনে হইতেছে। তখন এত খেয়াল করি নাই। লাশ লুকাইতে ব্যস্ত আছিলাম।”
আমি এবার বললাম, “এখন কী করবো আমরা?”
আমার দিকে ফিরে তিনি বললেন, “যত দ্রুত সম্ভব এখান থেকে চইলা যাইতে হইবো। ঝুঁকি নেওয়া ঠিক হইবো না। জালাল কখনও একা একা ঘোরে না...মানে ঘুরত না। অন্তত পাঁচ-সাতজন তো থাকতোই সবসময়। যেহেতু তাদের দেখা যাইতেছে না। তাই হয় তারাও মারা পড়ছে, নয়তো বাকিদের ডাকতে গেছে। যদি ডাকতে যায়, আইসা পড়তে পারে যে-কোনো সময়।”
রাজ্জাক বলে উঠলো, “কী আর করার, আইজকাও উপাস থাকা লাগবে, বাল।” স্বর উঁচু করে বলল, “কে আনছে রে এই মড়ার খবর? কোন মাদারচোদ?” চোখ বুলালো সবার ওপর। স্থির হলো কুচকুচে কালো দেহের আলালের ঝকঝকে দাঁতের ওপর। এই অবস্থাতেও সে দাঁত বের করে হাসছে। তাকে বলল, “হালার পুত, আর কোনো লাশ পাইলি না? এইটাই জুটল?”
“আমার কী দুষ? মজিদ ভাই আগে পাইছে। আমি তার পিছন পিছন আসছি। লাশ দেইখা বালু চাপা দিয়াই খবর দিতে গেছি তোমাগো।”
জসিম তার বিশাল ভুঁড়িতে হাত বুলিয়ে বলল, “এইটা কোনো কথা? এমনিতেই খুনোখুনির লাশ খাওয়া অনেক ঝুঁকির। পুলিশি ঝামেলা থাকে। তারওপর যদি লাশ হয় দাগী আসামীর, আর পাষণ্ড জালালের, তাইলে তো যারে কয়, কী যেন কয়—মড়ার ওপর খাড়ার ঘা! মজিদ ভাই আপনে কেমন খোঁজ পাইলেন?”
মজিদ চাচা কিছু বলতে চাইলেন, কিন্তু তখন হাশেম ভাই বসা থেকে উঠে দাঁড়ানোর কারণে থেমে গেলেন। হাশেম ভাই আমাদের দলে সবচেয়ে প্রবীণ। চামড়ায় ভাঁজ পড়ে গেছে। দুশ্চিন্তায় এখন কপালেও ভাঁজের ভিড় দেখা যাচ্ছে। চিন্তিত স্বরে বললেন, “আজাইরা আলাপ পরে করিস। এক কাজ কর। লাশটা আবার চাপা দে। তারপর যাই। যদি অর দলের কেউ খোঁজ না পায় বা পুলিশি ঝামেলা না থাকে তাইলে এখানেই থাকবে। খাওয়ার সুযোগ থাকবে।”
আমাদের কোদাল, শাবল সবই আছে। কবর খুঁড়ে লাশ বের করতে সাথে রাখতে হয়। আমার শাবল আছে, তা দিয়ে খুঁড়তে শুরু করলাম। আলাল ভাই হাত লাগালেন কোদাল দিয়ে, সমানে কোপাতে লাগলেন। বালুমাটি হওয়ায় কিছুক্ষণের মধ্যেই পুঁতে ফেলার মতো গর্ত প্রায় হয়ে এলো।
এসময় হঠাৎ করে কানে এলো শিঙার তীক্ষ্ণ আওয়াজ। একটা বেজে উঠতেই পরপর আরও কয়েকটা চক্রাকারে বেজে উঠলো আমাদের চারপাশে। তারপর সব চুপচাপ। শোঁ শোঁ করে বাতাস বয়ে গেল কাশবনের ওপর দিয়ে। সরসর আওয়াজ হচ্ছে। লজ্জাবতীর মতো একে অপরের গায়ে লুটিয়ে পড়ছে কাশগুলো।
“কী হইলো এইটা?” জসিম অবাক হয়ে বলে উঠলো।
মজিদ চাচা চিৎকার দিয়ে বললেন, “সবাই মাটিতে শুইয়া পড়।”
উনি আর হাশেম ভাই ত্বরিত শুয়ে পড়লেন। আমি তখনও গর্তের তলায় শাবল হাতে শেষ পর্যায়ের খোঁড়াখুঁড়িতে ব্যস্ত। ওনাদের কথা শোনার পরেও বোকার মতো বসে আছি। কারণ চারপাশে কী হচ্ছে তা বোঝার উপায় নেই।
আমাকে কিছু বোঝাতে হলো না। আমাদের মধ্যে সবচেয়ে লম্বা আর উত্তর দলের অপরজন সদস্য ঝাঁকড়া চুলের সামাদ গর্তটার পাশে কাটা কলাগাছের মতো করে ধুপ করে মুখ থুবড়ে পড়ে গেল। যেন হাওয়ার তোড়ে পড়ে গেছে।
এবার হাশেম ভাই ফিসফিসিয়ে যেন নিজেকে বললেন, “বাইজা গেছে ইসরাফিলের শিঙা।”
হারাধনের এগারোটি ছেলে, রইলো বাকি...
