শবশিঙা প্রিভিউ (দ্বিতীয় পর্ব)
সতর্কীকরণ
ম্যাচিউর কন্টেন্ট | ভায়োলেন্স | PG 18+
গত পর্ব : ক্লিক করুন
এতক্ষণে মজিদ মিয়ার খেয়াল হলো। মাটি থেকে বস্তাটা তুলে ছাদেকের দিকে বাড়িয়ে দিয়ে বলল, “পাষণ্ড জালালের মুণ্ডু।”
ছাদেক আঁতকে উঠে বলে, “কন কী? ওর মুণ্ডু কই পাইলেন?”
সব খুলে বলার পর মজিদ মিয়া বলল, “এইটা আর চরে থাকা লাশের বাকি অংশ নিয়া ময়নাতদন্ত করাবা। কোনো ক্লু পাও কিনা দেখো। কে খুন করছে এইটা জানা খুব দরকার।”
বিষাণদের নিজস্ব ল্যাব আছে। তাতে তারা নিজস্ব অস্ত্র বানায়। প্রয়োজনে ময়নাতদন্ত করে। গবেষণা করে বিভিন্ন বিষয়ে।
বস্তাটা নিতে নিতে ছাদেক বলে, “এইটা যে জালালের হেড সেটা বুঝলেন কেমনে? জানি আপনি তারে সবচেয়ে ভালো চেনেন, তাও...”
“কপালে লেইখা দিছে খুনি। আর চরে যে লাশটা খাইতে গেছিলাম সেইটা জালালের বডি আছিল। বুকের কাটা দাগ দেইখা বুঝছি। আর আঙুল তো কাটা ছিলই। আশেপাশে আরও লাশ থাকার কথা। ও তো একা একা চলাফেরা করতো না। পাও নাই?”
ছাদেক অবাক হয়ে বলল, “এইটা অদ্ভুত ব্যাপার। ভেরি স্ট্রেঞ্জ। আপনার দলের বাইরের আর কারো লাশ পাই নাই। জালাল একা একাই গেল?”
“কোথাও কিছু ঘাপলা আছে, যেইটা আমরা ধরতে পারতেছি না। তুমি এইটারে গুরুত্বসহকারে দেখো। বিষয়টা আমার কাছে কেমন যেন ঘোলাটে লাগতেছে। কিছু একটা ঠিক নাই। মিল খাইতেছে না। আর সবাইরে সাবধান কইরা দেও। জালাল মরায় তার দল এখন খুব ক্ষেইপা উঠবো। বাইড়া যাইবো আমাদের ওপর হামলার পরিমাণ।”
স্যালুট দেওয়ার ভঙ্গি করে ছাদেক বলে, “সেকেন্ড বস আদেশ দিয়েছেন, আমি অবশ্যই দেখবো। আর বাকিদের সাবধানও করে দেবো।”
এসময় আকাশ ডেকে উঠলো ভয়ানকভাবে। দুজনেই চমকে উঠলো।
নিজেকে সামলে নিয়ে মজিদ মিয়া বলল, “দেরি হইয়া যাইতেছে। সদাই কইরা ফিরতে হইবো। ছেলেটাকে একলা রাইখা আসছি। যাও অহন। অগ্রগতি জানাইয়ো। আর বসকে আমার সালাম দিও।”
“ইয়েস সেকেন্ড বস।” মুণ্ডুর বস্তাটা নিয়ে চলে যায় ছাদেক দফাদার।
দুজন আলাদা হতে না হতেই আকাশ কালো করে মুষলধারে বৃষ্টি পড়া শুরু হলো। সেইসাথে বজ্রপাত চলছে সমানতালে। চারদিক একদম অন্ধকার হয়ে এসেছে। তাই বজ্রপাতের আলোয় যেন ঝলসে উঠছে চারপাশ।
সদাই করে কাকভেজা হয়ে বাড়ির উঠানে পা রাখতেই চমকে উঠলো মজিদ মিয়া। পিছন ফিরে স্থির হয়ে দাঁড়িয়ে আছে ছেলেটা। ভিজে একদম চুপসে আছে। গায়ে লেপটে আছে কাপড়।
মাটিতে পড়ে আছে কেউ—যার বুকে আমূল বিঁধে আছে ছুরি। বৃষ্টির তোড়ে চারপাশ থই থই করছে পানিতে।
মাথা ঘুরিয়ে পিছনে তাকালো ছেলেটা। এসময় কড়কড় শব্দে বাজ পড়লো। আলোয় উদ্ভাসিত হলো চারপাশ। সেই আলোয় দেখা গেল সরলমনা হাসির ছেলেটার মুখে ঠোঁট বাঁকানো ক্রুর হাসি। গমগমে স্বরে বলল, “ওরে কইতো হইতো, ‘তুই বাইচা আছোস?’, কিন্তু কইছে ‘তুই মরস নাই?’...জা-ফর ...মী-র...মীর-জা-ফ-র...”
