Sazal Chowdhury's Blog - Posts Tagged "fiction"
শবশিঙা প্রিভিউ (প্রথম পর্ব)
সতর্কীকরণ
ম্যাচিউর কন্টেন্ট | ভায়োলেন্স | PG 18+
শবখাদক
আমরা মৃতদেহ খুঁজে বেড়াই। খুঁজে পেলে মিলেমিশে খাই।
দলটা খুব একটা ভারী না। এগারোজন। চার দলে ভাগ হয়ে খুঁজি। তাতে মৃতদেহ পাওয়ার সম্ভাবনা বাড়ে। দলের নাম দিকের নামে—উত্তর, দক্ষিণ, পূর্ব, পশ্চিম। নাম আর কাজের দিক একই। মানে উত্তর দল কেবল উত্তরে খোঁজে, দক্ষিণ দল দক্ষিণে।
টাটকা মৃতদেহ আমাদের সবচেয়ে আরাধ্য। আর ওটাই জোটে সবচেয়ে কম। মাঝেমধ্যে পচাগলাও গিলতে হয়, তবে চেষ্টা করি না গিলতে। স্বাদই যদি না পেলাম তাহলে আর এত কষ্ট করার কী হলো!
একটা টাটকা লাশের খবর এনেছে দক্ষিণ দল। দ্রুতপদে সেদিকেই ছুটছি। দক্ষিণ দল সবচেয়ে ছোটো দল। অন্যদলগুলো তিনজন করে, এই দলে দুজন—আলাল আর মজিদ চাচা। আলাল দেখতে অনেকটা নিগ্রোদের মতো, বেঁটেখাটো, কুচকুচে কালো দেহ, ঝকঝকে দাঁত। অন্যদিকে মজিদ চাচার মধ্যে একটা সৌম্য ভাব আছে। গোলগাল চেহারা, শান্ত চোখ, ধীরস্থির মনোভাব।
দ্রুত যাওয়ার আরেকটা কারণও আছে—প্রতিপক্ষ। হ্যাঁ, আমাদের অনেকগুলো প্রতিপক্ষ আছে। সবচেয়ে বড়ো প্রতিপক্ষ হলো জালালের দল। “পাষণ্ড জালালের দল”-ও বলে অনেকে। ওরা মৃতদেহ না পেলে মৃতদেহ বানিয়ে নেয়। মানে খুন করে। খিদের জ্বালায় না পড়লে আমরা অন্যান্যরা পারতপক্ষে অতটা সহিংস হই না।
আমাদের দলটা কিছুটা গোঁড়া বলা যায়। খুনটুনে নেই আমরা। মৃতদেহের ওপর কোনোরকম অত্যাচার করি না। বিকৃত আচারও পালন করি না।
আমাদের দলনেতা হাশেম ভাই। দাঁড়ি পেকে সাদা হয়ে গেছে। অভিজ্ঞতার বলিরেখা সর্বত্র। তিনি পশ্চিম দলে থাকেন।
অনেকদিন হয়ে গেছে শেষ টাটকা মৃতদেহ খাওয়ার। তাই খবরটা পেয়ে দলের সবারই চোখ চকচক করছে। জিহ্বা টলটল করছে জলে। হাঁটার গতিও তাই স্বাভাবিকের চেয়ে দ্রুত।
যখন পৌঁছলাম তখন জ্যোৎস্নায় চারদিক ঝকঝক করছে। মৃতদেহটা পাওয়া গেছে নির্জন চরে। মাথা একদম বিচ্ছিন্ন করা। পুরো চরজুড়ে উঁচু উঁচু কাশের বন। বাতাসে প্রায়ই সরসর শব্দে দুলছে। এখনও কেউ মৃতদেহটার খবর পায়নি মনে হয়। অবশ্য আলাল আর মজিদ চাচা খোঁজ পেয়েই বালুচাপা দিয়ে গেছে। তাই খোঁজ পাওয়ার সম্ভাবনাও কম ছিল।
পূর্ব দলের মোটাসোটা জসিম বলল, “রক্ত দেইখা মনে হইতেছে খুনটা এখানেই করা হইছে। মাথাটা গেল কোথায় তাইলে? থাক গা যেখানে খুশি। আমার গোশত পাইলেই হইলো।”
পশ্চিম দল, মানে হাশেম ভাইয়ের দল এখনও আসেনি। তাই লাশ ধুয়ে নিয়ে বসে আছি। আমরা একসাথে খাই, মিলেমিশে—পরিবারের মতো।
হাশেম ভাই এসে স্বভাবমতো খানিকটা সময় নিয়ে মৃতদেহটা আগাগোড়া বারকয়েক দেখলেন। তারপর খানিকটা অস্ফুটস্বরে বললেন, “পালা সবাই।”
সবাই অদ্ভুতভাবে তাকালাম তার দিকে। পালাবো? কিন্তু কেন? এটা তো মাত্র একটা মৃতদেহ। আর চারদিকের পরিবেশও সুনসান, জনশূন্য।
আমাদের সবার দিকে তাকিয়ে আবার বললেন, “পালা রে পালা। এইটা তো জালালের লাশ। ওর দল খোঁজ পেলে আমাদের সবাইকে খাবে।”
☠
ঊর্ধ্বশ্বাসে দৌড়চ্ছি। পাশে কেবল একজন। মজিদ চাচা। আর কেউ সুযোগ পায়নি পালানোর। না, জালালের দলের কেউ আক্রমণ করেনি। আক্রমণ করেছে “বিষাণ”। বিষাণ মানে পশুর শিং দিয়ে বানানো শিঙা। ওদের মাথায় বাঁধা থাকে লাল কাপড়ের পট্টি। তাতে আঁকা সাদা রঙের শিঙা। আমাদের মতো শবখাদকদের নিধন করার কুখ্যাত দল।
টোপ দিয়ে ফাঁদে ফেলেছিল। জালালের দলেরও কি একই ভাগ্য বরণ করতে হয়েছে? ওর দলটাই সবচেয়ে বড়ো আর ভয়ংকর ছিল। তাদেরই যদি এই অবস্থা হয় তাহলে আমাদের মতো ছোটোখাটো দল কীভাবে টিকবে? আমাদের যাত্রার শেষ কি এখানেই?
দৌড়াতে দৌড়াতে চাঁদের আলোয় মজিদ চাচার দিকে আরেকবার তাকালাম, আগের মতোই শান্ত, সৌম্য, ধীরস্থির। যেন কিছুই ঘটেনি।
অথচ ঘটে গেছে...ঘটে গেছে অনেককিছু।
ইসরাফিলের শিঙা
“পালা রে পালা। এইটা তো জালালের লাশ। ওর দল খোঁজ পেলে আমাদের সবাইকে খাবে।” লাশের পাশে হাঁটু গেঁড়ে বসা অবস্থায় থেকে চিৎকার দিয়ে বললেন হাশেম ভাই। চরের ঝরঝরে বালুতে কিছুটা দেবে আছে হাঁটু।
আমরা সবাই স্থির হয়ে তাকিয়ে রইলাম তার দিকে। হতভম্ব অবস্থা। যেন হুট করে থামিয়ে দেওয়া হয়েছে চলমান কোনো দৌড় প্রতিযোগিতা।
উত্তর দিকের দলের আনোয়ার বলে উঠলো, “এইটা যে জালালের লাশ সেইটা কেমনে বুঝলেন? মাথা তো নাই।” নিজের মাথায় হাত বোলালো সে।
আনোয়ার মানুষ হিসাবে যুক্তিবাদী। যাই বলে না কেন তার পিছনে একটা যুক্তি লুকিয়ে থাকে। অদ্ভুত ব্যাপার, এই যুক্তিবাদী মানুষটাকে দীর্ঘসময় পাগলা গারদে থাকতে হয়েছিল। সেখান থেকে পালিয়ে এদিকওদিক ঘুরতে ঘুরতে কীভাবে যেন আমাদের মতো শবখাদক হয়ে গেছে। একসময় ভিড়ে গেছে আমাদের দলে। আমি তার অধীনে উত্তর দিকের দলে থাকি।
তার রুগ্ন শরীরের দিকে একপলক তাকিয়ে মোটাসোটা জসিম তাল মেলালো, “হ, হ, কেমন বুঝলেন? জালালের লাশ তো নাও হবার পারে।”
লাশের ডান হাত উঁচিয়ে ধরে হাশেম ভাই বললেন, “দেখ, তর্জনী আঙুল অর্ধেক নাই। পরিচিতদের মধ্যে এইটা কেবল জালালেরই নাই।”
আমি লাশের পাশে দাঁড়িয়ে ছিলাম। ভালোভাবে দেখার জন্য আমাকে সরিয়ে আনোয়ার কোমর বাঁকিয়ে দেখার চেষ্টা করল। থুতনি ঘষতে ঘষতে বলল, “জন্মগত কোনো ত্রুটি না এইটা, কোনো দুর্ঘটনায় হারাইছে। তাও বেশ আগেই হারাইছে। পনেরো-বিশ বছর আগের তো হবেই। হয়তো কোনো মারামারি করতে গিয়া কোপ খাইছে কিংবা অন্য কোনো...”
তাকে থামিয়ে এবার এগিয়ে এলেন মজিদ চাচা। শান্তভাবে হাঁটু ভাঁজ করে পায়ের আঙুলের ওপর ভর করে বসলেন লাশের পাশে। একটা চেক শার্ট পাশে ফেলে রাখা। ওটা লাশের গায়ে ছিল। চাঁদের আলোয় রংটা ঠিক বোঝা যাচ্ছে না। লাশ ধোঁয়ার সময় শার্টটা খুলে রাখা হয়েছিল। তিনি লাশের বুকের ঘন পশমের ভেতর তর্জনী আঙুল চালিয়ে ডান দিকে কিছু একটা খুঁজলেন। আঙুলটা এদিকওদিক এলোমেলোভাবে ঘুরে স্থির হলো একটা কাটা দাগে। ইঞ্চিখানেক দাগ। পুরোনো ক্ষত মনে হলো।
জসিমের দলের আরেক সদস্য রাজ্জাক তার স্বভাবমতো খেঁকিয়ে উঠে বলল, “বালের মতো মুখে ছিপি আইটা বইসা আছোস ক্যা?”
রাজ্জাক ভীষণ খিটখিটে স্বভাবের। কোনো কথাই স্বাভাবিকভাবে বলতে পারে না। সব কথাই বলে উচ্চস্বরে আর সাথে খিস্তি ফ্রি।
উঠে দাঁড়ালেন মজিদ চাচা। “হুম। জালালেরই মনে হইতেছে। তখন এত খেয়াল করি নাই। লাশ লুকাইতে ব্যস্ত আছিলাম।”
আমি এবার বললাম, “এখন কী করবো আমরা?”
আমার দিকে ফিরে তিনি বললেন, “যত দ্রুত সম্ভব এখান থেকে চইলা যাইতে হইবো। ঝুঁকি নেওয়া ঠিক হইবো না। জালাল কখনও একা একা ঘোরে না...মানে ঘুরত না। অন্তত পাঁচ-সাতজন তো থাকতোই সবসময়। যেহেতু তাদের দেখা যাইতেছে না। তাই হয় তারাও মারা পড়ছে, নয়তো বাকিদের ডাকতে গেছে। যদি ডাকতে যায়, আইসা পড়তে পারে যে-কোনো সময়।”
রাজ্জাক বলে উঠলো, “কী আর করার, আইজকাও উপাস থাকা লাগবে, বাল।” স্বর উঁচু করে বলল, “কে আনছে রে এই মড়ার খবর? কোন মাদারচোদ?” চোখ বুলালো সবার ওপর। স্থির হলো কুচকুচে কালো দেহের আলালের ঝকঝকে দাঁতের ওপর। এই অবস্থাতেও সে দাঁত বের করে হাসছে। তাকে বলল, “হালার পুত, আর কোনো লাশ পাইলি না? এইটাই জুটল?”
“আমার কী দুষ? মজিদ ভাই আগে পাইছে। আমি তার পিছন পিছন আসছি। লাশ দেইখা বালু চাপা দিয়াই খবর দিতে গেছি তোমাগো।”
জসিম তার বিশাল ভুঁড়িতে হাত বুলিয়ে বলল, “এইটা কোনো কথা? এমনিতেই খুনোখুনির লাশ খাওয়া অনেক ঝুঁকির। পুলিশি ঝামেলা থাকে। তারওপর যদি লাশ হয় দাগী আসামীর, আর পাষণ্ড জালালের, তাইলে তো যারে কয়, কী যেন কয়—মড়ার ওপর খাড়ার ঘা! মজিদ ভাই আপনে কেমন খোঁজ পাইলেন?”
মজিদ চাচা কিছু বলতে চাইলেন, কিন্তু তখন হাশেম ভাই বসা থেকে উঠে দাঁড়ানোর কারণে থেমে গেলেন। হাশেম ভাই আমাদের দলে সবচেয়ে প্রবীণ। চামড়ায় ভাঁজ পড়ে গেছে। দুশ্চিন্তায় এখন কপালেও ভাঁজের ভিড় দেখা যাচ্ছে। চিন্তিত স্বরে বললেন, “আজাইরা আলাপ পরে করিস। এক কাজ কর। লাশটা আবার চাপা দে। তারপর যাই। যদি অর দলের কেউ খোঁজ না পায় বা পুলিশি ঝামেলা না থাকে তাইলে এখানেই থাকবে। খাওয়ার সুযোগ থাকবে।”
আমাদের কোদাল, শাবল সবই আছে। কবর খুঁড়ে লাশ বের করতে সাথে রাখতে হয়। আমার শাবল আছে, তা দিয়ে খুঁড়তে শুরু করলাম। আলাল ভাই হাত লাগালেন কোদাল দিয়ে, সমানে কোপাতে লাগলেন। বালুমাটি হওয়ায় কিছুক্ষণের মধ্যেই পুঁতে ফেলার মতো গর্ত প্রায় হয়ে এলো।
এসময় হঠাৎ করে কানে এলো শিঙার তীক্ষ্ণ আওয়াজ। একটা বেজে উঠতেই পরপর আরও কয়েকটা চক্রাকারে বেজে উঠলো আমাদের চারপাশে। তারপর সব চুপচাপ। শোঁ শোঁ করে বাতাস বয়ে গেল কাশবনের ওপর দিয়ে। সরসর আওয়াজ হচ্ছে। লজ্জাবতীর মতো একে অপরের গায়ে লুটিয়ে পড়ছে কাশগুলো।
“কী হইলো এইটা?” জসিম অবাক হয়ে বলে উঠলো।
মজিদ চাচা চিৎকার দিয়ে বললেন, “সবাই মাটিতে শুইয়া পড়।”
উনি আর হাশেম ভাই ত্বরিত শুয়ে পড়লেন। আমি তখনও গর্তের তলায় শাবল হাতে শেষ পর্যায়ের খোঁড়াখুঁড়িতে ব্যস্ত। ওনাদের কথা শোনার পরেও বোকার মতো বসে আছি। কারণ চারপাশে কী হচ্ছে তা বোঝার উপায় নেই।
আমাকে কিছু বোঝাতে হলো না। আমাদের মধ্যে সবচেয়ে লম্বা আর উত্তর দলের অপরজন সদস্য ঝাঁকড়া চুলের সামাদ গর্তটার পাশে কাটা কলাগাছের মতো করে ধুপ করে মুখ থুবড়ে পড়ে গেল। যেন হাওয়ার তোড়ে পড়ে গেছে।
এবার হাশেম ভাই ফিসফিসিয়ে যেন নিজেকে বললেন, “বাইজা গেছে ইসরাফিলের শিঙা।”
হারাধনের এগারোটি ছেলে, রইলো বাকি...
ইসলাম ধর্মে বিশ্বাসীরা বিশ্বাস করেন, কিয়ামত বা মহাপ্রলয় শুরু হবে আল্লাহর আদেশে ইসরাফিল (আ.) নামের এক ফেরেশতা বা দেবদূতের শিঙার ফুঁৎকারের মাধ্যমে। তার শিঙার ধ্বনিতে ধ্বংস হয়ে যাবে পুরো সৃষ্টিজগত।
☠
সামাদ আমাদের দলে সবচেয়ে লম্বা সদস্য...ছিল। ছ’ ফিট তিন ইঞ্চি লম্বা। আমরা ডাকতাম তালগাছ বলে। উচ্চতা নিয়ে ছিল তার অনেক গর্ব। উচ্চতা মাপার যন্ত্র চোখে পড়লেই মাপতো আর আমাদের দেখিয়ে, খেপিয়ে, মাথা ঝাঁকিয়ে, ভাব নিতো। সেসময় তার মাথার ঝাঁকড়া চুল সেভাবে দুলতো যেভাবে হাওয়ায় ধানগাছ দোলে। বাঁশি বাজানোর খুব শখ ছিল। আহামরি বাজাতে পারতো না যদিও। চেষ্টা করতো আর বলতো, “ভাই, আমি কৃষ্ণ হমু, বাঁশির আওয়াজে রাধারে ডাকমু।”
সে আর কখনই রাধাকে ডাকতে পারবে না। বিষণ্ণ মনে উদ্বিগ্নচিত্তে রাধা অপেক্ষা করবে তার ঘরে। বাঁশির আওয়াজ আর কখনই তার কানে পৌঁছাবে না। কখনই না।
যখন সে গর্তটার পাশে কাটা কলাগাছের মতো করে ধুপ করে মুখ থুবড়ে পড়ে গেল, তার স্থির চোখগুলোর দিকে তাকিয়ে এসব কথাই ভাবছিলাম।
ঘাড় উঁচিয়ে গর্তটার বাইরে একবার তাকালাম। হাশেম ভাই মাটিতে শুয়ে পড়েছেন। তার পাশেই মজিদ চাচাও আছেন। হাশেম ভাই ফিসফিসিয়ে যেন নিজেকে বললেন, “বাইজা গেছে ইসরাফিলের শিঙা।”
আমি বললাম, “মানে?”
“বিষান্নাইরা হামলা চালাইছে। ওরা আমাদের সবাইকে মাইরা পুঁইতা ফেলবে। আমাদের আর বাঁচার আশা নাই।”
আমি উদ্বিগ্ন স্বরে বললাম, “উপায় তো একটা না একটা পাওয়া যাবেই।”
“যখন শিঙা বাজে তখন আর কেউ বাঁচে না। সবাইরে মাইরা ফেলায়। এইটা হইলো গিয়া ইসরাফিলের শিঙা।”
আমি উঠে দাঁড়াতে গেলেই মজিদ চাচা শোয়া অবস্থায় দাঁত খিঁচিয়ে বললেন, “মাথা উঁচা কইরো না। মইরা যাবা। গর্তে থাকো।”
গর্তের পাশে মজিদ চাচার কাছাকাছি শুয়ে পড়েছে পূর্ব দলের আরেক সদস্য পরিতোষদা। খুবই পরিপাটি একজন মানুষ। গলায় গামছা ঝুলিয়ে রাখেন একটা। ডানহাতে লাল সুতো বাঁধা। তাদের কোনো ধর্মীয় রীতির কারণে হয়তো। তিনি কথা বলেন শুদ্ধভাবে। মজিদ চাচার কথা শুনে বরাবরের মতো শুদ্ধভাষায় বললেন, “বুঝতে পারলাম না ব্যাপারটা। না পালিয়ে এভাবে শুয়ে থাকলে তো মারা পড়ার সুযোগ বেশি। আমাদের পালাতে...”
পরিতোষদা কথা শেষ করতে পারলেন না। আমার সাথে কোদাল হাতে গর্ত খুঁড়ছিলেন যে আলাল ভাই, উনি তার কোদালখানা উঁচিয়ে তলোয়ারের মতো করে ধরে, চিৎকার দিয়ে আক্রমণকারীদের উদ্দেশ্যে বলছিলেন, “আয়, কাছে আয়। দেখি কত সাহস! এই কোদাল দিয়ে তোদের ফালাফালা...”
তিনিও তার কথা শেষ করতে পারলেন না। বিস্ফারিত চোখ নিয়ে মাটিতে মুখ থুবড়ে পড়লেন।
রাজ্জাক ভাই তার পাশে হাঁটু গেঁড়ে বসে বললেন, “মাইরা ফেলাইছে রে, কুত্তাগুলা মাইরা ফেলাইছে সামাইদ্দা আর আলাইল্লারে। মাগিগুলাকে যদি আজকে আমি না চুদছি...”
“চুপ করে শুইয়া পড়...নইলে তোকেই চুইদা দেবে বিষান্নাইরা।” হাশেম ভাই দাঁতে দাঁত ঘষে বললেন। “শুইয়া পড় সবাই।”
“কিন্তু শুইতে হইবো কেন? কুত্তাগুলাকে গিয়ে শেষ করে দিলেই তো হয়। আমরা তো এখানে কম মানুষ নাই।” শুয়ে থাকা হাশেম ভাইয়ের দিকে তাকিয়ে বলল রাজ্জাক। সে এখনও কিছু বুঝে উঠতে পারছে না।
আনোয়ার তার মাথা চেপে ধরে শুইয়ে দিতে দিতে বলল, “এখনও বুঝোস নাই, বোকাচোদা? ওরা বিষ মাখা ডাঁট ছুড়ে মারতেছে। ভালো করে সামাদ আর আলালকে খেয়াল কর। সামাদের ঘাড়ে আর আলালের পিঠে বিঁইধা আছে ডাঁট। সামাদ সবচেয়ে লম্বা মানে উঁচা ছিল। তাই সে সবার আগে সহজ লক্ষ্যে পরিণত হইছে। আর আলাল নিজের মৃত্যু নিজেই ডেকে আনছে নিজেরে লক্ষ্য বানাইয়া। আমরা সবাই খুব দ্রুতই মারা পড়তাম, কিন্তু ঘন কাশবনের কারণে ওরা ডাঁট মাইরা সুবিধা করতে পারতেছে না। তাই যে-ই নিজের মাথা উঁচু করবে সে-ই মরবে। তাই, হাশেম ভাইয়ের কথা শোন, আর শুয়ে থাক।”
হাশেম ভাই সাথে যোগ করলেন, “হ, আনোয়ার ঠিক কইছে। আর বিষাইন্নারা আসে দল বাঁইধা। অগো মাথায় বাঁন্ধা থাকে লাল কাপড়ের ফিতা। সেই কাপড়ে শিঙা আঁকা থাকে। সাদা রঙের শিঙা মনে হয়। প্রথমে বাজায় অগো দলনেতা। সিগন্যাল দেয়। তারপরপরই বাকিরা চাইরদিক থাইকা বাজায়। ওরা কেবল তখনই শিঙা বাজায় যখন চাইরদিক থাইকা ঘিইরা ধরে। তাই শিঙা বাজানো মানে সবার কাহিনি শ্যাষ। খেল খতম। কেয়ামত। তাই আমাদের অনেকেই এইটারে কয় ইসরাফিলের শিঙা।”
“চারদিকে ঘিরে ধরছে মানে তো আমরা শ্যাষ। এখন তো বাঁচার কোনো উপায় নাই। আমার অনেক ভয় করতেছে।” আতঙ্কিত স্বরে বলে উঠলো হুমায়ূন। সে হাশেম ভাইয়ের দলে মানে পশ্চিম দলে। গোল ফ্রেমের চশমা পরে। মাথার চুল কাঁচাপাকা। তার বেশভূষা দেখে মনে হয় সে অনেক জ্ঞানী গোছের কেউ। কিন্তু আদতে সে গণ্ডমূর্খ আর ভীতু। শবখাদকদের দলে এমন একজন ভীতু কীভাবে ঢুকলো এটা একটা রহস্য। আমরা প্রায়ই তাকে ভয় দেখিয়ে মজা নিই।
“আমারও অনেক ভয় করতেছে। ভয়ে থাকলে আমার অনেক খিদা লাগে। আমি এইখানে শুইয়া থাকলে ভয় আর খিদায় মইরা যামু।” জসিম চিত হয়ে শুয়ে আকাশের দিকে তাকিয়ে বলল। তার বিশাল ভুঁড়িটা উঁচু ঢিবির মতো দেখাচ্ছে। “চল্ হুমায়ূন, পালাই। এদের কথা শুনলে এইখানে শুইয়া শুইয়া মরুম। তারচেয়ে পালানোর চেষ্টা করি।”
“কিন্তু কীভাবে? মাথা উঁচা করলেই তো বিষ মাখা ডাঁট আইসা মাইরা দিবে।” হুমায়ূন উদ্বিগ্ন স্বরে বলল।
আনোয়ার বলল, “এখানে শুইয়া থাকলে আসলেই বাঁচার আশা কইমা আসবে। আমরা হামাগুড়ি দিয়ে যতটা পারা যায় দূরে যাওয়ার চেষ্টা করতে পারি। ডাঁট খুব বেশি দূর যাইতে পারে না। একটা দূরত্বে চইলা গেলে বাঁচার সুযোগ বাড়বে। তখন দৌড়ায়ে পালানো যাবে।”
“বাল, তোরা বকবক করতে থাক। আমি মাগিদের ভয়ে আর শুইয়া থাকতে পারবো না। আমরা এইখানে বেশ্যার মতো শুয়ে থাকবো আর ওরা আইসা চুইদা দিয়া যাবে...এইটা আমি বাঁইচা থাকতে হইতে দিমু না। থাক তোরা...” বলেই রাজ্জাক যতটা পারা যায় মাথা নিচু করে দৌড় লাগালো। তাকে দেখে ভীত হুমায়ূনও পিছু নিলো।
বেশিদূর দৌড়াতে পারলো না। দুজনেই পড়ে গেল। ঘন কাশের ঝোপের কারণে কেবল দুটো ঝুপ ঝুপ মৃদু পতনের শব্দ শোনা গেল। রাজ্জাকের গালি আর শুনতে হবে না। জানা হবে না হুমায়ূনের মতো ভীত একটা লোক কীভাবে এই শবখাদকদের দলে ভিড়েছিল।
আনোয়ার বলল, “বিষাণের দল তাদের বৃত্ত ক্রমশ ছোটো করে আনতেছে। তাই এরা দ্রুত লক্ষ্যে পরিণত হইছে। আমরা যদি এইখানে শুইয়া থাকি, তাইলে আর খুব বেশিক্ষণ বাঁইচা থাকতে পারবো বলে মনে হয় না।”
এবার মজিদ চাচা মুখ খুললেন, “দলে ছিলাম এগারোজন। এখন আছি সাতজন। যদি একসাথে একদিকে যাই তাইলে বাঁচার সুযোগের চেয়ে মরার সুযোগই বাড়বে। সহজে লক্ষ্যে পরিণত হবো। আমাদের দলে ভাগ হইয়া চারদিকে ছড়াইয়া যাইতে হবে। এতে কেউ না কেউ কিংবা সবাই বাঁইচা যাইতে পারি।” গর্তে বসে থাকা আমার দিকে তাকিয়ে বললেন, “ও আর আমি একদলে, হাশেম ভাই আর জসিম একদলে, পরিতোষ আর আনোয়ার একদলে। আরেকজন হইলো জাফর...সে কই?”
জাফর ভদ্রগোছের এক ছেলে। পুরু গোঁফের কারণে তাকে বয়স্ক মনে হলেও, ত্রিশের কোটা পার করেছে বলে মনে হয় না। আমাদের দলে খুব বেশিদিন হয়নি যোগ দিয়েছে। নতুন সদস্যদের দৌড়াদৌড়ির কাজ বেশি দেওয়া হয়। মানে খবর আনা-নেওয়া, বাজার-সদাই করা এসব। মনে পড়লো, তাকে আমরা বাজার করতে পাঠিয়েছিলাম। তার একটা অন্যতম সমস্যা হলো, সে তোতলায়।
জসিম বলে উঠলো, “ওই তোতলাকে তো সদাই আনতে বাজারে পাঠাইছিলাম। বাঁইচা গেল হারামজাদা।” আফসোস ঝরে পড়লো তার কণ্ঠে।
মজিদ চাচা পরিতোষদাকে উদ্দেশ্য করে বললেন, “তোমার গামছাটা দেও। কাজ আছে।”
পরিতোষদা কিছু বললেন না। দিয়ে দিলেন। বাঁচার আশা ছেড়ে দিয়েছেন।
মজিদ চাচা গামছার এক মাথায় একটা ছোটো পাথর বেঁধে বললেন, “দেখা যাক কাজ করে কিনা।” তারপর আমাকে উদ্দেশ্য করে বললেন, “গর্ত থেকে বাইর হইবার সময় হইয়া গেছে। চলো, দেখি আমাদের ভাইগ্যে কী আছে। জ্যাতা নাকি মুর্দা!”
তিন দল তিন দিকে মাটিতে বুক ঘষে ঘষে এগুতে লাগলাম। নিজেকে সরীসৃপ মনে হচ্ছে। আমি মজিদ চাচার পিছু পিছু যাচ্ছি। বেঁচে থাকলে বাকিদের খবর নেওয়া যাবে। তবে মনে হচ্ছে আনোয়ারের আর্তচিৎকার শুনলাম। এর মানে হয়তো তার দল শেষ। শেষ হয়ে গেল পাগলাগারদ থেকে পালানো এক যুক্তিবাদীর আর পরিপাটি থাকা আর শুদ্ধ ভাষায় বলা পরিতোষদার। রইলাম কেবল আমরা দুজন, হাশেম ভাই আর পেটুক জসিম।
কিছুদূর গিয়ে মজিদ চাচা এবার একদিকে পাথর বাঁধা গামছাটা শূন্যে চরকির মতো এদিকওদিক কিছুক্ষণ ঘোরালেন। শিসের মতো কিছু শুনলাম। যখন থামিয়ে নামালেন তখন দেখলাম তিনি গামছা থেকে কাঠির মতো কিছু একটা খুলে ফেলে দিলেন। এগিয়ে যাওয়ার পর দেখে বুঝলাম ওটা একটা ডাঁট। কিন্তু মজিদ চাচা করলেনটা কী?
