Hamida Mubasshera's Blog

April 18, 2022

পাপের বিজ্ঞাপন

ফেসবুকের হোম পেইজ এ একবার চোখ বুলাতেই একটা নিউজে চোখ আটকে গেল সুমির। এ কী! নীলার প্রোফাইলে সবাই Rest in Peace লিখছে কেন?

তাড়াতাড়ি করে মিতুকে ফোন দিল ও।

সুমিঃ এই নীলার কী হয়েছে রে?

মিতুঃ তুই জানিস না?

সুমিঃ নাতো, কী জানব?

মিতুঃ ও তো লাইফ সাপোর্টে ছিল তিন দিন, গতকাল রাতে মারা গেছে।

সুমিঃ ইন্নানিল্লাহি ওয়া ইন্নাইলাইহি রাজিঊন। কিভাবে? কী হয়েছিল?

মিতুঃ কিছুই নারে! সামান্য ডেঙ্গু। কিন্তু ব্রেনে ভাইরাল আক্রমণ করেছিল, ভর্তি হওয়ার দিন রাতেই একদম হঠাৎ কোমায় চলে যায়।

সুমিঃ এতো কিছু ঘটে গেছে, কিচ্ছু জানি না আমি!

মিতুঃ কেউই জানে নারে! আমিও গতকাল শুনেছি যে কোমায়, তার কিছুক্ষণ পরেই শুনি যে নাই ও। বলতে বলতে কান্নায় ভেঙ্গে পড়ল মিতু।

সুমিরও গলা রুদ্ধ হয়ে এল।

ওরা একসাথে স্কুলে পড়েছে ১০ বছর। সুমি ইসলামে আসার পর সুস্পষ্টভাবে এড়িয়ে চলত নীলা, অনেকদিন তাই যোগাযোগ ছিল না।

নীলার ফেসবুক প্রোফাইলে যেতেই ভয়ে কেঁপে উঠল সুমির সারা শরীর। জ্বলজ্বল করছে ওর হাসি মাখা ছবি। দুর্দান্ত সুন্দরী ছিল, একেকটা ছবি একেক স্টাইলের। শখানেক লাইক, হট, সেক্সি ইত্যাদি নানা বিশেষণে বিশেষিত। About এ বড়
বড় করে লেখা In a relationship with………..বয়ফ্রেণ্ডের সাথে এমন সব ভঙ্গিতে ছবি দিয়ে ভর্তি যে তাকানো যায় না! ওর ছবি হোমপেইজ থেকে হাইড করে রাখতে হয়েছিল এইজন্য!

ও আল্লাহ! এইগুলা সব যে এখন ওর বিরুদ্ধে সাক্ষী হবে! ওর কানের কাছে ভেসে উঠল কদিন আগেই পড়া একটা হাদীস-

“আমার সমগ্র উম্মাহ্‌ নিরাপদ, কেবল তারা ব্যতীত যারা কিনা তাদের পাপ নিয়ে দম্ভ করে বেড়ায়। তাদের কেউ যখন কোন কুকর্ম করে রাতে ঘুমাতে যায় এবং আল্লাহ্ তার পাপ গোপন রাখেন, সকালে ঘুম থেকে উঠার পর সে বলতে থাকে, “এই শোন, আমি না কাল রাতে এই এই (কুকর্ম) করেছি”। সে যখন ঘুমাতে যায়, আল্লাহ্ তার পাপ গোপন রাখেন, আর সকালে ঘুম থেকে উঠেই আল্লাহ্ যা গোপন রেখেছিলেন তা সে লোকজনের কাছে প্রকাশ করে বেড়ায়”। [সহীহ আল বুখারী]

আল্লাহ! ফেসবুক যে এখন আমাদের পাপের বিজ্ঞাপন দেয়ার জায়গা হয়ে গেছে। যত মানুষ এখন ওর প্রোফাইলে যাবে ওর পাপের সাক্ষী যে আরো বাড়বে………

হতবিহবল সুমির মাথায় হঠাৎ একটা বুদ্ধি আসল। ওর পরিচিত শখানেক বোনদের একটা ফেসবুক গ্রুপ আছে। ও ওদের বলল যে সবাই যেন নীলার ফেসবুক প্রোফাইলটার বিরুদ্ধে রিপোর্ট করে। গণহারে এতজন রিপোর্ট করতে থাকলে হয়ত ব্লক হয়ে যাবে ওর প্রোফাইলটা।

জীবনকে পূর্ণ মাত্রায় উপভোগে ব্যস্ত ওর এই ছোট্টবেলার বন্ধুটার জন্য এটা করা সুমির কাছে দায়িত্ব মনে হল।আল্লাহর অশেষ রহমতে দু-একদিনের মাঝেই প্রোফাইলটা ব্লক করিয়ে দিতে পারল!

সেইসাথে ছোট্টবেলার বন্ধুটার জন্য খুব করে দুআ করতে থাকলো। ও তো আমাদের আর সবার মতই মৃত্যুকে খুব দূরের কিছু ভেবেছিলো। ও এই যে ফেসবুকে এসব ছবি দিয়ে বেড়াতো, এতে আমাদের দায়ও কি এড়ানো যায়, যারা লাইক দিয়েছে, কমেন্ট দিয়ে প্রশংসা করেছে-ভাবছিলো সুমি। প্রশংসা পেতে কার না ভালো লাগে! একটা দীর্ঘশ্বাস ফেলে কুরআন খুলে সূরা নূর বের করলো সুমি। উল্টাতে উল্টাতে চোখে পড়লো নিচের আয়াতটা-

“যারা পছন্দ করে যে,ঈমানদারদের মধ্যে অশ্লীলতার প্রসার লাভ করুক,নিঃসন্দেহে ইহাকাল ও পরকালে তাদের জন্যে রয়েছে যন্ত্রণাদায়ক শাস্তি। [সূরা আন-নূর (২৪):১৯]

এটাকেই খুঁজছিলো ও। তারপর খুঁজে বের করলো সূরা যুমারের আয়াতটা যেটা একদম মন প্রশান্ত করে দেয়-

“হে আমার বান্দাগণ! যারা নিজেদের উপর বাড়াবাড়ি করেছ, তোমরা আল্লাহর রহমত থেকে নিরাশ হয়ো না। আল্লাহ সমস্ত গুনাহ ক্ষমা করে দেবেন। তিনি অতি ক্ষমাশীল, অতি দয়ালু।” [ সূরা যুমার (৩৯):৫৩]

মনে মনে আরো একবার তাওবা করলো নিজের অতীতের গুনাহগুলোর জন্য, দুআ করলো সবার জন্য যাতে আল্লাহ আর কাউকে এভাবে অপ্রস্তুত অবস্থায় তাঁর কাছে ফিরিয়ে না নিয়ে যান, আমীন।

2 likes ·   •  0 comments  •  flag
Share on Twitter
Published on April 18, 2022 08:52

হৃদয় নামের আধার

জানিস মীমপু কি হয়েছে? উত্তেজিত কণ্ঠে এসে বলল রুমা।

মীমঃ কী? এত উত্তেজিত কেন তুই?

রুমাঃ আরে আজকে যে গেলাম না জুঁই এর ভাই এর বিয়েতে? গিয়ে দেখি কনে কে জানো?

মীমঃ কে?

রুমাঃ আরে তোমার কলেজের বান্ধবী টুম্পা আপু! আমিতো দেখে পুরা বেকুব বনে গেছি! ঊনার না তোমাদের এক ক্লাসমেটের সাথে অ্যাফেয়ার ছিল? খালি যে গল্প করত আর ছবি দেখাত? উহ! কেমন পাগল পাগল ভালোবাসা! মনে আছে তোমার? Arrange Marriage এরকথা শুনে কেমন নাক সিঁটকাতো? বলত চিনি না জানি না এমন মানুষকে বিয়ে করার কথা ভাবতেই পারি না?

এই আপু চুপ কেন তুমি, বল না! মনে নাই তোমার? জুঁই এর ভাইয়ের তো হুট করে বিয়ে হল জানি।মেয়েকে নাকি খালি একবার দেখছে শুনছি! আমি তো কিছুতেই কিছু মিলাতে পারছি না।

আচ্ছা আপু মানুষ কিভাবে পারে এভাবে একজনের সাথে প্রেম করে পরে আবার অন্যকে বিয়ে করতে? ও মীম্পু! বলো না!

মীমঃ আচ্ছা বাবা থাম এখন! এভাবে বলে না মানুষকে নিয়ে।ভুল তো আমাদের সবারই হয় তাই না! কারো বেশী, কারো কম!

রুমাঃ হুম! কিন্তু এত যে গদগদ ভালোবাসা, সেটার কি হবে!

মীম অল্পক্ষণ চুপ করে থাকল। টুম্পা্র যে আজ বিয়ে সেটা ভুলেই গিয়েছিল ও।। দাওয়াত যে পায় নি তা না। রীতিমত কার্ড ছাপানো হয়েছে গায়ে হলুদ ও বিয়েতে। হিন্দী সিরিয়ালের আদতে নাচ গান হবে দেখে যায় নি মীম। আর বিয়েটা ইফতেখারের সাথে কেন হচ্ছে না এটাও জানতে চায় নি ও। ফ্রেন্ডদের এসব সম্পর্কের ব্যাপারে আর কথা বলে না ও। কুরআনের একটা আয়াতের তাফসীর পড়ে এই সিদ্ধান্ত নিয়েছে ও। আয়াতটা ছিলো-

“যারা পছন্দ করে যে,ঈমানদারদের মধ্যে অশ্লীলতার প্রসার লাভ করুক,নিঃসন্দেহে ইহাকাল ও পরকালে তাদের জন্যে রয়েছে যন্ত্রণাদায়ক শাস্তি। আল্লাহ্ জানেন,তোমরা জানো না”।
[সূরা আন-নূর; ২৪:১৯]

তাফসীরে ছিলো যে আমরা যদি একটা পাপের ব্যাপারে খুব স্বাভাবিকভাবে কথা বলতে থাকি তাহলে পরোক্ষভাবে সেটাকে উৎসাহিত করা হয়, একটা হারাম কাজ করার সময় মানুষের মাঝে যে স্বাভাবিক পাপবোধ থাকে, সেটা নষ্ট হয়ে যায়। তাই নিজেরা না করলেও বিয়ের আগের সম্পর্কগুলো নিয়ে আমরা হাল্কা হাস্যরস বা হাসি ঠাট্টা করি তাহলে আমরা নিজের অজান্তেই তাদের অন্তর্ভুক্ত হয়ে যাবো যারা পছন্দ করে যে অশ্লীলতা, ব্যাভিচার এগুলোর প্রসার ঘটুক। আর তাছাড়া এটা এক ধরণের গোপন ব্যাপার অনুসন্ধান যেটা সূরা হুজুরাতে দ্ব্যর্থহীণ ভাষায় না করা হয়েছে।
আল্লাহ বলেনঃ “মুমিনগণ, তোমরা অনেক ধারণা থেকে বেঁচে থাক। নিশ্চয় কতক ধারণা গোনাহ। এবং গোপনীয় বিষয় সন্ধান করো না। তোমাদের কেউ যেন কারও পশ্চাতে নিন্দা না করে। তোমাদের কেউ কি তারা মৃত ভ্রাতার মাংস ভক্ষণ করা পছন্দ করবে? বস্তুতঃ তোমরা তো একে ঘৃণাই কর। আল্লাহকে ভয় কর। নিশ্চয় আল্লাহ তওবা কবুলকারী, পরম দয়ালু। (৪৯:১২)”

আর একটা ব্যাপার হল ইফতেখারের সাথেই যে টুম্পার প্রথম সম্পর্ক তা তো নয়! সেই স্কুলে থাকতে ও প্রেম করেছে এলাকার এক বড় ভাইয়ের সাথে। সে কী প্রেম! ইন্টার পরীক্ষার সময় জানা গেল সেই ভাই মোটামুটি নিয়মিত ফেনসিডিল খান।তিন বছর প্রেম করেও সেটা বুঝতে পারে নি টুম্পা। তারপর সে কষ্ট ভুলতেই কী না কে জানে, আরো দুজনের সাথে ঘুরাঘুরি করেছে! শেষে ভার্সিটি ২য় বর্ষে উঠে থিতু হয়েছিল ওদের ক্লাসমেট ইফতেখারের সাথে। কাছের বন্ধু হওয়াতে এসবই জানে মীম। একবার মনে হল বলে রুমাকে বলে ফেলে যে এটা ওর জন্য কোনো ব্যাপার না, সব সম্পর্কের সময়ই এমন গদগদ ভাব করে ও, তারপর সেটা ছেড়ে আরো একটাতে জড়াতে দ্বিধাও করে না। কিন্তু সূরা হুজুরাতের ঐ আয়াতটার কথা ভেবেই চুপ করে গেলো কারণ এটা এক ধরণের ধারণা। হতেই তো পারে যে মীমের ভালোবাসায় কোনো খাদ ছিলো না, কিন্তু একান্ত নিরুপায় হয়েই এখানে বিয়ে করেছে! আর সবচেয়ে বড় কথা-
মানুষের পাপের কথা গোপন করার সওয়াব অনেক!
হাদীসে আছে-

রসূলুল্লাহ (সাল্লাল্লাহু ‘আলাইহি ওয়া সাল্লাম) বলেছেন, কোনো ব্যক্তি অপর মুসলিমের দোষ গোপনরাখলে, আল্লাহ্‌ দুনিয়া ও আখিরাতে তার দোষ গোপন রাখবেন। ( মুসলিম ২৬৯৯)

তাই এ ব্যাপারে মন্তব্য করা উচিৎ হবে মনে করল না মীম!