ইসলাম ধর্মে বিশ্বাসীরা বিশ্বাস করেন, কিয়ামত বা মহাপ্রলয় শুরু হবে আল্লাহর আদেশে ইসরাফিল (আ.) নামের এক ফেরেশতা বা দেবদূতের শিঙার ফুঁৎকারের মাধ্যমে। তার শিঙার ধ্বনিতে ধ্বংস হয়ে যাবে পুরো সৃষ্টিজগত।
☠
সামাদ আমাদের দলে সবচেয়ে লম্বা সদস্য...ছিল। ছ’ ফিট তিন ইঞ্চি লম্বা। আমরা ডাকতাম তালগাছ বলে। উচ্চতা নিয়ে ছিল তার অনেক গর্ব। উচ্চতা মাপার যন্ত্র চোখে পড়লেই মাপতো আর আমাদের দেখিয়ে, খেপিয়ে, মাথা ঝাঁকিয়ে, ভাব নিতো। সেসময় তার মাথার ঝাঁকড়া চুল সেভাবে দুলতো যেভাবে হাওয়ায় ধানগাছ দোলে। বাঁশি বাজানোর খুব শখ ছিল। আহামরি বাজাতে পারতো না যদিও। চেষ্টা করতো আর বলতো, “ভাই, আমি কৃষ্ণ হমু, বাঁশির আওয়াজে রাধারে ডাকমু।”
সে আর কখনই রাধাকে ডাকতে পারবে না। বিষণ্ণ মনে উদ্বিগ্নচিত্তে রাধা অপেক্ষা করবে তার ঘরে। বাঁশির আওয়াজ আর কখনই তার কানে পৌঁছাবে না। কখনই না।
যখন সে গর্তটার পাশে কাটা কলাগাছের মতো করে ধুপ করে মুখ থুবড়ে পড়ে গেল, তার স্থির চোখগুলোর দিকে তাকিয়ে এসব কথাই ভাবছিলাম।
ঘাড় উঁচিয়ে গর্তটার বাইরে একবার তাকালাম। হাশেম ভাই মাটিতে শুয়ে পড়েছেন। তার পাশেই মজিদ চাচাও আছেন। হাশেম ভাই ফিসফিসিয়ে যেন নিজেকে বললেন, “বাইজা গেছে ইসরাফিলের শিঙা।”
আমি বললাম, “মানে?”
“বিষান্নাইরা হামলা চালাইছে। ওরা আমাদের সবাইকে মাইরা পুঁইতা ফেলবে। আমাদের আর বাঁচার আশা নাই।”
আমি উদ্বিগ্ন স্বরে বললাম, “উপায় তো একটা না একটা পাওয়া যাবেই।”
“যখন শিঙা বাজে তখন আর কেউ বাঁচে না। সবাইরে মাইরা ফেলায়। এইটা হইলো গিয়া ইসরাফিলের শিঙা।”
আমি উঠে দাঁড়াতে গেলেই মজিদ চাচা শোয়া অবস্থায় দাঁত খিঁচিয়ে বললেন, “মাথা উঁচা কইরো না। মইরা যাবা। গর্তে থাকো।”
গর্তের পাশে মজিদ চাচার কাছাকাছি শুয়ে পড়েছে পূর্ব দলের আরেক সদস্য পরিতোষদা। খুবই পরিপাটি একজন মানুষ। গলায় গামছা ঝুলিয়ে রাখেন একটা। ডানহাতে লাল সুতো বাঁধা। তাদের কোনো ধর্মীয় রীতির কারণে হয়তো। তিনি কথা বলেন শুদ্ধভাবে। মজিদ চাচার কথা শুনে বরাবরের মতো শুদ্ধভাষায় বললেন, “বুঝতে পারলাম না ব্যাপারটা। না পালিয়ে এভাবে শুয়ে থাকলে তো মারা পড়ার সুযোগ বেশি। আমাদের পালাতে...”
পরিতোষদা কথা শেষ করতে পারলেন না। আমার সাথে কোদাল হাতে গর্ত খুঁড়ছিলেন যে আলাল ভাই, উনি তার কোদালখানা উঁচিয়ে তলোয়ারের মতো করে ধরে, চিৎকার দিয়ে আক্রমণকারীদের উদ্দেশ্যে বলছিলেন, “আয়, কাছে আয়। দেখি কত সাহস! এই কোদাল দিয়ে তোদের ফালাফালা...”
তিনিও তার কথা শেষ করতে পারলেন না। বিস্ফারিত চোখ নিয়ে মাটিতে মুখ থুবড়ে পড়লেন।
রাজ্জাক ভাই তার পাশে হাঁটু গেঁড়ে বসে বললেন, “মাইরা ফেলাইছে রে, কুত্তাগুলা মাইরা ফেলাইছে সামাইদ্দা আর আলাইল্লারে। মাগিগুলাকে যদি আজকে আমি না চুদছি...”