এবার তিনি যা বললেন তাতে ভয় পেয়ে গেলাম। উনি বললেন, “এইবার খিইচা দৌড় দিবা। যত জোরে দৌড়াবা বাঁচার সম্ভাবনা তত বেশি। আমাদের আশেপাশে একজনের বেশি বিষাইন্না নাই। থাকলে আরও ডাঁট পাইতাম। বুঝছো তো কি কইছি?”
ঢোক গিলে বললাম, “বুজছি।”
“এইদিকে যখন কেবল একজনই, তারমানে বাকি বিষাইন্নারা ওইদিকে চইলা গেছে। তারমানে...”
“তারমানে, হাশেম ভাইয়ের দলও শ্যাষ।”
“হ, হয়তো শ্যাষ। অত ভাবা লাগবে না। আরেকটু গিয়া দৌড় দিমু, তৈরি থাকো। ভাগ্য ভালো হলে বাঁইচা যাইতেও পারি...”
চাচার কথামতো দুজনে ঊর্ধ্বশ্বাসে দৌড়াচ্ছি। ভাবছি বিষাণের কথা। হয়তো টোপ দিয়ে ফাঁদে ফেলেছিল। জালালের দলেরও কি একই ভাগ্য বরণ করতে হয়েছে? আমাদের যাত্রার শেষ কি এখানেই?
দৌড়াতে দৌড়াতে চাঁদের আলোয় মজিদ চাচার দিকে আরেকবার তাকালাম, আগের মতোই শান্ত, সৌম্য, ধীরস্থির। যেন কিছুই ঘটেনি।
অথচ ঘটে গেছে...ঘটে গেছে অনেককিছু।
হারিয়েছি তালগাছ সামাদকে, ঝকঝকে দাঁতের আলালকে। হারিয়েছি খিস্তিরাজ রাজ্জাককে, ভীতু হুমায়ূনকে। আর দেখা হবে না হাশেম ভাইয়ের সাথে, পরিপাটি পরিতোষদার সাথে। আনোয়ার ভাইয়ের আর কোনো যুক্তি শোনা হবে না, পেটুক জসিমের খাবার নিয়ে হাহাকারও দেখা হবে না। জাফরের কী খবর কে জানে...
হারাধনের এগারোটি ছেলে, রইলো বাকি...দুই কিংবা তিন।
কাঠের ঘোড়া
মজিদের গল্প
মজিদ মিয়া দৌড়াচ্ছে। তবে প্রাণপণে নয়, আতঙ্কেও নয়, অনেকটা নিশ্চিন্তে আর কিছুটা দ্বিধায়। তবে তার পাশে ছেলেটা দৌড়াচ্ছে প্রাণপণে, আতঙ্কে, অনিশ্চয়তায়। মজিদ মিয়া ঠিক করে ফেলেছে তাদের এই দৌড় কোথায় গিয়ে থামবে। থামবে সেখানে, যেখানে গিয়ে থামলে আর কোনো ভয় থাকবে না।
তাই সে যখন মাত্র দুটো গ্রাম পেরিয়েই থেমে গেল, তখন সেই ছেলেটা তার প্রচণ্ড ভয়টা লুকাতে পারলো না। অনেকবার বলল আরও দূরে গিয়ে লুকাতে, কিন্তু মজিদ মিয়া জানে, সবচেয়ে নিরাপদ আশ্রয় এই গ্রামটাতেই। কারণ এই গ্রামেই আছে তার বাড়ি, তার পরিবার।
শবখাদকরা সারাক্ষণ একসাথে দল বেঁধে কাটায় না। তাদেরও নিজস্ব জীবন আছে, পরিবার আছে। প্রতি মাসের কিংবা সপ্তাহের নির্দিষ্ট কিছু দিন তারা দল বেঁধে শব খোঁজে আর খেয়ে বেড়ায়। বাকিটা সময় একেবারে স্বাভাবিক জীবন কাটায়। তবে কিছু কিছু দল যেমন, পাষণ্ড জালালের দলের মতো কিছু দল সবসময় দল বেঁধে কাটায়, শব খায় কিংবা খুনখারাপি, লুটতরাজ করে কাটায়। বলা যায় তারা একধরনের নরমাংসাশী ডাকাত।
বেশিরভাগ ক্ষেত্রে এক শবখাদক অন্য শবখাদকের পরিবার সম্বন্ধে তেমন কিছুই জানে না। কারণ, এটা অনেকটা অলিখিত নিয়ম যে, অন্য শবখাদকের ব্যক্তিগত জীবন নিয়ে ঘাঁটাঘাঁটি করা যাবে না। যখন তারা দলের বাইরে তখন তারা সভ্য জগতের মানুষ, একেঅপরের অপরিচিত। যখন তারা দলে তখন তারা একেঅপরের খুব পরিচিত, শবখাদক—মৃতদেহের মাংসই যাদের আহার্য।
বাড়ির কাছাকাছি আসতেই ছেলেটা প্রকৃতির ডাকে সাড়া দেওয়ার কথা বললে মজিদ মিয়া তাকে বাড়ির ঠিকানা বুঝিয়ে বাড়ির পথ ধরে। উঠানে এসেই বুঝতে পারে কিছু একটা ঠিক নেই। কী ঠিক নেই তা বুঝতে তার একটু সময় লাগলো। তার ঘরের দরজার তালাটা ভাঙা আর ভেজানো; অথচ তা তালাবন্ধ থাকার কথা। কারণ তার পরিবারে সদস্য একজনই, আর সেই একজন হলো সে নিজে। চোর নাকি বিষাণ হানা দিয়েছে তার বাসায়?
দ্বিধানিত্ব অবস্থায় দরজাটা ধীরেধীরে খোলে। ভেতরে আবছায়া অন্ধকার। সেই অন্ধকারেই ঘরের চারপাশে তাকায়, নাহ কেউ নেই। আন্দাজ করে বুঝতে পারে সব জিনিসপত্র সেভাবেই পড়ে আছে যেভাবে পড়ে ছিল। খোয়া যায়নি কিছুই। তার মানে চোরও হানা দেয়নি। তাহলে তালা ভাঙলো কে? কেন?
টের পায় কেমন একটা বোটকা গন্ধ ঘরজুড়ে। যেন কিছু মরে পচে আছে। আশেপাশে কিছু বদমাশ বিড়াল আছে, যেগুলো ইঁদুর ধরে মেরে খায় আর যারতার ঘরে সেগুলোর অবশিষ্ঠাংশ ফেলে যায়। তেমনি কিছু হতে পারে।
বাঁহাতের আঙুল দিয়ে চিমটার মতো করে নাক চেপে ঘরের এক কোণে থাকা বাতির সুইচটা টিপে ঘুরে দাঁড়াতেই চমকে ওঠে মজিদ মিয়া। তার শ্বাস ভারী হয়ে আসে। হৃদপিণ্ডে যেন কেউ জোরে জোরে হাঁপর চালাচ্ছে, ফুসফুস ভরিয়ে দিয়েছে পাথরে। পেন্ডুলামের মতো দুলতে থাকে চারপাশের পরিবেশ। কোনোমতে পাশে থাকা খাটের হাতল ধরে নিজের ভারসাম্য রক্ষা করে আর বিস্ফারিত চোখে তাকিয়ে থাকে ফ্যানের দিকে। সেখানে ঝুলে আছে একটা মুণ্ডু...বিচ্ছিন্ন একটা মুণ্ডু। একটা দড়ি মুখের ভেতর দিয়ে ঢুকিয়ে নাক দিয়ে বের করে ফ্যানের সাথে দড়ি বেঁধে ঝুলিয়ে রাখা হয়েছে।
মুণ্ডুটার চোখ উপড়ে ফেলা হয়েছে, কেটে নেওয়া হয়েছে জিহ্বা, দুটো কানেরই অস্তিত্ব নেই, ঠোঁটও কেটে ফেলা হয়েছে। আর তাতে উন্মুক্ত হয়েছে দাঁতের পাটি। সেইসাথে উন্মুক্ত হয়েছে আরেকটা ব্যাপার। আর তা হলো দাঁতগুলোও রেহাই পায়নি নৃশংসতা থেকে; ভারি কিছু দিয়ে ভেঙে ফেলা হয়েছে, এবড়োখেবড়ো আকার নিয়েছে সেগুলো। নাকটাও রেহাই পায়নি। এটা যে কী বীভৎস ব্যাপার তা সামনাসামনি না দেখলে কেউ অনুধাবন করতে পারবে না। মজিদ মিয়ার পেটের ভেতরে কেউ যেন একদল প্রজাপতি ছেড়ে দিয়েছে, আর তা উড়ছে মাতালের মতো। বের হয়ে আসতে চাচ্ছে সব।
এরকম অসুস্থ অবস্থাতেও দুয়ে দুয়ে চারের হিসাব মেলাতে তার কোনো অসুবিধাই হলো না। জালালের মৃতদেহে সব অঙ্গই পাওয়া গিয়েছিল, কেবল পাওয়া যায়নি তার মুণ্ডু। আর তার হিসাব মেলানো আরও সহজ করে দিয়েছে কপালে লেখা একটা নাম। ছুরির তীক্ষ্ণ ফলা দিয়ে লেখা—জালাল।
“কিন্তু কে করলো এই কাজ? বিষাণরা কখনই এরকম কিছু করে না। তাদের হিসাব সহজ। ডাঁট ছুড়ে মারো, এরপর পুঁতে ফেলো কিংবা...” আর কিছু ভাবার আগেই সে শুনতে পায় তাকে কেউ “মজিদ চাচা, মজিদ চাচা” বলে ডাকছে। তারমানে ছেলেটা এসে গেছে। “যদি সে এসে এটা দেখে তাহলে আমার চেয়েও বেশি ভয় পেয়ে যাবে। তাই এটাকে লুকাতে হবে।” এই কথা মনে মনে আওড়াতে আওড়াতে বিছানার তোষকের নিচে রাখা একটা চটের বস্তা বের করে। একটা চেয়ার ফ্যানের নিচে রাখাই ছিল। মনে হয় মুণ্ডুটা ফ্যানের সাথে বাঁধার সময় খুনি ব্যবহার করেছিল।
মজিদ মিয়া একটা চাকু খুঁজে চেয়ারটায় চড়ে দড়িটা কেটে দ্রুত মুণ্ডুটা বস্তায় ভরে ফেলে। দড়ি কাটার সময় বুঝতে পারে, ওটা আসলে পাটের দড়ি না, গামছা ছিঁড়ে বানানো হয়েছে। জানালা খুলে চালিয়ে দেয় ফ্যানটা, যাতে বোটকা গন্ধটা যতটা সম্ভব কমে আসে। একটা ন্যাকড়া দিয়ে মুণ্ডু থেকে মেঝেতে পড়া রক্ত মোছার চেষ্টা করে। শুকনো রক্ত, তাই সহজে ওঠে না। যতটা পারে ততটা তুলে বস্তাটা হাতে নিয়ে বাইরে আসে। ছেলেটাকে দেখে যতটা সম্ভব স্বাভাবিক গলায় বলে, “ঘর চিইনা বের করতে পারছো তাহলে।”
“হ, একটু কষ্ট হইছে বাইর করতে। তাই সময় লাগলো।” মজিদ মিয়ার বস্তার দিকে ইশারা করে বলল, “ওইটা কী চাচা? দুর্গন্ধ বাইর হইতেছে।”
মজিদ মিয়া নিজেকে সামলে নিয়ে বলে, “আর কইয়ো না, মুরগি মাইরা বাঘডাশা ঘরটাকে একদম পাখনা, নাড়ীভুঁড়ি দিয়া ভরায়ে ফেলছিল। ঘরও গন্ধ কইরা ফালাইছে। তুমি ততক্ষণ বাইরে বসো, চাইরপাশ ঘুইরা দেখতে থাকো। আমি এগুলা ফালায় আসতেছি।”
মজিদ মিয়া যেতে ধরতেই ছেলেটা তাকে থামিয়ে জিজ্ঞাসা করে, “এইটা কি আসলেই আপনার বাড়ি?”
“হ, আমার বাড়িই তো, আর কার হইবো?”
“না, মানে বাড়িতে আর কেউ নাই যে...”
“আমি একলা মানুষ। আমার আর কেউ নাই।”
“অহন থাইকা আমি আছি।” বলেই একটা সরলমনা হাসি দিল। “তাড়াতাড়ি আসেন, খিদা লাগছে।”
“আইচ্চা, আইতেছি ফালায় দিয়ে...ওহ চাইল-ডাইল তো নাই। কিইন্যা একেবারে আইতেছি।”
মজিদ মিয়া ছেলেটাকে পিছনে ফেলে এগিয়ে যায়। হাঁটতে থাকে একটা জঙ্গলের দিকে। একটা বড়ো গাছ পেরিয়ে যেতেই শিস শুনতে পায়...কান খাড়া করলে বুঝতে পারে শিস বাজছে একটা ছন্দে...তিন...দুই...তিন...
বস্তাটা আস্তে করে নামিয়ে এগিয়ে যায় শিসের উৎসের দিকে। উৎস থেকেও একজন বের হয়ে আসতে থাকে তার দিকে...একজন চল্লিশোর্ধ্ব বয়স্ক লোক। সবুজ রঙের শার্ট আর ঘাড়ে গামছা, খাকি রঙের প্যান্ট, সুন্দর করে বাঁদিকে সিঁথি করে আঁচড়ানো চুল। মুচকি হাসতে হাসতে এগিয়ে আসে মজিদ মিয়ার দিকে। দৃষ্টি ধূর্ততায় ভরা।
মজিদ মিয়া হাঁটার গতি চকিত বাড়িয়ে এগিয়ে গিয়ে লোকটার গামছা চেপে ধরে বলে, “আরেকটু হইলেই মাইরা ফেলতে ধরছিলি।”
জবাবে লোকটা কিছু না বলে ফিক করে হেসে ফেলে। তার খাকি রঙের প্যান্টের পকেট দিয়ে উঁকি দিচ্ছে একটা লাল কাপড়, ভালোভাবে লক্ষ করলে দেখা যাবে, তাতে আঁকা আছে সাদা শিঙা।
কাঠের ঘোড়ায় বজ্রাঘাত
মজিদের গল্প
ট্রয় নগরীর দুর্ভেদ্য প্রাচীর দশ বছরেও ভেদ করতে না পেরে নিশ্চিত পরাজয়ের মুখে সম্মুখীন গ্রিকরা। বিজয় ছিনিয়ে নিতে তারা আশ্রয় নিলো এক ছলের। বিশাল এক কাঠের ঘোড়ার মূর্তি বানিয়ে অপরাজয়ের প্রতীক হিসেবে উপহার দিয়ে তারা চলে যায়। গ্রিকদের চলে যাওয়া দেখে ট্রয়বাসীরা ভেতরে নিয়ে আসে উপহার। গভীররাত পর্যন্ত চলে তাদের বিজয়োৎসব। এরপর সবাই ঘুমিয়ে পড়লে কাঠের ঘোড়া থেকে সন্তর্পণে বেরিয়ে আসে কিছু স্পার্টান, খুলে দেয় নগরতোরণ। ঢুকে পড়ে চলে যাওয়ার ভান করে লুকিয়ে থাকা গ্রিক সৈন্যদল। চলে নারকীয় হত্যাযজ্ঞ। ধ্বংস হয় ট্রয় নগরীর। ইতিহাসে তাই কাঠের ঘোড়া লিপিবদ্ধ হয়ে যায় বিশ্বাসঘাতকতার প্রতীকরূপে...
☠
বাঁদিকে সিঁথি করে সুন্দর করে আঁচড়ানো চুলের লোকটার নাম ছাদেক দফাদার। হাসার পর সে বলে ওঠে, “আর ভাই কইয়েন না, মিসটেক হয়ে গেছে।” ডান হাতের বুড়ো আর তর্জনী আঙুল দিয়ে চিমটি দেখিয়ে বলে, “ছোটি সি মিসটেক।”
ছাদেক নিজেকে স্মার্ট দেখাতে তিনভাষা মিলিয়ে কথা বলতে ভালোবাসে। এটা নিয়ে পরিচিতরা বিরক্ত হলেও, এব্যাপারে তার কোনো ভ্রূক্ষেপ নেই।
গামছার ফাঁসটা আরেকটু শক্তভাবে চেপে ধরে মজিদ মিয়া বলে, “আমার জান চইলা যাইতে ধরছিল, আর এইটা হইয়া গেল ‘ছোটো ভুল’?”
“আরে ভাই, মাইন্ড কইরেন না, বললাম তো মিসআন্ডারস্ট্যান্ডিং হইছে। কুইক অপারেশন চালাইতে গিয়ে মিসটেকটা হইছে।”
এবার গামছা ছেড়ে দিয়ে মজিদ মিয়া বলে, “আমাকে না বলে এই ‘কুইক অপারেশন’ চালাতে হলো কেন?”
“আর ভাই কইয়েন না, সব শালা ওই জাফরের দোষ, হিজ ফল্ট।”
“জাফর? তোতলা জাফর?”
“হ ভাই। ও আমাদের নতুন স্পাই মানে টিকটিকি ছিল। আর আমি জানতামও না আপনি ওই শবখাদকের দলে ছিলেন। জাফরও আপনাকে চেনে না। ছাগলটা অল্প ক’মাসেই অধৈর্য হয়ে গেছিল। প্রোমোশনের আশায় একটু তাড়াহুড়া কইরা দলটাকে কোপ খাওয়াইছে। তাছাড়া বসের কাছ থেকে ‘আর্জেন্ট কল’ নিয়া আসছিল। আপনি তো আপনার মতিগতি সমন্ধে আমাদের কিছু বলেনও না। তাই মিস্টেকটা হয়ে গেছে।”
“নতুনদের নিয়ে এই এক সমস্যা। ধৈর্য ধরতে চায় না। সাফল্যকে মনে করে লিফট। বাটন চাপবে আর সুড়ুৎ করে ওপরে উঠে যাবে। সাফল্য হইলো গিয়া সিঁড়ির মতন। ধাপে ধাপে আগাইতে হয়। মাথার ঘাম পায়ে ফালাইতে হয়। সব কিছু কি আর এত সস্তা?” হতাশা ঝরে পড়ে মজিদ মিয়ার কণ্ঠে।
“কী আর করবেন ভাই, ইয়াং জেনারেশন তো। মাঘের শীতেও রক্ত গরম থাকে। অপারেশনেও তো ঝামেলা করছে।”
মজিদ মিয়া ভ্রু কুঁচকে বলে, “কী সমস্যা হইছিল?”
“ঠিকভাবে পুরাপুরি ঘিরে ধরার আগেই লম্বুটাকে ফালায় দিয়ে ঝামেলা বাঁধায় ফেলছিল। একদম ধৈর্য নাই।”
“সেই কারণে বাঁচছি মনে হয়। নইলে তো ঠিকভাবে টের পাওয়ার আগেই মরতাম। ভাগ্য ভালো ছি...”
“ভাই, চান্দের আলোয় আপনার সংকেতটা ধরতে একটু টাইম লাগছিল।”
মজিদ মিয়ার মনে পড়ে গেল গামছা বেঁধে শূন্যে ঘোরানোর কথা। তার সাথের ছেলেটা ভেবেছে সেটা ছিল প্রতিরক্ষা কৌশল, কিন্তু আসলে তা ছিল বিষাণদের কাছে পাঠানো গুপ্তসংকেত। নিয়ম করে ঘড়ির কাঁটার দিকে আর বিপরীত দিতে ঘোরাতে হয়। ঘোরানোর জন্য যে-কোনো কিছু হলেই হয়। দূর থেকে বোঝা গেলেই হলো।
“বুঝছিলাম যখন একটা ডাঁট এসে লাগছিল।”
ছাদেক মুখটা চোরের মতো করে বলে, “ওইটাও জাফর মারছিল। চান্দের আলোর কারণে মনে হয় সে সিগন্যালটা ভালোভাবে ধরতে পারে নাই। ভাগ্য ভালো আমি পাশে ছিলাম। দেইখা বুইঝাই ওরে মানা করে দিছি। নইলে আরও মারতো।”
“কোথায় তোমার এই জাফর? ওরে কয়টা থাপ্পড় দেওয়া দরকার।”
“আপনের কাছে যাওয়ার কথা। মাফ চাইতে যাইতে কইছি। আপনি হইলেন গিয়া লেজেন্ডারি বিষাণ, আমাগো ওস্তাদ, সেকেন্ড বস...”
আর কিছু বিশেষণ যুক্ত করার আগেই তাকে থামিয়ে মজিদ মিয়া বলল, “আমার সাথে দলের একটা পোলা আছে। তাই এখন আমার সাথে আপাতত কোনো যোগাযোগ রাখবা না।”
ছাদেক অবাক হয়ে বলে ওঠে, “শবখাদক লইয়া ঘুরতেছেন ক্যান?”
“এইজন্য তোগো উন্নতি নাই। আমাদের কাজ কী?”
ভ্রু কুঁচকে ছাদেক বলে, “শবখাদকদের ফিনিশ করা।”
“কেমনে করবা?”
“খুঁইজা খুঁইজা বাইর কইরা।”
“খুঁইজা খুঁইজা একটা-দুইটা পাবা, কোনো দলকে পাবা না, পুরা নেটওয়ার্ক পাবা না। এইজন্য কোনো না কোনো শবখাদকের দলে লুকাইয়া থাকতে হইবো।”
“ওই জাফরের মতো টিকটিকি হইয়া...”
“টিকটিকি হইয়া না, শবখাদক হইয়া।”
“কী কন?” অবাক হয়ে বলে ছাদেক।
“যদি পুরা নেটওয়ার্কটাকে ধ্বংস করতে হয়, তাহলে ওদের মতো কেউ হইয়া যাইতে হইবো।” দীর্ঘশ্বাস ফেলে মজিদ মিয়া বলল, “দলটায় বহুত দিন ধইরা ছিলাম। হাশেম ভাইয়ের সাথে অনেক খাতির ছিল। নেটওয়ার্কটাও কব্জায় আসতেছিল। তোরা ভেজাল করে দিলি। আবার শুরু থেকে শুরু করা লাগবে। একটা নতুন দলে সবার আস্থা অর্জন করা অনেক সময়ের ব্যাপার। কী যে করস না তোরা!”
অপরাধী ভঙ্গিতে ছাদেক দফাদার বলে, “মিস্টেক ভাই, মিস্টেক হয়ে গেছে। তা ওই পোলাকে দিয়া কী করবেন?”
“নতুন কোনো দলে ঢুকতে ওই ছেলেটাকে আমার লাগবে। ও আমার অ্যালিবাই হিসেবে কাজ করবে, বুঝছো?”
বিজ্ঞের মতো মাথা ঝাঁকিয়ে ছাদেক বলে, “ও আচ্ছা। আপনার ব্রেইন অনেক শার্প। আমি বসকে এ টু জেড সব বলবো। আপনি টেনশন নিয়েন না। তয় নতুন কোন দলে ঢুকলেন সেইটা জানায়ে রাইখেন। নয়তো...আচ্ছা আপনার হাতে কী জানি ছিল?”
পরের পর্ব : ক্লিক করুন
ম্যাচিউর কন্টেন্ট | ভায়োলেন্স | PG 18+
শবখাদক
আমরা মৃতদেহ খুঁজে বেড়াই। খুঁজে পেলে মিলেমিশে খাই।
দলটা খুব একটা ভারী না। এগারোজন। চার দলে ভাগ হয়ে খুঁজি। তাতে মৃতদেহ পাওয়ার সম্ভাবনা বাড়ে। দলের নাম দিকের নামে—উত্তর, দক্ষিণ, পূর্ব, পশ্চিম। নাম আর কাজের দিক একই। মানে উত্তর দল কেবল উত্তরে খোঁজে, দক্ষিণ দল দক্ষিণে।
টাটকা মৃতদেহ আমাদের সবচেয়ে আরাধ্য। আর ওটাই জোটে সবচেয়ে কম। মাঝেমধ্যে পচাগলাও গিলতে হয়, তবে চেষ্টা করি না গিলতে। স্বাদই যদি না পেলাম তাহলে আর এত কষ্ট করার কী হলো!
একটা টাটকা লাশের খবর এনেছে দক্ষিণ দল। দ্রুতপদে সেদিকেই ছুটছি। দক্ষিণ দল সবচেয়ে ছোটো দল। অন্যদলগুলো তিনজন করে, এই দলে দুজন—আলাল আর মজিদ চাচা। আলাল দেখতে অনেকটা নিগ্রোদের মতো, বেঁটেখাটো, কুচকুচে কালো দেহ, ঝকঝকে দাঁত। অন্যদিকে মজিদ চাচার মধ্যে একটা সৌম্য ভাব আছে। গোলগাল চেহারা, শান্ত চোখ, ধীরস্থির মনোভাব।
দ্রুত যাওয়ার আরেকটা কারণও আছে—প্রতিপক্ষ। হ্যাঁ, আমাদের অনেকগুলো প্রতিপক্ষ আছে। সবচেয়ে বড়ো প্রতিপক্ষ হলো জালালের দল। “পাষণ্ড জালালের দল”-ও বলে অনেকে। ওরা মৃতদেহ না পেলে মৃতদেহ বানিয়ে নেয়। মানে খুন করে। খিদের জ্বালায় না পড়লে আমরা অন্যান্যরা পারতপক্ষে অতটা সহিংস হই না।
আমাদের দলটা কিছুটা গোঁড়া বলা যায়। খুনটুনে নেই আমরা। মৃতদেহের ওপর কোনোরকম অত্যাচার করি না। বিকৃত আচারও পালন করি না।
আমাদের দলনেতা হাশেম ভাই। দাঁড়ি পেকে সাদা হয়ে গেছে। অভিজ্ঞতার বলিরেখা সর্বত্র। তিনি পশ্চিম দলে থাকেন।
অনেকদিন হয়ে গেছে শেষ টাটকা মৃতদেহ খাওয়ার। তাই খবরটা পেয়ে দলের সবারই চোখ চকচক করছে। জিহ্বা টলটল করছে জলে। হাঁটার গতিও তাই স্বাভাবিকের চেয়ে দ্রুত।
যখন পৌঁছলাম তখন জ্যোৎস্নায় চারদিক ঝকঝক করছে। মৃতদেহটা পাওয়া গেছে নির্জন চরে। মাথা একদম বিচ্ছিন্ন করা। পুরো চরজুড়ে উঁচু উঁচু কাশের বন। বাতাসে প্রায়ই সরসর শব্দে দুলছে। এখনও কেউ মৃতদেহটার খবর পায়নি মনে হয়। অবশ্য আলাল আর মজিদ চাচা খোঁজ পেয়েই বালুচাপা দিয়ে গেছে। তাই খোঁজ পাওয়ার সম্ভাবনাও কম ছিল।
পূর্ব দলের মোটাসোটা জসিম বলল, “রক্ত দেইখা মনে হইতেছে খুনটা এখানেই করা হইছে। মাথাটা গেল কোথায় তাইলে? থাক গা যেখানে খুশি। আমার গোশত পাইলেই হইলো।”
পশ্চিম দল, মানে হাশেম ভাইয়ের দল এখনও আসেনি। তাই লাশ ধুয়ে নিয়ে বসে আছি। আমরা একসাথে খাই, মিলেমিশে—পরিবারের মতো।
হাশেম ভাই এসে স্বভাবমতো খানিকটা সময় নিয়ে মৃতদেহটা আগাগোড়া বারকয়েক দেখলেন। তারপর খানিকটা অস্ফুটস্বরে বললেন, “পালা সবাই।”
সবাই অদ্ভুতভাবে তাকালাম তার দিকে। পালাবো? কিন্তু কেন? এটা তো মাত্র একটা মৃতদেহ। আর চারদিকের পরিবেশও সুনসান, জনশূন্য।
আমাদের সবার দিকে তাকিয়ে আবার বললেন, “পালা রে পালা। এইটা তো জালালের লাশ। ওর দল খোঁজ পেলে আমাদের সবাইকে খাবে।”
☠
ঊর্ধ্বশ্বাসে দৌড়চ্ছি। পাশে কেবল একজন। মজিদ চাচা। আর কেউ সুযোগ পায়নি পালানোর। না, জালালের দলের কেউ আক্রমণ করেনি। আক্রমণ করেছে “বিষাণ”। বিষাণ মানে পশুর শিং দিয়ে বানানো শিঙা। ওদের মাথায় বাঁধা থাকে লাল কাপড়ের পট্টি। তাতে আঁকা সাদা রঙের শিঙা। আমাদের মতো শবখাদকদের নিধন করার কুখ্যাত দল।
টোপ দিয়ে ফাঁদে ফেলেছিল। জালালের দলেরও কি একই ভাগ্য বরণ করতে হয়েছে? ওর দলটাই সবচেয়ে বড়ো আর ভয়ংকর ছিল। তাদেরই যদি এই অবস্থা হয় তাহলে আমাদের মতো ছোটোখাটো দল কীভাবে টিকবে? আমাদের যাত্রার শেষ কি এখানেই?