কিন্তু রুমা, ওর এই বছর পাঁচেকের ছোট মামাতো বোনটা একদমই নাছোরবান্দা! ও আপু! কিছু বলছ না কেন?

মীমঃ হুম! আসলেই শুনতে চাস এ ব্যাপারে আমার মন্তব্য?

রুমাঃ আরে! শুনতে চাই বলেই তো বসে আছি!

মীমঃ আমি ব্যাপারটা দেখি ইসলামিক সাইকোলোজির দিক থেকে! এই রিলেটেড কয়েকটা কোর্স করার পর থেকে আমার মাথায় এটা ঢুকসে। আমাদের হার্টটা হল একটা পাত্রের মত। এটা কখনো ফাঁকা থাকে না, বুঝলি? এটা কে যদি ‘ঠিক’ অনুভূতি দিয়ে ভর্তি না করা হয়, তবে এটা ভর্তি হবে ‘ভুল’ অনুভূতি দিয়ে। ছোটবেলা থেকে আমাদের কখনো জীবনের উদ্দেশ্য শিখানো হয় না, আল্লাহকে চেনানো হয় না তাই আমাদের হৃদয়টা আল্লাহ্‌র প্রতি ভালোবাসা দিয়ে পূর্ণ না থেকে এসব ইমোশোন দিয়ে পূর্ণ থাকে। অনেকে দেখবি বলে টাইম কাটানোর জন্য প্রেম করে। আসলে বয়সের চাহিদার জন্য তার মনটা কারো প্রশংসা শুনতে চায়, কারো সাথে গভীর রাতে কথা বলতে চায়………এইসব শুন্যতার জন্য মানুষ একটা ছুটে গেলেও আরেকটা প্রেম না করে থাকতে পারে না।

তারপর অনেক মেলামেশা করেও যখন বনিবনা হয় না, তখন জীবন নিয়ে একটা Gambling খেলার মানসিকতা তৈরি হয়ে যায়।ধুম করে একজনকে বিয়ে করে ফেলতে দ্বিধা করে না! ভালোবাসার কথা গুলো যে বলে,সেগুলো যে মিথ্যামিথ্যি বলে তা না, কিন্তু একটা সম্পর্ক ভেঙ্গে গেলে আরেকটাতে না জড়িয়ে থাকতে পারে না হৃদয়ের পাত্রটাকে ভরানোর জন্য! তবে ভুল জিনিস দিয়ে ভরায় বলেই শান্তি পায় না, বুঝলি? কারণ আল্লাহ বলেছেনঃ

”জেনে রাখো, আল্লাহর যিকির দ্বারাই অন্তর সমূহ শান্তি পায় ।”( ১৩:২৮)

রুমাঃ ইস কী অন্যরকম করে সব কিছু ব্যাখ্যা কর আপু তুমি! এইজন্যই তো কোনো ঘটনা ঘটলে আমি সেটা নিয়ে তোমার দৃষ্টিভঙ্গী জানতে চাই! জানো তুমি আমার মনের মাঝে অনেক দিন ধরে কিলবিল করা একটা প্রশ্নের উত্তর দিলা!

(সমাপ্ত)

 •  0 comments  •  flag
Share on Twitter
Published on April 18, 2022 08:41

ইসলামী অর্থনীতির পথে আমার যাত্রা শুরুর গল্প


১.
বোর্ডে ঝুলানো গ্রেডশীটে নিজের গ্রেডের দিকে এক ঝলক তাকিয়েই দৃষ্টি নামিয়ে নিলো মেয়েটি। ইতোমধ্যেই গাল তার রক্তিম আভায় ছেয়ে গেছে। সে C+ পেয়েছে ফিনান্সিয়াল ম্যানেজমেন্ট কোর্সে! এক রাশ হতাশা আর অপ্রাপ্তির অনুভূতি তাকে আচ্ছন্ন করলো। আজীবন শীর্ষ স্থান অর্জন করে এসেছে পড়াশোনায়, নিজেকে এত নিচে নামাতে কিছুতেই মন সায় দিচ্ছিলো না। ক্লাসে কোনো মনোযোগ না দিলে কিংবা পরীক্ষার জন্য কোনো পড়াশোনা না করলে এমন ফলাফলই তো স্বাভাবিক-মনকে সে যতই বুঝ দেওয়ার চেষ্টা করুক না কেন, তবুও মন যে মানে না!
“একটা মেয়ে কেন অর্থনীতি অথবা ফাইনান্স পড়বে? এটা তার জন্যে উপযুক্ত নয়। সে হয় পড়বে গার্হস্থ্য অর্থনীতি, তাফসীর, হাদীস ইত্যাদি। খুব বেশী হলে সে হয়ত ডাক্তার হতে পারে যেহেতু আজকাল মেয়েদের পর্দা রক্ষার জন্যও মহিলা ডাক্তারের প্রয়োজন।”
আজকাল সে যাদের সাথে মেশে, তারা প্রায়ই উপর্যুক্ত মন্তব্যটা করে থাকেন। এই কথাগুলো শতবার না হলেও অন্তত ৫০বার তো সে শুনেছেই! বারবার শুনতে শুনতে একসময় সে এটা বিশ্বাসও করা শুরু করেছে। এছাড়াও আরও একটি বহুল উল্লেখিত যুক্তি ছিলো যে- একজন মুসলিম হয়ে কেন সুদভিত্তিক সিস্টেম নিয়ে পড়াশুনা করতে হবে যেখানে সুদের সাথে লেনদেন আল্লাহ সুবহানাহু ওয়া তা’আলার সাথে যুদ্ধে লিপ্ত হবার শামিল? তাই ইকোনমিক্স, ফাইনান্স ইত্যাদি বিষয়গুলো নিয়ে পড়াশোনা মুসলিমদের এড়িয়ে যাওয়াই উত্তম। কথাগুলোর মাঝে যুক্তি ছিলো, তাই ফেলে দিতে পারতো না। এসব কথা শুনতে শুনতে খুব শীঘ্রই মেয়েটি বিবিএ নিয়ে পড়াশুনা চালিয়ে যাবার সমস্ত আগ্রহ হারিয়ে ফেললো আর সেটার প্রভাব পড়তে থাকলো তার গ্রেডে … কোর্সগুলোতে সে উত্তীর্ণ হতে থাকলো কেবল পাস মার্ক্স নিয়ে।“এখন আমি আমার জীবন নিয়ে কী করবো?” – প্রায়ই নিজেকে এই প্রশ্ন করতো মেয়েটা। “আমিতো মাত্রই ইসলামকে উপলদ্ধি করা শুরু করেছি, এর আগে তো আমি যে মুসলিম, এটা ছিলো শুধুই জন্মসূত্রে লাভ করা একটা পরিচয়! আমার পরিবার তো আমার এই পরিবর্তনটা একেবারেই ইতিবাচকভাবে নিচ্ছে না। তাদের ধারণা আমি যা করছি তার সবই স্রেফ বাড়াবাড়ি ছাড়া আর কিছুই না! এমনিতেই বাসার সবাই আমার উপর যারপরনাই বিরক্ত। তার উপর যদি শোনে যে আমি পড়াশোনা ছেড়ে দিতে চাই, আমাকে স্রেফ পাগল ভাববে। ত্যাজ্য ঘোষণা করে বাসার থেকে বের করে দেয়ারও সমূহ সম্ভাবনা আছে! দেশের শ্রেষ্ঠ বিজনেস স্কুলে পড়ার এই সুযোগের জন্য যেখানে শত শত মানুষ হাহাকার করছে, যেখান থেকে পাস করতে পারলেই কর্পোরেট জগতে লক্ষ টাকার চাকরি নিশ্চিত প্রায়, সেখানে পড়ার সুযোগ পেয়েও সেটা কেউ ছেড়ে দিতে চাচ্ছে এটা শুনে তাকে পাগল ছাড়া আর কী-ই বা বলা যায়?

২.
এভাবে পড়া ছেড়ে দিয়ে ‘মেয়েদের জন্য উপযোগী’ কিছু না পড়তে পারার আফসোস, অন্যদিকে ক্রমাগত খারাপ রেজাল্ট করার জন্য হতাশা- এমন দোদুল্যমান অবস্থায় মেয়েটার দিন কাটছিলো। সে এক বিশ্রী অবস্থা। এক দ্বীনী বোনের কাছে প্রায়ই এটা নিয়ে হা হুতাশ করতো সে। কথার এক পর্যায়ে হঠাৎ করেই একদিন উনি বলে উঠলেন যে “তুমি কেন ইসলামিক অর্থনীতি পড়ছো না? এই ফিল্ডে তো যোগ্য মুসলিম একদমই হাতে গোণা, কিন্তু দক্ষ জনশক্তির খুবই দরকার। তুমি যদি এই দিকে স্পেশালাইজেশন করতে পারো তাহলে তোমার বর্তমান পড়াশুনা স্বচ্ছন্দে চালিয়ে যেতে পারবে। তোমার পরিবারও এতে খুশি থাকবে আর তুমিও তোমার পড়াশুনাকে দ্বীনের খেদমতে এবং আল্লাহর সন্তুষ্টি অর্জনের পথে ব্যয় করতে পারবে ইনশাআল্লাহ।” কথাগুলো মেয়েটা যেন নিজের কানে বিশ্বাস করতে পারছিলো না। সে পাল্টা প্রশ্ন করলো, “আপনি কি আসলেই মনে করেন যে একটা মেয়ে প্রচলিত অর্থনীতি পড়তে পারবে যার মূল বিষয়ই হচ্ছে ‘সুদ’?” প্রত্যুত্তরে তিনি বললেন, “তুমি তো এই সুদভিত্তিক সিস্টেমে অবদান রাখার জন্য এটা পড়বে না। বরং পড়বে ইসলামী অর্থনীতির শ্রেষ্ঠত্ব প্রমাণ করার জন্য। তুমি যদি বর্তমান ব্যবস্থার খুঁটিনাটি না-ই জানো, তবে এর সীমাবদ্ধতাগুলো মানুষের সামনে উপস্থাপন করবে কীভাবে? বরং তুমি যদি আল্লাহ তা’আলার দেওয়া সীমারেখা মেনে এই ফিল্ডে পড়াশোনা চালিয়ে যাও, তাহলে তোমার মেধা ও যোগ্যতা দিয়ে মুসলিমদের সাথে বৃহত্তর মানবতার কল্যাণেও অবদান রাখতে পারবে। যা আল্লাহ নিষেধ করেছেন (সুদ) তা তো সমস্ত মানবজাতির জন্যই ক্ষতিকর, তাই না? তুমি যদি মুসলিমদের ইতিহাস পর্যবেক্ষণ করো, তাহলে দেখবে আমাদের একটা সমৃদ্ধ ইতিহাস আছে যেখানে নারী স্কলারদের অসমান্য অবদান স্বর্ণাক্ষরে লেখা আছে। দুঃখজনক হলেও সত্যি যে আমরা এই পরম্পরা এখন একেবারেই হারিয়ে ফেলেছি। আমরা আসলে এখন অনেক অলস হয়ে গেছি। একজন মুসলিম নারী হিসেবে আমাদের প্রাথমিক দায়িত্ব নিঃসন্দেহে একজন ভালো মা এবং স্ত্রী হওয়া। কিন্তু সেসব দায়িত্ব সুচারুভাবে পালন করেও উম্মাহর জন্য বৃহত্তর পরিসরে অনেক কিছু করা সম্ভব স্রেফ আমরা যদি আমাদের সময়টাকে ঠিক মতো কাজে লাগাই। একটু চিন্তা করলেই দেখবো আসলে হাতে অনেক সময়ই খালি পড়ে থাকে। দরকার শুধু সঠিক পরিকল্পনা, অনুকূল পরিবেশ আর গঠনমূলক কিছু করার তীব্র আকাঙ্ক্ষা।”
ওই বোনের সাথে এই একটি কথোপকথনই যথেষ্ট ছিল আমার জীবনের গতি-প্রকৃতি আমূল বদলে দেওয়ার জন্য। আমি সিদ্ধান্ত নিই ইসলামিক অর্থনীতি নিয়ে পড়াশুনা করার এবং এর মাধ্যমেই আমার জীবনের এই চমকপ্রদ অধ্যায়ের শুভ সূচনা হয় …
উপরের গল্পটি আমার নিজের জীবনের গল্প, আমার ইসলামী অর্থনীতির পথে পথ চলার পিছনের ইতিহাস। তবে এটা শুধু আমার একার জীবনের গল্প নয়, বরং সমসাময়িক অনেক মেয়েদেরই জীবনের কাহিনী। পার্থক্য হচ্ছে, সবাই হয়ত আমার মতো সৌভাগ্যবান নয় যারা এই গোলকধাঁধা থেকে বেরিয়ে আসতে পেরেছে। আমি এখন দৃঢ়ভাবে বিশ্বাস করি যে প্রাথমিকভাবে আমাকে যে ধারণা দেওয়া হয়েছে যে মেয়েরা কেবল কিছু সীমিতসংখ্যক ফিল্ডেই ভূমিকা রাখতে পারবে, তা ছিলো ভুল। কারণ জ্ঞানের প্রতিটা শাখা দিয়েই উম্মাহর কল্যাণে অবদান রাখা সম্ভব। আমার এক পরিচিত বোন আছেন যিনি এখন স্থাপত্য বিদ্যায় পিএইচডি করছেন যার রিসার্চের টপিক হচ্ছে বাচ্চাদের স্কুল, খেলনা এগুলোর ডিজাইন এমনভাবে করা যাতে শিশুদের শারীরিক পরিশ্রম অনেক বেশী হয় যা ছোট বয়সেই অনাকাঙ্ক্ষিত স্থুলতা এড়াতে মারাত্মক উপকারী। শুনে আমি অবাক হয়ে গিয়েছিলাম! আরো কত আইডিয়ার কথা যে আমার মাথায় আসে যা খুব সহজেই মেয়েরা ঘরে বসে করতে পারে। আজকের তথ্য প্রযুক্তির যুগে এভাবে কাজ করা তো অনেক সহজ আলহামদুলিল্লাহ।