“চুপ করে শুইয়া পড়...নইলে তোকেই চুইদা দেবে বিষান্নাইরা।” হাশেম ভাই দাঁতে দাঁত ঘষে বললেন। “শুইয়া পড় সবাই।”
“কিন্তু শুইতে হইবো কেন? কুত্তাগুলাকে গিয়ে শেষ করে দিলেই তো হয়। আমরা তো এখানে কম মানুষ নাই।” শুয়ে থাকা হাশেম ভাইয়ের দিকে তাকিয়ে বলল রাজ্জাক। সে এখনও কিছু বুঝে উঠতে পারছে না।
আনোয়ার তার মাথা চেপে ধরে শুইয়ে দিতে দিতে বলল, “এখনও বুঝোস নাই, বোকাচোদা? ওরা বিষ মাখা ডাঁট ছুড়ে মারতেছে। ভালো করে সামাদ আর আলালকে খেয়াল কর। সামাদের ঘাড়ে আর আলালের পিঠে বিঁইধা আছে ডাঁট। সামাদ সবচেয়ে লম্বা মানে উঁচা ছিল। তাই সে সবার আগে সহজ লক্ষ্যে পরিণত হইছে। আর আলাল নিজের মৃত্যু নিজেই ডেকে আনছে নিজেরে লক্ষ্য বানাইয়া। আমরা সবাই খুব দ্রুতই মারা পড়তাম, কিন্তু ঘন কাশবনের কারণে ওরা ডাঁট মাইরা সুবিধা করতে পারতেছে না। তাই যে-ই নিজের মাথা উঁচু করবে সে-ই মরবে। তাই, হাশেম ভাইয়ের কথা শোন, আর শুয়ে থাক।”
হাশেম ভাই সাথে যোগ করলেন, “হ, আনোয়ার ঠিক কইছে। আর বিষাইন্নারা আসে দল বাঁইধা। অগো মাথায় বাঁন্ধা থাকে লাল কাপড়ের ফিতা। সেই কাপড়ে শিঙা আঁকা থাকে। সাদা রঙের শিঙা মনে হয়। প্রথমে বাজায় অগো দলনেতা। সিগন্যাল দেয়। তারপরপরই বাকিরা চাইরদিক থাইকা বাজায়। ওরা কেবল তখনই শিঙা বাজায় যখন চাইরদিক থাইকা ঘিইরা ধরে। তাই শিঙা বাজানো মানে সবার কাহিনি শ্যাষ। খেল খতম। কেয়ামত। তাই আমাদের অনেকেই এইটারে কয় ইসরাফিলের শিঙা।”
“চারদিকে ঘিরে ধরছে মানে তো আমরা শ্যাষ। এখন তো বাঁচার কোনো উপায় নাই। আমার অনেক ভয় করতেছে।” আতঙ্কিত স্বরে বলে উঠলো হুমায়ূন। সে হাশেম ভাইয়ের দলে মানে পশ্চিম দলে। গোল ফ্রেমের চশমা পরে। মাথার চুল কাঁচাপাকা। তার বেশভূষা দেখে মনে হয় সে অনেক জ্ঞানী গোছের কেউ। কিন্তু আদতে সে গণ্ডমূর্খ আর ভীতু। শবখাদকদের দলে এমন একজন ভীতু কীভাবে ঢুকলো এটা একটা রহস্য। আমরা প্রায়ই তাকে ভয় দেখিয়ে মজা নিই।
“আমারও অনেক ভয় করতেছে। ভয়ে থাকলে আমার অনেক খিদা লাগে। আমি এইখানে শুইয়া থাকলে ভয় আর খিদায় মইরা যামু।” জসিম চিত হয়ে শুয়ে আকাশের দিকে তাকিয়ে বলল। তার বিশাল ভুঁড়িটা উঁচু ঢিবির মতো দেখাচ্ছে। “চল্ হুমায়ূন, পালাই। এদের কথা শুনলে এইখানে শুইয়া শুইয়া মরুম। তারচেয়ে পালানোর চেষ্টা করি।”
“কিন্তু কীভাবে? মাথা উঁচা করলেই তো বিষ মাখা ডাঁট আইসা মাইরা দিবে।” হুমায়ূন উদ্বিগ্ন স্বরে বলল।
আনোয়ার বলল, “এখানে শুইয়া থাকলে আসলেই বাঁচার আশা কইমা আসবে। আমরা হামাগুড়ি দিয়ে যতটা পারা যায় দূরে যাওয়ার চেষ্টা করতে পারি। ডাঁট খুব বেশি দূর যাইতে পারে না। একটা দূরত্বে চইলা গেলে বাঁচার সুযোগ বাড়বে। তখন দৌড়ায়ে পালানো যাবে।”
“বাল, তোরা বকবক করতে থাক। আমি মাগিদের ভয়ে আর শুইয়া থাকতে পারবো না। আমরা এইখানে বেশ্যার মতো শুয়ে থাকবো আর ওরা আইসা চুইদা দিয়া যাবে...এইটা আমি বাঁইচা থাকতে হইতে দিমু না। থাক তোরা...” বলেই রাজ্জাক যতটা পারা যায় মাথা নিচু করে দৌড় লাগালো। তাকে দেখে ভীত হুমায়ূনও পিছু নিলো।
বেশিদূর দৌড়াতে পারলো না। দুজনেই পড়ে গেল। ঘন কাশের ঝোপের কারণে কেবল দুটো ঝুপ ঝুপ মৃদু পতনের শব্দ শোনা গেল। রাজ্জাকের গালি আর শুনতে হবে না। জানা হবে না হুমায়ূনের মতো ভীত একটা লোক কীভাবে এই শবখাদকদের দলে ভিড়েছিল।
আনোয়ার বলল, “বিষাণের দল তাদের বৃত্ত ক্রমশ ছোটো করে আনতেছে। তাই এরা দ্রুত লক্ষ্যে পরিণত হইছে। আমরা যদি এইখানে শুইয়া থাকি, তাইলে আর খুব বেশিক্ষণ বাঁইচা থাকতে পারবো বলে মনে হয় না।”
এবার মজিদ চাচা মুখ খুললেন, “দলে ছিলাম এগারোজন। এখন আছি সাতজন। যদি একসাথে একদিকে যাই তাইলে বাঁচার সুযোগের চেয়ে মরার সুযোগই বাড়বে। সহজে লক্ষ্যে পরিণত হবো। আমাদের দলে ভাগ হইয়া চারদিকে ছড়াইয়া যাইতে হবে। এতে কেউ না কেউ কিংবা সবাই বাঁইচা যাইতে পারি।” গর্তে বসে থাকা আমার দিকে তাকিয়ে বললেন, “ও আর আমি একদলে, হাশেম ভাই আর জসিম একদলে, পরিতোষ আর আনোয়ার একদলে। আরেকজন হইলো জাফর...সে কই?”