দৌড়াতে দৌড়াতে চাঁদের আলোয় মজিদ চাচার দিকে আরেকবার তাকালাম, আগের মতোই শান্ত, সৌম্য, ধীরস্থির। যেন কিছুই ঘটেনি।
অথচ ঘটে গেছে...ঘটে গেছে অনেককিছু।
ইসরাফিলের শিঙা
“পালা রে পালা। এইটা তো জালালের লাশ। ওর দল খোঁজ পেলে আমাদের সবাইকে খাবে।” লাশের পাশে হাঁটু গেঁড়ে বসা অবস্থায় থেকে চিৎকার দিয়ে বললেন হাশেম ভাই। চরের ঝরঝরে বালুতে কিছুটা দেবে আছে হাঁটু।
আমরা সবাই স্থির হয়ে তাকিয়ে রইলাম তার দিকে। হতভম্ব অবস্থা। যেন হুট করে থামিয়ে দেওয়া হয়েছে চলমান কোনো দৌড় প্রতিযোগিতা।
উত্তর দিকের দলের আনোয়ার বলে উঠলো, “এইটা যে জালালের লাশ সেইটা কেমনে বুঝলেন? মাথা তো নাই।” নিজের মাথায় হাত বোলালো সে।
আনোয়ার মানুষ হিসাবে যুক্তিবাদী। যাই বলে না কেন তার পিছনে একটা যুক্তি লুকিয়ে থাকে। অদ্ভুত ব্যাপার, এই যুক্তিবাদী মানুষটাকে দীর্ঘসময় পাগলা গারদে থাকতে হয়েছিল। সেখান থেকে পালিয়ে এদিকওদিক ঘুরতে ঘুরতে কীভাবে যেন আমাদের মতো শবখাদক হয়ে গেছে। একসময় ভিড়ে গেছে আমাদের দলে। আমি তার অধীনে উত্তর দিকের দলে থাকি।
তার রুগ্ন শরীরের দিকে একপলক তাকিয়ে মোটাসোটা জসিম তাল মেলালো, “হ, হ, কেমন বুঝলেন? জালালের লাশ তো নাও হবার পারে।”
লাশের ডান হাত উঁচিয়ে ধরে হাশেম ভাই বললেন, “দেখ, তর্জনী আঙুল অর্ধেক নাই। পরিচিতদের মধ্যে এইটা কেবল জালালেরই নাই।”
আমি লাশের পাশে দাঁড়িয়ে ছিলাম। ভালোভাবে দেখার জন্য আমাকে সরিয়ে আনোয়ার কোমর বাঁকিয়ে দেখার চেষ্টা করল। থুতনি ঘষতে ঘষতে বলল, “জন্মগত কোনো ত্রুটি না এইটা, কোনো দুর্ঘটনায় হারাইছে। তাও বেশ আগেই হারাইছে। পনেরো-বিশ বছর আগের তো হবেই। হয়তো কোনো মারামারি করতে গিয়া কোপ খাইছে কিংবা অন্য কোনো...”
তাকে থামিয়ে এবার এগিয়ে এলেন মজিদ চাচা। শান্তভাবে হাঁটু ভাঁজ করে পায়ের আঙুলের ওপর ভর করে বসলেন লাশের পাশে। একটা চেক শার্ট পাশে ফেলে রাখা। ওটা লাশের গায়ে ছিল। চাঁদের আলোয় রংটা ঠিক বোঝা যাচ্ছে না। লাশ ধোঁয়ার সময় শার্টটা খুলে রাখা হয়েছিল। তিনি লাশের বুকের ঘন পশমের ভেতর তর্জনী আঙুল চালিয়ে ডান দিকে কিছু একটা খুঁজলেন। আঙুলটা এদিকওদিক এলোমেলোভাবে ঘুরে স্থির হলো একটা কাটা দাগে। ইঞ্চিখানেক দাগ। পুরোনো ক্ষত মনে হলো।
জসিমের দলের আরেক সদস্য রাজ্জাক তার স্বভাবমতো খেঁকিয়ে উঠে বলল, “বালের মতো মুখে ছিপি আইটা বইসা আছোস ক্যা?”
রাজ্জাক ভীষণ খিটখিটে স্বভাবের। কোনো কথাই স্বাভাবিকভাবে বলতে পারে না। সব কথাই বলে উচ্চস্বরে আর সাথে খিস্তি ফ্রি।
উঠে দাঁড়ালেন মজিদ চাচা। “হুম। জালালেরই মনে হইতেছে। তখন এত খেয়াল করি নাই। লাশ লুকাইতে ব্যস্ত আছিলাম।”
আমি এবার বললাম, “এখন কী করবো আমরা?”
আমার দিকে ফিরে তিনি বললেন, “যত দ্রুত সম্ভব এখান থেকে চইলা যাইতে হইবো। ঝুঁকি নেওয়া ঠিক হইবো না। জালাল কখনও একা একা ঘোরে না...মানে ঘুরত না। অন্তত পাঁচ-সাতজন তো থাকতোই সবসময়। যেহেতু তাদের দেখা যাইতেছে না। তাই হয় তারাও মারা পড়ছে, নয়তো বাকিদের ডাকতে গেছে। যদি ডাকতে যায়, আইসা পড়তে পারে যে-কোনো সময়।”
রাজ্জাক বলে উঠলো, “কী আর করার, আইজকাও উপাস থাকা লাগবে, বাল।” স্বর উঁচু করে বলল, “কে আনছে রে এই মড়ার খবর? কোন মাদারচোদ?” চোখ বুলালো সবার ওপর। স্থির হলো কুচকুচে কালো দেহের আলালের ঝকঝকে দাঁতের ওপর। এই অবস্থাতেও সে দাঁত বের করে হাসছে। তাকে বলল, “হালার পুত, আর কোনো লাশ পাইলি না? এইটাই জুটল?”
“আমার কী দুষ? মজিদ ভাই আগে পাইছে। আমি তার পিছন পিছন আসছি। লাশ দেইখা বালু চাপা দিয়াই খবর দিতে গেছি তোমাগো।”
জসিম তার বিশাল ভুঁড়িতে হাত বুলিয়ে বলল, “এইটা কোনো কথা? এমনিতেই খুনোখুনির লাশ খাওয়া অনেক ঝুঁকির। পুলিশি ঝামেলা থাকে। তারওপর যদি লাশ হয় দাগী আসামীর, আর পাষণ্ড জালালের, তাইলে তো যারে কয়, কী যেন কয়—মড়ার ওপর খাড়ার ঘা! মজিদ ভাই আপনে কেমন খোঁজ পাইলেন?”
মজিদ চাচা কিছু বলতে চাইলেন, কিন্তু তখন হাশেম ভাই বসা থেকে উঠে দাঁড়ানোর কারণে থেমে গেলেন। হাশেম ভাই আমাদের দলে সবচেয়ে প্রবীণ। চামড়ায় ভাঁজ পড়ে গেছে। দুশ্চিন্তায় এখন কপালেও ভাঁজের ভিড় দেখা যাচ্ছে। চিন্তিত স্বরে বললেন, “আজাইরা আলাপ পরে করিস। এক কাজ কর। লাশটা আবার চাপা দে। তারপর যাই। যদি অর দলের কেউ খোঁজ না পায় বা পুলিশি ঝামেলা না থাকে তাইলে এখানেই থাকবে। খাওয়ার সুযোগ থাকবে।”
আমাদের কোদাল, শাবল সবই আছে। কবর খুঁড়ে লাশ বের করতে সাথে রাখতে হয়। আমার শাবল আছে, তা দিয়ে খুঁড়তে শুরু করলাম। আলাল ভাই হাত লাগালেন কোদাল দিয়ে, সমানে কোপাতে লাগলেন। বালুমাটি হওয়ায় কিছুক্ষণের মধ্যেই পুঁতে ফেলার মতো গর্ত প্রায় হয়ে এলো।
এসময় হঠাৎ করে কানে এলো শিঙার তীক্ষ্ণ আওয়াজ। একটা বেজে উঠতেই পরপর আরও কয়েকটা চক্রাকারে বেজে উঠলো আমাদের চারপাশে। তারপর সব চুপচাপ। শোঁ শোঁ করে বাতাস বয়ে গেল কাশবনের ওপর দিয়ে। সরসর আওয়াজ হচ্ছে। লজ্জাবতীর মতো একে অপরের গায়ে লুটিয়ে পড়ছে কাশগুলো।
“কী হইলো এইটা?” জসিম অবাক হয়ে বলে উঠলো।
মজিদ চাচা চিৎকার দিয়ে বললেন, “সবাই মাটিতে শুইয়া পড়।”
উনি আর হাশেম ভাই ত্বরিত শুয়ে পড়লেন। আমি তখনও গর্তের তলায় শাবল হাতে শেষ পর্যায়ের খোঁড়াখুঁড়িতে ব্যস্ত। ওনাদের কথা শোনার পরেও বোকার মতো বসে আছি। কারণ চারপাশে কী হচ্ছে তা বোঝার উপায় নেই।
আমাকে কিছু বোঝাতে হলো না। আমাদের মধ্যে সবচেয়ে লম্বা আর উত্তর দলের অপরজন সদস্য ঝাঁকড়া চুলের সামাদ গর্তটার পাশে কাটা কলাগাছের মতো করে ধুপ করে মুখ থুবড়ে পড়ে গেল। যেন হাওয়ার তোড়ে পড়ে গেছে।
এবার হাশেম ভাই ফিসফিসিয়ে যেন নিজেকে বললেন, “বাইজা গেছে ইসরাফিলের শিঙা।”
হারাধনের এগারোটি ছেলে, রইলো বাকি...
ইসলাম ধর্মে বিশ্বাসীরা বিশ্বাস করেন, কিয়ামত বা মহাপ্রলয় শুরু হবে আল্লাহর আদেশে ইসরাফিল (আ.) নামের এক ফেরেশতা বা দেবদূতের শিঙার ফুঁৎকারের মাধ্যমে। তার শিঙার ধ্বনিতে ধ্বংস হয়ে যাবে পুরো সৃষ্টিজগত।
☠
সামাদ আমাদের দলে সবচেয়ে লম্বা সদস্য...ছিল। ছ’ ফিট তিন ইঞ্চি লম্বা। আমরা ডাকতাম তালগাছ বলে। উচ্চতা নিয়ে ছিল তার অনেক গর্ব। উচ্চতা মাপার যন্ত্র চোখে পড়লেই মাপতো আর আমাদের দেখিয়ে, খেপিয়ে, মাথা ঝাঁকিয়ে, ভাব নিতো। সেসময় তার মাথার ঝাঁকড়া চুল সেভাবে দুলতো যেভাবে হাওয়ায় ধানগাছ দোলে। বাঁশি বাজানোর খুব শখ ছিল। আহামরি বাজাতে পারতো না যদিও। চেষ্টা করতো আর বলতো, “ভাই, আমি কৃষ্ণ হমু, বাঁশির আওয়াজে রাধারে ডাকমু।”
সে আর কখনই রাধাকে ডাকতে পারবে না। বিষণ্ণ মনে উদ্বিগ্নচিত্তে রাধা অপেক্ষা করবে তার ঘরে। বাঁশির আওয়াজ আর কখনই তার কানে পৌঁছাবে না। কখনই না।
যখন সে গর্তটার পাশে কাটা কলাগাছের মতো করে ধুপ করে মুখ থুবড়ে পড়ে গেল, তার স্থির চোখগুলোর দিকে তাকিয়ে এসব কথাই ভাবছিলাম।
ঘাড় উঁচিয়ে গর্তটার বাইরে একবার তাকালাম। হাশেম ভাই মাটিতে শুয়ে পড়েছেন। তার পাশেই মজিদ চাচাও আছেন। হাশেম ভাই ফিসফিসিয়ে যেন নিজেকে বললেন, “বাইজা গেছে ইসরাফিলের শিঙা।”
আমি বললাম, “মানে?”
“বিষান্নাইরা হামলা চালাইছে। ওরা আমাদের সবাইকে মাইরা পুঁইতা ফেলবে। আমাদের আর বাঁচার আশা নাই।”
আমি উদ্বিগ্ন স্বরে বললাম, “উপায় তো একটা না একটা পাওয়া যাবেই।”
“যখন শিঙা বাজে তখন আর কেউ বাঁচে না। সবাইরে মাইরা ফেলায়। এইটা হইলো গিয়া ইসরাফিলের শিঙা।”
আমি উঠে দাঁড়াতে গেলেই মজিদ চাচা শোয়া অবস্থায় দাঁত খিঁচিয়ে বললেন, “মাথা উঁচা কইরো না। মইরা যাবা। গর্তে থাকো।”
গর্তের পাশে মজিদ চাচার কাছাকাছি শুয়ে পড়েছে পূর্ব দলের আরেক সদস্য পরিতোষদা। খুবই পরিপাটি একজন মানুষ। গলায় গামছা ঝুলিয়ে রাখেন একটা। ডানহাতে লাল সুতো বাঁধা। তাদের কোনো ধর্মীয় রীতির কারণে হয়তো। তিনি কথা বলেন শুদ্ধভাবে। মজিদ চাচার কথা শুনে বরাবরের মতো শুদ্ধভাষায় বললেন, “বুঝতে পারলাম না ব্যাপারটা। না পালিয়ে এভাবে শুয়ে থাকলে তো মারা পড়ার সুযোগ বেশি। আমাদের পালাতে...”
পরিতোষদা কথা শেষ করতে পারলেন না। আমার সাথে কোদাল হাতে গর্ত খুঁড়ছিলেন যে আলাল ভাই, উনি তার কোদালখানা উঁচিয়ে তলোয়ারের মতো করে ধরে, চিৎকার দিয়ে আক্রমণকারীদের উদ্দেশ্যে বলছিলেন, “আয়, কাছে আয়। দেখি কত সাহস! এই কোদাল দিয়ে তোদের ফালাফালা...”
তিনিও তার কথা শেষ করতে পারলেন না। বিস্ফারিত চোখ নিয়ে মাটিতে মুখ থুবড়ে পড়লেন।
রাজ্জাক ভাই তার পাশে হাঁটু গেঁড়ে বসে বললেন, “মাইরা ফেলাইছে রে, কুত্তাগুলা মাইরা ফেলাইছে সামাইদ্দা আর আলাইল্লারে। মাগিগুলাকে যদি আজকে আমি না চুদছি...”
“চুপ করে শুইয়া পড়...নইলে তোকেই চুইদা দেবে বিষান্নাইরা।” হাশেম ভাই দাঁতে দাঁত ঘষে বললেন। “শুইয়া পড় সবাই।”
“কিন্তু শুইতে হইবো কেন? কুত্তাগুলাকে গিয়ে শেষ করে দিলেই তো হয়। আমরা তো এখানে কম মানুষ নাই।” শুয়ে থাকা হাশেম ভাইয়ের দিকে তাকিয়ে বলল রাজ্জাক। সে এখনও কিছু বুঝে উঠতে পারছে না।
আনোয়ার তার মাথা চেপে ধরে শুইয়ে দিতে দিতে বলল, “এখনও বুঝোস নাই, বোকাচোদা? ওরা বিষ মাখা ডাঁট ছুড়ে মারতেছে। ভালো করে সামাদ আর আলালকে খেয়াল কর। সামাদের ঘাড়ে আর আলালের পিঠে বিঁইধা আছে ডাঁট। সামাদ সবচেয়ে লম্বা মানে উঁচা ছিল। তাই সে সবার আগে সহজ লক্ষ্যে পরিণত হইছে। আর আলাল নিজের মৃত্যু নিজেই ডেকে আনছে নিজেরে লক্ষ্য বানাইয়া। আমরা সবাই খুব দ্রুতই মারা পড়তাম, কিন্তু ঘন কাশবনের কারণে ওরা ডাঁট মাইরা সুবিধা করতে পারতেছে না। তাই যে-ই নিজের মাথা উঁচু করবে সে-ই মরবে। তাই, হাশেম ভাইয়ের কথা শোন, আর শুয়ে থাক।”
হাশেম ভাই সাথে যোগ করলেন, “হ, আনোয়ার ঠিক কইছে। আর বিষাইন্নারা আসে দল বাঁইধা। অগো মাথায় বাঁন্ধা থাকে লাল কাপড়ের ফিতা। সেই কাপড়ে শিঙা আঁকা থাকে। সাদা রঙের শিঙা মনে হয়। প্রথমে বাজায় অগো দলনেতা। সিগন্যাল দেয়। তারপরপরই বাকিরা চাইরদিক থাইকা বাজায়। ওরা কেবল তখনই শিঙা বাজায় যখন চাইরদিক থাইকা ঘিইরা ধরে। তাই শিঙা বাজানো মানে সবার কাহিনি শ্যাষ। খেল খতম। কেয়ামত। তাই আমাদের অনেকেই এইটারে কয় ইসরাফিলের শিঙা।”
“চারদিকে ঘিরে ধরছে মানে তো আমরা শ্যাষ। এখন তো বাঁচার কোনো উপায় নাই। আমার অনেক ভয় করতেছে।” আতঙ্কিত স্বরে বলে উঠলো হুমায়ূন। সে হাশেম ভাইয়ের দলে মানে পশ্চিম দলে। গোল ফ্রেমের চশমা পরে। মাথার চুল কাঁচাপাকা। তার বেশভূষা দেখে মনে হয় সে অনেক জ্ঞানী গোছের কেউ। কিন্তু আদতে সে গণ্ডমূর্খ আর ভীতু। শবখাদকদের দলে এমন একজন ভীতু কীভাবে ঢুকলো এটা একটা রহস্য। আমরা প্রায়ই তাকে ভয় দেখিয়ে মজা নিই।
“আমারও অনেক ভয় করতেছে। ভয়ে থাকলে আমার অনেক খিদা লাগে। আমি এইখানে শুইয়া থাকলে ভয় আর খিদায় মইরা যামু।” জসিম চিত হয়ে শুয়ে আকাশের দিকে তাকিয়ে বলল। তার বিশাল ভুঁড়িটা উঁচু ঢিবির মতো দেখাচ্ছে। “চল্ হুমায়ূন, পালাই। এদের কথা শুনলে এইখানে শুইয়া শুইয়া মরুম। তারচেয়ে পালানোর চেষ্টা করি।”
“কিন্তু কীভাবে? মাথা উঁচা করলেই তো বিষ মাখা ডাঁট আইসা মাইরা দিবে।” হুমায়ূন উদ্বিগ্ন স্বরে বলল।
আনোয়ার বলল, “এখানে শুইয়া থাকলে আসলেই বাঁচার আশা কইমা আসবে। আমরা হামাগুড়ি দিয়ে যতটা পারা যায় দূরে যাওয়ার চেষ্টা করতে পারি। ডাঁট খুব বেশি দূর যাইতে পারে না। একটা দূরত্বে চইলা গেলে বাঁচার সুযোগ বাড়বে। তখন দৌড়ায়ে পালানো যাবে।”
“বাল, তোরা বকবক করতে থাক। আমি মাগিদের ভয়ে আর শুইয়া থাকতে পারবো না। আমরা এইখানে বেশ্যার মতো শুয়ে থাকবো আর ওরা আইসা চুইদা দিয়া যাবে...এইটা আমি বাঁইচা থাকতে হইতে দিমু না। থাক তোরা...” বলেই রাজ্জাক যতটা পারা যায় মাথা নিচু করে দৌড় লাগালো। তাকে দেখে ভীত হুমায়ূনও পিছু নিলো।
বেশিদূর দৌড়াতে পারলো না। দুজনেই পড়ে গেল। ঘন কাশের ঝোপের কারণে কেবল দুটো ঝুপ ঝুপ মৃদু পতনের শব্দ শোনা গেল। রাজ্জাকের গালি আর শুনতে হবে না। জানা হবে না হুমায়ূনের মতো ভীত একটা লোক কীভাবে এই শবখাদকদের দলে ভিড়েছিল।
আনোয়ার বলল, “বিষাণের দল তাদের বৃত্ত ক্রমশ ছোটো করে আনতেছে। তাই এরা দ্রুত লক্ষ্যে পরিণত হইছে। আমরা যদি এইখানে শুইয়া থাকি, তাইলে আর খুব বেশিক্ষণ বাঁইচা থাকতে পারবো বলে মনে হয় না।”
এবার মজিদ চাচা মুখ খুললেন, “দলে ছিলাম এগারোজন। এখন আছি সাতজন। যদি একসাথে একদিকে যাই তাইলে বাঁচার সুযোগের চেয়ে মরার সুযোগই বাড়বে। সহজে লক্ষ্যে পরিণত হবো। আমাদের দলে ভাগ হইয়া চারদিকে ছড়াইয়া যাইতে হবে। এতে কেউ না কেউ কিংবা সবাই বাঁইচা যাইতে পারি।” গর্তে বসে থাকা আমার দিকে তাকিয়ে বললেন, “ও আর আমি একদলে, হাশেম ভাই আর জসিম একদলে, পরিতোষ আর আনোয়ার একদলে। আরেকজন হইলো জাফর...সে কই?”
জাফর ভদ্রগোছের এক ছেলে। পুরু গোঁফের কারণে তাকে বয়স্ক মনে হলেও, ত্রিশের কোটা পার করেছে বলে মনে হয় না। আমাদের দলে খুব বেশিদিন হয়নি যোগ দিয়েছে। নতুন সদস্যদের দৌড়াদৌড়ির কাজ বেশি দেওয়া হয়। মানে খবর আনা-নেওয়া, বাজার-সদাই করা এসব। মনে পড়লো, তাকে আমরা বাজার করতে পাঠিয়েছিলাম। তার একটা অন্যতম সমস্যা হলো, সে তোতলায়।
জসিম বলে উঠলো, “ওই তোতলাকে তো সদাই আনতে বাজারে পাঠাইছিলাম। বাঁইচা গেল হারামজাদা।” আফসোস ঝরে পড়লো তার কণ্ঠে।
মজিদ চাচা পরিতোষদাকে উদ্দেশ্য করে বললেন, “তোমার গামছাটা দেও। কাজ আছে।”
পরিতোষদা কিছু বললেন না। দিয়ে দিলেন। বাঁচার আশা ছেড়ে দিয়েছেন।
মজিদ চাচা গামছার এক মাথায় একটা ছোটো পাথর বেঁধে বললেন, “দেখা যাক কাজ করে কিনা।” তারপর আমাকে উদ্দেশ্য করে বললেন, “গর্ত থেকে বাইর হইবার সময় হইয়া গেছে। চলো, দেখি আমাদের ভাইগ্যে কী আছে। জ্যাতা নাকি মুর্দা!”
তিন দল তিন দিকে মাটিতে বুক ঘষে ঘষে এগুতে লাগলাম। নিজেকে সরীসৃপ মনে হচ্ছে। আমি মজিদ চাচার পিছু পিছু যাচ্ছি। বেঁচে থাকলে বাকিদের খবর নেওয়া যাবে। তবে মনে হচ্ছে আনোয়ারের আর্তচিৎকার শুনলাম। এর মানে হয়তো তার দল শেষ। শেষ হয়ে গেল পাগলাগারদ থেকে পালানো এক যুক্তিবাদীর আর পরিপাটি থাকা আর শুদ্ধ ভাষায় বলা পরিতোষদার। রইলাম কেবল আমরা দুজন, হাশেম ভাই আর পেটুক জসিম।
কিছুদূর গিয়ে মজিদ চাচা এবার একদিকে পাথর বাঁধা গামছাটা শূন্যে চরকির মতো এদিকওদিক কিছুক্ষণ ঘোরালেন। শিসের মতো কিছু শুনলাম। যখন থামিয়ে নামালেন তখন দেখলাম তিনি গামছা থেকে কাঠির মতো কিছু একটা খুলে ফেলে দিলেন। এগিয়ে যাওয়ার পর দেখে বুঝলাম ওটা একটা ডাঁট। কিন্তু মজিদ চাচা করলেনটা কী?
এবার তিনি যা বললেন তাতে ভয় পেয়ে গেলাম। উনি বললেন, “এইবার খিইচা দৌড় দিবা। যত জোরে দৌড়াবা বাঁচার সম্ভাবনা তত বেশি। আমাদের আশেপাশে একজনের বেশি বিষাইন্না নাই। থাকলে আরও ডাঁট পাইতাম। বুঝছো তো কি কইছি?”
ঢোক গিলে বললাম, “বুজছি।”
“এইদিকে যখন কেবল একজনই, তারমানে বাকি বিষাইন্নারা ওইদিকে চইলা গেছে। তারমানে...”
“তারমানে, হাশেম ভাইয়ের দলও শ্যাষ।”
“হ, হয়তো শ্যাষ। অত ভাবা লাগবে না। আরেকটু গিয়া দৌড় দিমু, তৈরি থাকো। ভাগ্য ভালো হলে বাঁইচা যাইতেও পারি...”
চাচার কথামতো দুজনে ঊর্ধ্বশ্বাসে দৌড়াচ্ছি। ভাবছি বিষাণের কথা। হয়তো টোপ দিয়ে ফাঁদে ফেলেছিল। জালালের দলেরও কি একই ভাগ্য বরণ করতে হয়েছে? আমাদের যাত্রার শেষ কি এখানেই?
দৌড়াতে দৌড়াতে চাঁদের আলোয় মজিদ চাচার দিকে আরেকবার তাকালাম, আগের মতোই শান্ত, সৌম্য, ধীরস্থির। যেন কিছুই ঘটেনি।
অথচ ঘটে গেছে...ঘটে গেছে অনেককিছু।
হারিয়েছি তালগাছ সামাদকে, ঝকঝকে দাঁতের আলালকে। হারিয়েছি খিস্তিরাজ রাজ্জাককে, ভীতু হুমায়ূনকে। আর দেখা হবে না হাশেম ভাইয়ের সাথে, পরিপাটি পরিতোষদার সাথে। আনোয়ার ভাইয়ের আর কোনো যুক্তি শোনা হবে না, পেটুক জসিমের খাবার নিয়ে হাহাকারও দেখা হবে না। জাফরের কী খবর কে জানে...
হারাধনের এগারোটি ছেলে, রইলো বাকি...দুই কিংবা তিন।
কাঠের ঘোড়া
মজিদের গল্প
মজিদ মিয়া দৌড়াচ্ছে। তবে প্রাণপণে নয়, আতঙ্কেও নয়, অনেকটা নিশ্চিন্তে আর কিছুটা দ্বিধায়। তবে তার পাশে ছেলেটা দৌড়াচ্ছে প্রাণপণে, আতঙ্কে, অনিশ্চয়তায়। মজিদ মিয়া ঠিক করে ফেলেছে তাদের এই দৌড় কোথায় গিয়ে থামবে। থামবে সেখানে, যেখানে গিয়ে থামলে আর কোনো ভয় থাকবে না।
তাই সে যখন মাত্র দুটো গ্রাম পেরিয়েই থেমে গেল, তখন সেই ছেলেটা তার প্রচণ্ড ভয়টা লুকাতে পারলো না। অনেকবার বলল আরও দূরে গিয়ে লুকাতে, কিন্তু মজিদ মিয়া জানে, সবচেয়ে নিরাপদ আশ্রয় এই গ্রামটাতেই। কারণ এই গ্রামেই আছে তার বাড়ি, তার পরিবার।
শবখাদকরা সারাক্ষণ একসাথে দল বেঁধে কাটায় না। তাদেরও নিজস্ব জীবন আছে, পরিবার আছে। প্রতি মাসের কিংবা সপ্তাহের নির্দিষ্ট কিছু দিন তারা দল বেঁধে শব খোঁজে আর খেয়ে বেড়ায়। বাকিটা সময় একেবারে স্বাভাবিক জীবন কাটায়। তবে কিছু কিছু দল যেমন, পাষণ্ড জালালের দলের মতো কিছু দল সবসময় দল বেঁধে কাটায়, শব খায় কিংবা খুনখারাপি, লুটতরাজ করে কাটায়। বলা যায় তারা একধরনের নরমাংসাশী ডাকাত।
বেশিরভাগ ক্ষেত্রে এক শবখাদক অন্য শবখাদকের পরিবার সম্বন্ধে তেমন কিছুই জানে না। কারণ, এটা অনেকটা অলিখিত নিয়ম যে, অন্য শবখাদকের ব্যক্তিগত জীবন নিয়ে ঘাঁটাঘাঁটি করা যাবে না। যখন তারা দলের বাইরে তখন তারা সভ্য জগতের মানুষ, একেঅপরের অপরিচিত। যখন তারা দলে তখন তারা একেঅপরের খুব পরিচিত, শবখাদক—মৃতদেহের মাংসই যাদের আহার্য।
বাড়ির কাছাকাছি আসতেই ছেলেটা প্রকৃতির ডাকে সাড়া দেওয়ার কথা বললে মজিদ মিয়া তাকে বাড়ির ঠিকানা বুঝিয়ে বাড়ির পথ ধরে। উঠানে এসেই বুঝতে পারে কিছু একটা ঠিক নেই। কী ঠিক নেই তা বুঝতে তার একটু সময় লাগলো। তার ঘরের দরজার তালাটা ভাঙা আর ভেজানো; অথচ তা তালাবন্ধ থাকার কথা। কারণ তার পরিবারে সদস্য একজনই, আর সেই একজন হলো সে নিজে। চোর নাকি বিষাণ হানা দিয়েছে তার বাসায়?
দ্বিধানিত্ব অবস্থায় দরজাটা ধীরেধীরে খোলে। ভেতরে আবছায়া অন্ধকার। সেই অন্ধকারেই ঘরের চারপাশে তাকায়, নাহ কেউ নেই। আন্দাজ করে বুঝতে পারে সব জিনিসপত্র সেভাবেই পড়ে আছে যেভাবে পড়ে ছিল। খোয়া যায়নি কিছুই। তার মানে চোরও হানা দেয়নি। তাহলে তালা ভাঙলো কে? কেন?