৩.
বিচিত্রময় ফিল্ডে মেয়েদের কাজের সুযোগ করে দেওয়াটা আজকের সময়ে আরো বেশি জরুরী, কারণ আজকাল সবাই ছোটবেলা থেকে পরিবারের মাধ্যমে ইসলামের সঠিক জ্ঞান পায় না। জীবনের অনেকটা পথ পার করে আসার পর আমার মতো যারা ইসলামকে আবিষ্কার করেন, তাঁদের জন্য এভাবে দরজাগুলো বন্ধ করে দিলে অনেক সময়ই ফিল্ড বদলিয়ে অন্য ফিল্ডে অবদান রাখা তাঁদের পক্ষে সম্ভব হয় না। তখন চরম মেধাবী এই মেয়েগুলোর মেধা ও যোগ্যতা অনেকাংশেই সুপ্ত, অবিকশিত রয়ে যায়, উম্মাহও হয় বঞ্চিত।
আমি যখন সিদ্ধান্ত নেই যে আমার বর্তমান পড়াশোনাকে ভিত্তি করে পরবর্তীতে আমি ইসলামী অর্থনীতি নিয়ে পড়বো, তখনই আমি ইন্টারনেটে এটা নিয়ে পড়াশোনা করা শুরু করে দেই। তখন আমি ব্যবসা প্রশাসনে ব্যাচেলর করছি, সাথে ইসলামিক অনলাইন ইউনিভার্সিটিতে (IOU) ইসলামী স্টাডিজ ২য় ব্যাচেলর শুরু করেছি। ফলে ইন্টারনেট ভিত্তিক পড়াশোনার যে চ্যালেঞ্জ, অর্থাৎ তথ্যের বিভ্রান্তিকর এবং সঠিক উৎসের মাঝে পার্থক্য করা, তা আমার জন্য বেশ সহজ ছিলো। তবে নিজ উদ্যোগে ইসলামিক অর্থনীতি নিয়ে প্রাথমিক যে জ্ঞান আমি অর্জন করেছিলাম, তাতে আমি পুরোপুরি সন্তুষ্ট ছিলাম না। একাধিক অমীমাংসিত বিষয়ে নানা প্রশ্ন আমাকে অস্থির করে তুলেছিলো। ফলে আমি আল্লাহ সুবহানাহু ওয়া তা’আলার দরবারে ক্রমাগত দুআ করতে থাকি।
আয়াতুল কুরসির একটা অংশ আমাকে খুব আলোড়িত করতো-
“তাঁর জ্ঞানসীমা থেকে তারা কোনো কিছুকেই পরিবেষ্টিত করতে পারে না, যতটুকু তিনি ইচ্ছা করেন ততটুকু ছাড়া।”
আমি এ ব্যাপারে নিশ্চিত ছিলাম যে আমি কিছুই শিখতে পারবো না যদি আল্লাহ তা’আলা না চান এবং আল্লাহ একটি আন্তরিক হৃদয়কে কখনোই ফিরিয়ে দেন না। আল্লাহ সুবহানাহু ওয়া তা’আলার অশেষ রহমত স্বরূপ আমার বিয়ে হয় মালয়শিয়াতে, যা হচ্ছে ইসলামিক অর্থনীতি অধ্যয়নের কেন্দ্রস্থল! জীবন সঙ্গীর অসামান্য সহযোগিতায় আমি আন্তর্জাতিক ইসলামিক বিশ্ববিদ্যালয় (IIUM) থেকে ইসলামী অর্থনীতির উপর স্নাতকোত্তর ডিগ্রি অর্জন করতে সক্ষম হই। সেখানে আমি প্রফেসর আহামেদ কামীল মাইদিন মীরার প্রত্যক্ষ তত্ত্বাবধানে পড়াশুনা করার সুযোগ পাই যিনি হচ্ছেন সমকালীন মুদ্রা অর্থনীতিতে ইসলামী ধারা প্রচলনের ক্ষেত্রে একজন প্রভাবশালী বক্তিত্ব। আলহামদুলিল্লাহ আমি আমার সকল প্রশ্নের সদুত্তর পেয়েছি তাঁর কাছে পড়তে গিয়ে।
তবে আমার যাত্রাটি মোটেও সহজ ছিল না। কারণ আমাকে একইসাথে তিনটি প্রজেক্টে কাজ করতে হয়েছিলো পড়ার খরচ যোগাড় করার জন্য। সেই সময়ে আন্তর্জাতিক ছাত্র-ছাত্রীদের জন্য স্নাতকোত্তর পর্যায়ে কোনো বৃত্তির সুযোগ ছিলো না। কাজ এবং পড়ার চাপে যখন সবকিছু এলোমেলো লাগতো তখন সুরা আল-ইমরান এর ১৯৫ নং আয়াতটি আমাকে খুব আশা জাগাতো-
“অতঃপর তাদের পালনকর্তা তাদের দুআ (এই বলে) কবুল করে নিলেন যে, আমি তোমাদের কোনো পরিশ্রমকারীর পরিশ্রমই বিনষ্ট করি না, তা সে পুরুষ হোক কিংবা স্ত্রীলোক।”

৪.
বর্তমানে আমি প্রচলিত অর্থনীতিতে পিএইচডি করছি, আমি গর্বিত এমন একটি সুযোগ পেয়ে যেখানে আমি বর্তমানের অসুস্থ সুদভিত্তিক অর্থনীতির সীমাবদ্ধতাগুলো মানুষের সামনে তুলে ধরতে পারি। কীভাবে হালাল উপায়ে অর্থ উপার্জন ও ব্যয় করা যায় তথা ইসলামের আলোকে সম্পদ ব্যবস্থাপনার ব্যাপারে মানুষকে সাহায্য করি।
আমি বিশ্বাস করি প্রত্যেক মুসলিম নারীরই তার নিজ নিজ ক্ষেত্র থেকে উম্মাহর সাহায্যের জন্যে এগিয়ে আসা উচিত। কেবল মাত্র একজন শিক্ষিত এবং আত্মবিশ্বাসী মা-ই পারেন এমন এক মুসলিম জাতিকে গড়ে তুলতে যারা উম্মাহকে বর্তমানের লাঞ্চনাদায়ক অবস্থা থেকে মুক্তি দিতে পারবে। আমরা নিজেরা যদি পরিবর্তনের রূপকার না হতে পারি, তাহলে বড় বড় কথা বলা আসলে সাজে না। কথার চেয়ে কাজে মনোনিবেশ করা এখন আমাদের জন্য বেশি দরকার।
আমি স্বপ্ন দেখি সেই দিনের যেদিন প্রত্যেকটি নারীরই স্পষ্ট জ্ঞান থাকবে বর্তমান মুদ্রানীতির গতিপ্রকৃতি সম্পর্কে। তারা জানবে কোন লেনদেন রিবা মুক্ত এবং কোনটি নয়, সেটার ভিত্তিতে তারা দূরদর্শী অর্থনৈতিক সিদ্ধান্ত নিতে সক্ষম হবে এবং নিজের পরিবারকেও এই ব্যাপারে সাহায্য করবে। এই স্বপ্ন পূরণের পথে আমি সক্রিয় ভূমিকা রাখতে চাই। কেবলমাত্র নারী বলে মানুষকে সুদ থেকে মুক্ত রাখার যে যুদ্ধ তাতে আমি দর্শক হয়ে থাকতে চাই না, যোদ্ধা হয়ে অবদান রাখতে চাই।

 •  0 comments  •  flag
Share on Twitter
Published on April 18, 2022 08:12

পূজা দেখতে যাওয়া, অতঃপর . . . . . . .

মুসলিমদের সপরিবারে পূজা দেখতে যাওয়া ইদানীং একটি কালচারে পরিণত হয়েছে। এর মাধ্যমে আমরা হয়তো নিজেদেরকে অসাম্প্রদায়িক চেতনার ধারক আধুনিকমনস্ক মানুষ হিসেবে প্রমাণ করতে চাই। কিন্তু অন্যের ধর্মবিশ্বাস নিয়ে হাসি ঠাট্টা না করা, তাদেরকে তাদের ধর্ম পালনে বাঁধা না দেয়া আর নিজেরাও অন্যের ধর্মীয় অনুষ্ঠানের দর্শক হওয়ার মাঝে যে একটা Thin line আছে এটা বোধহয় আমরা আজকাল বুঝতে পারি না। সেই সাথে এটাও অনুধাবন করতে পারি না, আমাদের পরবর্তী প্রজন্মকে হাত ধরে পূজামন্ডপে বেড়াতে নিয়ে গিয়ে আমরা কিভাবে নিজেদের অজান্তেই নিজেদের জন্য গুনাহ জারিয়ার পথ তৈরি করছি। “আমরা তো পূজা করছি না, শুধু দেখতে যাচ্ছি ”—-এই কথা বলে আমরা যতই নিজেদের কাজকে justify করতে চাই না কেন আমাদের এই অপরিণামদর্শী কর্মকান্ড আমাদের পরবর্তী প্রজন্মকে শিরকের মতো একটি ভয়াবহ গুনাহ সম্পর্কে অনুভূতিশূণ্য করে দিচ্ছে –এই বোধটা আমাদের মনে কাজ করছে না।
আমরা জানি, শিশুদের brain এমন একটি hard disk যার অনেকটাই এখনও ফাঁকা রয়ে গেছে এবং আশেপাশের বিভিন্ন ঘটনা থেকে এই hard disk এ ক্রমাগত information জমা হচ্ছে । এই information গুলোর ভিত্তিতে তাদের পরবর্তী জীবনের জীবণাচরণ অনেকটাই প্রভাবিত হবে। আমরা হয়তো ভাবছি , আমরা আমাদের সন্তানদের শিক্ষা দিয়েছি “আল্লাহ এক, তাঁর কোনো শরীক নাই। ” তাই পূজামন্ডপে গিয়ে যতই মূর্তিপূজা দেখুক না কেনো এটা তারা স্রেফ অন্য ধর্মের অনুষ্ঠান হিসেবেই উপভোগ করবে !! তাদের মনোজগতে এটার কোনো দীর্ঘমেয়াদী প্রভাব পড়বে না। কিন্তু এতটা আত্মবিশ্বাসী হবার অবকাশ আদৌ কি আছে?? আমাদের পরিণত Hard disk ( যেখানে তেমন আর জায়গা খালি নেই) এর সাথে তাদের অপরিণত Hard disk (যার অধিকাংশই এখনও খালি) তুলনা করাটা কিন্তু মারাত্মক বোকামি !! তাই মূর্তি পূজা দেখে আমাদের তাওহীদের কিশ্বাস হয়তো টলায়মান হয় না, কিন্তু শিশুরাও যে ভবিষ্যতে পথভ্রষ্ট হবে না তার কোনো গ্যারান্টি নেই ; বিশেষত যেখানে শয়তান সবসময় তার সৈন্যবাহিনী নিয়ে আমাদেরকে সিরাতুল মুস্তাকীম থেকে বিচ্যুত করার জন্য সদা তৎপর।