জাফর ভদ্রগোছের এক ছেলে। পুরু গোঁফের কারণে তাকে বয়স্ক মনে হলেও, ত্রিশের কোটা পার করেছে বলে মনে হয় না। আমাদের দলে খুব বেশিদিন হয়নি যোগ দিয়েছে। নতুন সদস্যদের দৌড়াদৌড়ির কাজ বেশি দেওয়া হয়। মানে খবর আনা-নেওয়া, বাজার-সদাই করা এসব। মনে পড়লো, তাকে আমরা বাজার করতে পাঠিয়েছিলাম। তার একটা অন্যতম সমস্যা হলো, সে তোতলায়।
জসিম বলে উঠলো, “ওই তোতলাকে তো সদাই আনতে বাজারে পাঠাইছিলাম। বাঁইচা গেল হারামজাদা।” আফসোস ঝরে পড়লো তার কণ্ঠে।
মজিদ চাচা পরিতোষদাকে উদ্দেশ্য করে বললেন, “তোমার গামছাটা দেও। কাজ আছে।”
পরিতোষদা কিছু বললেন না। দিয়ে দিলেন। বাঁচার আশা ছেড়ে দিয়েছেন।
মজিদ চাচা গামছার এক মাথায় একটা ছোটো পাথর বেঁধে বললেন, “দেখা যাক কাজ করে কিনা।” তারপর আমাকে উদ্দেশ্য করে বললেন, “গর্ত থেকে বাইর হইবার সময় হইয়া গেছে। চলো, দেখি আমাদের ভাইগ্যে কী আছে। জ্যাতা নাকি মুর্দা!”
তিন দল তিন দিকে মাটিতে বুক ঘষে ঘষে এগুতে লাগলাম। নিজেকে সরীসৃপ মনে হচ্ছে। আমি মজিদ চাচার পিছু পিছু যাচ্ছি। বেঁচে থাকলে বাকিদের খবর নেওয়া যাবে। তবে মনে হচ্ছে আনোয়ারের আর্তচিৎকার শুনলাম। এর মানে হয়তো তার দল শেষ। শেষ হয়ে গেল পাগলাগারদ থেকে পালানো এক যুক্তিবাদীর আর পরিপাটি থাকা আর শুদ্ধ ভাষায় বলা পরিতোষদার। রইলাম কেবল আমরা দুজন, হাশেম ভাই আর পেটুক জসিম।
কিছুদূর গিয়ে মজিদ চাচা এবার একদিকে পাথর বাঁধা গামছাটা শূন্যে চরকির মতো এদিকওদিক কিছুক্ষণ ঘোরালেন। শিসের মতো কিছু শুনলাম। যখন থামিয়ে নামালেন তখন দেখলাম তিনি গামছা থেকে কাঠির মতো কিছু একটা খুলে ফেলে দিলেন। এগিয়ে যাওয়ার পর দেখে বুঝলাম ওটা একটা ডাঁট। কিন্তু মজিদ চাচা করলেনটা কী?
এবার তিনি যা বললেন তাতে ভয় পেয়ে গেলাম। উনি বললেন, “এইবার খিইচা দৌড় দিবা। যত জোরে দৌড়াবা বাঁচার সম্ভাবনা তত বেশি। আমাদের আশেপাশে একজনের বেশি বিষাইন্না নাই। থাকলে আরও ডাঁট পাইতাম। বুঝছো তো কি কইছি?”
ঢোক গিলে বললাম, “বুজছি।”
“এইদিকে যখন কেবল একজনই, তারমানে বাকি বিষাইন্নারা ওইদিকে চইলা গেছে। তারমানে...”
“তারমানে, হাশেম ভাইয়ের দলও শ্যাষ।”
“হ, হয়তো শ্যাষ। অত ভাবা লাগবে না। আরেকটু গিয়া দৌড় দিমু, তৈরি থাকো। ভাগ্য ভালো হলে বাঁইচা যাইতেও পারি...”
চাচার কথামতো দুজনে ঊর্ধ্বশ্বাসে দৌড়াচ্ছি। ভাবছি বিষাণের কথা। হয়তো টোপ দিয়ে ফাঁদে ফেলেছিল। জালালের দলেরও কি একই ভাগ্য বরণ করতে হয়েছে? আমাদের যাত্রার শেষ কি এখানেই?
দৌড়াতে দৌড়াতে চাঁদের আলোয় মজিদ চাচার দিকে আরেকবার তাকালাম, আগের মতোই শান্ত, সৌম্য, ধীরস্থির। যেন কিছুই ঘটেনি।
অথচ ঘটে গেছে...ঘটে গেছে অনেককিছু।
হারিয়েছি তালগাছ সামাদকে, ঝকঝকে দাঁতের আলালকে। হারিয়েছি খিস্তিরাজ রাজ্জাককে, ভীতু হুমায়ূনকে। আর দেখা হবে না হাশেম ভাইয়ের সাথে, পরিপাটি পরিতোষদার সাথে। আনোয়ার ভাইয়ের আর কোনো যুক্তি শোনা হবে না, পেটুক জসিমের খাবার নিয়ে হাহাকারও দেখা হবে না। জাফরের কী খবর কে জানে...