টের পায় কেমন একটা বোটকা গন্ধ ঘরজুড়ে। যেন কিছু মরে পচে আছে। আশেপাশে কিছু বদমাশ বিড়াল আছে, যেগুলো ইঁদুর ধরে মেরে খায় আর যারতার ঘরে সেগুলোর অবশিষ্ঠাংশ ফেলে যায়। তেমনি কিছু হতে পারে।
বাঁহাতের আঙুল দিয়ে চিমটার মতো করে নাক চেপে ঘরের এক কোণে থাকা বাতির সুইচটা টিপে ঘুরে দাঁড়াতেই চমকে ওঠে মজিদ মিয়া। তার শ্বাস ভারী হয়ে আসে। হৃদপিণ্ডে যেন কেউ জোরে জোরে হাঁপর চালাচ্ছে, ফুসফুস ভরিয়ে দিয়েছে পাথরে। পেন্ডুলামের মতো দুলতে থাকে চারপাশের পরিবেশ। কোনোমতে পাশে থাকা খাটের হাতল ধরে নিজের ভারসাম্য রক্ষা করে আর বিস্ফারিত চোখে তাকিয়ে থাকে ফ্যানের দিকে। সেখানে ঝুলে আছে একটা মুণ্ডু...বিচ্ছিন্ন একটা মুণ্ডু। একটা দড়ি মুখের ভেতর দিয়ে ঢুকিয়ে নাক দিয়ে বের করে ফ্যানের সাথে দড়ি বেঁধে ঝুলিয়ে রাখা হয়েছে।
মুণ্ডুটার চোখ উপড়ে ফেলা হয়েছে, কেটে নেওয়া হয়েছে জিহ্বা, দুটো কানেরই অস্তিত্ব নেই, ঠোঁটও কেটে ফেলা হয়েছে। আর তাতে উন্মুক্ত হয়েছে দাঁতের পাটি। সেইসাথে উন্মুক্ত হয়েছে আরেকটা ব্যাপার। আর তা হলো দাঁতগুলোও রেহাই পায়নি নৃশংসতা থেকে; ভারি কিছু দিয়ে ভেঙে ফেলা হয়েছে, এবড়োখেবড়ো আকার নিয়েছে সেগুলো। নাকটাও রেহাই পায়নি। এটা যে কী বীভৎস ব্যাপার তা সামনাসামনি না দেখলে কেউ অনুধাবন করতে পারবে না। মজিদ মিয়ার পেটের ভেতরে কেউ যেন একদল প্রজাপতি ছেড়ে দিয়েছে, আর তা উড়ছে মাতালের মতো। বের হয়ে আসতে চাচ্ছে সব।
এরকম অসুস্থ অবস্থাতেও দুয়ে দুয়ে চারের হিসাব মেলাতে তার কোনো অসুবিধাই হলো না। জালালের মৃতদেহে সব অঙ্গই পাওয়া গিয়েছিল, কেবল পাওয়া যায়নি তার মুণ্ডু। আর তার হিসাব মেলানো আরও সহজ করে দিয়েছে কপালে লেখা একটা নাম। ছুরির তীক্ষ্ণ ফলা দিয়ে লেখা—জালাল।
“কিন্তু কে করলো এই কাজ? বিষাণরা কখনই এরকম কিছু করে না। তাদের হিসাব সহজ। ডাঁট ছুড়ে মারো, এরপর পুঁতে ফেলো কিংবা...” আর কিছু ভাবার আগেই সে শুনতে পায় তাকে কেউ “মজিদ চাচা, মজিদ চাচা” বলে ডাকছে। তারমানে ছেলেটা এসে গেছে। “যদি সে এসে এটা দেখে তাহলে আমার চেয়েও বেশি ভয় পেয়ে যাবে। তাই এটাকে লুকাতে হবে।” এই কথা মনে মনে আওড়াতে আওড়াতে বিছানার তোষকের নিচে রাখা একটা চটের বস্তা বের করে। একটা চেয়ার ফ্যানের নিচে রাখাই ছিল। মনে হয় মুণ্ডুটা ফ্যানের সাথে বাঁধার সময় খুনি ব্যবহার করেছিল।
মজিদ মিয়া একটা চাকু খুঁজে চেয়ারটায় চড়ে দড়িটা কেটে দ্রুত মুণ্ডুটা বস্তায় ভরে ফেলে। দড়ি কাটার সময় বুঝতে পারে, ওটা আসলে পাটের দড়ি না, গামছা ছিঁড়ে বানানো হয়েছে। জানালা খুলে চালিয়ে দেয় ফ্যানটা, যাতে বোটকা গন্ধটা যতটা সম্ভব কমে আসে। একটা ন্যাকড়া দিয়ে মুণ্ডু থেকে মেঝেতে পড়া রক্ত মোছার চেষ্টা করে। শুকনো রক্ত, তাই সহজে ওঠে না। যতটা পারে ততটা তুলে বস্তাটা হাতে নিয়ে বাইরে আসে। ছেলেটাকে দেখে যতটা সম্ভব স্বাভাবিক গলায় বলে, “ঘর চিইনা বের করতে পারছো তাহলে।”
“হ, একটু কষ্ট হইছে বাইর করতে। তাই সময় লাগলো।” মজিদ মিয়ার বস্তার দিকে ইশারা করে বলল, “ওইটা কী চাচা? দুর্গন্ধ বাইর হইতেছে।”
মজিদ মিয়া নিজেকে সামলে নিয়ে বলে, “আর কইয়ো না, মুরগি মাইরা বাঘডাশা ঘরটাকে একদম পাখনা, নাড়ীভুঁড়ি দিয়া ভরায়ে ফেলছিল। ঘরও গন্ধ কইরা ফালাইছে। তুমি ততক্ষণ বাইরে বসো, চাইরপাশ ঘুইরা দেখতে থাকো। আমি এগুলা ফালায় আসতেছি।”
মজিদ মিয়া যেতে ধরতেই ছেলেটা তাকে থামিয়ে জিজ্ঞাসা করে, “এইটা কি আসলেই আপনার বাড়ি?”
“হ, আমার বাড়িই তো, আর কার হইবো?”
“না, মানে বাড়িতে আর কেউ নাই যে...”
“আমি একলা মানুষ। আমার আর কেউ নাই।”
“অহন থাইকা আমি আছি।” বলেই একটা সরলমনা হাসি দিল। “তাড়াতাড়ি আসেন, খিদা লাগছে।”
“আইচ্চা, আইতেছি ফালায় দিয়ে...ওহ চাইল-ডাইল তো নাই। কিইন্যা একেবারে আইতেছি।”
মজিদ মিয়া ছেলেটাকে পিছনে ফেলে এগিয়ে যায়। হাঁটতে থাকে একটা জঙ্গলের দিকে। একটা বড়ো গাছ পেরিয়ে যেতেই শিস শুনতে পায়...কান খাড়া করলে বুঝতে পারে শিস বাজছে একটা ছন্দে...তিন...দুই...তিন...
বস্তাটা আস্তে করে নামিয়ে এগিয়ে যায় শিসের উৎসের দিকে। উৎস থেকেও একজন বের হয়ে আসতে থাকে তার দিকে...একজন চল্লিশোর্ধ্ব বয়স্ক লোক। সবুজ রঙের শার্ট আর ঘাড়ে গামছা, খাকি রঙের প্যান্ট, সুন্দর করে বাঁদিকে সিঁথি করে আঁচড়ানো চুল। মুচকি হাসতে হাসতে এগিয়ে আসে মজিদ মিয়ার দিকে। দৃষ্টি ধূর্ততায় ভরা।
মজিদ মিয়া হাঁটার গতি চকিত বাড়িয়ে এগিয়ে গিয়ে লোকটার গামছা চেপে ধরে বলে, “আরেকটু হইলেই মাইরা ফেলতে ধরছিলি।”
জবাবে লোকটা কিছু না বলে ফিক করে হেসে ফেলে। তার খাকি রঙের প্যান্টের পকেট দিয়ে উঁকি দিচ্ছে একটা লাল কাপড়, ভালোভাবে লক্ষ করলে দেখা যাবে, তাতে আঁকা আছে সাদা শিঙা।
কাঠের ঘোড়ায় বজ্রাঘাত
মজিদের গল্প
ট্রয় নগরীর দুর্ভেদ্য প্রাচীর দশ বছরেও ভেদ করতে না পেরে নিশ্চিত পরাজয়ের মুখে সম্মুখীন গ্রিকরা। বিজয় ছিনিয়ে নিতে তারা আশ্রয় নিলো এক ছলের। বিশাল এক কাঠের ঘোড়ার মূর্তি বানিয়ে অপরাজয়ের প্রতীক হিসেবে উপহার দিয়ে তারা চলে যায়। গ্রিকদের চলে যাওয়া দেখে ট্রয়বাসীরা ভেতরে নিয়ে আসে উপহার। গভীররাত পর্যন্ত চলে তাদের বিজয়োৎসব। এরপর সবাই ঘুমিয়ে পড়লে কাঠের ঘোড়া থেকে সন্তর্পণে বেরিয়ে আসে কিছু স্পার্টান, খুলে দেয় নগরতোরণ। ঢুকে পড়ে চলে যাওয়ার ভান করে লুকিয়ে থাকা গ্রিক সৈন্যদল। চলে নারকীয় হত্যাযজ্ঞ। ধ্বংস হয় ট্রয় নগরীর। ইতিহাসে তাই কাঠের ঘোড়া লিপিবদ্ধ হয়ে যায় বিশ্বাসঘাতকতার প্রতীকরূপে...
☠
বাঁদিকে সিঁথি করে সুন্দর করে আঁচড়ানো চুলের লোকটার নাম ছাদেক দফাদার। হাসার পর সে বলে ওঠে, “আর ভাই কইয়েন না, মিসটেক হয়ে গেছে।” ডান হাতের বুড়ো আর তর্জনী আঙুল দিয়ে চিমটি দেখিয়ে বলে, “ছোটি সি মিসটেক।”
ছাদেক নিজেকে স্মার্ট দেখাতে তিনভাষা মিলিয়ে কথা বলতে ভালোবাসে। এটা নিয়ে পরিচিতরা বিরক্ত হলেও, এব্যাপারে তার কোনো ভ্রূক্ষেপ নেই।
গামছার ফাঁসটা আরেকটু শক্তভাবে চেপে ধরে মজিদ মিয়া বলে, “আমার জান চইলা যাইতে ধরছিল, আর এইটা হইয়া গেল ‘ছোটো ভুল’?”
“আরে ভাই, মাইন্ড কইরেন না, বললাম তো মিসআন্ডারস্ট্যান্ডিং হইছে। কুইক অপারেশন চালাইতে গিয়ে মিসটেকটা হইছে।”
এবার গামছা ছেড়ে দিয়ে মজিদ মিয়া বলে, “আমাকে না বলে এই ‘কুইক অপারেশন’ চালাতে হলো কেন?”
“আর ভাই কইয়েন না, সব শালা ওই জাফরের দোষ, হিজ ফল্ট।”
“জাফর? তোতলা জাফর?”
“হ ভাই। ও আমাদের নতুন স্পাই মানে টিকটিকি ছিল। আর আমি জানতামও না আপনি ওই শবখাদকের দলে ছিলেন। জাফরও আপনাকে চেনে না। ছাগলটা অল্প ক’মাসেই অধৈর্য হয়ে গেছিল। প্রোমোশনের আশায় একটু তাড়াহুড়া কইরা দলটাকে কোপ খাওয়াইছে। তাছাড়া বসের কাছ থেকে ‘আর্জেন্ট কল’ নিয়া আসছিল। আপনি তো আপনার মতিগতি সমন্ধে আমাদের কিছু বলেনও না। তাই মিস্টেকটা হয়ে গেছে।”
“নতুনদের নিয়ে এই এক সমস্যা। ধৈর্য ধরতে চায় না। সাফল্যকে মনে করে লিফট। বাটন চাপবে আর সুড়ুৎ করে ওপরে উঠে যাবে। সাফল্য হইলো গিয়া সিঁড়ির মতন। ধাপে ধাপে আগাইতে হয়। মাথার ঘাম পায়ে ফালাইতে হয়। সব কিছু কি আর এত সস্তা?” হতাশা ঝরে পড়ে মজিদ মিয়ার কণ্ঠে।
“কী আর করবেন ভাই, ইয়াং জেনারেশন তো। মাঘের শীতেও রক্ত গরম থাকে। অপারেশনেও তো ঝামেলা করছে।”
মজিদ মিয়া ভ্রু কুঁচকে বলে, “কী সমস্যা হইছিল?”
“ঠিকভাবে পুরাপুরি ঘিরে ধরার আগেই লম্বুটাকে ফালায় দিয়ে ঝামেলা বাঁধায় ফেলছিল। একদম ধৈর্য নাই।”
“সেই কারণে বাঁচছি মনে হয়। নইলে তো ঠিকভাবে টের পাওয়ার আগেই মরতাম। ভাগ্য ভালো ছি...”
“ভাই, চান্দের আলোয় আপনার সংকেতটা ধরতে একটু টাইম লাগছিল।”
মজিদ মিয়ার মনে পড়ে গেল গামছা বেঁধে শূন্যে ঘোরানোর কথা। তার সাথের ছেলেটা ভেবেছে সেটা ছিল প্রতিরক্ষা কৌশল, কিন্তু আসলে তা ছিল বিষাণদের কাছে পাঠানো গুপ্তসংকেত। নিয়ম করে ঘড়ির কাঁটার দিকে আর বিপরীত দিতে ঘোরাতে হয়। ঘোরানোর জন্য যে-কোনো কিছু হলেই হয়। দূর থেকে বোঝা গেলেই হলো।
“বুঝছিলাম যখন একটা ডাঁট এসে লাগছিল।”
ছাদেক মুখটা চোরের মতো করে বলে, “ওইটাও জাফর মারছিল। চান্দের আলোর কারণে মনে হয় সে সিগন্যালটা ভালোভাবে ধরতে পারে নাই। ভাগ্য ভালো আমি পাশে ছিলাম। দেইখা বুইঝাই ওরে মানা করে দিছি। নইলে আরও মারতো।”
“কোথায় তোমার এই জাফর? ওরে কয়টা থাপ্পড় দেওয়া দরকার।”
“আপনের কাছে যাওয়ার কথা। মাফ চাইতে যাইতে কইছি। আপনি হইলেন গিয়া লেজেন্ডারি বিষাণ, আমাগো ওস্তাদ, সেকেন্ড বস...”
আর কিছু বিশেষণ যুক্ত করার আগেই তাকে থামিয়ে মজিদ মিয়া বলল, “আমার সাথে দলের একটা পোলা আছে। তাই এখন আমার সাথে আপাতত কোনো যোগাযোগ রাখবা না।”
ছাদেক অবাক হয়ে বলে ওঠে, “শবখাদক লইয়া ঘুরতেছেন ক্যান?”
“এইজন্য তোগো উন্নতি নাই। আমাদের কাজ কী?”
ভ্রু কুঁচকে ছাদেক বলে, “শবখাদকদের ফিনিশ করা।”
“কেমনে করবা?”
“খুঁইজা খুঁইজা বাইর কইরা।”
“খুঁইজা খুঁইজা একটা-দুইটা পাবা, কোনো দলকে পাবা না, পুরা নেটওয়ার্ক পাবা না। এইজন্য কোনো না কোনো শবখাদকের দলে লুকাইয়া থাকতে হইবো।”
“ওই জাফরের মতো টিকটিকি হইয়া...”
“টিকটিকি হইয়া না, শবখাদক হইয়া।”
“কী কন?” অবাক হয়ে বলে ছাদেক।
“যদি পুরা নেটওয়ার্কটাকে ধ্বংস করতে হয়, তাহলে ওদের মতো কেউ হইয়া যাইতে হইবো।” দীর্ঘশ্বাস ফেলে মজিদ মিয়া বলল, “দলটায় বহুত দিন ধইরা ছিলাম। হাশেম ভাইয়ের সাথে অনেক খাতির ছিল। নেটওয়ার্কটাও কব্জায় আসতেছিল। তোরা ভেজাল করে দিলি। আবার শুরু থেকে শুরু করা লাগবে। একটা নতুন দলে সবার আস্থা অর্জন করা অনেক সময়ের ব্যাপার। কী যে করস না তোরা!”
অপরাধী ভঙ্গিতে ছাদেক দফাদার বলে, “মিস্টেক ভাই, মিস্টেক হয়ে গেছে। তা ওই পোলাকে দিয়া কী করবেন?”
“নতুন কোনো দলে ঢুকতে ওই ছেলেটাকে আমার লাগবে। ও আমার অ্যালিবাই হিসেবে কাজ করবে, বুঝছো?”
বিজ্ঞের মতো মাথা ঝাঁকিয়ে ছাদেক বলে, “ও আচ্ছা। আপনার ব্রেইন অনেক শার্প। আমি বসকে এ টু জেড সব বলবো। আপনি টেনশন নিয়েন না। তয় নতুন কোন দলে ঢুকলেন সেইটা জানায়ে রাইখেন। নয়তো...আচ্ছা আপনার হাতে কী জানি ছিল?”
পরের পর্ব : ক্লিক করুন
Published on November 18, 2021 10:02
•
Tags:
adult, bengali, crime-fiction, dark, fiction, mystery, preview, suspense-thriller, thriller
শবশিঙা প্রিভিউ (দ্বিতীয় পর্ব)
সতর্কীকরণ
ম্যাচিউর কন্টেন্ট | ভায়োলেন্স | PG 18+
গত পর্ব : ক্লিক করুন
এতক্ষণে মজিদ মিয়ার খেয়াল হলো। মাটি থেকে বস্তাটা তুলে ছাদেকের দিকে বাড়িয়ে দিয়ে বলল, “পাষণ্ড জালালের মুণ্ডু।”
ছাদেক আঁতকে উঠে বলে, “কন কী? ওর মুণ্ডু কই পাইলেন?”
সব খুলে বলার পর মজিদ মিয়া বলল, “এইটা আর চরে থাকা লাশের বাকি অংশ নিয়া ময়নাতদন্ত করাবা। কোনো ক্লু পাও কিনা দেখো। কে খুন করছে এইটা জানা খুব দরকার।”
বিষাণদের নিজস্ব ল্যাব আছে। তাতে তারা নিজস্ব অস্ত্র বানায়। প্রয়োজনে ময়নাতদন্ত করে। গবেষণা করে বিভিন্ন বিষয়ে।
বস্তাটা নিতে নিতে ছাদেক বলে, “এইটা যে জালালের হেড সেটা বুঝলেন কেমনে? জানি আপনি তারে সবচেয়ে ভালো চেনেন, তাও...”
“কপালে লেইখা দিছে খুনি। আর চরে যে লাশটা খাইতে গেছিলাম সেইটা জালালের বডি আছিল। বুকের কাটা দাগ দেইখা বুঝছি। আর আঙুল তো কাটা ছিলই। আশেপাশে আরও লাশ থাকার কথা। ও তো একা একা চলাফেরা করতো না। পাও নাই?”
ছাদেক অবাক হয়ে বলল, “এইটা অদ্ভুত ব্যাপার। ভেরি স্ট্রেঞ্জ। আপনার দলের বাইরের আর কারো লাশ পাই নাই। জালাল একা একাই গেল?”
“কোথাও কিছু ঘাপলা আছে, যেইটা আমরা ধরতে পারতেছি না। তুমি এইটারে গুরুত্বসহকারে দেখো। বিষয়টা আমার কাছে কেমন যেন ঘোলাটে লাগতেছে। কিছু একটা ঠিক নাই। মিল খাইতেছে না। আর সবাইরে সাবধান কইরা দেও। জালাল মরায় তার দল এখন খুব ক্ষেইপা উঠবো। বাইড়া যাইবো আমাদের ওপর হামলার পরিমাণ।”
স্যালুট দেওয়ার ভঙ্গি করে ছাদেক বলে, “সেকেন্ড বস আদেশ দিয়েছেন, আমি অবশ্যই দেখবো। আর বাকিদের সাবধানও করে দেবো।”
এসময় আকাশ ডেকে উঠলো ভয়ানকভাবে। দুজনেই চমকে উঠলো।
নিজেকে সামলে নিয়ে মজিদ মিয়া বলল, “দেরি হইয়া যাইতেছে। সদাই কইরা ফিরতে হইবো। ছেলেটাকে একলা রাইখা আসছি। যাও অহন। অগ্রগতি জানাইয়ো। আর বসকে আমার সালাম দিও।”
“ইয়েস সেকেন্ড বস।” মুণ্ডুর বস্তাটা নিয়ে চলে যায় ছাদেক দফাদার।
দুজন আলাদা হতে না হতেই আকাশ কালো করে মুষলধারে বৃষ্টি পড়া শুরু হলো। সেইসাথে বজ্রপাত চলছে সমানতালে। চারদিক একদম অন্ধকার হয়ে এসেছে। তাই বজ্রপাতের আলোয় যেন ঝলসে উঠছে চারপাশ।
সদাই করে কাকভেজা হয়ে বাড়ির উঠানে পা রাখতেই চমকে উঠলো মজিদ মিয়া। পিছন ফিরে স্থির হয়ে দাঁড়িয়ে আছে ছেলেটা। ভিজে একদম চুপসে আছে। গায়ে লেপটে আছে কাপড়।
মাটিতে পড়ে আছে কেউ—যার বুকে আমূল বিঁধে আছে ছুরি। বৃষ্টির তোড়ে চারপাশ থই থই করছে পানিতে।
মাথা ঘুরিয়ে পিছনে তাকালো ছেলেটা। এসময় কড়কড় শব্দে বাজ পড়লো। আলোয় উদ্ভাসিত হলো চারপাশ। সেই আলোয় দেখা গেল সরলমনা হাসির ছেলেটার মুখে ঠোঁট বাঁকানো ক্রুর হাসি। গমগমে স্বরে বলল, “ওরে কইতো হইতো, ‘তুই বাইচা আছোস?’, কিন্তু কইছে ‘তুই মরস নাই?’...জা-ফর ...মী-র...মীর-জা-ফ-র...”
দুহাত ওপরে তুলে অট্টহাসিতে ফেটে পড়ে সে। বজ্রপাতের কড়কড় শব্দ ছাপিয়ে সেই শব্দ যেন হিম করে দেয় মজিদ মিয়ার হৃদপিণ্ড।
কাঠের ঘোড়ার গল্প
জাফরের গল্প
“জাফর, তোমাকে একটা গুরুত্বপূর্ণ দায়িত্ব দিতে চাই।” চেয়ারে গা এলিয়ে দিতে দিতে রাশভারী কণ্ঠের কেউ একজন বলল। ক্যাচ ক্যাচ শব্দে চেয়ার জানান দিল নিজের অস্তিত্বের। কংক্রিটের বিশাল রুমটায় আধখোলা জানালার কল্যাণে এক ভূতুড়ে আলোআঁধারি পরিবেশের সৃষ্টি করেছে।
পুরু গোঁফওয়ালা জাফর নাকের নিচটা ঘষতে ঘষতে বলল, “জি হুজুর, বলেন। আপনার জন্য জা-জান হা-হাজির।”
“জান-টান দিতে হবে না।” কণ্ঠস্বর নামিয়ে, “কিন্তু জান নিতে হবে।”
“আপনে খালি হু-হুকুম করেন হুজুর। জান নিতে নিতে সাগর রক্তে লালে লাল করে ফে-ফে-ফেলব।”
“সাগর লাল করতে হবে না। একটা নিতে হবে কেবল।”
“জি হুজুর, বলেন কার জা-জান নিতে হবে, আমি আপনার পায়ের তলায় এ-এ-এখনই এনে দি-দিচ্ছি।”
“আহ, তোষামোদি থামাও। বুদ্ধিকে কাজে লাগাও। যা যা বলি মনোযোগ দিয়ে শোনো। পরিকল্পনা একটু এদিকওদিক হলেই ভেস্তে যাবে। তাই বুদ্ধিটাকে ঠিকঠাকভাবে কাজে লাগাবা।”
“জি হুজুর, আপনার জন্য জান হা-হাজির।”
“তোমাকে যে দলে নেওয়া হয়েছে সেটা এখন পর্যন্ত আমি আর আমার কাছের অল্প কয়েকজন ছাড়া আর কেউ জানে না। যদি এই কাজটা করে দিতে পারো তাহলে তোমার জন্য উজ্জ্বল ভবিষ্যৎ অপেক্ষা করবে। তাই আবারও বলছি ধৈর্য ধরে ধীরেসুস্থে এগোবা। কাজটা যে-করেই হোক হওয়া চাই।”
“জি হুজুর, দ-দরকার হয় চল্লিশ ব-বছর ধৈর্য ধরব। তারপরও কাজটা সফল ক-ক-রেই ছাড়ব।”
এবার রাশভারী কণ্ঠের ব্যক্তিটি পিঠ টান টান করে বসলেন। নরম গদির চেয়ারটাও ক্যাচ ক্যাচ শব্দ করে তাকে অনুসরণ করলো। কাঠের টেবিলের ওপর বসানো কাচে প্রতিফলিত হচ্ছে তার প্রশস্ত কপালের চেহারা। সেই চেহারা বিরক্তিতে কুঁচকে আছে। তিক্ত স্বরে বললেন, “এত তোষামোদির তো কোনো কারণ দেখছি না। আমি শুধু চাচ্ছি কাজটা যাতে সফল হয়।” জাফর কিছু বলতে চাচ্ছিল, তাকে থামিয়ে দিয়ে বললেন, “আর কোনো কথা নয়, যাও কাজে নেমে পড়ো।”
অবস্থা বেগতিক দেখে জাফর আর কথা বাড়ায় না। সালাম ঠুকে বেরিয়ে আসে ঘরটা থেকে। বাইরে এসেই বুক ভরে শ্বাস নেয়। তার কাছে উজ্জ্বল ভবিষ্যৎ বলতে মাথার ওপর ঝুলে থাকা কেসটা থেকে রেহাই পেলেই হয়। রাস্তায় নেমে পিচিক করে মাটিতে একদলা থুতু ফেলেই হাঁটতে শুরু করে। প্রখর সূর্যের তাপে সেই থুতু ভেলকির মতো নিমেষেই গায়েব হয়ে যায়।
☠
হাশেম ভাইয়ের দলে ঢোকাটা জাফরের জন্য খুব কঠিনই ছিল। অচেনা এক আগন্তককে কেউই দলে ভেড়াতে চাইবে না। দেড় মাস ধরে জোঁকের মতো লেগে থাকার পর হাশেম ভাইয়ের আস্থা অর্জন করতে পারে সে। এরপর থেকেই তক্কে তক্কে থাকে। সুযোগ যেন হরিণী, আর সে যেন এক ক্ষুধার্ত বাঘ...অপেক্ষা কেবল একটু অসতর্কতার।
তাকে নেওয়া হয়েছে হাশেম ভাইয়ের গ্রুপে। তার ব্যক্তিগত ধারণা হাশেম ভাই সম্ভবত নিজে তাকে আগে ভালোভাবে পরখ করে নিতে চান। তার দিক পশ্চিম। সে আর হাশেম ভাই ছাড়াও গ্রুপে আছে চশমা পরা এক লোক, নাম হুমায়ূন। চশমার ফ্রেমটা গোল। কাচটা বেশ পুরু। সেকারণে চোখগুলো কেমন যেন অদ্ভুত ছোটো লাগে। ভয় লাগে। কাঁচাপাকা চুলের হুমায়ূনকে দেখে সে মনে করেছিল অনেক জ্ঞানী গোছের কেউ। কিন্তু কথাবার্তায় বুঝতে পারে আদতে সে গণ্ডমূর্খ। সোজা বাংলায় আবাল।
সে জানে আস্থা পাকাপোক্ত করতে আলাপের জুড়ি নেই। মুখ চেনাজানা হয়, নানান কথা আদানপ্রদান হয়, সম্পর্কটা মজবুত হয়। মজবুত সম্পর্ক এনে দেয় ‘আস্থা’। আর সে যে কাজ করতে এসেছে সেই কাজের জন্য আস্থা অর্জন করা খুব জরুরি। মৃত কেঁচো দেখিয়ে বড়শিতে মাছ ফাঁদা হয় সেটার প্রতি আস্থা অর্জন করার মাধ্যমেই। যে যত সহজে আস্থা অর্জন করতে পারে সে তত ভালো মাছ শিকারী।
আলাপের মাধ্যমে কারো আস্থা অর্জনের ক্ষেত্রে জাফরের ব্যক্তিগত মতামত হচ্ছে, আলাপের বিষয়বস্তু হতে হবে অপর ব্যক্তির অতীত আর সংসার। একমাত্র অতীতই অপরিবর্তনীয়। চাইলেও বদলানো যায় না। আর অতীত মানেই সেখানে থাকবে গোপন কিছু। জাতির গোপন অতীতের নাম হলো ‘পরাজিতদের ইতিহাস’, আর ব্যক্তিরটা ‘একান্ত ব্যক্তিগত’। আমরা যার যত বেশি ব্যক্তিগত অতীত জানতে পারি, সে আমাদের তত আপন হয়। আর যে আমাদের যত আপন, আমাদের প্রতি তার আস্থাও তত বেশি গাঢ়। যেমনটা দীঘির জল। যত বেশি গভীর জল তত বেশি কালো। আর সংসার হচ্ছে মানুষের সেই অংশ যাকে সে কখনো আলাদা করতে পারে না। আলাদা করতে পারে না বলেই, তার বেশিরভাগ ব্যক্তিগত ঘটনা এই সংসারকে ঘিরেই থাকে।
তাই জাফর সুযোগ পেলেই হুমায়ূনের সাথে আলাপ জুড়ে দেয়। হুমায়ূনের সাথে সখ্যতা হয়ে গেলে, হুমায়ূনের সাথে যার বেশি সখ্যতা তার আস্থা অর্জন করা আরও বেশি সহজ হয়ে যাবে। এটা অবশ্য অচেনা মেয়েদের ক্ষেত্রে সম্পর্ক গড়তে অনেক কাজে দেয়। একটা মেয়ে কখনো কারো প্রতি সহজে আস্থা রাখতে পারে না, কিন্তু যখনই দেখে তার পরিচিত কেউ সেই ব্যক্তির প্রতি আস্থা রেখেছে, তখন খুব দ্রুতই বিশ্বাস করে ফেলে। যেমনটা করেছিল আলেয়া।
আলেয়ার কথা মনে হতেই লকলকে জিহ্বাটাকে গাড়ির উইন্ডশিল্ডের মতো করে নাড়িয়ে ঠোঁট ভিজিয়ে নিলো। যেন এখনও সে তার ঠোঁটে পাচ্ছে আলেয়ার স্তনের বোঁটার স্পর্শ। মাছের মতো হা করে খেয়ে ফেলছে তার নরম স্তন। আঙুলে পাচ্ছে তার পেলব শরীরের উষ্ণ স্পর্শ। কিন্তু আলেয়ার মুখের কোনো মধুর কথা তার স্মৃতিতে নেই, আছে কেবল কিছু অর্থহীন গোঙানি—কারণ সে ছিল বোবা।
আলেয়ার স্মৃতিকে একপাশে রেখে এগিয়ে যায় হুমায়ূনের কাছে। সে এখন একা। একা মানেই ‘একান্ত ব্যক্তিগত’ জানার একান্ত সময়। হাশেম ভাই কোথাও গেছে। তাদের দুজনকে রেখে গেছে একটা নির্জন নদীর ধারে। হুহু করে বাতাস বইছে। ছন্দে ছন্দে ছলাৎ ছলাৎ শব্দে তীরে এসে আত্মাহুতি দিচ্ছে স্রোতের দল। হুমায়ূন তীরে বসে থেকে একদৃষ্টিতে তা দেখছে।
তার পাশে বসেই জাফর বলে উঠলো, “জানো, আমার একখান পে-পে-পেমিকা (প্রেমিকা) আছিল। নাম আছিল আলেয়া। খুব সো-সোন্দর দেখতে।” সে জানে গোপন কথা জানতে নিজেরও কিছু গোপন কথা জানাতে হয়। আর আলাপ এগিয়ে নিতে যে যেমন তার সাথে সে সেই ভঙ্গিতেই কথা বলে।
হুমায়ূন তার পুরু কাচের ভেতর থেকে জিজ্ঞাসু দৃষ্টি মেলে বলে, “হেয় কই এখন? দেখতেছি না যে?”