দুহাত ওপরে তুলে অট্টহাসিতে ফেটে পড়ে সে। বজ্রপাতের কড়কড় শব্দ ছাপিয়ে সেই শব্দ যেন হিম করে দেয় মজিদ মিয়ার হৃদপিণ্ড।
কাঠের ঘোড়ার গল্প
জাফরের গল্প
“জাফর, তোমাকে একটা গুরুত্বপূর্ণ দায়িত্ব দিতে চাই।” চেয়ারে গা এলিয়ে দিতে দিতে রাশভারী কণ্ঠের কেউ একজন বলল। ক্যাচ ক্যাচ শব্দে চেয়ার জানান দিল নিজের অস্তিত্বের। কংক্রিটের বিশাল রুমটায় আধখোলা জানালার কল্যাণে এক ভূতুড়ে আলোআঁধারি পরিবেশের সৃষ্টি করেছে।
পুরু গোঁফওয়ালা জাফর নাকের নিচটা ঘষতে ঘষতে বলল, “জি হুজুর, বলেন। আপনার জন্য জা-জান হা-হাজির।”
“জান-টান দিতে হবে না।” কণ্ঠস্বর নামিয়ে, “কিন্তু জান নিতে হবে।”
“আপনে খালি হু-হুকুম করেন হুজুর। জান নিতে নিতে সাগর রক্তে লালে লাল করে ফে-ফে-ফেলব।”
“সাগর লাল করতে হবে না। একটা নিতে হবে কেবল।”
“জি হুজুর, বলেন কার জা-জান নিতে হবে, আমি আপনার পায়ের তলায় এ-এ-এখনই এনে দি-দিচ্ছি।”
“আহ, তোষামোদি থামাও। বুদ্ধিকে কাজে লাগাও। যা যা বলি মনোযোগ দিয়ে শোনো। পরিকল্পনা একটু এদিকওদিক হলেই ভেস্তে যাবে। তাই বুদ্ধিটাকে ঠিকঠাকভাবে কাজে লাগাবা।”
“জি হুজুর, আপনার জন্য জান হা-হাজির।”
“তোমাকে যে দলে নেওয়া হয়েছে সেটা এখন পর্যন্ত আমি আর আমার কাছের অল্প কয়েকজন ছাড়া আর কেউ জানে না। যদি এই কাজটা করে দিতে পারো তাহলে তোমার জন্য উজ্জ্বল ভবিষ্যৎ অপেক্ষা করবে। তাই আবারও বলছি ধৈর্য ধরে ধীরেসুস্থে এগোবা। কাজটা যে-করেই হোক হওয়া চাই।”
“জি হুজুর, দ-দরকার হয় চল্লিশ ব-বছর ধৈর্য ধরব। তারপরও কাজটা সফল ক-ক-রেই ছাড়ব।”
এবার রাশভারী কণ্ঠের ব্যক্তিটি পিঠ টান টান করে বসলেন। নরম গদির চেয়ারটাও ক্যাচ ক্যাচ শব্দ করে তাকে অনুসরণ করলো। কাঠের টেবিলের ওপর বসানো কাচে প্রতিফলিত হচ্ছে তার প্রশস্ত কপালের চেহারা। সেই চেহারা বিরক্তিতে কুঁচকে আছে। তিক্ত স্বরে বললেন, “এত তোষামোদির তো কোনো কারণ দেখছি না। আমি শুধু চাচ্ছি কাজটা যাতে সফল হয়।” জাফর কিছু বলতে চাচ্ছিল, তাকে থামিয়ে দিয়ে বললেন, “আর কোনো কথা নয়, যাও কাজে নেমে পড়ো।”
অবস্থা বেগতিক দেখে জাফর আর কথা বাড়ায় না। সালাম ঠুকে বেরিয়ে আসে ঘরটা থেকে। বাইরে এসেই বুক ভরে শ্বাস নেয়। তার কাছে উজ্জ্বল ভবিষ্যৎ বলতে মাথার ওপর ঝুলে থাকা কেসটা থেকে রেহাই পেলেই হয়। রাস্তায় নেমে পিচিক করে মাটিতে একদলা থুতু ফেলেই হাঁটতে শুরু করে। প্রখর সূর্যের তাপে সেই থুতু ভেলকির মতো নিমেষেই গায়েব হয়ে যায়।
☠
হাশেম ভাইয়ের দলে ঢোকাটা জাফরের জন্য খুব কঠিনই ছিল। অচেনা এক আগন্তককে কেউই দলে ভেড়াতে চাইবে না। দেড় মাস ধরে জোঁকের মতো লেগে থাকার পর হাশেম ভাইয়ের আস্থা অর্জন করতে পারে সে। এরপর থেকেই তক্কে তক্কে থাকে। সুযোগ যেন হরিণী, আর সে যেন এক ক্ষুধার্ত বাঘ...অপেক্ষা কেবল একটু অসতর্কতার।
তাকে নেওয়া হয়েছে হাশেম ভাইয়ের গ্রুপে। তার ব্যক্তিগত ধারণা হাশেম ভাই সম্ভবত নিজে তাকে আগে ভালোভাবে পরখ করে নিতে চান। তার দিক পশ্চিম। সে আর হাশেম ভাই ছাড়াও গ্রুপে আছে চশমা পরা এক লোক, নাম হুমায়ূন। চশমার ফ্রেমটা গোল। কাচটা বেশ পুরু। সেকারণে চোখগুলো কেমন যেন অদ্ভুত ছোটো লাগে। ভয় লাগে। কাঁচাপাকা চুলের হুমায়ূনকে দেখে সে মনে করেছিল অনেক জ্ঞানী গোছের কেউ। কিন্তু কথাবার্তায় বুঝতে পারে আদতে সে গণ্ডমূর্খ। সোজা বাংলায় আবাল।