হারাধনের এগারোটি ছেলে, রইলো বাকি...দুই কিংবা তিন।
কাঠের ঘোড়া
মজিদের গল্প
মজিদ মিয়া দৌড়াচ্ছে। তবে প্রাণপণে নয়, আতঙ্কেও নয়, অনেকটা নিশ্চিন্তে আর কিছুটা দ্বিধায়। তবে তার পাশে ছেলেটা দৌড়াচ্ছে প্রাণপণে, আতঙ্কে, অনিশ্চয়তায়। মজিদ মিয়া ঠিক করে ফেলেছে তাদের এই দৌড় কোথায় গিয়ে থামবে। থামবে সেখানে, যেখানে গিয়ে থামলে আর কোনো ভয় থাকবে না।
তাই সে যখন মাত্র দুটো গ্রাম পেরিয়েই থেমে গেল, তখন সেই ছেলেটা তার প্রচণ্ড ভয়টা লুকাতে পারলো না। অনেকবার বলল আরও দূরে গিয়ে লুকাতে, কিন্তু মজিদ মিয়া জানে, সবচেয়ে নিরাপদ আশ্রয় এই গ্রামটাতেই। কারণ এই গ্রামেই আছে তার বাড়ি, তার পরিবার।
শবখাদকরা সারাক্ষণ একসাথে দল বেঁধে কাটায় না। তাদেরও নিজস্ব জীবন আছে, পরিবার আছে। প্রতি মাসের কিংবা সপ্তাহের নির্দিষ্ট কিছু দিন তারা দল বেঁধে শব খোঁজে আর খেয়ে বেড়ায়। বাকিটা সময় একেবারে স্বাভাবিক জীবন কাটায়। তবে কিছু কিছু দল যেমন, পাষণ্ড জালালের দলের মতো কিছু দল সবসময় দল বেঁধে কাটায়, শব খায় কিংবা খুনখারাপি, লুটতরাজ করে কাটায়। বলা যায় তারা একধরনের নরমাংসাশী ডাকাত।
বেশিরভাগ ক্ষেত্রে এক শবখাদক অন্য শবখাদকের পরিবার সম্বন্ধে তেমন কিছুই জানে না। কারণ, এটা অনেকটা অলিখিত নিয়ম যে, অন্য শবখাদকের ব্যক্তিগত জীবন নিয়ে ঘাঁটাঘাঁটি করা যাবে না। যখন তারা দলের বাইরে তখন তারা সভ্য জগতের মানুষ, একেঅপরের অপরিচিত। যখন তারা দলে তখন তারা একেঅপরের খুব পরিচিত, শবখাদক—মৃতদেহের মাংসই যাদের আহার্য।
বাড়ির কাছাকাছি আসতেই ছেলেটা প্রকৃতির ডাকে সাড়া দেওয়ার কথা বললে মজিদ মিয়া তাকে বাড়ির ঠিকানা বুঝিয়ে বাড়ির পথ ধরে। উঠানে এসেই বুঝতে পারে কিছু একটা ঠিক নেই। কী ঠিক নেই তা বুঝতে তার একটু সময় লাগলো। তার ঘরের দরজার তালাটা ভাঙা আর ভেজানো; অথচ তা তালাবন্ধ থাকার কথা। কারণ তার পরিবারে সদস্য একজনই, আর সেই একজন হলো সে নিজে। চোর নাকি বিষাণ হানা দিয়েছে তার বাসায়?
দ্বিধানিত্ব অবস্থায় দরজাটা ধীরেধীরে খোলে। ভেতরে আবছায়া অন্ধকার। সেই অন্ধকারেই ঘরের চারপাশে তাকায়, নাহ কেউ নেই। আন্দাজ করে বুঝতে পারে সব জিনিসপত্র সেভাবেই পড়ে আছে যেভাবে পড়ে ছিল। খোয়া যায়নি কিছুই। তার মানে চোরও হানা দেয়নি। তাহলে তালা ভাঙলো কে? কেন?