“এইখানে তারে পা-পা-বা কেমনে? সে আমার...কী বলে যেন...এক্স... এক্স গালফেন্ড।”
“সেক্স গালফেন্ড কী?”
“আরে সেক্স না, সেক্স না, এক্স...এ...এ...ক্স। মানে হইলো...” মাথা চুলকায় জাফর। সে শুধু জানে এক্স ইংরেজির একটা বর্ণ, এটার মানে যে কী সে ঠিক খেয়াল করতে পারছে না। সে খেয়াল করেনি যে এই এক্স (ex) বর্ণ এক্স (x) নয়। “এই ম-মনে করো, মইরা যাওয়া পেমিকারে কয় এক্স গালফেন্ড।” বলেই মনে মনে কয়েকটা গালি দেয় হুমায়ূনকে। এই নিয়ে প্রায় মাসখানেক সময় এই লোকের পিছনে সে ব্যয় করেছে। তেমন কিছু জানতে পারেনি। আজকেও যে পারবে বলে মনে হচ্ছে না। সে তার পুরু গোঁফটা আঙুল দিয়ে খস খস শব্দ করে বারকয়েক ঘষে।
“ও, আইচ্চা। কেমনে মরলো? প্যাটে বেদনা হইছিল?”
“আরে ধ্যাত। বা-বা-বাদ দেও আলেয়ার কথা। তো-তোমার কতা কও। তোমার কো-কোনো এক্স গালফেন্ড ছিল না?”
হুমায়ূন কিছুটা লজ্জা পায়। চোখ নামিয়ে ফেলে। ডান হাত দিয়ে খোঁচা খোঁচা দাঁড়ি ভরা ডান গাল চুলকাতে চুলকাতে বলে, “ইয়ে মানে, একখান আছিল। তয় তারে কখনো মনের কতা কইতে পারি নাই।”
জাফর মনে মনে তাকে আবার আরও কয়েকটা গালি দিয়ে ভাবে, “মনের কথাই বলতে পারিস নাই, এক্স গালফেন্ড হইলো কেমনে?’” মুখে বলে, “কেমন আছিল দেখতে?”
“খুব সোন্দর। কুমড়া পাকলে যেমন সোন্দর লাগে তেমন।”
জাফর হাসতে গিয়েও হাসে না। এখন হুমায়ূনের মুড নষ্ট করা যাবে না। সে বলে, “আইচ্চা, তার ক-কতা থা-থাউক, তোমার কতা কও। এই দলে ঢু-ঢুকলা কেমনে?”
“সে তো অনেক লম্বা এতিহাস। প্যাটে বেদনা হইছিল। রাস্তায় নাকি পইরা আছিলাম। হাশেম ভাই তুইলা আনছে। তারপর থাইকা তার লগে আছি।”
জাফর মনে মনে বলে, “আসলেই ‘অনেক লম্বা এতিহাস’,” মুখে দুঃখভাব ফুটিয়ে বলে, “ক্যা, তোমার ফ্যামিলিতে কেউ নাই?”
মাথা তুলে কিছুটা বিস্ময় নিয়ে বলে, “চামেলি কী? ফুল না?”
“আরে, চামেলি না, ফ্যা-ফ্যামিলি মানে হইলো প-পরিবার—মা-বাবা, ভাই-বোন এরা মিইলা হয় ফ্যামিলি।”
“ও...ছিল। শুধু আম্মা-আব্বা। ভাই-বোন নাই। আমার আম্মা মইরা যাওয়ার পর আব্বা নতুন বিয়া করছিল। জানেন, আমার আম্মা মইরা গেছিল প্যাট খারাপ হইয়া। খুব বেদনা উঠছিল। সারা রাইত পেট চাইপা ধইরা কান্দছে। বিছানার এপাশ থাইকা ওইপাশ গড়াগড়ি খাইছে। ফযরের আজানের সময় বেদনা থামছে, আম্মাও মরছে। আমারও তো প্যাট খারাপ হইছিল। আমি তো মরলাম না, হেয় মরলো ক্যান? বারবার কইছিলাম, ‘আম্মা, দুধ খাইছ না, দুধ খাইছ না।’ দুধ খাইয়াই মরলো।”
“দু-দুধ খাইয়া ম-মরছিল মানে?” কিছুটা বিস্ময় নিয়ে বলে জাফর।
“নতুন আম্মা দুধ দিছিল। অবশ্য তখনও নতুন আম্মা হয় নাই। আমাদের বাড়িত থাকতো। আব্বার কেমন যেন আত্মীয় হয়। সেই দুধ খাইয়াই তো তার বেদনা উঠলো। আব্বা কইছিল, খাঁটি দুধ হওয়ায় সমস্যা হইছিল। আমি তাই দুধে পানি দিয়া দুধ ভেজাল বানাইয়া খাই।”
“দুধ খাইয়া মরছে, সেইটা কেমন বুঝলা?”
“মরার পর তার মুখ দিয়ে ফেনার মতো দুধ বাইর হইছিল তো। খাঁটি দুধ আছিল তো, তাই।”
“তোমারেও খাঁটি দুধ দিছিল?” ভ্রু কুঁচকে বলে জাফর।
“হ, কিন্তু আমি পানি দিয়া ভেজাল কইরা খাইছিলাম। তবুও প্যাটে বেদনা উঠছিল। মনে হয় অজ্ঞান হয়ে গেছিলাম। জ্ঞান ফেরার পর চোখের সামনে হাশেম ভাইকে দেখি। উনি ক্যান জানি আর যাইতে দেন নাই। আমার সব কতা শুইনা কইছে, গেলে আবার প্যাটে বেদনা উঠবো।”
সব শুনে জাফর কিছুক্ষণ হুমায়ূনের মোটা কাচের দিকে তাকিয়ে থাকে। একজন মানুষ কী করে এতটা সহজ-সরল আর বোকা হতে পারে? দুজন মানুষের পরকীয়ার বলি যে হয়ে গেছে তার মা, এমনকী হতে ধরেছিল সে নিজেও, তা হয়তো কখনোই ধরতে পারবে না।
হুমায়ূন বলতে থাকে, “আমার আম্মা, আমারে খুব ভালোবাসতো। কখনো আমার প্যাটে বেদনা উঠতে দেয় নাই। আমার জন্য রাখা খাঁটি দুধ নিজে খাইয়া ফেলছে। বিছানায় যখন বেদনায় মোচড়ামুচড়ি করছে, তখনও আমার মাথায় হাত বুলাইয়া দিচ্ছিল আর কইতেছিল, ‘বাপ আমার, পলাইয়া যা, পলাইয়া যা’।” বলেই সে নিজের মাথায় হাত বুলায়।
জাফর উঠে দাঁড়ায়। প্যান্টের বালি ঝাড়তে ঝাড়তে বলে, “তো-তোমার বাসা কই ছিল?”
হুমায়ূন বলতে যেতেই হাশেম ভাই এসে দাঁড়ান। হাঁপাচ্ছেন। ধপ করে হুমায়ূনের পাশে বসে বলেন, “ আলাল জানিয়ে গেল যে একটা টাটকা লাশ পাওয়া গেছে। এই নদী ধরে এগুলেই হবে। দ্রুত হাঁটতে হবে। বাকিরা প্রায় পৌঁছে গেছে।”
হুমায়ূন লাফ দিয়ে উঠে বলে, “কতদিন টাটকা লাশের অভাবে ঘিলু খাওয়া হয় না। আম্মা কইছিল ঘিলু খাইলে ঘিলু হয়।”
হাশেম ভাই বললেন, “শুনলাম, লাশটার মুণ্ডু নাই। ঘিলু পাইবা না।”
☠
রাতের চাদর মুড়ি দিয়ে সূর্য ঘুমিয়ে গেছে। এখন পাহারায় বসেছে পূর্ণ চাঁদ। সেই চাঁদের আলোয় দ্রুতপদে হাঁটছে পশ্চিম দলের হাশেম ভাই, হুমায়ূন আর জাফর...এগিয়ে যাচ্ছে গল্পের এক পরিণতির দিকে।
এই প্রথম হুমায়ূনকে ভালোভাবে খেয়াল করে জাফর। তার হাঁটাচলা ঠিক পূর্ণবয়স্ক কারো মতো নয়। ছোটোবাচ্চার মতো হেলেদুলে হাঁটে। মাঝেমধ্যেই চলতে চলতে এদিকওদিক চলে যাচ্ছে। হাশেম ভাই ধমক দিয়ে তার পিছনে নিয়ে আসছেন। সে এগিয়ে যায়। হাশেম ভাইয়ের পাশে পাশে হাঁটতে হাঁটতে বলে, “ভাই, হু-হুমায়ূনের বু-বুদ্ধিশুদ্ধি এত কম ক্যা?”
হাশেম ভাই ভ্রু কুঞ্চিত করে বলেন, “তা দিয়া তোমার কী কাম?”
জাফর বুঝতে পারে যে সে ভুল প্রশ্ন করে ফেলেছে। তাই চটপট বলে, “না মানে, ওর বাবা-মায়ের কতা ক-ক-কইতে ছিল তো তাই ব-বলতেছিলাম।”
এবার হাশেম ভাই হুমায়ূনের দিকে বিরক্তি নিয়ে তাকিয়ে বলেন, “এই হুমায়ূন, যা তো সামনে যা।”
হুমায়ূন কিছুটা দৌড় দিয়ে সামনে এগিয়ে যায়।
এবার হাশেম ভাই হাঁটতে হাঁটতে জাফরের দিকে তাকিয়ে বলে, “এত তাড়াতাড়ি ওর বাবা-মায়ের কথা তোমার জানা উচিত হয় নাই। কারো ব্যক্তিগত ব্যাপারে শবখাদকরা নাক গলায় না। তোমারও গলানো উচিত হয় নাই। এখন যখন গলাইয়েই ফেলাইছো, তাই কই, সহজে বোঝা যায় না যে ও একটা বুদ্ধিপ্রতিবন্ধী। কখন কী বলে, কী করে ঠিক নাই। ওরে যখন পাই তখন ও আধমরা। অনেক কষ্ট হইছে বাঁচাইতে। ওর বাপ যদি ওর খবর পায় তাহলে এবার আর আগের ভুল করবে না। মাইরাই ফেলবে। তাই আমি চাই না তুমি ওরে নিয়ে আর ঘাঁটাঘাঁটি করো। বুঝতে পারছো?”
ঢোঁক গেলে জাফর। সাপের গর্তে হাত দিয়ে ফেলেছে। বিগত কয়েক মাসের পরিশ্রম যে-কোনো সময় ভেস্তে যেতে পারে। সে ভীত চোখে মাথা ঝাঁকাতে ঝাঁকাতে বলে, “না, ভাই আ-আমি আর ঘাঁটাঘাঁটি করমু না, করমু না। একা একা ছিলাম, তাই আ-আলাপ ক-করতেছিলাম। এই আরকি। হেহে...” হেসে সে পরিবেশ হালকা করার চেষ্টা করে।
হাশেম ভাই কিছু বলে না, সামনে তাকায়। তার অনেক তাড়া।
জাফর মনে মনে ঠিক করে, যা করার আজকেই করবে। আর সময় নষ্ট করতে সে চায় না। তারও অনেক তাড়া।
☠
জাফর এসেই সুযোগ খুঁজছিল কীভাবে আলাদা হওয়া যায়। সুযোগ পেতে বেশি দেরি হয়নি। দলে নতুন হিসাবে তার ঘাড়ে চাপিয়ে দেওয়া হয়েছে বাজার-সদাই করার দায়িত্ব। সে-ও হাসিমুখে নিয়েছে। বাজারে যাওয়ার আগে সে হুমায়ূনের কাছে আরেকবার যায়, কিছু কথাবার্তা বলে বিদায় নেয়। যদি কাজ ঠিকঠাকমতো হয়, তাহলে এটাই জীবিত অবস্থায় তার সাথে শেষ দেখা।
বাজারে এসেই লুকিয়ে রাখা ফোনটা দিয়ে বিষাণদের দলকে ডেকে আনে। এই দলটার প্রধান ছাদেক দফাদারের চেহারায় বিরক্তি। সেটাই স্বাভাবিক। তার দলকে জাফর আর্জেন্ট কল দিয়ে ডেকে এনেছে।
যতটা পারা যায় অল্প কথায় সে ছাদেকের দলকে সব বুঝিয়ে বলে। অভিজ্ঞ ছাদেকের সব দ্রুত বুঝে নিতে কোনো সমস্যা হয় না। সে তার দলের বাকিদের দায়িত্ব ভাগ করে দেয়।
যখন তাদের কোনো স্পাই কোনো শবখাদকদের দলের খবর নিয়ে আসে তখন ফাঁদে ফেলে শিকার করাটা অনেক সহজ হয়ে যায়। একদম অচেনা কোনো শবখাদকদের দলকে শিকার করা খুব কঠিন। কে কখন কোনখানে ঘাপটি মেরে লুকিয়ে থাকে তা সহজে বের করা যায় না। সেক্ষেত্রে অনেক শবখাদক আঙুলের ফাঁক গলিয়ে পালিয়ে যায়। আর ফিরে আসে ঘাতক হয়ে। যেভাবে শিকারির গুলিতে আহত বাঘ ফেরে নরখাদক হয়ে।
দূর থেকে পুরো দলটার অবস্থান বুঝে নেয় ছাদেক। চাঁদের আলোয় দূর থেকে শবখাদকদের দলের সবাইকে তেমন বোঝা যাচ্ছে না। কেবল বোঝা যাচ্ছে তারা একটা গর্ত খুঁড়ছে। অল্প দূরত্বের মধ্যেই অবস্থান করছে সবাই। আর জাফর বলে দিয়েছে এই কজনের বাইরে আর কেউ নেই। বলা যায়, ব্যাপারটা অনেক সৌভাগ্যের।
জাফরকে নিজের সাথে নিয়ে বাকিদের বৃত্তাকারে ছড়িয়ে যেতে বলে ছাদেক। আর শিঙার কথা সবাইকে আবার মনে করিয়ে দেয়। সংকেত পেলেই কেবল আক্রমণ করতে হবে। ভুল যেন না হয় সে কথাটাও বুঝিয়ে দিতে থাকে বারবার। একটা গভীর শ্বাস নিয়ে এগিয়ে যাওয়া শুরু করে সে। আজকে একটা বড়ো দাঁও মারা হবে।
জাফর অনেক অস্থির হয়ে আছে। কেউ টের পাওয়ার আগেই তাকে তার কাজ শেষ করতে হবে। ভুল করা যাবে না। আজকের সফলতার ওপরেই নির্ভর করছে তার আগামীদিনের ভবিষ্যৎ। ডাঁট ছুড়ে মারার ব্লোপাইপটা মুঠোর মধ্যে শক্ত করে রেখেছে। এটাই এখন তার ভবিষ্যৎ লেখার কলম। নিখুঁত সই এখনও তার আয়ত্বে আসেনি, তবে মোটামুটি ঠিকভাবেই লক্ষ্যভেদ করতে পারে। প্রশিক্ষণ শেষে তার স্কোর ছিল দশে সাত।
সমস্যা হচ্ছে এখন সে কোনো প্রশিক্ষণের ডামি পুতুলের ওপর ডাঁট মারবে না, সে মারবে জ্যান্ত মানুষের ওপর। তার হৃদপিণ্ড দাপাদাপি শুরু করে দিয়েছে। বুক ফেঁড়ে বেরিয়ে আসতে চাইছে। বারবার হাতের মুঠো আলগা আর শক্ত করছে। যেন ওটাই হয়ে গেছে হৃদপিণ্ড। হাত ঘেমে যাচ্ছে। কপাল বেয়ে সাপের মতো একেবেঁকে নামছে ঘাম। কাশবনের মধ্য দিয়ে যতটা সম্ভব নিচু হয়ে চুপচাপ চলছে। এরইমধ্যে ছাদেক দফাদার দুবার পিছন ফিরে তাকে সাবধান করে দিয়েছে। ছাদেকের মতো তার মাথাতেও শোভা পাচ্ছে লাল কাপড়, তাতে আঁকা সাদা শিঙা। তবে বাকি বিষাণদের মতো তার হাতে কোনো শিঙা নেই। বিষাণরা বাড়তি শিঙা নিয়ে ঘোরে না। মাঝেমধ্যে প্রয়োজনে একাধিক ব্লোপাইপ রাখে। সেগুলোরই একটা তার হাতে শোভা পাচ্ছে।
ছাদেক ঠিক যখনই শিঙা ফুঁ দিলো ঠিক তখনই সে একটা ডাঁট ছুড়ে মারলো ছ’ফিট তিন ইঞ্চি লম্বা ঝাঁকড়া চুলের শবঘাতক সামাদকে লক্ষ্য করে। আজকের সবচেয়ে সহজ লক্ষ্য। সে যত শবখাদক মারবে ততগুলো সাফল্যের পালক তার মুকুটে জুড়বে। এই হিসাবটা সহজে করার জন্য প্রতিটা বিষাণের ডাঁটগুলো আলাদা আলাদা রঙের হয়। তার ডাঁটটা উজ্জ্বল সবুজ রঙের। চাঁদের সাদাকালো আলোয় সেটাকে দেখাচ্ছে হালকা ধূসর।
তার ডাঁট ছুড়ে মারা দেখে শিঙায় ফুঁ দেওয়া শেষে ছাদেক প্রচণ্ড বিরক্তি নিয়ে তাকালো। দুজন ইতোমধ্যে শুয়ে পড়েছে। ছাদেক ধারণা করলো, দলের মাথা ওদেরই কেউ একজন, আর ওই দুজনই বিষাণদের ব্যাপারে অভিজ্ঞ। আর দলের মাথাকে বিষ মাখা ডাঁট নয়, অজ্ঞান করার ডাঁট মারতে হয় যাতে জিজ্ঞাসাবাদের জন্য ধরা যায়। কিন্তু কথা হচ্ছে, আর্জেন্ট কল’র মাধ্যমে ওপর থেকে তাকে জানিয়ে দেওয়া হয়েছে আজকে কাউকেই পাকড়াও করা হবে না। সবাইকেই বিষমাখা ডাঁট মারতে হবে। সে জানে তার দলের বাকিরা ব্যাপারটা জানে। আজ এই দলের সব শবখাদকরা অতীত হয়ে যাবে।
বেশ কিছুক্ষণ হয়ে গেছে আক্রমণের। ক্রমে ক্রমে তারা বৃত্তটাকে ছোটো করে আনছে। জাফর এবার খুঁজছে তার আসল লক্ষ্যকে।
সমস্যা হচ্ছে ছাদেক তাকে কোনোভাবেই একা ছাড়ছে না। বুঝতে পারছে শুরুর ভুলের পুনরাবৃত্তি আবার সে চাচ্ছে না। তারওপর সবাইকে মারার আদেশ পেয়েছে। তাই একটাও যাতে পালিয়ে না যায় সেদিকেও তার খেয়াল রাখতে হচ্ছে।
সবকিছু হুট করে চুপচাপ হয়ে যাবার কিছুক্ষণ পর জাফর কিছু একটা নড়ে ওঠা দেখতে পেল। কাশবনের ভেতরে কেউ চক্রাকারে কিছু একটা ঘোরাচ্ছে। সে জানে একই দৃশ্য দেখছে ছাদেকও। আর দুজনেই জানে যে চক্রাকারে ঘোরাচ্ছে সে তাদের কী বোঝাতে চাইছে। কিন্তু দুজনের মধ্যে কেবল জাফর জানে কে ঘোরাচ্ছে, তার একমাত্র লক্ষ্য। তার হাতে এখন সুযোগ একটাই। ছাদেক তাকে থামিয়ে দেওয়ার আগেই সে ছুঁড়ে মারে ডাঁট তার একমাত্র লক্ষ্যের দিকে, যার জন্য এত পরিশ্রম—আর তার একমাত্র লক্ষ্য কোনো শবখাদক নয়, বরং শবখাদকদের ঘাতক মজিদ মিয়া।
দ্বিতীয় ডাঁট ছোঁড়ার আগেই ছাদেক তাকে থামিয়ে দেয়। বলে ওঠে, “ওইটা আমাদের লোক, আর ছুঁড়িস না।”
জাফর দাঁত চেপে নিজেকে সামলায়। এখন আর দ্বিতীয়বার ডাঁট ছোড়া যাবে না। নইলে সব ফাঁস হয়ে যাবে। তার মনে একটা ক্ষীণ আশা ছিল যে হয়তো ডাঁটটা মজিদ মিয়ার গায়ে লেগেছে। কিন্তু তার আশায় জল ঢেলে দিয়ে দুটি ছায়ামূর্তি প্রাণপণে দৌড়াতে থাকে কাশের ঝোপ দিয়ে।
এবার ছায়ামূর্তির একটাকে ছাদেক চিনতে পেরে নিচের ঠোঁট কামড়ে ধরে বিড়বিড় করে বলে, “ওস্তাদের কাছে মিসটেকের জন্য মাফি (ক্ষমা) চেয়ে নিতে হবে।” তবে সে দ্রুতই ভুলে গেল যে সে ছায়ামূর্তি একটা নয়, দুটোকে দেখেছে।
সবকটা লাশ পুঁতে ফেলার সময় জাফর হুমায়ূনের লাশের কাছে হাঁটু গেঁড়ে বসে। কিছু একটা বিড়বিড় করে বলতে বলতে পুরু কাচের চশমাটা নিজের বুকপকেটে রেখে দেয়।
ছাদেক তাকে ডেকে বলে, “কালকে অবশ্যই ওস্তাদ মজিদের কাছে যেয়ে মাফি চেয়ে নিবা। ওস্তাদের ঠিকানা হলো...”
জাফর আর দেরি করতে চায় না। দ্রুত ঠিকানা শুনে নেয়। তাকে এখনই রিপোর্ট করতে হবে। আরও একটা কাজ বাকি রয়ে গেছে। সেটা আজ রাতেই শেষ করতে হবে।
সে সবাইকে রেখে দূরে এসে কল করে ওপাশে সব জানায়। ওপাশ থেকে রাশভারী কণ্ঠটা বলে, “আমার বোঝা উচিত ছিল যে তুমি একটা আস্ত অপদার্থ। এখন কীভাবে এই পরিস্থিতি সামাল দেবে? আর কবেই বা পরের সুযোগ আসবে?”
জাফর জানে তোষামোদির সময় এখন আর নেই, এখন সময় মাফ চাওয়ার। ছোটো কিন্তু অনেক বড়ো একটা কাজ দেওয়া হয়েছিল তাকে। মজিদকে মেরে ফেলতে হবে। আর মারতে হবে এমনভাবে যেন সেটা একটা দুর্ঘটনা হয়। আর শবখাদকদের মারতে গিয়ে তাদের ভেতর লুকিয়ে থাকা একজন বিষাণ মারা যেতেই পারে। এটা বিশ্বাসযোগ্য দুর্ঘটনা। কিন্তু সেই সুযোগটা ফসকে গেছে। পাশে যদি ছাদেক দফাদার না থাকতো তাহলে ফসকে যাওয়ার কোনো সম্ভাবনা ছিল না।
সে মেকি কাঁদোকাঁদো সুরে ক্ষমা চায়। বলে পরেরবার এই ভুল কোনোভাবেই হবে না। ওপাশ থেকে আরও কিছু গরম বাক্য তার কানের পর্দা ভেদ করে মস্তিষ্ককে জ্বালিয়ে দিয়ে ক্ষান্ত হয়। মোবাইলটা রাখার পর ভাবে ক্ষমতা মানুষকে কোন পর্যায়ে নামিয়ে নিয়ে আসে। ক্ষমতা দখলের লড়াইয়ে এগিয়ে থাকতে বিষাণদের প্রধান তাকে ঠিক করেছে আরেক অঘোষিত প্রধানকে মেরে ফেলার জন্য। বিনিময়ে সে পাবে কেস থেকে মুক্তি। কেসের কথা মনে হতেই সে হারিয়ে যায় তার স্মৃতির সাগরে। আলেয়ার সাগরে...
☠
আলেয়াকে সে ঠিক ভালোবেসেছিল কিনা তা মনে করতে পারে না। একজন বোবা মেয়েকে কে ভালোবাসবে? সব মানুষই তার ভালোবাসার মানুষের কাছ থেকে মধুর বুলি শুনতে চায়। খুনসুটি করতে চায়। ঝগড়া করতে চায়। সে-ও হয়তো তাই চেয়েছিল। কিন্তু পারেনি। বোবা মেয়েটাকে নিয়েই জীবন সাগরে ভাসতে চেয়েছিল।
সে ছিল তার গ্রামের চেয়ারম্যানের খাসচামচা। আর বেশিরভাগ চেয়ারম্যানের মতোই তার চেয়ারম্যান শামসুলও ক্ষমতার অপব্যবহার করতে ভোলেনি।
তার এখনও মনে পড়ে সেই দিনটার কথা। চেয়ারম্যান তাকে ডেকে বলে, “জাফর, তুই তো জানিস আমি তোরে কতটা বিশ্বাস করি। তাই তোর ওপর একটি গুরুত্বপূর্ণ দায়িত্ব দিতে চাই।”
জাফর তার পুরু গোঁফের ঘষতে ঘষতে বলল, “জি হুজুর, বলেন। আপনার জন্য জা-জান হা-হাজির।” সে মাত্রই তিনদিনের যাত্রাপালা দেখে গ্রামে এসেছে। অনেক ক্লান্ত, কিন্তু হুকুম না মানা ছাড়া উপায় নাই।
“জান-টান দিতে হবে না। শুধু একটা কাজ করে দিলেই হবে।”
“আপনে খালি হু-হুকুম করেন হুজুর। একটা ক্যা-ক্যান, হা-হাজারটা কাজ করে ফেলবো।”
“ভেতরে একখান লাশ আছে। বস্তায় বেঁধে পুঁতে ফেলবা। কাকপক্ষীও যেন টের না পায়।”
“কী যে ব-বলেন হুজুর। কাকপক্ষী তো দূ-দূরের ব্যাপার। আমিও নিজেই টের পা-পাবো না। হেহে।”
“হইছে, অত তেল মারা লাগবে না। আমার সাথে আসো।” বলে চেয়ারম্যান ঘরের ভেতরে ঢোকে। জাফরও তার পিছু পিছু যেতে থাকে।
চলতে চলতেই চেয়ারম্যান বলে ওঠে, “কও তো জাফর, একটা বোবাকে রেপ কইরা কী করতে হয়?”
“কী হুজুর?”
“আঙুল কাইটা দিতে হয়।”
জাফর কিছুটা অবাক হয়ে বলে, “ক্যা হুজুর?”