সে জানে আস্থা পাকাপোক্ত করতে আলাপের জুড়ি নেই। মুখ চেনাজানা হয়, নানান কথা আদানপ্রদান হয়, সম্পর্কটা মজবুত হয়। মজবুত সম্পর্ক এনে দেয় ‘আস্থা’। আর সে যে কাজ করতে এসেছে সেই কাজের জন্য আস্থা অর্জন করা খুব জরুরি। মৃত কেঁচো দেখিয়ে বড়শিতে মাছ ফাঁদা হয় সেটার প্রতি আস্থা অর্জন করার মাধ্যমেই। যে যত সহজে আস্থা অর্জন করতে পারে সে তত ভালো মাছ শিকারী।
আলাপের মাধ্যমে কারো আস্থা অর্জনের ক্ষেত্রে জাফরের ব্যক্তিগত মতামত হচ্ছে, আলাপের বিষয়বস্তু হতে হবে অপর ব্যক্তির অতীত আর সংসার। একমাত্র অতীতই অপরিবর্তনীয়। চাইলেও বদলানো যায় না। আর অতীত মানেই সেখানে থাকবে গোপন কিছু। জাতির গোপন অতীতের নাম হলো ‘পরাজিতদের ইতিহাস’, আর ব্যক্তিরটা ‘একান্ত ব্যক্তিগত’। আমরা যার যত বেশি ব্যক্তিগত অতীত জানতে পারি, সে আমাদের তত আপন হয়। আর যে আমাদের যত আপন, আমাদের প্রতি তার আস্থাও তত বেশি গাঢ়। যেমনটা দীঘির জল। যত বেশি গভীর জল তত বেশি কালো। আর সংসার হচ্ছে মানুষের সেই অংশ যাকে সে কখনো আলাদা করতে পারে না। আলাদা করতে পারে না বলেই, তার বেশিরভাগ ব্যক্তিগত ঘটনা এই সংসারকে ঘিরেই থাকে।
তাই জাফর সুযোগ পেলেই হুমায়ূনের সাথে আলাপ জুড়ে দেয়। হুমায়ূনের সাথে সখ্যতা হয়ে গেলে, হুমায়ূনের সাথে যার বেশি সখ্যতা তার আস্থা অর্জন করা আরও বেশি সহজ হয়ে যাবে। এটা অবশ্য অচেনা মেয়েদের ক্ষেত্রে সম্পর্ক গড়তে অনেক কাজে দেয়। একটা মেয়ে কখনো কারো প্রতি সহজে আস্থা রাখতে পারে না, কিন্তু যখনই দেখে তার পরিচিত কেউ সেই ব্যক্তির প্রতি আস্থা রেখেছে, তখন খুব দ্রুতই বিশ্বাস করে ফেলে। যেমনটা করেছিল আলেয়া।
আলেয়ার কথা মনে হতেই লকলকে জিহ্বাটাকে গাড়ির উইন্ডশিল্ডের মতো করে নাড়িয়ে ঠোঁট ভিজিয়ে নিলো। যেন এখনও সে তার ঠোঁটে পাচ্ছে আলেয়ার স্তনের বোঁটার স্পর্শ। মাছের মতো হা করে খেয়ে ফেলছে তার নরম স্তন। আঙুলে পাচ্ছে তার পেলব শরীরের উষ্ণ স্পর্শ। কিন্তু আলেয়ার মুখের কোনো মধুর কথা তার স্মৃতিতে নেই, আছে কেবল কিছু অর্থহীন গোঙানি—কারণ সে ছিল বোবা।
আলেয়ার স্মৃতিকে একপাশে রেখে এগিয়ে যায় হুমায়ূনের কাছে। সে এখন একা। একা মানেই ‘একান্ত ব্যক্তিগত’ জানার একান্ত সময়। হাশেম ভাই কোথাও গেছে। তাদের দুজনকে রেখে গেছে একটা নির্জন নদীর ধারে। হুহু করে বাতাস বইছে। ছন্দে ছন্দে ছলাৎ ছলাৎ শব্দে তীরে এসে আত্মাহুতি দিচ্ছে স্রোতের দল। হুমায়ূন তীরে বসে থেকে একদৃষ্টিতে তা দেখছে।
তার পাশে বসেই জাফর বলে উঠলো, “জানো, আমার একখান পে-পে-পেমিকা (প্রেমিকা) আছিল। নাম আছিল আলেয়া। খুব সো-সোন্দর দেখতে।” সে জানে গোপন কথা জানতে নিজেরও কিছু গোপন কথা জানাতে হয়। আর আলাপ এগিয়ে নিতে যে যেমন তার সাথে সে সেই ভঙ্গিতেই কথা বলে।
হুমায়ূন তার পুরু কাচের ভেতর থেকে জিজ্ঞাসু দৃষ্টি মেলে বলে, “হেয় কই এখন? দেখতেছি না যে?”