টের পায় কেমন একটা বোটকা গন্ধ ঘরজুড়ে। যেন কিছু মরে পচে আছে। আশেপাশে কিছু বদমাশ বিড়াল আছে, যেগুলো ইঁদুর ধরে মেরে খায় আর যারতার ঘরে সেগুলোর অবশিষ্ঠাংশ ফেলে যায়। তেমনি কিছু হতে পারে।
বাঁহাতের আঙুল দিয়ে চিমটার মতো করে নাক চেপে ঘরের এক কোণে থাকা বাতির সুইচটা টিপে ঘুরে দাঁড়াতেই চমকে ওঠে মজিদ মিয়া। তার শ্বাস ভারী হয়ে আসে। হৃদপিণ্ডে যেন কেউ জোরে জোরে হাঁপর চালাচ্ছে, ফুসফুস ভরিয়ে দিয়েছে পাথরে। পেন্ডুলামের মতো দুলতে থাকে চারপাশের পরিবেশ। কোনোমতে পাশে থাকা খাটের হাতল ধরে নিজের ভারসাম্য রক্ষা করে আর বিস্ফারিত চোখে তাকিয়ে থাকে ফ্যানের দিকে। সেখানে ঝুলে আছে একটা মুণ্ডু...বিচ্ছিন্ন একটা মুণ্ডু। একটা দড়ি মুখের ভেতর দিয়ে ঢুকিয়ে নাক দিয়ে বের করে ফ্যানের সাথে দড়ি বেঁধে ঝুলিয়ে রাখা হয়েছে।
মুণ্ডুটার চোখ উপড়ে ফেলা হয়েছে, কেটে নেওয়া হয়েছে জিহ্বা, দুটো কানেরই অস্তিত্ব নেই, ঠোঁটও কেটে ফেলা হয়েছে। আর তাতে উন্মুক্ত হয়েছে দাঁতের পাটি। সেইসাথে উন্মুক্ত হয়েছে আরেকটা ব্যাপার। আর তা হলো দাঁতগুলোও রেহাই পায়নি নৃশংসতা থেকে; ভারি কিছু দিয়ে ভেঙে ফেলা হয়েছে, এবড়োখেবড়ো আকার নিয়েছে সেগুলো। নাকটাও রেহাই পায়নি। এটা যে কী বীভৎস ব্যাপার তা সামনাসামনি না দেখলে কেউ অনুধাবন করতে পারবে না। মজিদ মিয়ার পেটের ভেতরে কেউ যেন একদল প্রজাপতি ছেড়ে দিয়েছে, আর তা উড়ছে মাতালের মতো। বের হয়ে আসতে চাচ্ছে সব।
এরকম অসুস্থ অবস্থাতেও দুয়ে দুয়ে চারের হিসাব মেলাতে তার কোনো অসুবিধাই হলো না। জালালের মৃতদেহে সব অঙ্গই পাওয়া গিয়েছিল, কেবল পাওয়া যায়নি তার মুণ্ডু। আর তার হিসাব মেলানো আরও সহজ করে দিয়েছে কপালে লেখা একটা নাম। ছুরির তীক্ষ্ণ ফলা দিয়ে লেখা—জালাল।
“কিন্তু কে করলো এই কাজ? বিষাণরা কখনই এরকম কিছু করে না। তাদের হিসাব সহজ। ডাঁট ছুড়ে মারো, এরপর পুঁতে ফেলো কিংবা...” আর কিছু ভাবার আগেই সে শুনতে পায় তাকে কেউ “মজিদ চাচা, মজিদ চাচা” বলে ডাকছে। তারমানে ছেলেটা এসে গেছে। “যদি সে এসে এটা দেখে তাহলে আমার চেয়েও বেশি ভয় পেয়ে যাবে। তাই এটাকে লুকাতে হবে।” এই কথা মনে মনে আওড়াতে আওড়াতে বিছানার তোষকের নিচে রাখা একটা চটের বস্তা বের করে। একটা চেয়ার ফ্যানের নিচে রাখাই ছিল। মনে হয় মুণ্ডুটা ফ্যানের সাথে বাঁধার সময় খুনি ব্যবহার করেছিল।
মজিদ মিয়া একটা চাকু খুঁজে চেয়ারটায় চড়ে দড়িটা কেটে দ্রুত মুণ্ডুটা বস্তায় ভরে ফেলে। দড়ি কাটার সময় বুঝতে পারে, ওটা আসলে পাটের দড়ি না, গামছা ছিঁড়ে বানানো হয়েছে। জানালা খুলে চালিয়ে দেয় ফ্যানটা, যাতে বোটকা গন্ধটা যতটা সম্ভব কমে আসে। একটা ন্যাকড়া দিয়ে মুণ্ডু থেকে মেঝেতে পড়া রক্ত মোছার চেষ্টা করে। শুকনো রক্ত, তাই সহজে ওঠে না। যতটা পারে ততটা তুলে বস্তাটা হাতে নিয়ে বাইরে আসে। ছেলেটাকে দেখে যতটা সম্ভব স্বাভাবিক গলায় বলে, “ঘর চিইনা বের করতে পারছো তাহলে।”
“হ, একটু কষ্ট হইছে বাইর করতে। তাই সময় লাগলো।” মজিদ মিয়ার বস্তার দিকে ইশারা করে বলল, “ওইটা কী চাচা? দুর্গন্ধ বাইর হইতেছে।”
মজিদ মিয়া নিজেকে সামলে নিয়ে বলে, “আর কইয়ো না, মুরগি মাইরা বাঘডাশা ঘরটাকে একদম পাখনা, নাড়ীভুঁড়ি দিয়া ভরায়ে ফেলছিল। ঘরও গন্ধ কইরা ফালাইছে। তুমি ততক্ষণ বাইরে বসো, চাইরপাশ ঘুইরা দেখতে থাকো। আমি এগুলা ফালায় আসতেছি।”
মজিদ মিয়া যেতে ধরতেই ছেলেটা তাকে থামিয়ে জিজ্ঞাসা করে, “এইটা কি আসলেই আপনার বাড়ি?”
“হ, আমার বাড়িই তো, আর কার হইবো?”
“না, মানে বাড়িতে আর কেউ নাই যে...”
“আমি একলা মানুষ। আমার আর কেউ নাই।”
“অহন থাইকা আমি আছি।” বলেই একটা সরলমনা হাসি দিল। “তাড়াতাড়ি আসেন, খিদা লাগছে।”
“আইচ্চা, আইতেছি ফালায় দিয়ে...ওহ চাইল-ডাইল তো নাই। কিইন্যা একেবারে আইতেছি।”
মজিদ মিয়া ছেলেটাকে পিছনে ফেলে এগিয়ে যায়। হাঁটতে থাকে একটা জঙ্গলের দিকে। একটা বড়ো গাছ পেরিয়ে যেতেই শিস শুনতে পায়...কান খাড়া করলে বুঝতে পারে শিস বাজছে একটা ছন্দে...তিন...দুই...তিন...