“যাতে সে কাউরে কইতে না পারে।” বলেই হো হো করে হাসতে থাকে চেয়ারম্যান।
জাফর ঠিকভাবে ধরতে না পারলেও সে তাল মেলাতে হোহো করে হাসতে থাকে। আলেয়ার কথা মনে যায়, সে হাত দিয়ে ইশারায় কথা বলে আর অর্থহীন গো গো আওয়াজ করে। এবার ব্যাপারটা বুঝে আরেকদফা হেসে নেয়।
একদম ভেতরের ঘরের বদ্ধ দরজার সামনে এসে চেয়ারম্যান দাঁড়ায়। এই বাড়িটায় চেয়ারম্যান আর তার সাঙ্গোপাঙ্গ ছাড়া আর কেউ থাকে না। এটা তাদের গোপন আস্তানা। গমসহ যত রকমের সরকারি অনুদান আসে সবকিছুর ঠাঁই হয় এখানে। অল্প কয়েকটা দানা ছিটানো হয় গ্রামে। সেই অল্প কয়েকটা দানায় যেসব মানুষ সন্তুষ্ট হয় না তাদের এখানে এনে ডলা দেওয়া হয়। বেশি ঝামেলা করলে আজকের মতো মেরে পুঁতে ফেলাও হয়। সে নিজেই দুইটাকে পুঁতেছে। একটাকে মেরেছিল বল্লম ছুঁড়ে। উঠানে এখনও সেই বল্লমটা রাখা আছে। তার নিজের সাহসের দ্যুতি ছড়ায় ওটা। আজকে সে আস্তানায় চেয়ারম্যানকে ছাড়া আর কাউকে দেখছেও না।
চেয়ারম্যান ধাক্কা দিয়ে কাঠের দরজাটা খুলতেই বোটকা একটা গন্ধ তার নাকে এসে লাগে। অন্ধকার রুম। চোখ সয়ে আসতেই চমকে ওঠে সে। জানত লাশ দেখবে, তারপরও নিজেকে সামলাতে পারলো না। চেয়ারম্যান লাইটের সুইচটা চাপ দিতেই ভয়ংকর দৃশ্যটার চোখে পড়লো।
চাপ চাপ রক্তে চারপাশ ভরে আছে। দেওয়াল ভরে গেছে রক্তের ছিটার দাগে। মেঝেতে ছড়িয়ে ছিটিয়ে আছে বেশ কটা কাটা আঙুল। আর লাশটা পড়ে আছে রুমের এককোণায় থাকা বিছানার ওপর। লাশটা একটা মেয়ের। উপুড় হয়ে আছে। কেবল দেহ নয়, তার প্রাণটাকেও উপভোগ করেছে চেয়ারম্যান।
একটা অজানা আশংকাকে পরখ করতে কিছুটা দৌড়ে গিয়ে লাশটা উলটায়। তার আশংকাকে সত্যি করে দেয় লাশটা। ওটা আলেয়ারই লাশ। লাশের গায়ে কাপড়ের বদলে আছে ক্ষতের পরত। জাফরের চারপাশটা যেন দুলে ওঠে। সে আলেয়ার লাশটাকে বুকে নেয়। চেপে ধরে। আলেয়ার মুখটাকে তার কানের কাছে নেয়। চিরচেনা সেই গো গো শব্দ যদি শোনা যায় এই আশায়।
চেয়ারম্যান খানিকটা বিস্মিত আর বিরক্তি নিয়ে বলে, “কী করতাছোস জাফর? গত পরশু ধইরা আনছিলাম। আইজ সকালের দিকেই মনে হয় মরছে। এখন তো সন্ধ্যা হয়ে গেছে। এখনও কি আর বাঁইচা আছে? মাগির কৈমাছের প্রাণ। খালি গোঁ-গোঁ শব্দ করতেছিল। চুইদা মজা পাই নাই। শীৎকার ছাড়া কী আর চুদে মজা আছে, বল? সেলিম আর রুবেল দুইটা একটা আস্ত বোকাচোদা। এইটারে ধইরা আনছে। যখন চুইদা মজা পাইতেছিলাম না তখন সেই কৌতুকটা একটু বাস্তব করার টেরাই (ট্রাই) করছিলাম এই আরকি। এইকারণে রুমটা একেবারে নোংরা হইয়া গেছে। বাকিদের বাড়িত পাঠায় দিয়া কেবল সেলিম আর রুবেলকে পাঠাইছি ঘর পরিষ্কার করার জিনিসপাতি আনতে। তুই যা পুঁতে দিয়ে আয়। কী রে? কথা কস না ক্যান? এখনও লাশটাকে চাইপা ধইরা আছোস ক্যা?”
চেয়ারম্যান কিছুটা অবাক হয়েই চুপ হয়ে যায়। পরক্ষণেই বলে ওঠে, “জানোস, সেলিম কি কামটা করছে?” বলে একটা রক্তমাখা লাটি হাতে নিয়ে বলে, “এইটা ওর ভোঁদায় ঢুকাই দিছিল। অ্যা-অ্যা কইরা সে কী চিক্কুর পারছে রে ভাই। বোবা তো, অত মজা পাওয়া যায় নাই। দুই হাত এক কইরা কতবার যে মাফ চাইছে কী আর বলবো। চোখ দিয়া গল গল কইরা জল ফেলাইছে, অই জল যদি ভোঁদা দিয়া ফেলাইতো, তাইলেই না বেশি মজা হইতো। এইসব দেইখা রুবেলও কি চুপ থাইকা পারে? সে লাঠিটা ভোঁদা থাইকা বাইর কইরা গোয়ায় ঢুকাইছে। তখন অবশ্য সেলিম ওরে চাইপা ধইরা ছিল। তখন যদি মাগিটার চোখগুলা দেখতিরে ভাই, রসগোল্লার মতো বড়ো হইয়া গেছিল। আমি অবশ্য ওদের এসব কীর্তি দেখার পর আঙুল কাটছিলাম। তুই থাকলে কী করতিরে জাফর...?”
জাফর গমগমে স্বরে বলে, “চুপ...চু-উ-প...আমার আলেয়া কিছু কইতেছে, তুই চু-চু-প হ।”
চেয়ারম্যান শামসুল খোশমেজাজে আছে, তাই তাৎক্ষণিক কোনো প্রতিক্রিয়া দেখালো না। তাই কৌতুকস্বরে বলল, “কী কইতেছে মুর্দা মাগিটা? আই লাব ইউ? হাহা।”
জাফর যেন শুনতে পায়, অনেক দূর থেকে আলেয়ার গোঁ-গোঁ আওয়াজ ভেসে আসছে। অর্থহীন আওয়াজগুলো আস্তে আস্তে অর্থবোধক হয়ে যাচ্ছে। এবার যেন সে বুঝতে পারছে আলেয়া কী বলতে চাচ্ছে...আলেয়া বলছে, “তোমার লগে ঘর বান্ধতে পারলাম না...”
চেয়ারম্যান এবার বিরক্ত হয়ে জাফরকে ঝাঁকি দেয়। জাফরের যেন ঘোর ভেঙে যায়। ঝট করে উঠে দাঁড়ায়। ইতিউতি তাকায়। মেঝেতে পড়ে আছে লম্বা ছুরিটা। ওটা দিয়েই কেটে নিয়েছে আলেয়ার স্তন, পোঁচ দিয়েছে বাহুতে, তালুতে, বুকে, উরুতে—সবখানে। কেটে নিয়েছে হাতের সবকটা আঙুল।
ছুরি হাতে নিয়ে ঘুরে দাঁড়ায় চেয়ারম্যানের দিকে। অভিজ্ঞ শামসুল বুঝতে পারে অবস্থাটা ঠিক সুবিধার না। ধমকের সুরে কিন্তু ভীতকণ্ঠে বলে, “এই জাফর...তুই এমন করতাছোস ক্যা? তুই মজা নিতে পাস নাই তো কী হইছে? দ্যাশে কি মাইয়ার অভাব? পুঁতে রেখে আয়, কাল আরও মাইয়া আনবোনে। তুই একলাই চুদিস। মাথা গরম করিস না...”
জাফর পাগলের মতো ছুরি চালায়। চেয়ারম্যান হাত দিয়ে নিজেকে বাঁচাতে গেলে ডান হাতের তিনটা আঙুল ছুরির কোপে পড়ে যায়। চিৎকার দিয়ে ওঠে সে। জাফর আবার ছুরি চালায়, এবার বাম হাতের দুটো আঙুল পড়ে যায়। ভয়ে পেছাতে গিয়ে মেঝের রক্তে পিছলে পড়ে শামসুল। মরিয়া হয়ে আঙুল কাটা দিয়েই নিজেকে বাঁচানোর চেষ্টা করে। কিন্তু জাফরের মধ্যে ক্ষোভ যেন আগ্নেয়গিরি হয়ে ফুঁসে উঠছে। কিছুই তাকে আজকে থামাতে পারবে না। সে শামসুলের বুকের ওপর চেপে বসে। ডানহাতের কব্জি মেঝেতে চেপে ধরে বাকি দুটো আঙুলও ফেলে দেয়। যন্ত্রণায় জাফরকে সরিয়ে দিতে চায়। কিন্তু পারে না। এবার জাফর বাম হাত মেঝেতে চেপে তিনটা আঙুল একটা একটা করে তিন কোপে ফেলে দেয়। শামসুল এবার আর সহ্য করতে পারে না। চেতনা হারায়। জাফরের সেদিকে ভ্রূক্ষেপ নেই। সে দুহাত দিয়ে ছুরির হাতল চেপে ধরে সজোরে নামিয়ে আনে শামসুলের ঠিক হৃদপিণ্ড বরাবর। ধড়ফড় করে অচেতন দেহ। চেতনা লুপ্ত হলেও দেহটা ঠিকই সজাগ। কাটা মুরগির মতো কিছুক্ষণ সেটা দাপাদাপি করে। অচেতন অবস্থাতেই শামসুল তার পাপের প্রায়শ্চিত্ত করে।
এভাবে ঠিক কতক্ষণ কেটে গেছে জাফর তা মনে করতে পারে না। তার সংবিৎ ফেরে কারো ডাকে। ডাকটা খেয়াল করলে বুঝতে পারে, ডাকটা আসছে বাইরে থেকে আর সেটা সেলিমের। বের হবার আর ঢোকার রাস্তা একটাই হওয়ায় সেলিম ঘরে ঢোকার আগেই সে বের হতে যায়। তার শরীর রক্তমাখা, সেটা দেখে সেলিম কিছু বলতে গিয়েও থেমে গেল। ভাবলো, জাফর হয়তো রুমটা পরিষ্কার করছিল সেকারণে তার ওই অবস্থা। কিন্তু সে মোটেও খেয়াল করলো না যে জাফরের হাতে একটা রক্তাক্ত ছুরিও আছে।
পরের পর্ব : ক্লিক করুন
ম্যাচিউর কন্টেন্ট | ভায়োলেন্স | PG 18+
গত পর্ব : ক্লিক করুন
এতক্ষণে মজিদ মিয়ার খেয়াল হলো। মাটি থেকে বস্তাটা তুলে ছাদেকের দিকে বাড়িয়ে দিয়ে বলল, “পাষণ্ড জালালের মুণ্ডু।”
ছাদেক আঁতকে উঠে বলে, “কন কী? ওর মুণ্ডু কই পাইলেন?”
সব খুলে বলার পর মজিদ মিয়া বলল, “এইটা আর চরে থাকা লাশের বাকি অংশ নিয়া ময়নাতদন্ত করাবা। কোনো ক্লু পাও কিনা দেখো। কে খুন করছে এইটা জানা খুব দরকার।”
বিষাণদের নিজস্ব ল্যাব আছে। তাতে তারা নিজস্ব অস্ত্র বানায়। প্রয়োজনে ময়নাতদন্ত করে। গবেষণা করে বিভিন্ন বিষয়ে।
বস্তাটা নিতে নিতে ছাদেক বলে, “এইটা যে জালালের হেড সেটা বুঝলেন কেমনে? জানি আপনি তারে সবচেয়ে ভালো চেনেন, তাও...”
“কপালে লেইখা দিছে খুনি। আর চরে যে লাশটা খাইতে গেছিলাম সেইটা জালালের বডি আছিল। বুকের কাটা দাগ দেইখা বুঝছি। আর আঙুল তো কাটা ছিলই। আশেপাশে আরও লাশ থাকার কথা। ও তো একা একা চলাফেরা করতো না। পাও নাই?”
ছাদেক অবাক হয়ে বলল, “এইটা অদ্ভুত ব্যাপার। ভেরি স্ট্রেঞ্জ। আপনার দলের বাইরের আর কারো লাশ পাই নাই। জালাল একা একাই গেল?”
“কোথাও কিছু ঘাপলা আছে, যেইটা আমরা ধরতে পারতেছি না। তুমি এইটারে গুরুত্বসহকারে দেখো। বিষয়টা আমার কাছে কেমন যেন ঘোলাটে লাগতেছে। কিছু একটা ঠিক নাই। মিল খাইতেছে না। আর সবাইরে সাবধান কইরা দেও। জালাল মরায় তার দল এখন খুব ক্ষেইপা উঠবো। বাইড়া যাইবো আমাদের ওপর হামলার পরিমাণ।”
স্যালুট দেওয়ার ভঙ্গি করে ছাদেক বলে, “সেকেন্ড বস আদেশ দিয়েছেন, আমি অবশ্যই দেখবো। আর বাকিদের সাবধানও করে দেবো।”
এসময় আকাশ ডেকে উঠলো ভয়ানকভাবে। দুজনেই চমকে উঠলো।
নিজেকে সামলে নিয়ে মজিদ মিয়া বলল, “দেরি হইয়া যাইতেছে। সদাই কইরা ফিরতে হইবো। ছেলেটাকে একলা রাইখা আসছি। যাও অহন। অগ্রগতি জানাইয়ো। আর বসকে আমার সালাম দিও।”
“ইয়েস সেকেন্ড বস।” মুণ্ডুর বস্তাটা নিয়ে চলে যায় ছাদেক দফাদার।
দুজন আলাদা হতে না হতেই আকাশ কালো করে মুষলধারে বৃষ্টি পড়া শুরু হলো। সেইসাথে বজ্রপাত চলছে সমানতালে। চারদিক একদম অন্ধকার হয়ে এসেছে। তাই বজ্রপাতের আলোয় যেন ঝলসে উঠছে চারপাশ।
সদাই করে কাকভেজা হয়ে বাড়ির উঠানে পা রাখতেই চমকে উঠলো মজিদ মিয়া। পিছন ফিরে স্থির হয়ে দাঁড়িয়ে আছে ছেলেটা। ভিজে একদম চুপসে আছে। গায়ে লেপটে আছে কাপড়।
মাটিতে পড়ে আছে কেউ—যার বুকে আমূল বিঁধে আছে ছুরি। বৃষ্টির তোড়ে চারপাশ থই থই করছে পানিতে।
মাথা ঘুরিয়ে পিছনে তাকালো ছেলেটা। এসময় কড়কড় শব্দে বাজ পড়লো। আলোয় উদ্ভাসিত হলো চারপাশ। সেই আলোয় দেখা গেল সরলমনা হাসির ছেলেটার মুখে ঠোঁট বাঁকানো ক্রুর হাসি। গমগমে স্বরে বলল, “ওরে কইতো হইতো, ‘তুই বাইচা আছোস?’, কিন্তু কইছে ‘তুই মরস নাই?’...জা-ফর ...মী-র...মীর-জা-ফ-র...”
দুহাত ওপরে তুলে অট্টহাসিতে ফেটে পড়ে সে। বজ্রপাতের কড়কড় শব্দ ছাপিয়ে সেই শব্দ যেন হিম করে দেয় মজিদ মিয়ার হৃদপিণ্ড।
কাঠের ঘোড়ার গল্প
জাফরের গল্প
“জাফর, তোমাকে একটা গুরুত্বপূর্ণ দায়িত্ব দিতে চাই।” চেয়ারে গা এলিয়ে দিতে দিতে রাশভারী কণ্ঠের কেউ একজন বলল। ক্যাচ ক্যাচ শব্দে চেয়ার জানান দিল নিজের অস্তিত্বের। কংক্রিটের বিশাল রুমটায় আধখোলা জানালার কল্যাণে এক ভূতুড়ে আলোআঁধারি পরিবেশের সৃষ্টি করেছে।
পুরু গোঁফওয়ালা জাফর নাকের নিচটা ঘষতে ঘষতে বলল, “জি হুজুর, বলেন। আপনার জন্য জা-জান হা-হাজির।”
“জান-টান দিতে হবে না।” কণ্ঠস্বর নামিয়ে, “কিন্তু জান নিতে হবে।”
“আপনে খালি হু-হুকুম করেন হুজুর। জান নিতে নিতে সাগর রক্তে লালে লাল করে ফে-ফে-ফেলব।”
“সাগর লাল করতে হবে না। একটা নিতে হবে কেবল।”
“জি হুজুর, বলেন কার জা-জান নিতে হবে, আমি আপনার পায়ের তলায় এ-এ-এখনই এনে দি-দিচ্ছি।”
“আহ, তোষামোদি থামাও। বুদ্ধিকে কাজে লাগাও। যা যা বলি মনোযোগ দিয়ে শোনো। পরিকল্পনা একটু এদিকওদিক হলেই ভেস্তে যাবে। তাই বুদ্ধিটাকে ঠিকঠাকভাবে কাজে লাগাবা।”
“জি হুজুর, আপনার জন্য জান হা-হাজির।”
“তোমাকে যে দলে নেওয়া হয়েছে সেটা এখন পর্যন্ত আমি আর আমার কাছের অল্প কয়েকজন ছাড়া আর কেউ জানে না। যদি এই কাজটা করে দিতে পারো তাহলে তোমার জন্য উজ্জ্বল ভবিষ্যৎ অপেক্ষা করবে। তাই আবারও বলছি ধৈর্য ধরে ধীরেসুস্থে এগোবা। কাজটা যে-করেই হোক হওয়া চাই।”
“জি হুজুর, দ-দরকার হয় চল্লিশ ব-বছর ধৈর্য ধরব। তারপরও কাজটা সফল ক-ক-রেই ছাড়ব।”
এবার রাশভারী কণ্ঠের ব্যক্তিটি পিঠ টান টান করে বসলেন। নরম গদির চেয়ারটাও ক্যাচ ক্যাচ শব্দ করে তাকে অনুসরণ করলো। কাঠের টেবিলের ওপর বসানো কাচে প্রতিফলিত হচ্ছে তার প্রশস্ত কপালের চেহারা। সেই চেহারা বিরক্তিতে কুঁচকে আছে। তিক্ত স্বরে বললেন, “এত তোষামোদির তো কোনো কারণ দেখছি না। আমি শুধু চাচ্ছি কাজটা যাতে সফল হয়।” জাফর কিছু বলতে চাচ্ছিল, তাকে থামিয়ে দিয়ে বললেন, “আর কোনো কথা নয়, যাও কাজে নেমে পড়ো।”
অবস্থা বেগতিক দেখে জাফর আর কথা বাড়ায় না। সালাম ঠুকে বেরিয়ে আসে ঘরটা থেকে। বাইরে এসেই বুক ভরে শ্বাস নেয়। তার কাছে উজ্জ্বল ভবিষ্যৎ বলতে মাথার ওপর ঝুলে থাকা কেসটা থেকে রেহাই পেলেই হয়। রাস্তায় নেমে পিচিক করে মাটিতে একদলা থুতু ফেলেই হাঁটতে শুরু করে। প্রখর সূর্যের তাপে সেই থুতু ভেলকির মতো নিমেষেই গায়েব হয়ে যায়।
☠
হাশেম ভাইয়ের দলে ঢোকাটা জাফরের জন্য খুব কঠিনই ছিল। অচেনা এক আগন্তককে কেউই দলে ভেড়াতে চাইবে না। দেড় মাস ধরে জোঁকের মতো লেগে থাকার পর হাশেম ভাইয়ের আস্থা অর্জন করতে পারে সে। এরপর থেকেই তক্কে তক্কে থাকে। সুযোগ যেন হরিণী, আর সে যেন এক ক্ষুধার্ত বাঘ...অপেক্ষা কেবল একটু অসতর্কতার।
তাকে নেওয়া হয়েছে হাশেম ভাইয়ের গ্রুপে। তার ব্যক্তিগত ধারণা হাশেম ভাই সম্ভবত নিজে তাকে আগে ভালোভাবে পরখ করে নিতে চান। তার দিক পশ্চিম। সে আর হাশেম ভাই ছাড়াও গ্রুপে আছে চশমা পরা এক লোক, নাম হুমায়ূন। চশমার ফ্রেমটা গোল। কাচটা বেশ পুরু। সেকারণে চোখগুলো কেমন যেন অদ্ভুত ছোটো লাগে। ভয় লাগে। কাঁচাপাকা চুলের হুমায়ূনকে দেখে সে মনে করেছিল অনেক জ্ঞানী গোছের কেউ। কিন্তু কথাবার্তায় বুঝতে পারে আদতে সে গণ্ডমূর্খ। সোজা বাংলায় আবাল।
সে জানে আস্থা পাকাপোক্ত করতে আলাপের জুড়ি নেই। মুখ চেনাজানা হয়, নানান কথা আদানপ্রদান হয়, সম্পর্কটা মজবুত হয়। মজবুত সম্পর্ক এনে দেয় ‘আস্থা’। আর সে যে কাজ করতে এসেছে সেই কাজের জন্য আস্থা অর্জন করা খুব জরুরি। মৃত কেঁচো দেখিয়ে বড়শিতে মাছ ফাঁদা হয় সেটার প্রতি আস্থা অর্জন করার মাধ্যমেই। যে যত সহজে আস্থা অর্জন করতে পারে সে তত ভালো মাছ শিকারী।
আলাপের মাধ্যমে কারো আস্থা অর্জনের ক্ষেত্রে জাফরের ব্যক্তিগত মতামত হচ্ছে, আলাপের বিষয়বস্তু হতে হবে অপর ব্যক্তির অতীত আর সংসার। একমাত্র অতীতই অপরিবর্তনীয়। চাইলেও বদলানো যায় না। আর অতীত মানেই সেখানে থাকবে গোপন কিছু। জাতির গোপন অতীতের নাম হলো ‘পরাজিতদের ইতিহাস’, আর ব্যক্তিরটা ‘একান্ত ব্যক্তিগত’। আমরা যার যত বেশি ব্যক্তিগত অতীত জানতে পারি, সে আমাদের তত আপন হয়। আর যে আমাদের যত আপন, আমাদের প্রতি তার আস্থাও তত বেশি গাঢ়। যেমনটা দীঘির জল। যত বেশি গভীর জল তত বেশি কালো। আর সংসার হচ্ছে মানুষের সেই অংশ যাকে সে কখনো আলাদা করতে পারে না। আলাদা করতে পারে না বলেই, তার বেশিরভাগ ব্যক্তিগত ঘটনা এই সংসারকে ঘিরেই থাকে।
তাই জাফর সুযোগ পেলেই হুমায়ূনের সাথে আলাপ জুড়ে দেয়। হুমায়ূনের সাথে সখ্যতা হয়ে গেলে, হুমায়ূনের সাথে যার বেশি সখ্যতা তার আস্থা অর্জন করা আরও বেশি সহজ হয়ে যাবে। এটা অবশ্য অচেনা মেয়েদের ক্ষেত্রে সম্পর্ক গড়তে অনেক কাজে দেয়। একটা মেয়ে কখনো কারো প্রতি সহজে আস্থা রাখতে পারে না, কিন্তু যখনই দেখে তার পরিচিত কেউ সেই ব্যক্তির প্রতি আস্থা রেখেছে, তখন খুব দ্রুতই বিশ্বাস করে ফেলে। যেমনটা করেছিল আলেয়া।
আলেয়ার কথা মনে হতেই লকলকে জিহ্বাটাকে গাড়ির উইন্ডশিল্ডের মতো করে নাড়িয়ে ঠোঁট ভিজিয়ে নিলো। যেন এখনও সে তার ঠোঁটে পাচ্ছে আলেয়ার স্তনের বোঁটার স্পর্শ। মাছের মতো হা করে খেয়ে ফেলছে তার নরম স্তন। আঙুলে পাচ্ছে তার পেলব শরীরের উষ্ণ স্পর্শ। কিন্তু আলেয়ার মুখের কোনো মধুর কথা তার স্মৃতিতে নেই, আছে কেবল কিছু অর্থহীন গোঙানি—কারণ সে ছিল বোবা।
আলেয়ার স্মৃতিকে একপাশে রেখে এগিয়ে যায় হুমায়ূনের কাছে। সে এখন একা। একা মানেই ‘একান্ত ব্যক্তিগত’ জানার একান্ত সময়। হাশেম ভাই কোথাও গেছে। তাদের দুজনকে রেখে গেছে একটা নির্জন নদীর ধারে। হুহু করে বাতাস বইছে। ছন্দে ছন্দে ছলাৎ ছলাৎ শব্দে তীরে এসে আত্মাহুতি দিচ্ছে স্রোতের দল। হুমায়ূন তীরে বসে থেকে একদৃষ্টিতে তা দেখছে।
তার পাশে বসেই জাফর বলে উঠলো, “জানো, আমার একখান পে-পে-পেমিকা (প্রেমিকা) আছিল। নাম আছিল আলেয়া। খুব সো-সোন্দর দেখতে।” সে জানে গোপন কথা জানতে নিজেরও কিছু গোপন কথা জানাতে হয়। আর আলাপ এগিয়ে নিতে যে যেমন তার সাথে সে সেই ভঙ্গিতেই কথা বলে।
হুমায়ূন তার পুরু কাচের ভেতর থেকে জিজ্ঞাসু দৃষ্টি মেলে বলে, “হেয় কই এখন? দেখতেছি না যে?”
“এইখানে তারে পা-পা-বা কেমনে? সে আমার...কী বলে যেন...এক্স... এক্স গালফেন্ড।”
“সেক্স গালফেন্ড কী?”
“আরে সেক্স না, সেক্স না, এক্স...এ...এ...ক্স। মানে হইলো...” মাথা চুলকায় জাফর। সে শুধু জানে এক্স ইংরেজির একটা বর্ণ, এটার মানে যে কী সে ঠিক খেয়াল করতে পারছে না। সে খেয়াল করেনি যে এই এক্স (ex) বর্ণ এক্স (x) নয়। “এই ম-মনে করো, মইরা যাওয়া পেমিকারে কয় এক্স গালফেন্ড।” বলেই মনে মনে কয়েকটা গালি দেয় হুমায়ূনকে। এই নিয়ে প্রায় মাসখানেক সময় এই লোকের পিছনে সে ব্যয় করেছে। তেমন কিছু জানতে পারেনি। আজকেও যে পারবে বলে মনে হচ্ছে না। সে তার পুরু গোঁফটা আঙুল দিয়ে খস খস শব্দ করে বারকয়েক ঘষে।
“ও, আইচ্চা। কেমনে মরলো? প্যাটে বেদনা হইছিল?”
“আরে ধ্যাত। বা-বা-বাদ দেও আলেয়ার কথা। তো-তোমার কতা কও। তোমার কো-কোনো এক্স গালফেন্ড ছিল না?”
হুমায়ূন কিছুটা লজ্জা পায়। চোখ নামিয়ে ফেলে। ডান হাত দিয়ে খোঁচা খোঁচা দাঁড়ি ভরা ডান গাল চুলকাতে চুলকাতে বলে, “ইয়ে মানে, একখান আছিল। তয় তারে কখনো মনের কতা কইতে পারি নাই।”
জাফর মনে মনে তাকে আবার আরও কয়েকটা গালি দিয়ে ভাবে, “মনের কথাই বলতে পারিস নাই, এক্স গালফেন্ড হইলো কেমনে?’” মুখে বলে, “কেমন আছিল দেখতে?”
“খুব সোন্দর। কুমড়া পাকলে যেমন সোন্দর লাগে তেমন।”
জাফর হাসতে গিয়েও হাসে না। এখন হুমায়ূনের মুড নষ্ট করা যাবে না। সে বলে, “আইচ্চা, তার ক-কতা থা-থাউক, তোমার কতা কও। এই দলে ঢু-ঢুকলা কেমনে?”
“সে তো অনেক লম্বা এতিহাস। প্যাটে বেদনা হইছিল। রাস্তায় নাকি পইরা আছিলাম। হাশেম ভাই তুইলা আনছে। তারপর থাইকা তার লগে আছি।”
জাফর মনে মনে বলে, “আসলেই ‘অনেক লম্বা এতিহাস’,” মুখে দুঃখভাব ফুটিয়ে বলে, “ক্যা, তোমার ফ্যামিলিতে কেউ নাই?”
মাথা তুলে কিছুটা বিস্ময় নিয়ে বলে, “চামেলি কী? ফুল না?”
“আরে, চামেলি না, ফ্যা-ফ্যামিলি মানে হইলো প-পরিবার—মা-বাবা, ভাই-বোন এরা মিইলা হয় ফ্যামিলি।”
“ও...ছিল। শুধু আম্মা-আব্বা। ভাই-বোন নাই। আমার আম্মা মইরা যাওয়ার পর আব্বা নতুন বিয়া করছিল। জানেন, আমার আম্মা মইরা গেছিল প্যাট খারাপ হইয়া। খুব বেদনা উঠছিল। সারা রাইত পেট চাইপা ধইরা কান্দছে। বিছানার এপাশ থাইকা ওইপাশ গড়াগড়ি খাইছে। ফযরের আজানের সময় বেদনা থামছে, আম্মাও মরছে। আমারও তো প্যাট খারাপ হইছিল। আমি তো মরলাম না, হেয় মরলো ক্যান? বারবার কইছিলাম, ‘আম্মা, দুধ খাইছ না, দুধ খাইছ না।’ দুধ খাইয়াই মরলো।”
“দু-দুধ খাইয়া ম-মরছিল মানে?” কিছুটা বিস্ময় নিয়ে বলে জাফর।
“নতুন আম্মা দুধ দিছিল। অবশ্য তখনও নতুন আম্মা হয় নাই। আমাদের বাড়িত থাকতো। আব্বার কেমন যেন আত্মীয় হয়। সেই দুধ খাইয়াই তো তার বেদনা উঠলো। আব্বা কইছিল, খাঁটি দুধ হওয়ায় সমস্যা হইছিল। আমি তাই দুধে পানি দিয়া দুধ ভেজাল বানাইয়া খাই।”
“দুধ খাইয়া মরছে, সেইটা কেমন বুঝলা?”