আমরা যদি একটি উদাহরণ দিয়ে ব্যাপারটা বোঝার চেষ্টা করি, আমাদের পার্শ্ববর্তী দেশের দুটি জনপ্রিয় সিরিয়াল হলো জয়ী এবং নকশীকাঁথা । জয়ী সিরিয়ালের নায়িকা একজন ফুটবলার এবং নকশীকাঁথা সিরিয়ালের নায়িকা শবনম, যশ নামে একজন হিন্দু ছেলেকে ভালোবাসে। এখন আমাদের দেশের মা, মামী, চাচীরা যখন প্রতিদিন এসব সিরিয়াল দেখেন ,তখন তারা হয়তো এগুলোকে বিনোদনমূলক অনুষ্ঠান হিসেবেই দেখেন। এই বয়সে এসে নিশ্চয়ই তাদের মনে ফুটবলার হওয়ার বা অন্য ধর্মের কাউকে ভালোবাসার সাধ জাগে না,, কিন্ত এই মা, মামী, চাচীদের সাথে যখন তার পরিবারের শিশু সন্তানটিও এসব দেখে তখন কি তার মনে একই রকম প্রভাব পড়ে? সে যদি বড় হয়ে ফুটবলার হতে চায় বা অন্য ধর্মের কাউকে বিয়ে করতে চায় তবে কি এই মা, খালা, মামীরাই বিষয়টিকে স্বাভাবিক ভাবে মেনে নিতে পারবেন? এই ধরনের পেশা বা বিয়ে যে মুসলিম মেয়েদের জন্য প্রযোজ্য না, এই কথাগুলো বোঝানো কি তখন সহজসাধ্য হবে??? তখন যদি আজকের শিশুরা বড় হয়ে আমাদেরকে backdated বলে অভিহিত করে তবে তার জবাব দেয়ার ভাষা কি আমাদের থাকবে?? আসুন সন্তানদের সাথে নিয়ে সিরিয়াল দেখার পূর্বে বিষয়টি ভেবে দেখি।

এবারে আসি ধর্মীয় আচার- অনুষ্ঠানের বিষয়ে। পার্শ্ববর্তী দেশের সিরিয়ালগুলোর একটি কমন বৈশিষ্ট্য হলো, সিরিয়ালগুলোতে সারা বছর জুড়েই তাদের কোন না কোন ধর্মীয় আচার -অনুষ্ঠান সম্পর্কিত পর্ব চলতে থাকে। এভাবে ক্রমাগত তাদের ধর্মীয় আচার-অনুষ্ঠানের উদযাপন দেখতে দেখতে আমরা কখন যে নিজেদের জীবনেও এসব অনুষ্ঠানের অনুকরণে উদযাপন শুরু করে দিয়েছি তা হয়তো আমরা নিজেরাও জানি না। হয়তো আমাদের অনুষ্ঠানের নাম ভিন্ন, কিন্তু উদযাপনের ধরন একই। যেমন-শিশুদের জন্য অন্নপ্রাশনের অনুকরণে মুখে ভাত, অন্ত:সত্তাদের জন্য গোদ-ভরাইয়ের অনুকরণে সাথ, দোলের সময় হোলি খেলার অনুকরণে রং ছিটানো, বিয়ের সময় আশির্বাদের অনুকরণে এনগেজমেন্ট, মেহেদী সন্ধ্যার অনুকরণে গায়ে হলুদ—-এই জাতীয় অনুষ্ঠান গুলো অলরেডি আমাদের সংস্কৃতির অংশ হয়ে দাঁড়িয়েছে যা মুসলিমদের ধর্মীয় বিশ্বাস এবং ইসলামিক সংস্কৃতির সাথে সম্পূর্ণ সাংঘর্ষিক ।

এরই ধারাবাহিকতায় যখন মহালয়া থেকে শুরু করে বিসর্জন পর্যন্ত প্রতিদিন প্রতিটি সিরিয়ালের পর্বে পূজার বর্নাঢ্য ও আকষর্ণীয় উদযাপন দেখানো হয় তখন খুব স্বাভাবিকভাবেই মুসলিমদেরও ইচ্ছা করে সপরিবারে সুসজ্জিত হয়ে পূজার গেট, আলোক সজ্জা, পূজা মন্ডপ ও দেবী বিসর্জন দেখতে যাওয়ার । আর এই স্রেফ দেখতে যাওয়ার পরিনতি যে পরবর্তী প্রজন্মের জন্য কতটা ভয়াবহ হতে পারে তা হয়তো আমরা ধারণাও করতে পারছি না।

আমরা যদি মূর্তি পূজার ইতিহাস অনুসন্ধান করি, তবে জানবো চূড়ান্ত পথভ্রষ্টতা কখনই একদিনে আসেনি। ইব্‌নু ‘আব্বাস (রাঃ) থেকে বর্ণনা করেছেন,
প্রতিমার পূজা নূহ্ (‘আ.)-এর লোকদের মাঝে চালু ছিল, পরবর্তী সময়ে আরবদের মাঝেও তার পূজা প্রচলিত হয়েছিল। নূহ (‘আ.)-এর সম্প্রদায়ের কতিপয় নেক লোকের নাম নাসর ছিল। তারা মারা গেলে, শয়তান তাদের কওমের লোকদের অন্তরে এ কথা ঢেলে দিল যে, তারা যেখানে বসে মাজলিস করত, সেখানে তোমরা কতিপয় মূর্তি স্থাপন কর এবং ঐ সমস্ত পুণ্যবান লোকের নামেই এগুলোর নামকরণ কর। কাজেই তারা তাই করল, কিন্তু তখনও ঐ সব মূর্তির পূজা করা হত না। তবে মূর্তি স্থাপনকারী লোকগুলো মারা গেলে এবং মূর্তিগুলোর ব্যাপারে সত্যিকারের জ্ঞান বিলুপ্ত হলে লোকজন তাদের পূজা আরম্ভ করে দেয়। [বুখারী (৪৯২০) তাফসীর ইবনে কাসীর (১৮/১৪২-১৪৪) ]

এভাবেই শয়তান কোন পাপ কাজের প্রতি মানুষের বিতৃষ্ণার অনুভূতি ম্লান করতে করতে তাকে স্বাভাবিকের পর্যায়ে নিয়ে যায় এবং অত্যন্ত ধৈর্য্যের সাথে কয়েক প্রজন্ম ধরে চেষ্টা চালিয়ে যায় মানুষকে শিরকে লিপ্ত করতে। আমাদের সময়ের প্রেক্ষিতে যদি প্রক্রিয়াটা এরূপ হয় যে,
আমাদের সন্তানরা পূজা দেখতে যাচ্ছে দর্শক হিসেবে——তাদের পরবর্তী প্রজন্ম পূজার কিছু আচার-অনুষ্ঠানে অংশ নিচ্ছে ফান হিসেবে ———তাদের পরবর্তী প্রজন্ম নিজেরাই পূজা করা শুরু করে দিচ্ছে সিরিয়াসলি ( আল্লাহ মাফ করুন।)

তবে কি আজ হাত ধরে পূজা দেখতে নিয়ে যাওয়ার জন্য আমরা দায়ী থাকবো না? সাদকায়ে জারিয়ার পরিবর্তে তখন আমাদের সন্তানরা কি আমাদের জন্য গুনাহর জারিয়ার উপলক্ষ হবে না???( রাসূল সা:) তো ভবিষ্যৎ বাণী করেই গেছেন—-
‘অচিরেই আমার উম্মতের কিছু লোক মূর্তিপূজা করবে। আর অতি শীঘ্রই আমার উম্মতের কিছু লোক হিন্দু বা বিজাতিদের সাথে মিশে যাবে’ (ইবনে মাজাহ হা/৩৯৫২, সহীহ হাদীস)।
আমাদের বংশধরদের মধ্যে কে্উ যেন এই জাতীয় গুনাহ না করে সেজন্য আসুন সময় থাকতেই সচেতন হই। পূজার অনুষ্ঠানগুলো যতই চাকচিক্যময় হোক না কেন, সন্তানদের উমার রাদ্বিয়াল্লাহু আনহুর নিচের কথাটি সম্পর্কে জানাই-
“মুশরিকরা যখন পূজা করতে থাকে তখন আমরা চাক্ষুষ দেখতে না পেলেও আল্লাহর ক্রোধ তাদের উপর পড়তে থাকে। ঐ সময় ওখানে উপস্থিত থাকলে আমরাও তার সম্মুখীন হবো এটা নিশ্চিত।” (বায়হাক্কী)
সেই সাথে সন্তানদের মনে এ্ই বিশ্বাস দৃঢ়ভাবে প্রোথিত করি যে,আল্লাহর সাথে শিরক করা এমন পর্যায়ের পাপ যা শত সহস্র অন্য ভালো কাজকে অর্থহীণ করে দেয়ার জন্য যথেষ্ট। তওবা না করে মৃত্যুবরণ করলে একমাত্র যে পাপ আল্লাহ ক্ষমা করবেন না, তা হল শিরক। আল্লাহ বলেছেন-

নিশ্চয় যে ব্যক্তি আল্লাহর সাথে অংশীদার স্থির করে, আল্লাহ তার জন্যে জান্নাত হারাম করে দেন। ( সূরা মায়িদা: ৭২)

আমাদের জন্য আরেকটি করণীয় হলো, সন্তানদের জন্য দুআ করা যেমন ইব্রাহীম আলাইহিস সালাম পড়েছিলেন-
হে পালনকর্তা, এ শহরকে শান্তিময় করে দিন এবং আমাকে ও আমার সন্তান সন্ততিকে মূর্তি পূজা থেকে দূরে রাখুন। ( সূরা ইবরাহিম :৩৫)
সাথে হাদীস থেকে শিখানো আরেকটি দুআ
হে আল্লাহ! আমি জ্ঞাতসারে আপনার সাথে শিরক করা থেকে আপনার নিকট আশ্রয় চাই এবং অজ্ঞতাসারে (শিরক) হয়ে গেলে তার জন্য ক্ষমা চাই।
[আহমাদ ৪/৪০৩, নং ১৯৬০৬; ইমাম বুখারীর আল-আদাবুল মুফরাদ, নং ৭১৬]

আল্লাহ আমাদের এবং আমাদের পরবর্তী প্রজন্মকে জ্ঞাতসারে বা অজ্ঞাতসারে শিরকের মতো ভয়াবহ গুনাহ থেকে দূরে থাকার তৌফিক দান করুন । আমীন।

 •  0 comments  •  flag
Share on Twitter
Published on April 18, 2022 07:54

Halloween : শুধুই কি মজা?

সে বছর আমি সদ্য আমেরিকাতে এসেছি।উঠেছি এক বাঙ্গালী পাড়ার মাঝে। মানে উপরে, নিচে, ডানে বামে সব দিকে ছিলো বাঙ্গালী। প্রতিবেশী এক আপু বিশাল একটা মিষ্টি কুমড়া কিনেছেন। একদম ঢাউশ সাইজ। সবাইকে ভাগ দিয়ে বেড়াচ্ছেন। জানালেন এই সময়টাতে অনেক ছাড় পাওয়া যায় মিষ্টি কুমড়াতে। আমি তখন Halloween এর ব্যাপারে একদম খ্যাত, মানে কিছুই জানিনা। যদিও অ্যামেরিকান প্রতিবেশীদের বাসায় দেখছিলাম যে বাসার বাইরে মিষ্টি কুমড়া দিয়ে ডেকোরেট করা……আগা মাথা কিছুই বুঝতেছিলাম না। তবে একটা জিনিস মনে হয়েছিলো যে এই দেশে উৎসব উদযাপনের জন্য যা লাগে সেটা যেন সবাই কিনতে পারে সেজন্য ছাড় দেয়া হয়, আমাদের দেশের মত রোযা, ঈদের সময় জিনিসের দাম বেড়ে যায় না। এইটা একটা ভালো দিক।
যাই হোক, সেই বছরই আপাদমস্তক কালো, বেশ ঢিলাঢালা বোরখা পরে গিয়েছি Wallmart এ বাজার করতে। সেখানে এক লোক আমাকে দেখে হেসে বললো Halloween Costume? Nice! আমার তো যাকে বলে চক্ষু ছানাবড়া! খুবই মেজাজ গরম হয়েছিলো, কিন্তু কিছু বলি নি। সেইদিনই বাসায় আসার পরই রাত ৮-৯টার দিকে আমার প্রতিবেশী কিছু বাঙ্গালী দরজায় নক করলো। দরজা খুলতেই তারা সানিয়া আপুউউউ বলে একটা চিৎকার দিলো, আমি একটু পিছিয়ে গেলাম, সামনে তাকিয়ে দেখি ভয়ংকর মুখোশ পরা একাধিক চেহারা। আমাকে ভয় দেখাতে এসেছে। পরে লক্ষ্য করলাম যে ফেসবুকের হোমপেইজে পরিচিতরা প্রায় সবাই Halloween Costume পরা ছবি পোস্ট করছে- Halloween Fun এমন নানা ধরণের ট্যাগ দিয়ে। এসব ব্যাপারে আমি বরাবরই একটু ব্যাকডেটেড আর রসকসহীণ টাইপ। এইসব কুৎসিত দর্শন মুখোশ পরা আর মানুষকে ভয় দেখানোর মাঝে কী ফান থাকতে পারে সেটা আমার বুঝে আসতো না, সত্যি বলতে কী আমার কেমন যেন গা গুলাতো।
আস্তে আস্তে সময় গড়ালো, এই উৎসবের উদযাপনের সাথে আরো পরিচিত হলাম। ৩১শে অক্টোবরের আগে সমস্ত স্টোরগুলোতে Halloween এর পোশাক, মুখোশ এগুলো সাজানো থাকতো, আমেরিক্যান প্রতিবেশীদের দেখতাম বাসার বাইরে ঢাউশ সাইজের মিষ্টিকুমরার সাথে নানা ধরণের কংকাল, শয়তানের চিহ্ন, বিমূর্ত জিনিসপাতি যা দেখলেই কেমন যেন গা ছমছম করতো।
উদযাপনের ব্যাপকতা দেখে আমার কৌতূহলী মন এগুলোর মানে বুঝতে চাইলো। আজকাল যেহেতু উৎসবটা ভৌগোলিক সীমানার দ্বার অতিক্রম করে ছড়িয়ে পড়েছে আমাদের দেশেও, বিশেষ করে ইংলিশ মিডিয়াম শিক্ষা প্রতিষ্ঠানগুলোতে, তাই এটা নিয়ে পড়াশোনা করে যা বুঝলাম সেটা আজকে সংক্ষেপে তুলে ধরার চেষ্টা করবো ইনশাল্লাহ।