বস্তাটা আস্তে করে নামিয়ে এগিয়ে যায় শিসের উৎসের দিকে। উৎস থেকেও একজন বের হয়ে আসতে থাকে তার দিকে...একজন চল্লিশোর্ধ্ব বয়স্ক লোক। সবুজ রঙের শার্ট আর ঘাড়ে গামছা, খাকি রঙের প্যান্ট, সুন্দর করে বাঁদিকে সিঁথি করে আঁচড়ানো চুল। মুচকি হাসতে হাসতে এগিয়ে আসে মজিদ মিয়ার দিকে। দৃষ্টি ধূর্ততায় ভরা।
মজিদ মিয়া হাঁটার গতি চকিত বাড়িয়ে এগিয়ে গিয়ে লোকটার গামছা চেপে ধরে বলে, “আরেকটু হইলেই মাইরা ফেলতে ধরছিলি।”
জবাবে লোকটা কিছু না বলে ফিক করে হেসে ফেলে। তার খাকি রঙের প্যান্টের পকেট দিয়ে উঁকি দিচ্ছে একটা লাল কাপড়, ভালোভাবে লক্ষ করলে দেখা যাবে, তাতে আঁকা আছে সাদা শিঙা।
কাঠের ঘোড়ায় বজ্রাঘাত
মজিদের গল্প
ট্রয় নগরীর দুর্ভেদ্য প্রাচীর দশ বছরেও ভেদ করতে না পেরে নিশ্চিত পরাজয়ের মুখে সম্মুখীন গ্রিকরা। বিজয় ছিনিয়ে নিতে তারা আশ্রয় নিলো এক ছলের। বিশাল এক কাঠের ঘোড়ার মূর্তি বানিয়ে অপরাজয়ের প্রতীক হিসেবে উপহার দিয়ে তারা চলে যায়। গ্রিকদের চলে যাওয়া দেখে ট্রয়বাসীরা ভেতরে নিয়ে আসে উপহার। গভীররাত পর্যন্ত চলে তাদের বিজয়োৎসব। এরপর সবাই ঘুমিয়ে পড়লে কাঠের ঘোড়া থেকে সন্তর্পণে বেরিয়ে আসে কিছু স্পার্টান, খুলে দেয় নগরতোরণ। ঢুকে পড়ে চলে যাওয়ার ভান করে লুকিয়ে থাকা গ্রিক সৈন্যদল। চলে নারকীয় হত্যাযজ্ঞ। ধ্বংস হয় ট্রয় নগরীর। ইতিহাসে তাই কাঠের ঘোড়া লিপিবদ্ধ হয়ে যায় বিশ্বাসঘাতকতার প্রতীকরূপে...
☠
বাঁদিকে সিঁথি করে সুন্দর করে আঁচড়ানো চুলের লোকটার নাম ছাদেক দফাদার। হাসার পর সে বলে ওঠে, “আর ভাই কইয়েন না, মিসটেক হয়ে গেছে।” ডান হাতের বুড়ো আর তর্জনী আঙুল দিয়ে চিমটি দেখিয়ে বলে, “ছোটি সি মিসটেক।”
ছাদেক নিজেকে স্মার্ট দেখাতে তিনভাষা মিলিয়ে কথা বলতে ভালোবাসে। এটা নিয়ে পরিচিতরা বিরক্ত হলেও, এব্যাপারে তার কোনো ভ্রূক্ষেপ নেই।
গামছার ফাঁসটা আরেকটু শক্তভাবে চেপে ধরে মজিদ মিয়া বলে, “আমার জান চইলা যাইতে ধরছিল, আর এইটা হইয়া গেল ‘ছোটো ভুল’?”
“আরে ভাই, মাইন্ড কইরেন না, বললাম তো মিসআন্ডারস্ট্যান্ডিং হইছে। কুইক অপারেশন চালাইতে গিয়ে মিসটেকটা হইছে।”
এবার গামছা ছেড়ে দিয়ে মজিদ মিয়া বলে, “আমাকে না বলে এই ‘কুইক অপারেশন’ চালাতে হলো কেন?”
“আর ভাই কইয়েন না, সব শালা ওই জাফরের দোষ, হিজ ফল্ট।”
“জাফর? তোতলা জাফর?”
“হ ভাই। ও আমাদের নতুন স্পাই মানে টিকটিকি ছিল। আর আমি জানতামও না আপনি ওই শবখাদকের দলে ছিলেন। জাফরও আপনাকে চেনে না। ছাগলটা অল্প ক’মাসেই অধৈর্য হয়ে গেছিল। প্রোমোশনের আশায় একটু তাড়াহুড়া কইরা দলটাকে কোপ খাওয়াইছে। তাছাড়া বসের কাছ থেকে ‘আর্জেন্ট কল’ নিয়া আসছিল। আপনি তো আপনার মতিগতি সমন্ধে আমাদের কিছু বলেনও না। তাই মিস্টেকটা হয়ে গেছে।”
“নতুনদের নিয়ে এই এক সমস্যা। ধৈর্য ধরতে চায় না। সাফল্যকে মনে করে লিফট। বাটন চাপবে আর সুড়ুৎ করে ওপরে উঠে যাবে। সাফল্য হইলো গিয়া সিঁড়ির মতন। ধাপে ধাপে আগাইতে হয়। মাথার ঘাম পায়ে ফালাইতে হয়। সব কিছু কি আর এত সস্তা?” হতাশা ঝরে পড়ে মজিদ মিয়ার কণ্ঠে।
“কী আর করবেন ভাই, ইয়াং জেনারেশন তো। মাঘের শীতেও রক্ত গরম থাকে। অপারেশনেও তো ঝামেলা করছে।”
মজিদ মিয়া ভ্রু কুঁচকে বলে, “কী সমস্যা হইছিল?”