“মরার পর তার মুখ দিয়ে ফেনার মতো দুধ বাইর হইছিল তো। খাঁটি দুধ আছিল তো, তাই।”
“তোমারেও খাঁটি দুধ দিছিল?” ভ্রু কুঁচকে বলে জাফর।
“হ, কিন্তু আমি পানি দিয়া ভেজাল কইরা খাইছিলাম। তবুও প্যাটে বেদনা উঠছিল। মনে হয় অজ্ঞান হয়ে গেছিলাম। জ্ঞান ফেরার পর চোখের সামনে হাশেম ভাইকে দেখি। উনি ক্যান জানি আর যাইতে দেন নাই। আমার সব কতা শুইনা কইছে, গেলে আবার প্যাটে বেদনা উঠবো।”
সব শুনে জাফর কিছুক্ষণ হুমায়ূনের মোটা কাচের দিকে তাকিয়ে থাকে। একজন মানুষ কী করে এতটা সহজ-সরল আর বোকা হতে পারে? দুজন মানুষের পরকীয়ার বলি যে হয়ে গেছে তার মা, এমনকী হতে ধরেছিল সে নিজেও, তা হয়তো কখনোই ধরতে পারবে না।
হুমায়ূন বলতে থাকে, “আমার আম্মা, আমারে খুব ভালোবাসতো। কখনো আমার প্যাটে বেদনা উঠতে দেয় নাই। আমার জন্য রাখা খাঁটি দুধ নিজে খাইয়া ফেলছে। বিছানায় যখন বেদনায় মোচড়ামুচড়ি করছে, তখনও আমার মাথায় হাত বুলাইয়া দিচ্ছিল আর কইতেছিল, ‘বাপ আমার, পলাইয়া যা, পলাইয়া যা’।” বলেই সে নিজের মাথায় হাত বুলায়।
জাফর উঠে দাঁড়ায়। প্যান্টের বালি ঝাড়তে ঝাড়তে বলে, “তো-তোমার বাসা কই ছিল?”
হুমায়ূন বলতে যেতেই হাশেম ভাই এসে দাঁড়ান। হাঁপাচ্ছেন। ধপ করে হুমায়ূনের পাশে বসে বলেন, “ আলাল জানিয়ে গেল যে একটা টাটকা লাশ পাওয়া গেছে। এই নদী ধরে এগুলেই হবে। দ্রুত হাঁটতে হবে। বাকিরা প্রায় পৌঁছে গেছে।”
হুমায়ূন লাফ দিয়ে উঠে বলে, “কতদিন টাটকা লাশের অভাবে ঘিলু খাওয়া হয় না। আম্মা কইছিল ঘিলু খাইলে ঘিলু হয়।”
হাশেম ভাই বললেন, “শুনলাম, লাশটার মুণ্ডু নাই। ঘিলু পাইবা না।”
☠
রাতের চাদর মুড়ি দিয়ে সূর্য ঘুমিয়ে গেছে। এখন পাহারায় বসেছে পূর্ণ চাঁদ। সেই চাঁদের আলোয় দ্রুতপদে হাঁটছে পশ্চিম দলের হাশেম ভাই, হুমায়ূন আর জাফর...এগিয়ে যাচ্ছে গল্পের এক পরিণতির দিকে।
এই প্রথম হুমায়ূনকে ভালোভাবে খেয়াল করে জাফর। তার হাঁটাচলা ঠিক পূর্ণবয়স্ক কারো মতো নয়। ছোটোবাচ্চার মতো হেলেদুলে হাঁটে। মাঝেমধ্যেই চলতে চলতে এদিকওদিক চলে যাচ্ছে। হাশেম ভাই ধমক দিয়ে তার পিছনে নিয়ে আসছেন। সে এগিয়ে যায়। হাশেম ভাইয়ের পাশে পাশে হাঁটতে হাঁটতে বলে, “ভাই, হু-হুমায়ূনের বু-বুদ্ধিশুদ্ধি এত কম ক্যা?”
হাশেম ভাই ভ্রু কুঞ্চিত করে বলেন, “তা দিয়া তোমার কী কাম?”
জাফর বুঝতে পারে যে সে ভুল প্রশ্ন করে ফেলেছে। তাই চটপট বলে, “না মানে, ওর বাবা-মায়ের কতা ক-ক-কইতে ছিল তো তাই ব-বলতেছিলাম।”
এবার হাশেম ভাই হুমায়ূনের দিকে বিরক্তি নিয়ে তাকিয়ে বলেন, “এই হুমায়ূন, যা তো সামনে যা।”
হুমায়ূন কিছুটা দৌড় দিয়ে সামনে এগিয়ে যায়।
এবার হাশেম ভাই হাঁটতে হাঁটতে জাফরের দিকে তাকিয়ে বলে, “এত তাড়াতাড়ি ওর বাবা-মায়ের কথা তোমার জানা উচিত হয় নাই। কারো ব্যক্তিগত ব্যাপারে শবখাদকরা নাক গলায় না। তোমারও গলানো উচিত হয় নাই। এখন যখন গলাইয়েই ফেলাইছো, তাই কই, সহজে বোঝা যায় না যে ও একটা বুদ্ধিপ্রতিবন্ধী। কখন কী বলে, কী করে ঠিক নাই। ওরে যখন পাই তখন ও আধমরা। অনেক কষ্ট হইছে বাঁচাইতে। ওর বাপ যদি ওর খবর পায় তাহলে এবার আর আগের ভুল করবে না। মাইরাই ফেলবে। তাই আমি চাই না তুমি ওরে নিয়ে আর ঘাঁটাঘাঁটি করো। বুঝতে পারছো?”
ঢোঁক গেলে জাফর। সাপের গর্তে হাত দিয়ে ফেলেছে। বিগত কয়েক মাসের পরিশ্রম যে-কোনো সময় ভেস্তে যেতে পারে। সে ভীত চোখে মাথা ঝাঁকাতে ঝাঁকাতে বলে, “না, ভাই আ-আমি আর ঘাঁটাঘাঁটি করমু না, করমু না। একা একা ছিলাম, তাই আ-আলাপ ক-করতেছিলাম। এই আরকি। হেহে...” হেসে সে পরিবেশ হালকা করার চেষ্টা করে।
হাশেম ভাই কিছু বলে না, সামনে তাকায়। তার অনেক তাড়া।
জাফর মনে মনে ঠিক করে, যা করার আজকেই করবে। আর সময় নষ্ট করতে সে চায় না। তারও অনেক তাড়া।
☠
জাফর এসেই সুযোগ খুঁজছিল কীভাবে আলাদা হওয়া যায়। সুযোগ পেতে বেশি দেরি হয়নি। দলে নতুন হিসাবে তার ঘাড়ে চাপিয়ে দেওয়া হয়েছে বাজার-সদাই করার দায়িত্ব। সে-ও হাসিমুখে নিয়েছে। বাজারে যাওয়ার আগে সে হুমায়ূনের কাছে আরেকবার যায়, কিছু কথাবার্তা বলে বিদায় নেয়। যদি কাজ ঠিকঠাকমতো হয়, তাহলে এটাই জীবিত অবস্থায় তার সাথে শেষ দেখা।
বাজারে এসেই লুকিয়ে রাখা ফোনটা দিয়ে বিষাণদের দলকে ডেকে আনে। এই দলটার প্রধান ছাদেক দফাদারের চেহারায় বিরক্তি। সেটাই স্বাভাবিক। তার দলকে জাফর আর্জেন্ট কল দিয়ে ডেকে এনেছে।
যতটা পারা যায় অল্প কথায় সে ছাদেকের দলকে সব বুঝিয়ে বলে। অভিজ্ঞ ছাদেকের সব দ্রুত বুঝে নিতে কোনো সমস্যা হয় না। সে তার দলের বাকিদের দায়িত্ব ভাগ করে দেয়।
যখন তাদের কোনো স্পাই কোনো শবখাদকদের দলের খবর নিয়ে আসে তখন ফাঁদে ফেলে শিকার করাটা অনেক সহজ হয়ে যায়। একদম অচেনা কোনো শবখাদকদের দলকে শিকার করা খুব কঠিন। কে কখন কোনখানে ঘাপটি মেরে লুকিয়ে থাকে তা সহজে বের করা যায় না। সেক্ষেত্রে অনেক শবখাদক আঙুলের ফাঁক গলিয়ে পালিয়ে যায়। আর ফিরে আসে ঘাতক হয়ে। যেভাবে শিকারির গুলিতে আহত বাঘ ফেরে নরখাদক হয়ে।
দূর থেকে পুরো দলটার অবস্থান বুঝে নেয় ছাদেক। চাঁদের আলোয় দূর থেকে শবখাদকদের দলের সবাইকে তেমন বোঝা যাচ্ছে না। কেবল বোঝা যাচ্ছে তারা একটা গর্ত খুঁড়ছে। অল্প দূরত্বের মধ্যেই অবস্থান করছে সবাই। আর জাফর বলে দিয়েছে এই কজনের বাইরে আর কেউ নেই। বলা যায়, ব্যাপারটা অনেক সৌভাগ্যের।
জাফরকে নিজের সাথে নিয়ে বাকিদের বৃত্তাকারে ছড়িয়ে যেতে বলে ছাদেক। আর শিঙার কথা সবাইকে আবার মনে করিয়ে দেয়। সংকেত পেলেই কেবল আক্রমণ করতে হবে। ভুল যেন না হয় সে কথাটাও বুঝিয়ে দিতে থাকে বারবার। একটা গভীর শ্বাস নিয়ে এগিয়ে যাওয়া শুরু করে সে। আজকে একটা বড়ো দাঁও মারা হবে।
জাফর অনেক অস্থির হয়ে আছে। কেউ টের পাওয়ার আগেই তাকে তার কাজ শেষ করতে হবে। ভুল করা যাবে না। আজকের সফলতার ওপরেই নির্ভর করছে তার আগামীদিনের ভবিষ্যৎ। ডাঁট ছুড়ে মারার ব্লোপাইপটা মুঠোর মধ্যে শক্ত করে রেখেছে। এটাই এখন তার ভবিষ্যৎ লেখার কলম। নিখুঁত সই এখনও তার আয়ত্বে আসেনি, তবে মোটামুটি ঠিকভাবেই লক্ষ্যভেদ করতে পারে। প্রশিক্ষণ শেষে তার স্কোর ছিল দশে সাত।
সমস্যা হচ্ছে এখন সে কোনো প্রশিক্ষণের ডামি পুতুলের ওপর ডাঁট মারবে না, সে মারবে জ্যান্ত মানুষের ওপর। তার হৃদপিণ্ড দাপাদাপি শুরু করে দিয়েছে। বুক ফেঁড়ে বেরিয়ে আসতে চাইছে। বারবার হাতের মুঠো আলগা আর শক্ত করছে। যেন ওটাই হয়ে গেছে হৃদপিণ্ড। হাত ঘেমে যাচ্ছে। কপাল বেয়ে সাপের মতো একেবেঁকে নামছে ঘাম। কাশবনের মধ্য দিয়ে যতটা সম্ভব নিচু হয়ে চুপচাপ চলছে। এরইমধ্যে ছাদেক দফাদার দুবার পিছন ফিরে তাকে সাবধান করে দিয়েছে। ছাদেকের মতো তার মাথাতেও শোভা পাচ্ছে লাল কাপড়, তাতে আঁকা সাদা শিঙা। তবে বাকি বিষাণদের মতো তার হাতে কোনো শিঙা নেই। বিষাণরা বাড়তি শিঙা নিয়ে ঘোরে না। মাঝেমধ্যে প্রয়োজনে একাধিক ব্লোপাইপ রাখে। সেগুলোরই একটা তার হাতে শোভা পাচ্ছে।
ছাদেক ঠিক যখনই শিঙা ফুঁ দিলো ঠিক তখনই সে একটা ডাঁট ছুড়ে মারলো ছ’ফিট তিন ইঞ্চি লম্বা ঝাঁকড়া চুলের শবঘাতক সামাদকে লক্ষ্য করে। আজকের সবচেয়ে সহজ লক্ষ্য। সে যত শবখাদক মারবে ততগুলো সাফল্যের পালক তার মুকুটে জুড়বে। এই হিসাবটা সহজে করার জন্য প্রতিটা বিষাণের ডাঁটগুলো আলাদা আলাদা রঙের হয়। তার ডাঁটটা উজ্জ্বল সবুজ রঙের। চাঁদের সাদাকালো আলোয় সেটাকে দেখাচ্ছে হালকা ধূসর।
তার ডাঁট ছুড়ে মারা দেখে শিঙায় ফুঁ দেওয়া শেষে ছাদেক প্রচণ্ড বিরক্তি নিয়ে তাকালো। দুজন ইতোমধ্যে শুয়ে পড়েছে। ছাদেক ধারণা করলো, দলের মাথা ওদেরই কেউ একজন, আর ওই দুজনই বিষাণদের ব্যাপারে অভিজ্ঞ। আর দলের মাথাকে বিষ মাখা ডাঁট নয়, অজ্ঞান করার ডাঁট মারতে হয় যাতে জিজ্ঞাসাবাদের জন্য ধরা যায়। কিন্তু কথা হচ্ছে, আর্জেন্ট কল’র মাধ্যমে ওপর থেকে তাকে জানিয়ে দেওয়া হয়েছে আজকে কাউকেই পাকড়াও করা হবে না। সবাইকেই বিষমাখা ডাঁট মারতে হবে। সে জানে তার দলের বাকিরা ব্যাপারটা জানে। আজ এই দলের সব শবখাদকরা অতীত হয়ে যাবে।
বেশ কিছুক্ষণ হয়ে গেছে আক্রমণের। ক্রমে ক্রমে তারা বৃত্তটাকে ছোটো করে আনছে। জাফর এবার খুঁজছে তার আসল লক্ষ্যকে।
সমস্যা হচ্ছে ছাদেক তাকে কোনোভাবেই একা ছাড়ছে না। বুঝতে পারছে শুরুর ভুলের পুনরাবৃত্তি আবার সে চাচ্ছে না। তারওপর সবাইকে মারার আদেশ পেয়েছে। তাই একটাও যাতে পালিয়ে না যায় সেদিকেও তার খেয়াল রাখতে হচ্ছে।
সবকিছু হুট করে চুপচাপ হয়ে যাবার কিছুক্ষণ পর জাফর কিছু একটা নড়ে ওঠা দেখতে পেল। কাশবনের ভেতরে কেউ চক্রাকারে কিছু একটা ঘোরাচ্ছে। সে জানে একই দৃশ্য দেখছে ছাদেকও। আর দুজনেই জানে যে চক্রাকারে ঘোরাচ্ছে সে তাদের কী বোঝাতে চাইছে। কিন্তু দুজনের মধ্যে কেবল জাফর জানে কে ঘোরাচ্ছে, তার একমাত্র লক্ষ্য। তার হাতে এখন সুযোগ একটাই। ছাদেক তাকে থামিয়ে দেওয়ার আগেই সে ছুঁড়ে মারে ডাঁট তার একমাত্র লক্ষ্যের দিকে, যার জন্য এত পরিশ্রম—আর তার একমাত্র লক্ষ্য কোনো শবখাদক নয়, বরং শবখাদকদের ঘাতক মজিদ মিয়া।
দ্বিতীয় ডাঁট ছোঁড়ার আগেই ছাদেক তাকে থামিয়ে দেয়। বলে ওঠে, “ওইটা আমাদের লোক, আর ছুঁড়িস না।”
জাফর দাঁত চেপে নিজেকে সামলায়। এখন আর দ্বিতীয়বার ডাঁট ছোড়া যাবে না। নইলে সব ফাঁস হয়ে যাবে। তার মনে একটা ক্ষীণ আশা ছিল যে হয়তো ডাঁটটা মজিদ মিয়ার গায়ে লেগেছে। কিন্তু তার আশায় জল ঢেলে দিয়ে দুটি ছায়ামূর্তি প্রাণপণে দৌড়াতে থাকে কাশের ঝোপ দিয়ে।
এবার ছায়ামূর্তির একটাকে ছাদেক চিনতে পেরে নিচের ঠোঁট কামড়ে ধরে বিড়বিড় করে বলে, “ওস্তাদের কাছে মিসটেকের জন্য মাফি (ক্ষমা) চেয়ে নিতে হবে।” তবে সে দ্রুতই ভুলে গেল যে সে ছায়ামূর্তি একটা নয়, দুটোকে দেখেছে।
সবকটা লাশ পুঁতে ফেলার সময় জাফর হুমায়ূনের লাশের কাছে হাঁটু গেঁড়ে বসে। কিছু একটা বিড়বিড় করে বলতে বলতে পুরু কাচের চশমাটা নিজের বুকপকেটে রেখে দেয়।
ছাদেক তাকে ডেকে বলে, “কালকে অবশ্যই ওস্তাদ মজিদের কাছে যেয়ে মাফি চেয়ে নিবা। ওস্তাদের ঠিকানা হলো...”
জাফর আর দেরি করতে চায় না। দ্রুত ঠিকানা শুনে নেয়। তাকে এখনই রিপোর্ট করতে হবে। আরও একটা কাজ বাকি রয়ে গেছে। সেটা আজ রাতেই শেষ করতে হবে।
সে সবাইকে রেখে দূরে এসে কল করে ওপাশে সব জানায়। ওপাশ থেকে রাশভারী কণ্ঠটা বলে, “আমার বোঝা উচিত ছিল যে তুমি একটা আস্ত অপদার্থ। এখন কীভাবে এই পরিস্থিতি সামাল দেবে? আর কবেই বা পরের সুযোগ আসবে?”
জাফর জানে তোষামোদির সময় এখন আর নেই, এখন সময় মাফ চাওয়ার। ছোটো কিন্তু অনেক বড়ো একটা কাজ দেওয়া হয়েছিল তাকে। মজিদকে মেরে ফেলতে হবে। আর মারতে হবে এমনভাবে যেন সেটা একটা দুর্ঘটনা হয়। আর শবখাদকদের মারতে গিয়ে তাদের ভেতর লুকিয়ে থাকা একজন বিষাণ মারা যেতেই পারে। এটা বিশ্বাসযোগ্য দুর্ঘটনা। কিন্তু সেই সুযোগটা ফসকে গেছে। পাশে যদি ছাদেক দফাদার না থাকতো তাহলে ফসকে যাওয়ার কোনো সম্ভাবনা ছিল না।
সে মেকি কাঁদোকাঁদো সুরে ক্ষমা চায়। বলে পরেরবার এই ভুল কোনোভাবেই হবে না। ওপাশ থেকে আরও কিছু গরম বাক্য তার কানের পর্দা ভেদ করে মস্তিষ্ককে জ্বালিয়ে দিয়ে ক্ষান্ত হয়। মোবাইলটা রাখার পর ভাবে ক্ষমতা মানুষকে কোন পর্যায়ে নামিয়ে নিয়ে আসে। ক্ষমতা দখলের লড়াইয়ে এগিয়ে থাকতে বিষাণদের প্রধান তাকে ঠিক করেছে আরেক অঘোষিত প্রধানকে মেরে ফেলার জন্য। বিনিময়ে সে পাবে কেস থেকে মুক্তি। কেসের কথা মনে হতেই সে হারিয়ে যায় তার স্মৃতির সাগরে। আলেয়ার সাগরে...
☠
আলেয়াকে সে ঠিক ভালোবেসেছিল কিনা তা মনে করতে পারে না। একজন বোবা মেয়েকে কে ভালোবাসবে? সব মানুষই তার ভালোবাসার মানুষের কাছ থেকে মধুর বুলি শুনতে চায়। খুনসুটি করতে চায়। ঝগড়া করতে চায়। সে-ও হয়তো তাই চেয়েছিল। কিন্তু পারেনি। বোবা মেয়েটাকে নিয়েই জীবন সাগরে ভাসতে চেয়েছিল।
সে ছিল তার গ্রামের চেয়ারম্যানের খাসচামচা। আর বেশিরভাগ চেয়ারম্যানের মতোই তার চেয়ারম্যান শামসুলও ক্ষমতার অপব্যবহার করতে ভোলেনি।
তার এখনও মনে পড়ে সেই দিনটার কথা। চেয়ারম্যান তাকে ডেকে বলে, “জাফর, তুই তো জানিস আমি তোরে কতটা বিশ্বাস করি। তাই তোর ওপর একটি গুরুত্বপূর্ণ দায়িত্ব দিতে চাই।”
জাফর তার পুরু গোঁফের ঘষতে ঘষতে বলল, “জি হুজুর, বলেন। আপনার জন্য জা-জান হা-হাজির।” সে মাত্রই তিনদিনের যাত্রাপালা দেখে গ্রামে এসেছে। অনেক ক্লান্ত, কিন্তু হুকুম না মানা ছাড়া উপায় নাই।
“জান-টান দিতে হবে না। শুধু একটা কাজ করে দিলেই হবে।”
“আপনে খালি হু-হুকুম করেন হুজুর। একটা ক্যা-ক্যান, হা-হাজারটা কাজ করে ফেলবো।”
“ভেতরে একখান লাশ আছে। বস্তায় বেঁধে পুঁতে ফেলবা। কাকপক্ষীও যেন টের না পায়।”
“কী যে ব-বলেন হুজুর। কাকপক্ষী তো দূ-দূরের ব্যাপার। আমিও নিজেই টের পা-পাবো না। হেহে।”
“হইছে, অত তেল মারা লাগবে না। আমার সাথে আসো।” বলে চেয়ারম্যান ঘরের ভেতরে ঢোকে। জাফরও তার পিছু পিছু যেতে থাকে।
চলতে চলতেই চেয়ারম্যান বলে ওঠে, “কও তো জাফর, একটা বোবাকে রেপ কইরা কী করতে হয়?”
“কী হুজুর?”
“আঙুল কাইটা দিতে হয়।”
জাফর কিছুটা অবাক হয়ে বলে, “ক্যা হুজুর?”
“যাতে সে কাউরে কইতে না পারে।” বলেই হো হো করে হাসতে থাকে চেয়ারম্যান।
জাফর ঠিকভাবে ধরতে না পারলেও সে তাল মেলাতে হোহো করে হাসতে থাকে। আলেয়ার কথা মনে যায়, সে হাত দিয়ে ইশারায় কথা বলে আর অর্থহীন গো গো আওয়াজ করে। এবার ব্যাপারটা বুঝে আরেকদফা হেসে নেয়।
একদম ভেতরের ঘরের বদ্ধ দরজার সামনে এসে চেয়ারম্যান দাঁড়ায়। এই বাড়িটায় চেয়ারম্যান আর তার সাঙ্গোপাঙ্গ ছাড়া আর কেউ থাকে না। এটা তাদের গোপন আস্তানা। গমসহ যত রকমের সরকারি অনুদান আসে সবকিছুর ঠাঁই হয় এখানে। অল্প কয়েকটা দানা ছিটানো হয় গ্রামে। সেই অল্প কয়েকটা দানায় যেসব মানুষ সন্তুষ্ট হয় না তাদের এখানে এনে ডলা দেওয়া হয়। বেশি ঝামেলা করলে আজকের মতো মেরে পুঁতে ফেলাও হয়। সে নিজেই দুইটাকে পুঁতেছে। একটাকে মেরেছিল বল্লম ছুঁড়ে। উঠানে এখনও সেই বল্লমটা রাখা আছে। তার নিজের সাহসের দ্যুতি ছড়ায় ওটা। আজকে সে আস্তানায় চেয়ারম্যানকে ছাড়া আর কাউকে দেখছেও না।
চেয়ারম্যান ধাক্কা দিয়ে কাঠের দরজাটা খুলতেই বোটকা একটা গন্ধ তার নাকে এসে লাগে। অন্ধকার রুম। চোখ সয়ে আসতেই চমকে ওঠে সে। জানত লাশ দেখবে, তারপরও নিজেকে সামলাতে পারলো না। চেয়ারম্যান লাইটের সুইচটা চাপ দিতেই ভয়ংকর দৃশ্যটার চোখে পড়লো।
চাপ চাপ রক্তে চারপাশ ভরে আছে। দেওয়াল ভরে গেছে রক্তের ছিটার দাগে। মেঝেতে ছড়িয়ে ছিটিয়ে আছে বেশ কটা কাটা আঙুল। আর লাশটা পড়ে আছে রুমের এককোণায় থাকা বিছানার ওপর। লাশটা একটা মেয়ের। উপুড় হয়ে আছে। কেবল দেহ নয়, তার প্রাণটাকেও উপভোগ করেছে চেয়ারম্যান।
একটা অজানা আশংকাকে পরখ করতে কিছুটা দৌড়ে গিয়ে লাশটা উলটায়। তার আশংকাকে সত্যি করে দেয় লাশটা। ওটা আলেয়ারই লাশ। লাশের গায়ে কাপড়ের বদলে আছে ক্ষতের পরত। জাফরের চারপাশটা যেন দুলে ওঠে। সে আলেয়ার লাশটাকে বুকে নেয়। চেপে ধরে। আলেয়ার মুখটাকে তার কানের কাছে নেয়। চিরচেনা সেই গো গো শব্দ যদি শোনা যায় এই আশায়।
চেয়ারম্যান খানিকটা বিস্মিত আর বিরক্তি নিয়ে বলে, “কী করতাছোস জাফর? গত পরশু ধইরা আনছিলাম। আইজ সকালের দিকেই মনে হয় মরছে। এখন তো সন্ধ্যা হয়ে গেছে। এখনও কি আর বাঁইচা আছে? মাগির কৈমাছের প্রাণ। খালি গোঁ-গোঁ শব্দ করতেছিল। চুইদা মজা পাই নাই। শীৎকার ছাড়া কী আর চুদে মজা আছে, বল? সেলিম আর রুবেল দুইটা একটা আস্ত বোকাচোদা। এইটারে ধইরা আনছে। যখন চুইদা মজা পাইতেছিলাম না তখন সেই কৌতুকটা একটু বাস্তব করার টেরাই (ট্রাই) করছিলাম এই আরকি। এইকারণে রুমটা একেবারে নোংরা হইয়া গেছে। বাকিদের বাড়িত পাঠায় দিয়া কেবল সেলিম আর রুবেলকে পাঠাইছি ঘর পরিষ্কার করার জিনিসপাতি আনতে। তুই যা পুঁতে দিয়ে আয়। কী রে? কথা কস না ক্যান? এখনও লাশটাকে চাইপা ধইরা আছোস ক্যা?”
চেয়ারম্যান কিছুটা অবাক হয়েই চুপ হয়ে যায়। পরক্ষণেই বলে ওঠে, “জানোস, সেলিম কি কামটা করছে?” বলে একটা রক্তমাখা লাটি হাতে নিয়ে বলে, “এইটা ওর ভোঁদায় ঢুকাই দিছিল। অ্যা-অ্যা কইরা সে কী চিক্কুর পারছে রে ভাই। বোবা তো, অত মজা পাওয়া যায় নাই। দুই হাত এক কইরা কতবার যে মাফ চাইছে কী আর বলবো। চোখ দিয়া গল গল কইরা জল ফেলাইছে, অই জল যদি ভোঁদা দিয়া ফেলাইতো, তাইলেই না বেশি মজা হইতো। এইসব দেইখা রুবেলও কি চুপ থাইকা পারে? সে লাঠিটা ভোঁদা থাইকা বাইর কইরা গোয়ায় ঢুকাইছে। তখন অবশ্য সেলিম ওরে চাইপা ধইরা ছিল। তখন যদি মাগিটার চোখগুলা দেখতিরে ভাই, রসগোল্লার মতো বড়ো হইয়া গেছিল। আমি অবশ্য ওদের এসব কীর্তি দেখার পর আঙুল কাটছিলাম। তুই থাকলে কী করতিরে জাফর...?”
জাফর গমগমে স্বরে বলে, “চুপ...চু-উ-প...আমার আলেয়া কিছু কইতেছে, তুই চু-চু-প হ।”
চেয়ারম্যান শামসুল খোশমেজাজে আছে, তাই তাৎক্ষণিক কোনো প্রতিক্রিয়া দেখালো না। তাই কৌতুকস্বরে বলল, “কী কইতেছে মুর্দা মাগিটা? আই লাব ইউ? হাহা।”
জাফর যেন শুনতে পায়, অনেক দূর থেকে আলেয়ার গোঁ-গোঁ আওয়াজ ভেসে আসছে। অর্থহীন আওয়াজগুলো আস্তে আস্তে অর্থবোধক হয়ে যাচ্ছে। এবার যেন সে বুঝতে পারছে আলেয়া কী বলতে চাচ্ছে...আলেয়া বলছে, “তোমার লগে ঘর বান্ধতে পারলাম না...”
চেয়ারম্যান এবার বিরক্ত হয়ে জাফরকে ঝাঁকি দেয়। জাফরের যেন ঘোর ভেঙে যায়। ঝট করে উঠে দাঁড়ায়। ইতিউতি তাকায়। মেঝেতে পড়ে আছে লম্বা ছুরিটা। ওটা দিয়েই কেটে নিয়েছে আলেয়ার স্তন, পোঁচ দিয়েছে বাহুতে, তালুতে, বুকে, উরুতে—সবখানে। কেটে নিয়েছে হাতের সবকটা আঙুল।
ছুরি হাতে নিয়ে ঘুরে দাঁড়ায় চেয়ারম্যানের দিকে। অভিজ্ঞ শামসুল বুঝতে পারে অবস্থাটা ঠিক সুবিধার না। ধমকের সুরে কিন্তু ভীতকণ্ঠে বলে, “এই জাফর...তুই এমন করতাছোস ক্যা? তুই মজা নিতে পাস নাই তো কী হইছে? দ্যাশে কি মাইয়ার অভাব? পুঁতে রেখে আয়, কাল আরও মাইয়া আনবোনে। তুই একলাই চুদিস। মাথা গরম করিস না...”