Halloween শব্দের উৎপত্তি All Hallows Eve শব্দটি থেকে। এটার অর্থ ‘পবিত্র সন্ধ্যা ’। প্রায় দুই হাজার বছর আগে ইংল্যান্ড ,আয়ারল্যান্ড ও উত্তর ফ্রান্সের Celtic religion এ বিশ্বাসীরা নববর্ষ পালন করতো ১লা নভেম্বর। ৩১ অক্টোবর সন্ধ্যায় তারা গ্রীস্মকালকে বিদায় জানিয়ে শীতকালকে স্বাগত জানাতো। তারা বিশ্বাস করতো যে এই দিন ইহলৌকিক ও পারলৌকিক- এই দুই জগতের মধ্যবর্তী প্রাচীর বিলুপ্ত হয়ে যায়। ফলে মৃত ব্যক্তির আত্মারা পৃথিবীতে ঘুরতে আসে। ফেরৎ যাওয়ার সময় তারা তাদের প্রিয়জনকে সাথে নিয়ে যেতে চায়। এই রাতটি তাই একটি ভয়ের রাত। মূলত এসব মৃত আত্মার দ্বারা সম্ভাব্য জান-মালের ক্ষতি এড়ানোর জন্য তারা পাহাড়ের চূড়ায় আগুন জ্বালিয়ে রাখতো এবং নিজেরা ভয়ংকর পোশাক ও মুখোশ পরে ঘুরে বেড়াতো। তারা ভাবতো তাদের এই ভয়ংকর বেশ কিংবা বাসার সামনে প্রেতাত্মার মুখের আদলে কেটে রাখা মিষ্টিকুমড়া, তার ভিতরে জ্বলতে থাকা বাতি মৃতদের আত্মারা পালিয়ে যাবে কিংবা কে কোন জন সেটা চিনতে পারবে না। Halloween উদযাপনের মূল থিম তাই Treat and Trick. মানে মৃত আত্মাদের Treat দেয়া যেন তারা খুশী থাকে, কোনো ক্ষতি না করে, কিংবা Trick করা, মানে চাইলেও ক্ষতি যেন করতে না পারে।

এখন এসব বিশ্বাস যে ইসলামের সাথে সম্পূর্ণ সাংঘর্ষিক সে ব্যাপারে তো কোনো সন্দেহ নেই। মৃত্যুর পর আত্মার সাথে এই দুনিয়ার সম্পর্ক সম্পূর্ণরূপে বিছিন্ন হয়ে যায়। আর আল্লাহ ছাড়া অন্য কোনও সত্তার পক্ষে মানুষের সুরক্ষা/ ক্ষতি করা সম্ভব নয়। তাই Halloween উদযাপনের উৎপত্তিগত বিশ্বাসগুলো নিঃসন্দেহে শিরকের অন্তর্ভূক্ত। কিন্তু এগুলো কিছু না বিশ্বাস করে এমনিই যদি কেউ Fun হিসেবে করে? বড়রা কিংবা বাচ্চারা যদি স্রেফ এসব পোশাক/ মুখোশ পরে ভয় দেখাতে চায়?

এটা নিয়ে কথা বলার আগে আমি নিজের কিছু উপলব্ধি শেয়ার করতে চাই। আমার ছোটবেলা কোনো ঠাকুরমার ঝুলির রাক্ষস ক্ষোক্কস বা সিন্ড্রারেলা টাইপের রূপকথা পড়ে কাটেনি। আমার আব্বা আমাকে ঘুমানোর আগে নবী রাসূলদের নানা কাহিনী শুনাতেন…আমার ছোটবেলা তাই এক কথায় বাস্তবধর্মী ছিলো। সেজন্য কী না জানি না, বড় হয়েও ভুতের গল্প আমাকে কখনো টানেনি। আত্মহত্যা করলে বা অপঘাতে মারা গেলে সেই অতৃপ্ত আত্মারা আমাদের চারপাশে ঘুরে বেড়ায়, তাদের সৎকার করলে আর ডিস্টার্ব করে না এই টাইপের গল্পগুলো যখন ভারতীয় লেখকদের বইতে পড়তাম তখন অবধারিতভাবে আমার মনে হত এগুলো হিন্দুদের বিশ্বাস, ওদের কালচার। এর বহু বছর পর আমি যখন ইসলাম নিয়ে পড়াশোনা করেছি, The world of jinn and devils made perfect sense to me. আমাদের চারপাশে নানা অলৌকিক ঘটনা কিভাবে ঘটে, জ্যোতিষীরা কিভাবে ভবিষ্যৎ বলে, কোয়ান্টাম মেথড বা এগুলোর একদম পরের ধাপগুলোতে যে জ্বীনের সাহায্য নিয়ে মানুষকে ফাঁদে ফেলা হয়, এগুলো আমি খুব সহজে বুঝেছি আলহামদুলিল্লাহ। আমি বিশ্বাস করি আমাদের চারপাশে বহু শিরকের দরজা বন্ধ করতে হলে এই অদৃশ্য জগতটা নিয়ে মানুষের ব্যাসিক জ্ঞান থাকাটা একদম আবশ্যক। কিন্তু অদ্ভূত ব্যাপার হল সামনাসামনি প্রতিবেশীদের মাঝে হোক আর অনলাইনে হোক, যখনই আমি world of jinn and devils নিয়ে ক্লাস নিতে চেয়েছি, আমি অধিকাংশ শ্রোতাদের মাঝে এক ধরণের অনীহা দেখেছি। তারা বলতো তাদের ভয় লাগবে, রাতে ঘুমাতে পারবে না ইত্যাদি।

আমি অবশ্যই এই দাবী করবো না যে ছোটবেলায় যারা রাক্ষস ক্ষোক্কসের গল্প পড়ে বড় হয়েছে তারাই জ্বীনজগত সম্পর্কে জানতে অনাগ্রহী ছিলো, কিন্তু আমি খুব দৃঢ়ভাবে বিশ্বাস করি যে ছোটবেলায় আমরা যা পড়ি বা যা করি তার একটা Life long impact থাকে। আমাদের জীবনে তো যা হয়েছে হয়েছে, কিন্তু আমাদের বাচ্চারা কিসে মজা পাবে আর কিসে ভয় পাবে এইটা গড়ে দেয়ার দায়িত্বটা কিন্তু আমাদের, অন্তত মুসলিম মা বাবার, যারা আমরা চাই আমাদের বাচ্চারা বুঝে শুনে ইসলাম পালন করুক।
মনে হতে পারে যে এসব কথার সাথে Halloween উদযাপনের কী সম্পর্ক।
আছে।
গভীর সম্পর্ক আছে।
প্রথমত, Halloween এর দিনে যেসব মুখোশ ও পোশাক ব্যবহার করা হয় তা যে কারো মনে বিবমিষার অনূভূতি সৃষ্টি করাটাই স্বাভাবিক। এসব জিনিস গায়ে চরিয়ে কাউকে ভয় দেখানোর মাঝে আদতে মজার কিছু নেই। কিন্তু ছোটবেলা থেকে প্রতি বছর বাচ্চারা যদি এসব পোশাক ও মুখোশ পরিধানে অভ্যস্ত হয়ে যায় এবং এসব কাজ করাটা তাদের জন্য আনন্দের খোরাক হতে থাকে তাহলে তারা এমন কিছুতে আনন্দ পাবে যেটাতে আসলে খুব দুঃখ বা কষ্টকর অনুভূতি হওয়ার কথা ছিলো।
একটা উদাহরণ দিলে ব্যাপারটা হয়ত ক্লিয়ার হবে। এবারের রামাদ্বানে আমি মাসজিদের যে সেকশনে নামায পড়েছি সেটা ছিলো এক্সক্লুসিভলি বাচ্চাদের মায়েদের জন্য নির্ধারিত। সেখানে মায়েদের সাথে ৮-৯ বছরের বেশ কয়েকটা বাচ্চা আসত। মায়েরা নামাযের সময়টা মোবাইল দিয়ে ওদের ব্যস্ত রাখত। আমি খেয়াল করে দেখলাম যে ওরা পুরাটা সময় মোবাইলে গেম খেলে না হয় সেলফি তুলে সেই ছবিকে কোনো একটা অ্যাপ দিয়ে এডিট করে সেটা দেখে খিলখিল করে হাসে। ব্যাপারটাতে আমার খুব অবাক লাগছিলো কারণ এডিট করা ছবিগুলা অধিকাংশ ক্ষেত্রেই খুব বিকৃত হত। ওটা দেখে হাসি আসা তো দূরের কথা, ভয়ে গা শিউরে ওঠা উচিৎ। আমি চিন্তা করছিলাম যে এই বাচ্চাগুলো যদি রাস্তায় কাউকে দেখে যে গণপিটুনি খেয়ে পড়ে আছে কিংবা অসুস্থ বা অসহায় তাহলে তাদের কাছেও কি ব্যাপারটা ফানি লাগবে? নিজের সহপাঠী বা আত্মীয় কাউকে পিটিয়ে ভর্তা করে তারা কি মজা পাবে? আবরারের খুনীদের মত?
কিংবা চিন্তা করুন ফেসবুকে ফেস অ্যাপ দিয়ে নিজের বর্তমান চেহারাকে পরিবর্তন করে বৃদ্ধ বয়সের চেহারা বানানোর ব্যাপারটাই। সুস্থভাবে চিন্তা করলে বৃদ্ধ বয়সে কারও চেহারাই দৃষ্টিসুখকর থাকে না। চুল সাদা হয়ে যায়, চোখ, গালের চামড়া কুঁচকে যায়, দাঁত পড়ে যায়। এই বয়সের অসহায়ত্ব আসলে আল্লাহর এক নিদর্শন যেটার কথা আল্লাহ কুরআনে উল্লেখ করেছেন। আজকের বৃদ্ধ কাউকে দেখে আমাদের নিজেদের এহেন পরিণতির কথা ভেবে আমাদের ইগো বিসর্জন দেয়া উচিৎ, মৃত্যুমুখী জীবন যাপন করা উচিৎ। কিন্তু এমন চেহারা দেখে যদি তরুণ প্রজন্মের মধ্যে আনন্দের অনূভূতি জন্মে তাহলে তাদের মাঝে কি কোনো গঠনমূলক পরিবর্তন আসবে?
দ্বিতীয়ত, যতই বিষয়গুলোকে fun হিসেবে উপস্থাপন করা হোক না কেন, এভাবে উৎকট দর্শন মুখোশ আর পোশাক পরে উদযাপন করতে থাকলে শিশুদের মনে অজান্তেই অদৃশ্য জগত সম্পর্কে এক ধরনের ভুল ধারণা তৈরি হতে থাকবে। এরপর আমরা যখন তাদেরকে ইসলামের ‘বাস্তব অথচ অদৃশ্য সত্তা’ যেমন শয়তান, ফেরেশতা, জ্বীন সম্পর্কে ধারণা দেব তখন হয়তো তারা এদেরকেও funny character হিসেবে চিন্তা করা শুরু করবে। ধরেন আপনি আপনার বাচ্চাকে কবরের প্রশ্নোত্তরের ব্যাপারে ধারণা দিচ্ছেন যেখানে বলা হয়েছে মুনকার নাকীরের কথা। কিংবা মৃত্যুর আগে অবিশ্বাসীদের জান ক্ববজ করতে যেসব ফেরেশতা আসবে তারা যে খুবই ভয়ংকর দর্শন হবে সেটা জানাচ্ছেন। দেখা যাবে Halloween উদযাপনে অভ্যস্ত আপনার সন্তান আপনাকে জিজ্ঞেস করছে আমার অমুক মুখোশটার মত দেখতে হবে আম্মু? That’s funny! I can handle that!
তখন কী বলবেন আপনি?
আমি আসলে নিজের চোখে দেখেছি রক মেটালের Devil Worship এর গান শুনে কিভাবে বাচ্চারা Lucifar, Satan কে ভালোবাসতে শুরু করে, আমি জানি বিভিন্ন ধরণের ভিডিও গেমস যেখানে Fireball দিয়ে খেলতে হয় সেগুলো খেলে অভ্যস্ত বাচ্চারা জাহান্নামের বর্ণনা শুনে কিভাবে সেটাকে ছেলেখেলা মনে করে, কিভাবে কার্টুনগুলোতে সবসময় দারুণ শক্তিমান চরিত্রকে এক চোখা করে দেখানো হয় যাতে দাজ্জাল যখন আসবে তখন খুব সহজেই তার কর্তৃত্ব মেনে নিতে পারে ………The list can go on and on.
আমার কথাগুলো শুনে অনেকেরই হয়তো আমাকে conspiracy Theorist মনে হবে যে বিশ্বাস করে আমাদের বাচ্চাদের নষ্ট করার সবরকম চেষ্টা নন-মুসলিমরা করছে। কিংবা অপ্রয়োজনীয় রকমের সিরিয়াস, Overthink করা কেউ। আবার হয়তো এটাও মনে হতে পারে যে ইসলাম একটা কঠোর ধর্ম যেটা পালন করতে গেলে জীবন থেকে সব আনন্দ ফূর্তি উধাও হয়ে যায়।
হয়তো সত্যি, হয়তো না। আল্লাহই ভালো জানেন, কিন্তু আমি শুধু বুঝি আমার সন্তান এমন অদ্ভুত, Baseless কাজকর্ম করে মজা পাক এটা আমি চাই না। আমি চাই আমার, আমাদের বাচ্চারা যেন আল্লাহর আনুগত্য করে ও আল্লাহর অবাধ্যতা থেকে দূরে থাকার মাধ্যমে এক অপার্থিব আনন্দ খুঁজে পাক।
Last but not the least, Halloween এর দিনে বাচ্চাদেরকে বাড়ি বাড়ি গিয়ে চকলেট সংগ্রহ করতে পাঠানোর যে কালচার গড়ে উঠেছে তাকে আজকাল পশ্চিমা মিডিয়াই নিরুৎসাহিত করে। কারণ অবিশ্বাস্য হলেও শয়তানের সত্যিকারের পূজারী আজো আছে যারা এই দিনে ওৎ পেতে থাকে এভাবে একা বাচ্চাদের নাগাল পাওয়ার জন্য। অনেক দুর্ঘটনা ঘটে এইসময়। বাচ্চাদের বলি দেয়ার, যৌন নির্যাতন করার ইত্যাদি নানা অপরাধ এই সময়ে ঘটে। তাই নিতান্ত দুনিয়াবী কারণেও আমাদের আর একটু সচেতন হওয়া উচিৎ এটা নিয়ে।