“এইখানে তারে পা-পা-বা কেমনে? সে আমার...কী বলে যেন...এক্স... এক্স গালফেন্ড।”
“সেক্স গালফেন্ড কী?”
“আরে সেক্স না, সেক্স না, এক্স...এ...এ...ক্স। মানে হইলো...” মাথা চুলকায় জাফর। সে শুধু জানে এক্স ইংরেজির একটা বর্ণ, এটার মানে যে কী সে ঠিক খেয়াল করতে পারছে না। সে খেয়াল করেনি যে এই এক্স (ex) বর্ণ এক্স (x) নয়। “এই ম-মনে করো, মইরা যাওয়া পেমিকারে কয় এক্স গালফেন্ড।” বলেই মনে মনে কয়েকটা গালি দেয় হুমায়ূনকে। এই নিয়ে প্রায় মাসখানেক সময় এই লোকের পিছনে সে ব্যয় করেছে। তেমন কিছু জানতে পারেনি। আজকেও যে পারবে বলে মনে হচ্ছে না। সে তার পুরু গোঁফটা আঙুল দিয়ে খস খস শব্দ করে বারকয়েক ঘষে।
“ও, আইচ্চা। কেমনে মরলো? প্যাটে বেদনা হইছিল?”
“আরে ধ্যাত। বা-বা-বাদ দেও আলেয়ার কথা। তো-তোমার কতা কও। তোমার কো-কোনো এক্স গালফেন্ড ছিল না?”
হুমায়ূন কিছুটা লজ্জা পায়। চোখ নামিয়ে ফেলে। ডান হাত দিয়ে খোঁচা খোঁচা দাঁড়ি ভরা ডান গাল চুলকাতে চুলকাতে বলে, “ইয়ে মানে, একখান আছিল। তয় তারে কখনো মনের কতা কইতে পারি নাই।”
জাফর মনে মনে তাকে আবার আরও কয়েকটা গালি দিয়ে ভাবে, “মনের কথাই বলতে পারিস নাই, এক্স গালফেন্ড হইলো কেমনে?’” মুখে বলে, “কেমন আছিল দেখতে?”
“খুব সোন্দর। কুমড়া পাকলে যেমন সোন্দর লাগে তেমন।”
জাফর হাসতে গিয়েও হাসে না। এখন হুমায়ূনের মুড নষ্ট করা যাবে না। সে বলে, “আইচ্চা, তার ক-কতা থা-থাউক, তোমার কতা কও। এই দলে ঢু-ঢুকলা কেমনে?”
“সে তো অনেক লম্বা এতিহাস। প্যাটে বেদনা হইছিল। রাস্তায় নাকি পইরা আছিলাম। হাশেম ভাই তুইলা আনছে। তারপর থাইকা তার লগে আছি।”
জাফর মনে মনে বলে, “আসলেই ‘অনেক লম্বা এতিহাস’,” মুখে দুঃখভাব ফুটিয়ে বলে, “ক্যা, তোমার ফ্যামিলিতে কেউ নাই?”
মাথা তুলে কিছুটা বিস্ময় নিয়ে বলে, “চামেলি কী? ফুল না?”
“আরে, চামেলি না, ফ্যা-ফ্যামিলি মানে হইলো প-পরিবার—মা-বাবা, ভাই-বোন এরা মিইলা হয় ফ্যামিলি।”
“ও...ছিল। শুধু আম্মা-আব্বা। ভাই-বোন নাই। আমার আম্মা মইরা যাওয়ার পর আব্বা নতুন বিয়া করছিল। জানেন, আমার আম্মা মইরা গেছিল প্যাট খারাপ হইয়া। খুব বেদনা উঠছিল। সারা রাইত পেট চাইপা ধইরা কান্দছে। বিছানার এপাশ থাইকা ওইপাশ গড়াগড়ি খাইছে। ফযরের আজানের সময় বেদনা থামছে, আম্মাও মরছে। আমারও তো প্যাট খারাপ হইছিল। আমি তো মরলাম না, হেয় মরলো ক্যান? বারবার কইছিলাম, ‘আম্মা, দুধ খাইছ না, দুধ খাইছ না।’ দুধ খাইয়াই মরলো।”
“দু-দুধ খাইয়া ম-মরছিল মানে?” কিছুটা বিস্ময় নিয়ে বলে জাফর।
“নতুন আম্মা দুধ দিছিল। অবশ্য তখনও নতুন আম্মা হয় নাই। আমাদের বাড়িত থাকতো। আব্বার কেমন যেন আত্মীয় হয়। সেই দুধ খাইয়াই তো তার বেদনা উঠলো। আব্বা কইছিল, খাঁটি দুধ হওয়ায় সমস্যা হইছিল। আমি তাই দুধে পানি দিয়া দুধ ভেজাল বানাইয়া খাই।”
“দুধ খাইয়া মরছে, সেইটা কেমন বুঝলা?”