“ঠিকভাবে পুরাপুরি ঘিরে ধরার আগেই লম্বুটাকে ফালায় দিয়ে ঝামেলা বাঁধায় ফেলছিল। একদম ধৈর্য নাই।”
“সেই কারণে বাঁচছি মনে হয়। নইলে তো ঠিকভাবে টের পাওয়ার আগেই মরতাম। ভাগ্য ভালো ছি...”
“ভাই, চান্দের আলোয় আপনার সংকেতটা ধরতে একটু টাইম লাগছিল।”
মজিদ মিয়ার মনে পড়ে গেল গামছা বেঁধে শূন্যে ঘোরানোর কথা। তার সাথের ছেলেটা ভেবেছে সেটা ছিল প্রতিরক্ষা কৌশল, কিন্তু আসলে তা ছিল বিষাণদের কাছে পাঠানো গুপ্তসংকেত। নিয়ম করে ঘড়ির কাঁটার দিকে আর বিপরীত দিতে ঘোরাতে হয়। ঘোরানোর জন্য যে-কোনো কিছু হলেই হয়। দূর থেকে বোঝা গেলেই হলো।
“বুঝছিলাম যখন একটা ডাঁট এসে লাগছিল।”
ছাদেক মুখটা চোরের মতো করে বলে, “ওইটাও জাফর মারছিল। চান্দের আলোর কারণে মনে হয় সে সিগন্যালটা ভালোভাবে ধরতে পারে নাই। ভাগ্য ভালো আমি পাশে ছিলাম। দেইখা বুইঝাই ওরে মানা করে দিছি। নইলে আরও মারতো।”
“কোথায় তোমার এই জাফর? ওরে কয়টা থাপ্পড় দেওয়া দরকার।”
“আপনের কাছে যাওয়ার কথা। মাফ চাইতে যাইতে কইছি। আপনি হইলেন গিয়া লেজেন্ডারি বিষাণ, আমাগো ওস্তাদ, সেকেন্ড বস...”
আর কিছু বিশেষণ যুক্ত করার আগেই তাকে থামিয়ে মজিদ মিয়া বলল, “আমার সাথে দলের একটা পোলা আছে। তাই এখন আমার সাথে আপাতত কোনো যোগাযোগ রাখবা না।”
ছাদেক অবাক হয়ে বলে ওঠে, “শবখাদক লইয়া ঘুরতেছেন ক্যান?”
“এইজন্য তোগো উন্নতি নাই। আমাদের কাজ কী?”
ভ্রু কুঁচকে ছাদেক বলে, “শবখাদকদের ফিনিশ করা।”
“কেমনে করবা?”
“খুঁইজা খুঁইজা বাইর কইরা।”
“খুঁইজা খুঁইজা একটা-দুইটা পাবা, কোনো দলকে পাবা না, পুরা নেটওয়ার্ক পাবা না। এইজন্য কোনো না কোনো শবখাদকের দলে লুকাইয়া থাকতে হইবো।”
“ওই জাফরের মতো টিকটিকি হইয়া...”
“টিকটিকি হইয়া না, শবখাদক হইয়া।”
“কী কন?” অবাক হয়ে বলে ছাদেক।
“যদি পুরা নেটওয়ার্কটাকে ধ্বংস করতে হয়, তাহলে ওদের মতো কেউ হইয়া যাইতে হইবো।” দীর্ঘশ্বাস ফেলে মজিদ মিয়া বলল, “দলটায় বহুত দিন ধইরা ছিলাম। হাশেম ভাইয়ের সাথে অনেক খাতির ছিল। নেটওয়ার্কটাও কব্জায় আসতেছিল। তোরা ভেজাল করে দিলি। আবার শুরু থেকে শুরু করা লাগবে। একটা নতুন দলে সবার আস্থা অর্জন করা অনেক সময়ের ব্যাপার। কী যে করস না তোরা!”
অপরাধী ভঙ্গিতে ছাদেক দফাদার বলে, “মিস্টেক ভাই, মিস্টেক হয়ে গেছে। তা ওই পোলাকে দিয়া কী করবেন?”
“নতুন কোনো দলে ঢুকতে ওই ছেলেটাকে আমার লাগবে। ও আমার অ্যালিবাই হিসেবে কাজ করবে, বুঝছো?”
বিজ্ঞের মতো মাথা ঝাঁকিয়ে ছাদেক বলে, “ও আচ্ছা। আপনার ব্রেইন অনেক শার্প। আমি বসকে এ টু জেড সব বলবো। আপনি টেনশন নিয়েন না। তয় নতুন কোন দলে ঢুকলেন সেইটা জানায়ে রাইখেন। নয়তো...আচ্ছা আপনার হাতে কী জানি ছিল?”
পরের পর্ব : ক্লিক করুন
Published on November 18, 2021 10:02
•
Tags:
adult, bengali, crime-fiction, dark, fiction, mystery, preview, suspense-thriller, thriller
No comments have been added yet.