আবারো বলছি আমি conspiracy Theorist নই। অমুক ইহুদীদের ষড়যন্ত্র তমুক নাসারাদের, এমন কথা বলা আমি ভয়ংকর রকম অপছন্দ করি। এগুলোকে পরাজিত মানসিকতা ভাবি। কিন্তু তারপরও আমার কেন যেন মনে হয় নন- মুসলিমরা তাদের সব ধর্মীয় উদযাপনের মাঝে একটা বাচ্চাদের উপযোগী অনুষঙ্গ তৈরি করে রাখে যেন এটা বাচ্চাদের জন্য খুব আনন্দের হয়। ধরুন ক্রিস্টমাসের ক্ষেত্রে সান্টা ক্লস, ইস্টারের সময় এগ হান্টিং। এভাবে ওরা ধীরে ধীরে তাদের ধর্মীয় উদযাপনের প্রক্রিয়াগুলোকে এমন নিষ্পাপ fun হিসেবে উপস্থাপন করা যে; সব ধর্মের শিশুরাই নির্দ্বিধায় এসব fun activities এ অংশ নিতে উৎসাহ বোধ করে। শিশুদের involve করার মাধ্যমে ধর্মীয় সব ব্যাপারগুলাকেই তাদের কাছে স্রেফ fun। তাতে যে জিনিসটা আমি সবচেয়ে ভয় করি তা হল একটা চিন্তা না করা প্রজন্ম গড়ে ওঠা। ছোটবেলায় না হয় বাচ্চাদের হাবি জাবি বুঝানো যায় কিন্তু বড় হয়ে মা বাবা হয়েও সে সান্টা ক্লজ এসে ক্রিসমাস গিফট দিয়ে যায় এমন আজগুবি জিনিস বাচ্চাদের শিখায়। Halloween এর Just for fun এর ক্ষতিকর প্রভাব বুঝতে হবে তাই আমাদের নিজেদের একটু চিন্তাশীল হতে হবে। এই কথাটা আমি আজকাল খুব বলি………আসুন নিজে চিন্তা করি, অন্যকে চিন্তা করতে উৎসাহিত করি। একটা উদ্দেশ্যবাদী প্রজন্ম তৈরি হবে তাইলে ইনশাল্লাহ, হুজুগে গা ভাসানো না।
আল্লাহ আমাদের, আমাদের সন্তানদের চিন্তাশীল করে গড়ে তুলুন যারা বুঝে শুনে ইসলাম পালন করে। আমীন।

 •  0 comments  •  flag
Share on Twitter
Published on April 18, 2022 07:44

’শিকড়ের সন্ধানে’ বইয়ের উপর নির্মিত ভিডিও ‍সিরিজ

’শিকড়ের সন্ধানে’ বইটি পড়ার পর দশম শ্রেণির ছাত্র একজন ছোট ভাই বইটির বিষয়বস্তু অবলম্বনে ভিডিও সিরিজ বানানোর আগ্রহ প্রকাশ করে Mubashera Sisiters page এ মেসেজ দেয়। আমরা ভাইটির করা আগের একটি ভিডিও দেখে তার কাজের মানে সন্তুষ্ট হয়ে তাকে ভিডিও সিরিজ করার অনুমতি দেই।

আলহামদুলিল্লাহ! ভাইটি বেশ ভালো কাজ করেছে। যারা বলে আজকের তরুণ প্রজন্ম শুধু আজেবাজে টিকটক ভিডিও বানিয়ে সময় নষ্ট করে, তাদের জন্য সম্পূর্ণ দাওয়াহর উদ্দেশ্যে তৈরি এই ভিডিও একটি উদাহরণ যে, তরুণ প্রজন্ম এখনও নষ্ট হয়ে যায়নি। যারা ভালো কাজ করছে তাদের জন্য দরকার উৎসাহ আর দুয়া।
আল্লাহ যেন এই ছোট ভাইটির মহৎ প্রচেষ্টা কবুল করে নেন এবং ’শিকড়ের সন্ধানে’ বইটিকে আরও অনেক তরুণ-তরুণীর ভালো কাজের উসিলা বানিয়ে দেন। আমীন।

সম্পূর্ণ বইয়ের ওপর ভিডিও সিরিজটির নির্মাণ এখনো চলমান রয়েছে, নিচের লিঙ্ক থেকে ধারাবাহিকভাবে নির্মিত পর্বগুলো দেখুন।

 •  0 comments  •  flag
Share on Twitter
Published on April 18, 2022 07:15

April 10, 2022

বুক রিভিউ-২

বুক রিভিউ : “শিকড়ের সন্ধানে”
লেখিকা : হামিদা মুবাশ্বেরা
লিখেছেন- Aouana Marzia Monadi

I have been reading Al Quran for years after years only knowing that each word of Quran has reward. I completed my Quran khatam when I was in Grade 4 and later I could memorize Sura Ar Rahman, Sura Yaseen and Sura Mulk by Grade 9. However, better late than never Alhamdulillah I also came to know that how Allah rewards quality over quantity and the ultimate goal of Allah’s word in Quran is to reflect in daily life.
The series published in “Mubashera Sisiters” on the topic ‘Ramadan katuk Sura Kahf er shathe’ opened my eyes to know Al Quran in more reflective way. I saved all of that series in one pdf after reading, as writing method of Hamida Mubashera method is very thought provoking.
Then I started reading “Shikorer Sondhane” written by her. This book allowed me to think about my recitation in salat what I actually mean beyond translation in Bangla. As I was struggling to follow other classy narration in Bangla and few English Speaking scholars to understand Al Quran, now Allah decreased my struggling through this book in Bangla in such a way, as if it is just the way I learn anything in my daily life. This book gave me a momentum to hook me with Al Quran in more reflective way despite my busy life.
I never expressed my feelings after reading “Shikorer Sondhane” except dua for the writer. This book changed my thought pattern to accelerate my Iman as well as practice of Islam to be a Muslima. I am grateful to almighty Allah. May Allah accept our dua to march forward through your effort.
I am a teacher. I teach students with special needs. To be more specific students who have disabilities. Now I have been teaching in tertiary level of a university in Dhaka. I am blessed to be a mother of three children. One son and two daughters.
I completed my Quran khatam when I was in Grade 4 and later I could memorize ura Ar Rahman, Sura Yaseen and Sura Mulk by Grade 9. What happened after completion of my school life I lost my connection with Al Quran and faded out all the memorzation of those significant suras. Before introducing myself with Hanida Mubashera’s writing I was casual on understanding Quran. And that write up geared me to read and know more about writing of hamida Mubashera gave me a momentum to hook me with Al Quran in more reflective way despite my busy life. I am grateful to almighty Allah. May Allah accept our dua to march forward through her effort.

 •  0 comments  •  flag
Share on Twitter
Published on April 10, 2022 09:24

বুক রিভিউ-১

বুক রিভিউ : “শিকড়ের সন্ধানে”
লেখিকা : হামিদা মুবাশ্বেরা
লিখেছেন- তানজিনা রহমান

১৪০০ বছর আগে যে বইটির আয়াত শুনে কাফের মুশরিকদের চোখ অশ্রুসিক্ত হয়েছে, মন হয়েছে আল্লাহ ভীরু; সেই বইটিকে আজকে আমরা সম্মানের উচ্চশিখরে তুলে বুক শেলফের সব চেয়ে উঁচু তাকে সাজিয়ে রেখেছি | অথচ জন্মগত ভাবে মুসলিম পরিচয় ধারী হয়েও কেন এই মুজিজায় ঠাসা কুরআন এক বারও মনে গভীর দাগ কাটেনি সেই প্রশ্ন নিজেকে করতে গিয়ে দেখি আমিও অনেকের মতোই দ্বিতীয় সূরা বাকারায় এসে থেমে গেছি, confused হয়েছি আল্লাহ তা’লা যখন বিচ্ছিন্ন ভাবে বিভিন্ন ঘটনার রেফারেন্স টেনে এনে দিশেহারা আমাকে বোঝাচ্ছেন |

আরবি না জানা এবং এই বিচ্ছিন্ন ঘটনা প্রবাহ সম্পর্কে ধারণা না থাকাই এই বিরাট সমস্যার হেতু | এই সময় আলোকবর্তিকার মতো বোন হামিদা মুবাশ্বেরা একটি ফেসবুক সিরিজ লেখা শুরু করেন। | সাবলীল ভাষায় কঠিন বিষয়গুলো অবলীলায় বলে যাওয়ার ক্ষেত্রে প্রসিদ্ধ আপু টির সিরিজটি নিয়ে নড়ে চড়ে বসলাম আর অবাক বিস্ময়ে গলধঃকরণ করলাম কুরআনের ঘটনা প্রবাহ এবং সমসময়িক বিভিন্ন সমস্যার আল্লাহ প্রদত্ত সমাধান | যা বিশেষ ভাবে কুরআনকে নিয়ে, এর প্রতিটা আয়াতকে নিয়ে ভাবতে শিখিয়েছে | ফলশ্রুতিতে, কুরআনের অনুবাদ পড়াটা হয়েছে আনন্দ দায়ক ও সুখপাঠ্য |

সিরিজটি এতটাই জনপ্রিয় ছিল যে প্রতি পর্বের শেষে আমরা তীর্থের কাকের মতো অপেক্ষায় থাকতাম পরবর্তী পর্বের জন্য | অনেকেই সব পর্বগুলো একত্রে এক মলাট বদ্ধ ভাবে পেতে চাইলেন | কারণ, এটি যেমন আমাদের মুসলিম হিসেবে স্বতন্ত্রতা সম্পর্কে সচেতন করেছে তেমনি পরবর্তী প্রজন্মের জন্য এর সংরক্ষণের প্রয়োজনীয়তা তৈরী করেছে | তাই কয়েক বছরের ব্যবধানে যখন সিরিজটি বই আকারে হাতে পেলাম তখন মন থেকে বলেছি আলহামদুলিল্লাহ!