“মরার পর তার মুখ দিয়ে ফেনার মতো দুধ বাইর হইছিল তো। খাঁটি দুধ আছিল তো, তাই।”
“তোমারেও খাঁটি দুধ দিছিল?” ভ্রু কুঁচকে বলে জাফর।
“হ, কিন্তু আমি পানি দিয়া ভেজাল কইরা খাইছিলাম। তবুও প্যাটে বেদনা উঠছিল। মনে হয় অজ্ঞান হয়ে গেছিলাম। জ্ঞান ফেরার পর চোখের সামনে হাশেম ভাইকে দেখি। উনি ক্যান জানি আর যাইতে দেন নাই। আমার সব কতা শুইনা কইছে, গেলে আবার প্যাটে বেদনা উঠবো।”
সব শুনে জাফর কিছুক্ষণ হুমায়ূনের মোটা কাচের দিকে তাকিয়ে থাকে। একজন মানুষ কী করে এতটা সহজ-সরল আর বোকা হতে পারে? দুজন মানুষের পরকীয়ার বলি যে হয়ে গেছে তার মা, এমনকী হতে ধরেছিল সে নিজেও, তা হয়তো কখনোই ধরতে পারবে না।
হুমায়ূন বলতে থাকে, “আমার আম্মা, আমারে খুব ভালোবাসতো। কখনো আমার প্যাটে বেদনা উঠতে দেয় নাই। আমার জন্য রাখা খাঁটি দুধ নিজে খাইয়া ফেলছে। বিছানায় যখন বেদনায় মোচড়ামুচড়ি করছে, তখনও আমার মাথায় হাত বুলাইয়া দিচ্ছিল আর কইতেছিল, ‘বাপ আমার, পলাইয়া যা, পলাইয়া যা’।” বলেই সে নিজের মাথায় হাত বুলায়।
জাফর উঠে দাঁড়ায়। প্যান্টের বালি ঝাড়তে ঝাড়তে বলে, “তো-তোমার বাসা কই ছিল?”
হুমায়ূন বলতে যেতেই হাশেম ভাই এসে দাঁড়ান। হাঁপাচ্ছেন। ধপ করে হুমায়ূনের পাশে বসে বলেন, “ আলাল জানিয়ে গেল যে একটা টাটকা লাশ পাওয়া গেছে। এই নদী ধরে এগুলেই হবে। দ্রুত হাঁটতে হবে। বাকিরা প্রায় পৌঁছে গেছে।”
হুমায়ূন লাফ দিয়ে উঠে বলে, “কতদিন টাটকা লাশের অভাবে ঘিলু খাওয়া হয় না। আম্মা কইছিল ঘিলু খাইলে ঘিলু হয়।”
হাশেম ভাই বললেন, “শুনলাম, লাশটার মুণ্ডু নাই। ঘিলু পাইবা না।”
☠
রাতের চাদর মুড়ি দিয়ে সূর্য ঘুমিয়ে গেছে। এখন পাহারায় বসেছে পূর্ণ চাঁদ। সেই চাঁদের আলোয় দ্রুতপদে হাঁটছে পশ্চিম দলের হাশেম ভাই, হুমায়ূন আর জাফর...এগিয়ে যাচ্ছে গল্পের এক পরিণতির দিকে।
এই প্রথম হুমায়ূনকে ভালোভাবে খেয়াল করে জাফর। তার হাঁটাচলা ঠিক পূর্ণবয়স্ক কারো মতো নয়। ছোটোবাচ্চার মতো হেলেদুলে হাঁটে। মাঝেমধ্যেই চলতে চলতে এদিকওদিক চলে যাচ্ছে। হাশেম ভাই ধমক দিয়ে তার পিছনে নিয়ে আসছেন। সে এগিয়ে যায়। হাশেম ভাইয়ের পাশে পাশে হাঁটতে হাঁটতে বলে, “ভাই, হু-হুমায়ূনের বু-বুদ্ধিশুদ্ধি এত কম ক্যা?”
হাশেম ভাই ভ্রু কুঞ্চিত করে বলেন, “তা দিয়া তোমার কী কাম?”
জাফর বুঝতে পারে যে সে ভুল প্রশ্ন করে ফেলেছে। তাই চটপট বলে, “না মানে, ওর বাবা-মায়ের কতা ক-ক-কইতে ছিল তো তাই ব-বলতেছিলাম।”
এবার হাশেম ভাই হুমায়ূনের দিকে বিরক্তি নিয়ে তাকিয়ে বলেন, “এই হুমায়ূন, যা তো সামনে যা।”
হুমায়ূন কিছুটা দৌড় দিয়ে সামনে এগিয়ে যায়।
এবার হাশেম ভাই হাঁটতে হাঁটতে জাফরের দিকে তাকিয়ে বলে, “এত তাড়াতাড়ি ওর বাবা-মায়ের কথা তোমার জানা উচিত হয় নাই। কারো ব্যক্তিগত ব্যাপারে শবখাদকরা নাক গলায় না। তোমারও গলানো উচিত হয় নাই। এখন যখন গলাইয়েই ফেলাইছো, তাই কই, সহজে বোঝা যায় না যে ও একটা বুদ্ধিপ্রতিবন্ধী। কখন কী বলে, কী করে ঠিক নাই। ওরে যখন পাই তখন ও আধমরা। অনেক কষ্ট হইছে বাঁচাইতে। ওর বাপ যদি ওর খবর পায় তাহলে এবার আর আগের ভুল করবে না। মাইরাই ফেলবে। তাই আমি চাই না তুমি ওরে নিয়ে আর ঘাঁটাঘাঁটি করো। বুঝতে পারছো?”