জাফর পাগলের মতো ছুরি চালায়। চেয়ারম্যান হাত দিয়ে নিজেকে বাঁচাতে গেলে ডান হাতের তিনটা আঙুল ছুরির কোপে পড়ে যায়। চিৎকার দিয়ে ওঠে সে। জাফর আবার ছুরি চালায়, এবার বাম হাতের দুটো আঙুল পড়ে যায়। ভয়ে পেছাতে গিয়ে মেঝের রক্তে পিছলে পড়ে শামসুল। মরিয়া হয়ে আঙুল কাটা দিয়েই নিজেকে বাঁচানোর চেষ্টা করে। কিন্তু জাফরের মধ্যে ক্ষোভ যেন আগ্নেয়গিরি হয়ে ফুঁসে উঠছে। কিছুই তাকে আজকে থামাতে পারবে না। সে শামসুলের বুকের ওপর চেপে বসে। ডানহাতের কব্জি মেঝেতে চেপে ধরে বাকি দুটো আঙুলও ফেলে দেয়। যন্ত্রণায় জাফরকে সরিয়ে দিতে চায়। কিন্তু পারে না। এবার জাফর বাম হাত মেঝেতে চেপে তিনটা আঙুল একটা একটা করে তিন কোপে ফেলে দেয়। শামসুল এবার আর সহ্য করতে পারে না। চেতনা হারায়। জাফরের সেদিকে ভ্রূক্ষেপ নেই। সে দুহাত দিয়ে ছুরির হাতল চেপে ধরে সজোরে নামিয়ে আনে শামসুলের ঠিক হৃদপিণ্ড বরাবর। ধড়ফড় করে অচেতন দেহ। চেতনা লুপ্ত হলেও দেহটা ঠিকই সজাগ। কাটা মুরগির মতো কিছুক্ষণ সেটা দাপাদাপি করে। অচেতন অবস্থাতেই শামসুল তার পাপের প্রায়শ্চিত্ত করে।
এভাবে ঠিক কতক্ষণ কেটে গেছে জাফর তা মনে করতে পারে না। তার সংবিৎ ফেরে কারো ডাকে। ডাকটা খেয়াল করলে বুঝতে পারে, ডাকটা আসছে বাইরে থেকে আর সেটা সেলিমের। বের হবার আর ঢোকার রাস্তা একটাই হওয়ায় সেলিম ঘরে ঢোকার আগেই সে বের হতে যায়। তার শরীর রক্তমাখা, সেটা দেখে সেলিম কিছু বলতে গিয়েও থেমে গেল। ভাবলো, জাফর হয়তো রুমটা পরিষ্কার করছিল সেকারণে তার ওই অবস্থা। কিন্তু সে মোটেও খেয়াল করলো না যে জাফরের হাতে একটা রক্তাক্ত ছুরিও আছে।
পরের পর্ব : ক্লিক করুন
Published on November 18, 2021 10:09
•
Tags:
adult, bengali, crime-fiction, dark, fiction, mystery, preview, suspense-thriller, thriller
শবশিঙা প্রিভিউ (শেষ পর্ব)
সতর্কীকরণ
ম্যাচিউর কন্টেন্ট | ভায়োলেন্স | PG 18+
গত পর্ব : ক্লিক করুন
পাশ কাটিয়ে যাওয়ার সময় জাফর বুঝলো এরচেয়ে সহজ সুযোগ আর সে পাবে না। তাই সেলিম যখনই তাকে পাশ কাটিয়ে ভেতরে যাচ্ছিল ঠিক তখনই সেলিমের পিঠে সে সজোরে আমূল বিঁধিয়ে দেয় ছুরিটা। জাফরকে বিস্মিত আর বিস্ফারিত চোখে ঘুরে দেখে ধপ করে একপাশ হয়ে পড়ে যায়। সেলিমকে পা দিয়ে চেপে ধরে ছুরিটা বের করে লাথি দিয়ে চিৎ করে ঘুরিয়ে নেয়। তখনো সে মরেনি। এবার জাফর ছুরিটা গেঁথে দেয় সেলিমের পুরুষাঙ্গ বরাবর। খুব একটা প্রতিক্রিয়া দেখাতে পারে না সেলিম। ধনুষ্টংকার রোগীর মতো বেঁকে ওঠে। ওভাবেই রয়ে যায়—মূর্তি হয়ে।
দূর থেকে এই আকস্মিক ঘটনাটা রুবেল দেখে কিছুক্ষণ স্থির হয়ে দাঁড়িয়ে বোঝার চেষ্টা করে অবস্থাটা। দ্রুতই সে হিতাহিত জ্ঞান হারিয়ে ফেলে। হাতে থাকা বালতি, মগ, ব্রাশসহ পরিষ্কার করার অন্যান্য জিনিসগুলো ফেলে দৌড় দেয়। খুব বেশিদূর দৌড়াতে পারে না। উঠানে বাড়ির দেওয়ালে ঠেস দিয়ে রাখা সেই বল্লমটা হাতে নিয়ে শরীরের সমস্ত জোর একসাথে করে ছুড়ে মারে জাফর। বল্লমটা তার আস্থা রাখে। এফোঁড়ওফোঁড় করে দেয় রুবেলকে।
এবার মাটিতে হাত-পা ছড়িয়ে ধপ করে বসে পড়ে জাফর। আর শরীরে যেন আর কোনো শক্তি অবশিষ্ট নেই। বুকের সাথে লেগে গেছে থুঁতনি। প্রতিশোধ নেওয়া শেষ হতে না হতেই মাথা যেন একদম ঠান্ডা হয়ে গেছে, শান্ত হয়ে গেছে মন। আর ঠিক একারণেই সে ভাবতে পারলো, তিন-তিনটা খুনের দায় এখন তার মাথায়। তার মধ্যে একটা খুন হলো ক্ষমতাসীন দলের এক সদস্য, গ্রামের চেয়ারম্যান আর প্রভাবশালী লোক শামসুল। ফাঁসি-ই তার একমাত্র শাস্তি। কী করবে এখন সে? বেঁচে থাকতে হলে পালাতে হবে। উঠে একবার আলেয়ার কাছে যেতে চাইলো। আবার পরক্ষণেই নিজেকে বোঝালো, ওই অবস্থায় আরেকবার তাকে দেখলে সে নিজেকেই শেষ করে দিতে চাইবে।
চেয়ারম্যানের এই আস্তানাটা কিছুটা নির্জন হওয়ায় হয়তো গ্রামবাসীদের জানতে দেরি হবে, কিন্তু খুব একটা সময় লাগবে না। নিজেকে জোর করে দাঁড় করায়। মাটিতে পা ঘষে ঘষে আস্তানা থেকে বেরিয়ে আসে। অন্ধকার হয়ে আসায় সহজে কেউ তাকে খেয়াল করতে পারবে না ভেবে হাঁটতে শুরু করে।
এরপরের দিনগুলো কেবল পালিয়ে বেড়ানোর। অভাব নেই চেয়ারম্যানের শুভাকাঙ্ক্ষীর। তাই একজায়গায় লুকিয়ে থাকার মতো অবস্থা নেই। আর তাই এসময় সে খেয়াল করে আসলে তার কোথাও পালিয়ে যাওয়ার জায়গা নেই। অথচ আগে মনে করেছিল দুনিয়াটা মস্ত বড়ো। ক্ষুধায় কাতর হয়ে চুরি করতে যাওয়ার দুঃসাহস সে দেখাতে পারেনি। পাছে ধরা পড়ে যায়, আর ঝুলিয়ে দেওয়া হয় ফাঁসি কাষ্ঠে। একটা সময় বুঝতে পারে গোরস্থান লুকানোর জন্য চমৎকার এক জায়গা। বিশেষ করে পুরোনো গোরস্থান। সেখানেই এক রাতে সে প্রথম দেখা পায় শবখাদকের। তার সাথে মিলে শব খাওয়ার সময় বুঝতে পারে ক্ষুধার্ত পেটে পচাগলা মাংসও যে এতটা সুস্বাদু লাগবে পারে। আর এভাবেই সে ঢুকে পড়ে একটা শবখাদকের দলে। এই অভিজ্ঞতাই পরে তাকে অন্যান্য শবখাদকের দলে ভিড়তে সহজ করে দিয়েছে।
সর্বশেষ যে শবখাদকের দলে সে ঢুকেছিল সেই দল ধরা পড়ে বিষাণের হাতে। তার ভাগ্য ভালো কিংবা খারাপ ছিল। তার ঘাড়ে লাগে অজ্ঞান করার ডাঁট। পরবর্তীতে সে যোগ দেয় বিষাণে। টিকটিকি বানানোর জন্য বিষাণ তাদের দলে এরকম ধরে সিঁধে বানানো শবখাদকদের প্রায়ই ঢোকায়। কেননা, এরা খুব সহজেই শব খেয়ে শবখাদকদের দলে ঢুকতে পারে যেটা সাধারণ বিষাণরা পারে না। যেহেতু তার ঘাড়ে মার্ডার কেস ঝুলছে তাই তার পরিচয় খুব কম বিষাণদের কাছে রাখা হয়। আর সেইসাথে সুযোগ পায় মার্ডার কেস থেকে রেহাই পাবার সুযোগ। আর সুযোগটা হাতে আসে একটা গোপন শর্তে, যদি সে মজিদকে শব বানাতে পারে কেবল তবে।
☠
বুকপকেটে হুমায়ূনের চশমাটা নিয়ে দাঁড়ায় একটা বাড়ির সামনে। বাড়ির সবাই ঘুমিয়ে পড়েছে। পুরো বাড়ি অন্ধকার। এই বাড়িটা হুমায়ূনের।
বাজারে যাবার আগে যখন সে হুমায়ূনের সাথে কথা বলেছিল তখনই তার বাড়ির ঠিকানা শুনে নেয়। জানে যে এরপর আর শোনার সুযোগ হবে না। মোটরসাইকেলে করে ঘণ্টা দুয়েকের পথ ছিল। বিষাণদের অফিসে এসেই একটা মোটরসাইকেল নিয়ে রওনা দেয়। প্রশিক্ষণের সময় মোটরসাইকেল চালানো শেখাটা এখন খুব কাজে দিচ্ছে।
কেন যেন সে অনুভব করছিল যে তার সময় শেষ হয়ে এসেছে। আর এই কাজটা তার মরার আগেই করে যে করেই হোক করে ফেলতে হবে। মা ছাড়া মাতাল বাবার সংসারে বড়ো হওয়া জাফর জানে মায়ের অভাব কাকে বলে।
আলেয়ার কথা খুব মনে পড়ছে তার। আলেয়া কাগজের নৌকা বানাতে খুব পছন্দ করতো। খুব আনন্দ পেত পানিতে ভাসিয়ে। আর বৃষ্টি হলে তো কথাই নেই। তার আনন্দ পেত চরম পূর্ণতা। স্মৃতিটাকে জাফর হারিয়ে যেতে দেয়নি। এখনও প্রায়ই বুকপকেটে একটা কাগজের নৌকা রাখে। ভাসিয়ে দেওয়ার সুযোগ পেলে ভাসিয়ে দেয়।
প্যান্টের পকেটে হাত ঢোকালে একটা শিশির অস্তিত্ব টের পায়। একহাতে শিশিটা নিয়ে বাড়িটার দিকে এগিয়ে যায়। আসার পথেই আশেপাশের এক দোকানে খোঁজ নিয়ে জেনেছে এই বাড়িতে হুমায়ূনের বাবা আর নতুন মা ছাড়া আপাতত আর কেউ নেই। খোঁজ নেওয়ার সময় চেষ্টা করেছে নিজেকে আড়ালে রাখার, তবে দেখলেও সমস্যা নেই। কেউ তাকে খুঁজে পাবে না। জাফরের আরেক হাতে হাফ লিটারের দুইটা দুধের প্যাকেট। খোঁজ নেওয়ার সময় দোকানটা থেকে নিয়েছিল। কিছু পেতে হলে কিছু দিতে হয়।
রান্নাঘর থেকে নেওয়া ছুরি দেখিয়ে ঘুম থেকে চকিত ডেকে ওঠানো দুজন মানুষকে দুধ খাওয়াতে তার খুব একটা দুর্ভোগ পোহাতে হয়নি। খুনি দম্পতি ভয় পাওয়ার চেয়ে বরং অবাকই হয়েছিল বেশি।
জাফর যখন মোটরসাইকেল চালু করে ততক্ষণে দম্পতি বিছানায় গড়াগড়ি দিচ্ছে প্রবল “প্যাটের বেদনা”য়। শীঘ্রই তারা হুমায়ূনের মুখোমুখি হবে। জাফর আশা করছে মৃত্যুর পরের জগতে হুমায়ূন আর সেই বোকাসোকা নেই, কারণ তার সাথে এখন তার “আম্মা” আছেন।
মোটরসাইকেলটা রেখে মজিদ মিয়ার বাড়ির পথ ধরতে ধরতে বেলা গড়িয়ে গেছে বেশখানিকটা। সাথে একটা ছুরি নিয়েছে। সেই সাথে করে নিয়েছে একটা পরিকল্পনা। মজিদ মিয়াকে একা পাবে বলে শুনেছে। এই সুযোগ আর পাওয়া না-ও যেতে পারে। তাই এই সুযোগটা সে হাতছাড়া করতে চাচ্ছে না। মজিদ মিয়াকে মেরে সে জানাবে, কথা কাটাকাটির এক পর্যায়ে ভুলে ঘটে গেছে। যেহেতু বিষাণের প্রধানই তার পক্ষে আছেন, তাই ঝামেলা এড়াতে খুব একটা সমস্যা হবে না।
মজিদ মিয়ার বাসায় আসতে আসতে হুট করে আবহাওয়া প্রচণ্ড খারাপ হয়ে গেল। ভীষণ জোরে বজ্রপাত হচ্ছে। যখন সে উঠানে পা রাখলো চমকে উঠলো হাশেম ভাইয়ের দলের এক ছেলেকে দেখে। মনে পড়ে গেল সে দুজনকে পালাতে দেখেছিল। হুমায়ূনের উত্তেজনায় ভুলে গিয়েছিল একদমই। সেই ছেলেটা কিছুক্ষণ থমকে থেকে তাকে দেখলো। হঠাৎ করে বলে উঠলো, “তোর বুকপকেটে হুমায়ূনের চশমা ক্যা?”
প্রত্যুত্তরে নিজের অজান্তেই জাফর বলে উঠলো, “তুই মরস নাই?”
তার হাতে স্বংয়ক্রিয়ভাবে চলে আসে মজিদ মিয়াকে মারার জন্য আনা সেই ছুরি। কিন্তু তাকে অবাক করে দিয়ে ভীষণ ক্ষিপ্রতায় ছুরিটা কেড়ে নিয়ে তার বুকে আমূল বসিয়ে দেয় ছেলেটা। সে অনুভব করলো তার ফুসফুস থেকে সমস্ত বাতাস বেরিয়ে যাচ্ছে, সেখানে ভরে যাচ্ছে রক্তে। দম আটকে গেছে। শেষবারের মতো বুকপকেটে হাত রাখে সে। নৌকাটাকে ছোঁয়ার আগেই সবকিছু অন্ধকার হয়ে আসে। উঠানে জমা বৃষ্টির পানিতে মৃদু ছলাৎ শব্দে পড়ে যায় তার নিঃস্পন্দ দেহ।
তার মৃতদেহ ভিজতে থাকে বৃষ্টির পানিতে। বুকপকেটে থাকা সাদা নৌকাটা চুপসে যায় কিছুটা বৃষ্টির পানিতে, আর অনেকটা রক্তে, টকটকে লাল রক্তে...
প্রিভিউ সমাপ্ত
বই : শবশিঙা
লেখক : সজল চৌধুরী
জনরা : ডার্ক থ্রিলার
প্রকাশনা : ভূমিপ্রকাশ
ম্যাচিউর কন্টেন্ট | ভায়োলেন্স | PG 18+
গত পর্ব : ক্লিক করুন
পাশ কাটিয়ে যাওয়ার সময় জাফর বুঝলো এরচেয়ে সহজ সুযোগ আর সে পাবে না। তাই সেলিম যখনই তাকে পাশ কাটিয়ে ভেতরে যাচ্ছিল ঠিক তখনই সেলিমের পিঠে সে সজোরে আমূল বিঁধিয়ে দেয় ছুরিটা। জাফরকে বিস্মিত আর বিস্ফারিত চোখে ঘুরে দেখে ধপ করে একপাশ হয়ে পড়ে যায়। সেলিমকে পা দিয়ে চেপে ধরে ছুরিটা বের করে লাথি দিয়ে চিৎ করে ঘুরিয়ে নেয়। তখনো সে মরেনি। এবার জাফর ছুরিটা গেঁথে দেয় সেলিমের পুরুষাঙ্গ বরাবর। খুব একটা প্রতিক্রিয়া দেখাতে পারে না সেলিম। ধনুষ্টংকার রোগীর মতো বেঁকে ওঠে। ওভাবেই রয়ে যায়—মূর্তি হয়ে।
দূর থেকে এই আকস্মিক ঘটনাটা রুবেল দেখে কিছুক্ষণ স্থির হয়ে দাঁড়িয়ে বোঝার চেষ্টা করে অবস্থাটা। দ্রুতই সে হিতাহিত জ্ঞান হারিয়ে ফেলে। হাতে থাকা বালতি, মগ, ব্রাশসহ পরিষ্কার করার অন্যান্য জিনিসগুলো ফেলে দৌড় দেয়। খুব বেশিদূর দৌড়াতে পারে না। উঠানে বাড়ির দেওয়ালে ঠেস দিয়ে রাখা সেই বল্লমটা হাতে নিয়ে শরীরের সমস্ত জোর একসাথে করে ছুড়ে মারে জাফর। বল্লমটা তার আস্থা রাখে। এফোঁড়ওফোঁড় করে দেয় রুবেলকে।
এবার মাটিতে হাত-পা ছড়িয়ে ধপ করে বসে পড়ে জাফর। আর শরীরে যেন আর কোনো শক্তি অবশিষ্ট নেই। বুকের সাথে লেগে গেছে থুঁতনি। প্রতিশোধ নেওয়া শেষ হতে না হতেই মাথা যেন একদম ঠান্ডা হয়ে গেছে, শান্ত হয়ে গেছে মন। আর ঠিক একারণেই সে ভাবতে পারলো, তিন-তিনটা খুনের দায় এখন তার মাথায়। তার মধ্যে একটা খুন হলো ক্ষমতাসীন দলের এক সদস্য, গ্রামের চেয়ারম্যান আর প্রভাবশালী লোক শামসুল। ফাঁসি-ই তার একমাত্র শাস্তি। কী করবে এখন সে? বেঁচে থাকতে হলে পালাতে হবে। উঠে একবার আলেয়ার কাছে যেতে চাইলো। আবার পরক্ষণেই নিজেকে বোঝালো, ওই অবস্থায় আরেকবার তাকে দেখলে সে নিজেকেই শেষ করে দিতে চাইবে।
চেয়ারম্যানের এই আস্তানাটা কিছুটা নির্জন হওয়ায় হয়তো গ্রামবাসীদের জানতে দেরি হবে, কিন্তু খুব একটা সময় লাগবে না। নিজেকে জোর করে দাঁড় করায়। মাটিতে পা ঘষে ঘষে আস্তানা থেকে বেরিয়ে আসে। অন্ধকার হয়ে আসায় সহজে কেউ তাকে খেয়াল করতে পারবে না ভেবে হাঁটতে শুরু করে।
এরপরের দিনগুলো কেবল পালিয়ে বেড়ানোর। অভাব নেই চেয়ারম্যানের শুভাকাঙ্ক্ষীর। তাই একজায়গায় লুকিয়ে থাকার মতো অবস্থা নেই। আর তাই এসময় সে খেয়াল করে আসলে তার কোথাও পালিয়ে যাওয়ার জায়গা নেই। অথচ আগে মনে করেছিল দুনিয়াটা মস্ত বড়ো। ক্ষুধায় কাতর হয়ে চুরি করতে যাওয়ার দুঃসাহস সে দেখাতে পারেনি। পাছে ধরা পড়ে যায়, আর ঝুলিয়ে দেওয়া হয় ফাঁসি কাষ্ঠে। একটা সময় বুঝতে পারে গোরস্থান লুকানোর জন্য চমৎকার এক জায়গা। বিশেষ করে পুরোনো গোরস্থান। সেখানেই এক রাতে সে প্রথম দেখা পায় শবখাদকের। তার সাথে মিলে শব খাওয়ার সময় বুঝতে পারে ক্ষুধার্ত পেটে পচাগলা মাংসও যে এতটা সুস্বাদু লাগবে পারে। আর এভাবেই সে ঢুকে পড়ে একটা শবখাদকের দলে। এই অভিজ্ঞতাই পরে তাকে অন্যান্য শবখাদকের দলে ভিড়তে সহজ করে দিয়েছে।
সর্বশেষ যে শবখাদকের দলে সে ঢুকেছিল সেই দল ধরা পড়ে বিষাণের হাতে। তার ভাগ্য ভালো কিংবা খারাপ ছিল। তার ঘাড়ে লাগে অজ্ঞান করার ডাঁট। পরবর্তীতে সে যোগ দেয় বিষাণে। টিকটিকি বানানোর জন্য বিষাণ তাদের দলে এরকম ধরে সিঁধে বানানো শবখাদকদের প্রায়ই ঢোকায়। কেননা, এরা খুব সহজেই শব খেয়ে শবখাদকদের দলে ঢুকতে পারে যেটা সাধারণ বিষাণরা পারে না। যেহেতু তার ঘাড়ে মার্ডার কেস ঝুলছে তাই তার পরিচয় খুব কম বিষাণদের কাছে রাখা হয়। আর সেইসাথে সুযোগ পায় মার্ডার কেস থেকে রেহাই পাবার সুযোগ। আর সুযোগটা হাতে আসে একটা গোপন শর্তে, যদি সে মজিদকে শব বানাতে পারে কেবল তবে।
☠
বুকপকেটে হুমায়ূনের চশমাটা নিয়ে দাঁড়ায় একটা বাড়ির সামনে। বাড়ির সবাই ঘুমিয়ে পড়েছে। পুরো বাড়ি অন্ধকার। এই বাড়িটা হুমায়ূনের।
বাজারে যাবার আগে যখন সে হুমায়ূনের সাথে কথা বলেছিল তখনই তার বাড়ির ঠিকানা শুনে নেয়। জানে যে এরপর আর শোনার সুযোগ হবে না। মোটরসাইকেলে করে ঘণ্টা দুয়েকের পথ ছিল। বিষাণদের অফিসে এসেই একটা মোটরসাইকেল নিয়ে রওনা দেয়। প্রশিক্ষণের সময় মোটরসাইকেল চালানো শেখাটা এখন খুব কাজে দিচ্ছে।
কেন যেন সে অনুভব করছিল যে তার সময় শেষ হয়ে এসেছে। আর এই কাজটা তার মরার আগেই করে যে করেই হোক করে ফেলতে হবে। মা ছাড়া মাতাল বাবার সংসারে বড়ো হওয়া জাফর জানে মায়ের অভাব কাকে বলে।
আলেয়ার কথা খুব মনে পড়ছে তার। আলেয়া কাগজের নৌকা বানাতে খুব পছন্দ করতো। খুব আনন্দ পেত পানিতে ভাসিয়ে। আর বৃষ্টি হলে তো কথাই নেই। তার আনন্দ পেত চরম পূর্ণতা। স্মৃতিটাকে জাফর হারিয়ে যেতে দেয়নি। এখনও প্রায়ই বুকপকেটে একটা কাগজের নৌকা রাখে। ভাসিয়ে দেওয়ার সুযোগ পেলে ভাসিয়ে দেয়।
প্যান্টের পকেটে হাত ঢোকালে একটা শিশির অস্তিত্ব টের পায়। একহাতে শিশিটা নিয়ে বাড়িটার দিকে এগিয়ে যায়। আসার পথেই আশেপাশের এক দোকানে খোঁজ নিয়ে জেনেছে এই বাড়িতে হুমায়ূনের বাবা আর নতুন মা ছাড়া আপাতত আর কেউ নেই। খোঁজ নেওয়ার সময় চেষ্টা করেছে নিজেকে আড়ালে রাখার, তবে দেখলেও সমস্যা নেই। কেউ তাকে খুঁজে পাবে না। জাফরের আরেক হাতে হাফ লিটারের দুইটা দুধের প্যাকেট। খোঁজ নেওয়ার সময় দোকানটা থেকে নিয়েছিল। কিছু পেতে হলে কিছু দিতে হয়।
রান্নাঘর থেকে নেওয়া ছুরি দেখিয়ে ঘুম থেকে চকিত ডেকে ওঠানো দুজন মানুষকে দুধ খাওয়াতে তার খুব একটা দুর্ভোগ পোহাতে হয়নি। খুনি দম্পতি ভয় পাওয়ার চেয়ে বরং অবাকই হয়েছিল বেশি।
জাফর যখন মোটরসাইকেল চালু করে ততক্ষণে দম্পতি বিছানায় গড়াগড়ি দিচ্ছে প্রবল “প্যাটের বেদনা”য়। শীঘ্রই তারা হুমায়ূনের মুখোমুখি হবে। জাফর আশা করছে মৃত্যুর পরের জগতে হুমায়ূন আর সেই বোকাসোকা নেই, কারণ তার সাথে এখন তার “আম্মা” আছেন।
মোটরসাইকেলটা রেখে মজিদ মিয়ার বাড়ির পথ ধরতে ধরতে বেলা গড়িয়ে গেছে বেশখানিকটা। সাথে একটা ছুরি নিয়েছে। সেই সাথে করে নিয়েছে একটা পরিকল্পনা। মজিদ মিয়াকে একা পাবে বলে শুনেছে। এই সুযোগ আর পাওয়া না-ও যেতে পারে। তাই এই সুযোগটা সে হাতছাড়া করতে চাচ্ছে না। মজিদ মিয়াকে মেরে সে জানাবে, কথা কাটাকাটির এক পর্যায়ে ভুলে ঘটে গেছে। যেহেতু বিষাণের প্রধানই তার পক্ষে আছেন, তাই ঝামেলা এড়াতে খুব একটা সমস্যা হবে না।
মজিদ মিয়ার বাসায় আসতে আসতে হুট করে আবহাওয়া প্রচণ্ড খারাপ হয়ে গেল। ভীষণ জোরে বজ্রপাত হচ্ছে। যখন সে উঠানে পা রাখলো চমকে উঠলো হাশেম ভাইয়ের দলের এক ছেলেকে দেখে। মনে পড়ে গেল সে দুজনকে পালাতে দেখেছিল। হুমায়ূনের উত্তেজনায় ভুলে গিয়েছিল একদমই। সেই ছেলেটা কিছুক্ষণ থমকে থেকে তাকে দেখলো। হঠাৎ করে বলে উঠলো, “তোর বুকপকেটে হুমায়ূনের চশমা ক্যা?”
প্রত্যুত্তরে নিজের অজান্তেই জাফর বলে উঠলো, “তুই মরস নাই?”
তার হাতে স্বংয়ক্রিয়ভাবে চলে আসে মজিদ মিয়াকে মারার জন্য আনা সেই ছুরি। কিন্তু তাকে অবাক করে দিয়ে ভীষণ ক্ষিপ্রতায় ছুরিটা কেড়ে নিয়ে তার বুকে আমূল বসিয়ে দেয় ছেলেটা। সে অনুভব করলো তার ফুসফুস থেকে সমস্ত বাতাস বেরিয়ে যাচ্ছে, সেখানে ভরে যাচ্ছে রক্তে। দম আটকে গেছে। শেষবারের মতো বুকপকেটে হাত রাখে সে। নৌকাটাকে ছোঁয়ার আগেই সবকিছু অন্ধকার হয়ে আসে। উঠানে জমা বৃষ্টির পানিতে মৃদু ছলাৎ শব্দে পড়ে যায় তার নিঃস্পন্দ দেহ।
তার মৃতদেহ ভিজতে থাকে বৃষ্টির পানিতে। বুকপকেটে থাকা সাদা নৌকাটা চুপসে যায় কিছুটা বৃষ্টির পানিতে, আর অনেকটা রক্তে, টকটকে লাল রক্তে...
প্রিভিউ সমাপ্ত
আমরা শবখাদক। আর ওরা শবখাদকদের ঘাতক—বিষাণ। আমাদের মধ্যে লড়াইটা নেকড়ে আর ভেড়ার মতো। কখনো আমরা ভেড়া তারা নেকড়ে, আবার কখনো তারা ভেড়া আমরা নেকড়ে। এই ভেড়া-নেকড়ের মধ্যে ঢুকে গেছে কিছু হায়েনা। ভেড়া আর নেকড়ে উভয়ই তার লক্ষ্যবস্তু। এই ভেড়া-নেকড়ে-হায়েনার ত্রিমুখী যুদ্ধে আপনাকে আমি আমন্ত্রণ বা নিমন্ত্রণ কোনোটাই করতে পারছি না। কারণ, এ-জগতে কেউ ঢুকলে তার লাশও বের হতে পারে না। তাই সিদ্ধান্ত পুরোটাই আপনার। সাহস আছে? থাকলে ঢুকে পড়ুন বীভৎস, হিংস্র, রোমাঞ্চকর জগৎ “শবশিঙা”য়।
বই : শবশিঙা
লেখক : সজল চৌধুরী
জনরা : ডার্ক থ্রিলার
প্রকাশনা : ভূমিপ্রকাশ
Published on November 18, 2021 10:18
•
Tags:
adult, bengali, crime-fiction, dark, fiction, mystery, preview, suspense-thriller, thriller