নতুন উদ্দামে পড়ে ফেললাম এ মলাট থেকে ও মলাট | রিভিউ করতে গিয়ে বইটির যে বৈশিষ্ট্য গুলো মন ছুঁয়েছে তার একটা সংক্ষিপ্ত রূপ না বললেই নয় –

১. কঠিন বিষয় সহজ করে বলার মুন্সিয়ানা তারাই দেখতে পারে যাদের বিষয়টি সম্পর্কে রয়েছে অগাধ ধারণা | বইটির প্রতিটা পরতে পরতে রয়েছে সুগভীর চিন্তা থেকে বেরিয়ে আসা এবং ইসলামিক দলিল ভিত্তিক কথন | যা পাঠককে শুধু ইসলাম সম্পর্কিত হাতেখড়িই দেয়নি, আল্লাহর আয়াত গলো নিয়ে কিভাবে ভাবতে হয় তা ও শিখিয়েছে, জন্ম দিয়েছে যুক্তি বাদী মন |

২. ক্রমান্বয়ে ইতিহাসের দলিল এবং যুক্তির ওপর দাঁড় করানো বিভিন্ন প্রেক্ষাপটে নবীদের (বিশেষত মুসা (আ) এর জীবনের ঘটনা প্রবাহ) জীবনী নিয়ে আল্লাহ আমাদেরকেই কি বলতে চাইছেন তার প্রাঞ্জল বর্ণনা রয়েছে বইটিতে | সব চেয়ে গুরুত্বপূর্ণ বিষয় টি হলো, মুসা (আ) সহ অন্যান্য নবীদের এর জীবনী থেকে যে শিক্ষা আল্লাহ তা’লা আমাদের দিয়েছেন তা নবীজি (সা) কি করে তাঁর সময় কালে আরোপ করেছেন তার সাথে লেখিকা আমাদের পরিচয় করিয়েছেন | যেন অনুরূপ প্রেক্ষাপটে আমরা এই শিক্ষা থেকে আমাদের করণীয় নিয়ে confused না হই |

৩. আল্লাহ সুবহানাল্লাহু তা’লা কোনো জাতিকে যখন তাঁর দিকে ডাকেন তখন তাদের আলোক বর্তিকা স্বরূপ পাঠিয়েছেন নবীদের | তারা যেন সহজেই ঈমান আনতে পারে তাই সেসব নবীদের দিয়েছেন অলৌকিক মুজিজা | যেমন মুসা (আ) কে দিয়েছেন সাগর ফেরে পথ তৈরির সক্ষমতা, সুলায়মান (আ) কে দিয়েছেন জ্বীন জাতির উপর কর্তৃত্ব, ঈসা (আ) দিয়েছেন মৃতকে জীবিত করার মুজিজা | কিন্তু, সর্ব কালের শ্রেষ্ঠ নবী মুহাম্মদ (সা) কে দিয়েছেন একটি বই | যার পরতে পরতে রয়েছে ভাষাগত অলৌকিক মুজিজা যা আল্লাহ কিয়ামত পর্যন্ত আমাদের জন্য সংরক্ষণ করবেন বলে ওয়াদা করেছেন | আরবি না জানার কারণে এই স্বর্গীয় সুধা থেকে আমরা যারা বঞ্চিত, লেখিকা তার বইটিতে এর কিছু দিক চমকপ্রদভাবে উল্লেখ করেছেন |

৪. নবীদের জীবনী বর্ণনা কালে এক নবীর সাথে আরেক নবীর সম্পৃক্ততা কিভাবে ছিল তার অনেক খানি ইতিহাসের পাতা থেকে মুছে গেলেও মিসিং লিংক হিসেবে লেখিকা দালিলিক প্রমাণ দিয়ে তা পুনঃ প্রতিষ্ঠা করেছেন যা পাঠককে দেবে চরম রোমাঞ্চ |

৫. সর্বোপরি, ইব্রাহিম (আ) এর প্রকৃত অনুসারী হিসেবে দাবি করা মানুষ গুলো আজকে কিভাবে ইহুদি, খ্রিসটান ও মুসলিম এই তিন পরিচয়ে বিভক্ত এবং কারা এখনো ঘটনা পরিক্রমায় সত্য পথে রয়েছে সেই ইতিহাস প্ৰাঞ্জলভাবে ফুটে এসেছে বই টিতে |

আমরা যদি নিজের পরিচয় সম্পর্কে জানি , জানি আমাদের আলোকিত স্বর্ণ যুগের ইতিহাস আর আমাদের স্বাতন্ত্র্য, তাহলে আপনা আপনি আমরা বুঝে যাবো আমাদের জীবনের করণীয় ও বর্জনীয় সম্পর্কে, আবিষ্ট হবো নিজ লক্ষ্যে, খুঁজে পাবো জীবনের উদ্দেশ্য | লেখিকাকে অজস্র ধন্যবাদ কান্ডারিবিহীন এই প্রজন্মকে এমন একটি দিশারী দিয়ে সাহায্য করার জন্য | আল্লাহ তা’লা উনাকে ইসলামের বৃহৎ কল্যাণে নিয়োজিত করে আমাদের উপকার করার তৌফিক দিন |

 •  0 comments  •  flag
Share on Twitter
Published on April 10, 2022 09:11

দৃঢ় হোক দ্বীনের পথে যাত্রা

আলহামদুলিল্লাহ আমরা যখন কোনো এক উসিলায় হিদায়াত পাই এবং অত্যন্ত আনন্দের সাথে নিজেদের নামের পাশে “প্র্যাক্টিসিং” শব্দটা যুক্ত করি এরপর তা আমাদের আচরণে কতটা প্রতিফলিত হয়?

আমাদের এই “দ্বীনে ফেরা” থেকে কি আশেপাশের মানুষগুলো উপকৃত হতে শুরু করে? আমরা কি  আবেগ এবং বুদ্ধিমত্তার ভারসাম্য বজায় রাখতে পারি ? নাকি “দ্বীনের নামে” ক্ষণে ক্ষণে সম্পর্ক নষ্ট করার চর্চা শুরু করি?

আমরা কি জানি ইসলামে নতুন আসার পর  সবার আগে আমাদের ফোকাস হওয়া উচিত  জ্ঞানার্জনের দিকে?  আমরা যদি কুরআনের আয়াত নাযিলের ক্রমধারা খেয়াল করি তবে দেখবো, একটা পুরোপুরি অনৈসলামিক সমাজে প্রথম নির্দেশ ছিলো ”পড়ো, তোমার রবের নামে।”

এরপরের ইমিডিয়েট ফোকাস হওয়া উচিত “ আখলাক্ব।” যদিও এটা নিয়ে মতভেদ আছে যে আগে সূরা ক্বালাম নাকি সূরা মুযযাম্মিল নাযিল হয়েছে, তবে একদম শুরুর দিকে যে সূরা ক্বালাম নাযিল হয়েছে সে ব্যাপারে সন্দেহ নেই। আর এই সূরাতে আল্লাহর দৃষ্টিতে খুবই অপছন্দনীয় কিছু স্বভাবের কথা উল্লেখ করা হয়েছে।

আয়াত নাযিলের এই ক্রম না জানার কারণে আমরা fatal সব ভুল করে ফেলি।আমরা হয়তো ইসলামী জ্ঞান অর্জনের গুরুত্ব ঠিকই বুঝতে পারি কিন্তু জ্ঞানকে ’দ্বীনী’ ও ’দুনিয়াবী ’এই দুই ভাগে অযথা ভাগ করে পরিবারের সাথে নিতান্ত অপ্রয়োজনীয় একটা বিরোধে জড়িয়ে যাই। ইসলামে আসার পর সবার আগে একজন ভালো মেয়ে কিংবা ভালো বোন হবার বদলে আমরা হয়ে যাই আরও দুর্বিনীত একজন, যে হঠাৎ করেই তার পরিবারের কাউকে সহ্য করতে পারছে না কারণ তারা নন প্রাক্টিসিং আর সে প্রাক্টিসিং! কিন্তু আমাদের এই আচরণ যে আদতে কতটা ভুল, শয়তান যে এভাবে পরিবার, আত্মীয় থেকে দূরে সরিয়ে আমাদের  একা করে ফেলতে চায় তা আমরা আদৌ বুঝি না।

 এই কোর্সে আলোচনা করা হয়েছে কীভাবে প্র্যাক্টিসিং মুসলিমাহ হিসেবে সুষ্ঠু ইলম অর্জনের হাতেখড়ি হবে, কীভাবে পরিবারের মানুষগুলোর সাথে ভারসাম্যপূর্ণ আচরণ করা যাবে।

যদিও যারা দ্বীন ইসলামের পথে নতুন, তাদের কথা মাথায় রেখে এই কোর্স ডিজাইন করা হয়েছে

তারপরও এটা সবার জন্য উন্মুক্ত । যদি কেউ মনে করেন এই কোর্স করলে তারা নতুন সহযাত্রীদের সাহায্য করতে পারবেন তাহলে তারাও কোর্সটি করতে পারেন।

দৃঢ়, আত্মবিশ্বাসী পদক্ষেপে দ্বীনের পথে যাত্রায় আপনাকে স্বাগতম!

কোর্সের নাম:  দৃঢ় হোক দ্বীনের পথে যাত্রাকোর্স থেকে আপনারা যা যা শিখবেন:  ইসলামে আসার পর—

১। ইসলামিক, একাডেমিক, আত্মউন্নয়ন মূলক জ্ঞানসহ  সব ধরনের পড়াশোনার মাঝে কীভাবে ভারসাম্য করবেন (Knowledge gain- why, what & how)

২। আবেগ ও বুদ্ধিমত্তার মধ্যে কীভাবে ভারসাম্য করবেন (Emotional intelligence)

৩। পরিবারের সাথে কীভাবে সুসম্পর্ক বজায় রাখবেন (How to deal with family)

৪। মুসলিমাহ হিসেবে উম্মাহর বৃহত্তর কল্যাণে কীভাবে ভূমিকা রাখবেন (How to have a vision in life as a Muslimah)

কোর্স ইন্সট্রাক্টর:

            হামিদা মুবাশ্বেরা

             PhD Student, Department of Economics

             Temple University, USA

              Bachelor in Islamic Studies (IOU)

              Master’s in Finance (IIUM)

              BBA (IBA , DU)

                           এবং

            শারিন সফি অদ্রিতা

        BA, Islamic studies, IOU (running)

        MS, Clinical & Mental Health Counseling, University of Pittsburgh.