ঢোঁক গেলে জাফর। সাপের গর্তে হাত দিয়ে ফেলেছে। বিগত কয়েক মাসের পরিশ্রম যে-কোনো সময় ভেস্তে যেতে পারে। সে ভীত চোখে মাথা ঝাঁকাতে ঝাঁকাতে বলে, “না, ভাই আ-আমি আর ঘাঁটাঘাঁটি করমু না, করমু না। একা একা ছিলাম, তাই আ-আলাপ ক-করতেছিলাম। এই আরকি। হেহে...” হেসে সে পরিবেশ হালকা করার চেষ্টা করে।
হাশেম ভাই কিছু বলে না, সামনে তাকায়। তার অনেক তাড়া।
জাফর মনে মনে ঠিক করে, যা করার আজকেই করবে। আর সময় নষ্ট করতে সে চায় না। তারও অনেক তাড়া।
☠
জাফর এসেই সুযোগ খুঁজছিল কীভাবে আলাদা হওয়া যায়। সুযোগ পেতে বেশি দেরি হয়নি। দলে নতুন হিসাবে তার ঘাড়ে চাপিয়ে দেওয়া হয়েছে বাজার-সদাই করার দায়িত্ব। সে-ও হাসিমুখে নিয়েছে। বাজারে যাওয়ার আগে সে হুমায়ূনের কাছে আরেকবার যায়, কিছু কথাবার্তা বলে বিদায় নেয়। যদি কাজ ঠিকঠাকমতো হয়, তাহলে এটাই জীবিত অবস্থায় তার সাথে শেষ দেখা।
বাজারে এসেই লুকিয়ে রাখা ফোনটা দিয়ে বিষাণদের দলকে ডেকে আনে। এই দলটার প্রধান ছাদেক দফাদারের চেহারায় বিরক্তি। সেটাই স্বাভাবিক। তার দলকে জাফর আর্জেন্ট কল দিয়ে ডেকে এনেছে।
যতটা পারা যায় অল্প কথায় সে ছাদেকের দলকে সব বুঝিয়ে বলে। অভিজ্ঞ ছাদেকের সব দ্রুত বুঝে নিতে কোনো সমস্যা হয় না। সে তার দলের বাকিদের দায়িত্ব ভাগ করে দেয়।
যখন তাদের কোনো স্পাই কোনো শবখাদকদের দলের খবর নিয়ে আসে তখন ফাঁদে ফেলে শিকার করাটা অনেক সহজ হয়ে যায়। একদম অচেনা কোনো শবখাদকদের দলকে শিকার করা খুব কঠিন। কে কখন কোনখানে ঘাপটি মেরে লুকিয়ে থাকে তা সহজে বের করা যায় না। সেক্ষেত্রে অনেক শবখাদক আঙুলের ফাঁক গলিয়ে পালিয়ে যায়। আর ফিরে আসে ঘাতক হয়ে। যেভাবে শিকারির গুলিতে আহত বাঘ ফেরে নরখাদক হয়ে।
দূর থেকে পুরো দলটার অবস্থান বুঝে নেয় ছাদেক। চাঁদের আলোয় দূর থেকে শবখাদকদের দলের সবাইকে তেমন বোঝা যাচ্ছে না। কেবল বোঝা যাচ্ছে তারা একটা গর্ত খুঁড়ছে। অল্প দূরত্বের মধ্যেই অবস্থান করছে সবাই। আর জাফর বলে দিয়েছে এই কজনের বাইরে আর কেউ নেই। বলা যায়, ব্যাপারটা অনেক সৌভাগ্যের।
জাফরকে নিজের সাথে নিয়ে বাকিদের বৃত্তাকারে ছড়িয়ে যেতে বলে ছাদেক। আর শিঙার কথা সবাইকে আবার মনে করিয়ে দেয়। সংকেত পেলেই কেবল আক্রমণ করতে হবে। ভুল যেন না হয় সে কথাটাও বুঝিয়ে দিতে থাকে বারবার। একটা গভীর শ্বাস নিয়ে এগিয়ে যাওয়া শুরু করে সে। আজকে একটা বড়ো দাঁও মারা হবে।
জাফর অনেক অস্থির হয়ে আছে। কেউ টের পাওয়ার আগেই তাকে তার কাজ শেষ করতে হবে। ভুল করা যাবে না। আজকের সফলতার ওপরেই নির্ভর করছে তার আগামীদিনের ভবিষ্যৎ। ডাঁট ছুড়ে মারার ব্লোপাইপটা মুঠোর মধ্যে শক্ত করে রেখেছে। এটাই এখন তার ভবিষ্যৎ লেখার কলম। নিখুঁত সই এখনও তার আয়ত্বে আসেনি, তবে মোটামুটি ঠিকভাবেই লক্ষ্যভেদ করতে পারে। প্রশিক্ষণ শেষে তার স্কোর ছিল দশে সাত।
সমস্যা হচ্ছে এখন সে কোনো প্রশিক্ষণের ডামি পুতুলের ওপর ডাঁট মারবে না, সে মারবে জ্যান্ত মানুষের ওপর। তার হৃদপিণ্ড দাপাদাপি শুরু করে দিয়েছে। বুক ফেঁড়ে বেরিয়ে আসতে চাইছে। বারবার হাতের মুঠো আলগা আর শক্ত করছে। যেন ওটাই হয়ে গেছে হৃদপিণ্ড। হাত ঘেমে যাচ্ছে। কপাল বেয়ে সাপের মতো একেবেঁকে নামছে ঘাম। কাশবনের মধ্য দিয়ে যতটা সম্ভব নিচু হয়ে চুপচাপ চলছে। এরইমধ্যে ছাদেক দফাদার দুবার পিছন ফিরে তাকে সাবধান করে দিয়েছে। ছাদেকের মতো তার মাথাতেও শোভা পাচ্ছে লাল কাপড়, তাতে আঁকা সাদা শিঙা। তবে বাকি বিষাণদের মতো তার হাতে কোনো শিঙা নেই। বিষাণরা বাড়তি শিঙা নিয়ে ঘোরে না। মাঝেমধ্যে প্রয়োজনে একাধিক ব্লোপাইপ রাখে। সেগুলোরই একটা তার হাতে শোভা পাচ্ছে।
ছাদেক ঠিক যখনই শিঙা ফুঁ দিলো ঠিক তখনই সে একটা ডাঁট ছুড়ে মারলো ছ’ফিট তিন ইঞ্চি লম্বা ঝাঁকড়া চুলের শবঘাতক সামাদকে লক্ষ্য করে। আজকের সবচেয়ে সহজ লক্ষ্য। সে যত শবখাদক মারবে ততগুলো সাফল্যের পালক তার মুকুটে জুড়বে। এই হিসাবটা সহজে করার জন্য প্রতিটা বিষাণের ডাঁটগুলো আলাদা আলাদা রঙের হয়। তার ডাঁটটা উজ্জ্বল সবুজ রঙের। চাঁদের সাদাকালো আলোয় সেটাকে দেখাচ্ছে হালকা ধূসর।
তার ডাঁট ছুড়ে মারা দেখে শিঙায় ফুঁ দেওয়া শেষে ছাদেক প্রচণ্ড বিরক্তি নিয়ে তাকালো। দুজন ইতোমধ্যে শুয়ে পড়েছে। ছাদেক ধারণা করলো, দলের মাথা ওদেরই কেউ একজন, আর ওই দুজনই বিষাণদের ব্যাপারে অভিজ্ঞ। আর দলের মাথাকে বিষ মাখা ডাঁট নয়, অজ্ঞান করার ডাঁট মারতে হয় যাতে জিজ্ঞাসাবাদের জন্য ধরা যায়। কিন্তু কথা হচ্ছে, আর্জেন্ট কল’র মাধ্যমে ওপর থেকে তাকে জানিয়ে দেওয়া হয়েছে আজকে কাউকেই পাকড়াও করা হবে না। সবাইকেই বিষমাখা ডাঁট মারতে হবে। সে জানে তার দলের বাকিরা ব্যাপারটা জানে। আজ এই দলের সব শবখাদকরা অতীত হয়ে যাবে।
বেশ কিছুক্ষণ হয়ে গেছে আক্রমণের। ক্রমে ক্রমে তারা বৃত্তটাকে ছোটো করে আনছে। জাফর এবার খুঁজছে তার আসল লক্ষ্যকে।
সমস্যা হচ্ছে ছাদেক তাকে কোনোভাবেই একা ছাড়ছে না। বুঝতে পারছে শুরুর ভুলের পুনরাবৃত্তি আবার সে চাচ্ছে না। তারওপর সবাইকে মারার আদেশ পেয়েছে। তাই একটাও যাতে পালিয়ে না যায় সেদিকেও তার খেয়াল রাখতে হচ্ছে।
সবকিছু হুট করে চুপচাপ হয়ে যাবার কিছুক্ষণ পর জাফর কিছু একটা নড়ে ওঠা দেখতে পেল। কাশবনের ভেতরে কেউ চক্রাকারে কিছু একটা ঘোরাচ্ছে। সে জানে একই দৃশ্য দেখছে ছাদেকও। আর দুজনেই জানে যে চক্রাকারে ঘোরাচ্ছে সে তাদের কী বোঝাতে চাইছে। কিন্তু দুজনের মধ্যে কেবল জাফর জানে কে ঘোরাচ্ছে, তার একমাত্র লক্ষ্য। তার হাতে এখন সুযোগ একটাই। ছাদেক তাকে থামিয়ে দেওয়ার আগেই সে ছুঁড়ে মারে ডাঁট তার একমাত্র লক্ষ্যের দিকে, যার জন্য এত পরিশ্রম—আর তার একমাত্র লক্ষ্য কোনো শবখাদক নয়, বরং শবখাদকদের ঘাতক মজিদ মিয়া।
দ্বিতীয় ডাঁট ছোঁড়ার আগেই ছাদেক তাকে থামিয়ে দেয়। বলে ওঠে, “ওইটা আমাদের লোক, আর ছুঁড়িস না।”
জাফর দাঁত চেপে নিজেকে সামলায়। এখন আর দ্বিতীয়বার ডাঁট ছোড়া যাবে না। নইলে সব ফাঁস হয়ে যাবে। তার মনে একটা ক্ষীণ আশা ছিল যে হয়তো ডাঁটটা মজিদ মিয়ার গায়ে লেগেছে। কিন্তু তার আশায় জল ঢেলে দিয়ে দুটি ছায়ামূর্তি প্রাণপণে দৌড়াতে থাকে কাশের ঝোপ দিয়ে।
এবার ছায়ামূর্তির একটাকে ছাদেক চিনতে পেরে নিচের ঠোঁট কামড়ে ধরে বিড়বিড় করে বলে, “ওস্তাদের কাছে মিসটেকের জন্য মাফি (ক্ষমা) চেয়ে নিতে হবে।” তবে সে দ্রুতই ভুলে গেল যে সে ছায়ামূর্তি একটা নয়, দুটোকে দেখেছে।
সবকটা লাশ পুঁতে ফেলার সময় জাফর হুমায়ূনের লাশের কাছে হাঁটু গেঁড়ে বসে। কিছু একটা বিড়বিড় করে বলতে বলতে পুরু কাচের চশমাটা নিজের বুকপকেটে রেখে দেয়।
ছাদেক তাকে ডেকে বলে, “কালকে অবশ্যই ওস্তাদ মজিদের কাছে যেয়ে মাফি চেয়ে নিবা। ওস্তাদের ঠিকানা হলো...”