       Founder, Muslimah Confidence Workshop

রেকর্ড ক্লাসের জন্য Bkash/Nagad#  01711472379 নম্বরে ২৫০ টাকা send money করে তার স্ক্রীনশট পাঠাতে হবে Mubashera sisters পেইজের ইনবক্সে। রেফারেন্স লিখতে হবে Recorded class
 •  0 comments  •  flag
Share on Twitter
Published on April 10, 2022 08:41

April 8, 2022

রিজিক

১.
সেই ভোর রাত থেকে ময়মনসিংহ বাস স্ট্যান্ডে বসে আছে শোভা। কাল থেকে গার্মেন্টস খোলা। আজ ভোর ভোর রওয়ানা করে যদি তাড়াতাড়ি পৌঁছে যাওয়া যায় নারায়ণগঞ্জ, সে আশায় একটু আগেই বের হয়েছে বাড়ি থেকে।
বাড়ির কথা ভাবতেই অজান্তে দীর্ঘশ্বাস বেরিয়ে এলো বুক চিড়ে!! বাড়িতে কি করছে দেড় বছরের মেয়েটা? মেয়েটার মুখে বোল ফুটেছে মাস দুয়েক হয়। মেয়ে ঘুম থেকে উঠে শোভাকে দেখলে আর ছাড়তে চাইবে না। তড়িঘড়ি করে চলে আসার এটাও একটা কারণ।
মেয়ের আট মাস বয়সেই নিজের বৃদ্ধা মা আর বৃদ্ধ বাবার কাছে রেখে শহরে পা বাড়িয়েছিল শোভা। বিয়ের আগেও এই গার্মেন্টসেই চাকরি করতো। আগের ঘরের কোনো ছেলে সন্তান না থাকায় দ্বিতীয় স্ত্রী হিসেবে শোভাকে ঘরে তুলেছিল তার স্বামী। বিয়ের বছর না ঘুরতেই সন্তান সম্ভবা শোভার কোল জুড়ে মেয়ে সন্তান আসার অপরাধে স্বামী নামের বস্তুটি তিন তালাক ঘোষণা করে পরবর্তী স্ত্রী যোগাড় করার মিশনে বেরিয়েছে।
সেই থেকে সংসারের জোয়াল উনিশ বছর বয়সী শোভার ঘাড়েই। গত দশটি মাস ঘাড় গুঁজে কেবল কাজ করেছে শোভা। মেয়ের জন্য দুধ, নিজের থাকা খাওয়া,বাবা মায়ের থাকা খাওয়া, সব এসে চেপেছে মেয়েটার কাঁধে। দশ মাস পর নিজের মেয়েকে দেখার সুযোগ এলো করোনার কারণে। কি এক অদ্ভুত অসুখ এসেছে দেশে, সবাই খুব কথা বলছে এই নিয়ে। হঠাৎ করেই গার্মেন্টস বন্ধ হয়ে গেল। রোজার ঈদের আগে অপ্রত্রাশিত ছুটি পেয়ে তাই আর আগ পিছ না ভেবে বাড়ি চলে গেছিলো শোভা।
মার্চ মাসের বেতন হাতে আসেনি। জমানো সাতশো টাকা নিয়ে মেয়েটার টানে চলে এসেছে বাড়ি। যদিও সবাই বলাবলি করছিল করোনা রোগটা নাকি অনেক ছেঁায়াচে, এভাবে গাদাগাদি করে বাড়ি ফেরাটা নাকি ঠিক হচ্ছে না, তবে মায়ের মন এত কিছু বুঝতে চায় না। করোনার উসিলায় ছুটি পেয়ে নিজের নাড়ি ছেঁড়া ধনকে তো কোলে নেয়া গেলো! বুক তো জুড়ালো!
এক সপ্তাহ পার হয়ে যেতেই এই সুখ আর রইলো না। মোবাইলে মেসেজ আসলো ছুটি শেষে কারখানায় যোগ না দিলে গত মাসের বেতন তো পাবেই না বরং চাকরীও চলে যেতে পারে। এই মেসেজ পেয়েই পরদিন ভোরে রওনা দিয়েছে শোভা।
বাজারে জিনিসপাতির দাম বাড়তি। চারটি মুখের প্রতি বেলার খাবার জুটানোই কঠিন হয়ে যাচ্ছে। এই অবস্থায় বেতন না পেলে,চাকরি চলে গেলে ভবিষ্যতে কি হবে এসব ভেবে রীতিমত ঘাম ছুটছে শোভার।
অইদিকে কোনো বাসের নিশানাও নাই রাস্তায়। সকাল হবার সাথে সাথে আরো লোকজন জড়ো হছে বাসস্ট্যান্ডে। এতো মানুষ যাবে কিভাবে! এরমধ্যে পুলিশ এসে হাজির। জানা গেলো বাসের ব্যবস্থা হবে না। বাড়ি ফিরে যাওয়ার কোনো উপায় নেই। যে করেই হোক ঢাকা পৌঁছতে হবে। গাড়ি ভাড়ার জন্য পাঁচশো টাকা মা ধার করে এনে দিয়েছে পাশের বাড়ির খালাম্মার কাছ থেকে। বেতন পেয়ে টাকাটা শোধ করতে হবে। এর মধ্যে একটা পিকআপ আসলো খালি, শ্রীপুর অব্দি যাবে। উপায়ন্তর না দেখে সবাই তাতেই উঠে পড়লো। কিন্তু শ্রীপুর অব্দি যাওয়া হলো না। আমতলী আসতেই পুলিশের পিটুনির মুখে পিকাপ থেকে নেমে যেতো হলো সবাইকে। অগত্যা সবাই পায়ে হেঁটে রওনা দিল। শোভাও ঢলের সাথে হাটতে লাগলো। দুপুরের ঠা ঠা রোড শরীরের সব চুঁষে নিয়ে নিচ্ছে যেনো।
পাঁচ ঘণ্টা টানা হাটার পর ভাওয়াল এসে ঠেকলো মানুষের ঢল। আর হাঁটা সম্ভব হচ্ছেনা। এখান থেকে আটোরিক্সা যাচ্ছে গাজীপুর অব্দি। অটোরিক্সায় চেপে গাজীপুর এলো। কেউ কেউ এবার একটু পানি আর বিস্কুট মুখে দিচ্ছে। শোভার অতো সময় কই! নারায়ণগঞ্জ ফিরে একবারে খাবে ভেবে নেয় সে। এমনিতেই যাচ্ছেতাই খরচ হচ্ছে এটায় ওটায় উঠে। সে বাকিপথ কিভাবে যাবে উপায় খুজতে থাকে। এরমধ্যে লোকাল সিএনজি ম্যানেজ করলো কারা যেনো কথা বলে। সেই সিএনজি করে ঢাকায় পৌছালো শোভা। এখানেও সেই পুলিশের দাপট। পায়ে হাটা ছাড়া আর কোনো গতি নেই। কিছুটা পথ পায়ে হেঁটে, কিছু পথ রিক্সায় করে নারায়ণগঞ্জ যখন পৌছুলো,তখন এশার আজান হচ্ছে।
মেসে পৌঁছানার পরই শুনলো , গার্মেন্টেস এর ছুটি বাড়িয়ে দিয়েছে । কাল বেতন পাওয়া যাবে না। এদিকে মেসের মালিক এসে বলে গেলো, গ্রাম থেকে ফেরা কাউকেই মেসে উঠতে দেওয়া হবে না। কার সাথে ভাইরাস আছে তাতো আর জানে না কেউ।
অসহায় শোভা মেসের সামনের রাস্তাতেই বসে পড়লো। নিজেকে আর বহন শক্তি নেই তার। পা দুটোর জায়গায় জায়গায় ফোস্কা পড়েছে আর গিটে গিটে ব্যাথা । হাতের মুঠো খুলে অবিশিষ্ট একশো টাকার দলা পাকানো নোটটা উপরের দিকে ছুঁড়ে দিল শোভা , অশ্রুসজল চোখে আকাশপানে তাকিয়ে বিড়বিড় করে লাগতে লাগল, “সন্তানের মুখে দুইডা খাবার তুইলা দেওনের লাইগা, বাপ-মায়ের ওষুধ কিইন্যা দেওনের লাইগা যে চাকরী করি সেই চাকরি চইলা যাওনের ভয় দেখাইয়্যা আজ সারাদিন যে আমারে কষ্ট দিল তারে তুমি ক্ষমা কইরো না আ্ল্লাহ।”

২.
রওশন আরার চোখ বেয়ে ঝরঝর করে জল বেয়ে পড়ছে। ফোনটা হাতে নিয়ে আরেকবার শোভনের বাবার নম্বরে ডায়াল করলো। গত কয়েকবার কল কেটে দিয়েছেন রফিকউদ্দিন সাহেব। রওশন আরা তবুও বারবার কল দিয়েই যাচ্ছে দেখে রাগটা আর সামলে রাখা গেলো না। রিসিভ করে চাপা গলায় ইচ্ছেমত ঝাড়লেন বোকার হদ্দ মহিলাকে “বাড়ি বসে নিত্যনতুন রেসিপি ট্রাই করা, ইচ্ছেমত শপিং করা আর বছর বছর বিদেশ যাওয়ার টাকাটা তো আর তোমার রোজগার করতে হয় না,তুমি কি বুঝবে আমার অবস্থা!! বায়াররা অধিকাংশ অর্ডার ক্যান্সেল করে দিচ্ছে অথচ শ্রমিকদের বেতন, ফ্যাক্টরির খরচ ম্যানেজ করতে হবে, অর্ডার যাও আছে তা কমপ্লিট করার জন্য গার্মেন্টস খোলা রাখতে চাইলাম কিন্তু মিডিয়ার চাপে সেটাও সম্ভব হলো না। সরকারের পক্ষ থেকেও কোনো রেসপন্স নেই ,অইদিকে অজাতকুজাত শ্রমিকগুলা বেতনের দাবীতে চিৎকার করছে গার্মেন্টসের সামনে দাঁড়িয়ে। এসব তো তোমাকে সামাল দিতে হয় না,তোমাকে এসব বলেও বা কি লাভ! তুমি তো ফোনের পর ফোন দিয়েই যাচ্ছো!! তোমার আক্কেলের বলিহারি!”
রওশন আরা নিচু গলায় বললেন “শোভন তোমাকে সকাল থেকে ফোনে পাচ্ছে না। লিয়ার অবস্থা খুব খারাপ। কোনো হসপিটাল ওকে ভর্তি নেয়নি। ওর বাচ্চা দুটোরও শ্বাসকষ্ট হচ্ছে। সরকার থেকে লোক এসে লক ডাউন করে গেছে গোটা এলাকা। শোভন আর ওর বউ আটকে গেছে ওখানেই। শোভন কিছুক্ষণ আগে বললো ওরও জ্বর এসেছে। আমার ছেলেমেয়ে দুটো ওদের স্বামী স্ত্রী আর সন্তানদের নিয়ে বিনে চিকিৎসায় মারা যাচ্ছে, আর তুমি এই অবস্থায়ও তোমার ব্যবসা নিয়ে কথা বলছো। এসব আসলেই আমি বুঝবো না”।

১৮ ডিগ্রীতে দেয়া এসির মধ্যে বসেও রফিকউদ্দিন ঘামতে শুরু করলেন। হ্যাচকা টানে টাইয়ের নট ঢিলা করলেন। গার্মেন্টস নিয়ে এতক্ষণের দুশ্চিন্তা উবে গিয়ে হঠাৎ করে মাথাটা ফাঁকা হয়ে গেল। নিশ্চিন্ত, নিরাপদ জীবনের আশায় নিজের সন্তানদের বিদেশে পড়ালেখা করিয়েছেন, ওখানেই সেটল হওয়ার জন্য অকাতরে অর্থ ব্যয় করতেও কার্পণ্য করেননি। আজ যদি পৃথিবীর সর্বোন্নত দেশে থেকেও ওরা বিনা চিকিৎসায় মারা যায় তবে কি হবে তার এই গার্মেন্টস ,বাড়ি, গাড়ি, ব্যাংক ব্যালেন্স দিয়ে?সকাল বেলা শোনা একটা শ্রমিকের গলার আওয়াজ প্রতিধ্বনির মতো বারবার অণুরণিত হতে লাগল তার কানের মধ্যে– “তগোর সন্তান নাই? তাগরে বিনা ভাতে,বিনা চিকিস্সায় মরতে দিবি তরা? তয় আমরার গরীবের পাওনা টাকা কেন দিতে চাস না, কথায় কথায় চাকরী খাওনের ভয় দেখাস?”

এদিকে ফোনটা হাতে নিয়ে সুইমিংপুলের কাছটায় এসে দাঁড়ালেন রওশন আরা। উলটো ঘুরে নিজের আলিশান ডুপ্লেক্সের দিকে তাকিয়ে আবার হাপুস নয়নে কাঁদতে লাগলেন। কে জানতো, অই সব ভালোর দেশে আর্থিক স্বচ্ছলতা থাকা স্বত্বেও ধুঁকে মরতে হবে তার সন্তানদের!

আজ সকালে ইউটিউবে শোনা একজন শায়খের একটা কথা মনে পড়লো রওশন আরার। শায়খ বলছিলেন, “রিজিক মানে তো কেবল প্রতি বেলার খাদ্য কিংবা অর্থ নয়। রিজিক হচ্ছে জীবনধারণের জন্য প্রয়োজনীয় সকল বিষয়। আর মানুষ ততোটুকু রিজিকই ভোগ করতে পারে যা তার তাকদীরে আছে। অনেক দূরের পাহাড়ে থাকা রিজিকও যেমন ঠিকই ভোগ করা যায় যদি তা তাকদীরে থাকে তেমনি চোখের সামনে থকা রিজিকও ভোগ না করে চলে যেতে হতে পারে যদি তাকদীরে লেখা না থাকে। তাই নিজের রিজিক নিশ্চিত করার প্রলোভনে পড়ে যেন অন্যের হক নষ্ট না করি, অন্যের দীর্ঘশ্বাসের কারণ না হই। আমরা যেন ভুলে না যাই মজলুমের দুআ আর স্রষ্টার মাঝে কোনো আড়াল থাকে না। তিনি তো সবারই রিজিকদাতা,সর্বশ্রেষ্ঠ বিচারক!!

 •  0 comments  •  flag
Share on Twitter
Published on April 08, 2022 08:09

Hamida Mubasshera's Blog

Hamida Mubasshera
Hamida Mubasshera isn't a Goodreads Author (yet), but they do have a blog, so here are some recent posts imported from their feed.
Follow Hamida Mubasshera's blog with rss.