জাফর আর দেরি করতে চায় না। দ্রুত ঠিকানা শুনে নেয়। তাকে এখনই রিপোর্ট করতে হবে। আরও একটা কাজ বাকি রয়ে গেছে। সেটা আজ রাতেই শেষ করতে হবে।
সে সবাইকে রেখে দূরে এসে কল করে ওপাশে সব জানায়। ওপাশ থেকে রাশভারী কণ্ঠটা বলে, “আমার বোঝা উচিত ছিল যে তুমি একটা আস্ত অপদার্থ। এখন কীভাবে এই পরিস্থিতি সামাল দেবে? আর কবেই বা পরের সুযোগ আসবে?”
জাফর জানে তোষামোদির সময় এখন আর নেই, এখন সময় মাফ চাওয়ার। ছোটো কিন্তু অনেক বড়ো একটা কাজ দেওয়া হয়েছিল তাকে। মজিদকে মেরে ফেলতে হবে। আর মারতে হবে এমনভাবে যেন সেটা একটা দুর্ঘটনা হয়। আর শবখাদকদের মারতে গিয়ে তাদের ভেতর লুকিয়ে থাকা একজন বিষাণ মারা যেতেই পারে। এটা বিশ্বাসযোগ্য দুর্ঘটনা। কিন্তু সেই সুযোগটা ফসকে গেছে। পাশে যদি ছাদেক দফাদার না থাকতো তাহলে ফসকে যাওয়ার কোনো সম্ভাবনা ছিল না।
সে মেকি কাঁদোকাঁদো সুরে ক্ষমা চায়। বলে পরেরবার এই ভুল কোনোভাবেই হবে না। ওপাশ থেকে আরও কিছু গরম বাক্য তার কানের পর্দা ভেদ করে মস্তিষ্ককে জ্বালিয়ে দিয়ে ক্ষান্ত হয়। মোবাইলটা রাখার পর ভাবে ক্ষমতা মানুষকে কোন পর্যায়ে নামিয়ে নিয়ে আসে। ক্ষমতা দখলের লড়াইয়ে এগিয়ে থাকতে বিষাণদের প্রধান তাকে ঠিক করেছে আরেক অঘোষিত প্রধানকে মেরে ফেলার জন্য। বিনিময়ে সে পাবে কেস থেকে মুক্তি। কেসের কথা মনে হতেই সে হারিয়ে যায় তার স্মৃতির সাগরে। আলেয়ার সাগরে...
☠
আলেয়াকে সে ঠিক ভালোবেসেছিল কিনা তা মনে করতে পারে না। একজন বোবা মেয়েকে কে ভালোবাসবে? সব মানুষই তার ভালোবাসার মানুষের কাছ থেকে মধুর বুলি শুনতে চায়। খুনসুটি করতে চায়। ঝগড়া করতে চায়। সে-ও হয়তো তাই চেয়েছিল। কিন্তু পারেনি। বোবা মেয়েটাকে নিয়েই জীবন সাগরে ভাসতে চেয়েছিল।
সে ছিল তার গ্রামের চেয়ারম্যানের খাসচামচা। আর বেশিরভাগ চেয়ারম্যানের মতোই তার চেয়ারম্যান শামসুলও ক্ষমতার অপব্যবহার করতে ভোলেনি।
তার এখনও মনে পড়ে সেই দিনটার কথা। চেয়ারম্যান তাকে ডেকে বলে, “জাফর, তুই তো জানিস আমি তোরে কতটা বিশ্বাস করি। তাই তোর ওপর একটি গুরুত্বপূর্ণ দায়িত্ব দিতে চাই।”
জাফর তার পুরু গোঁফের ঘষতে ঘষতে বলল, “জি হুজুর, বলেন। আপনার জন্য জা-জান হা-হাজির।” সে মাত্রই তিনদিনের যাত্রাপালা দেখে গ্রামে এসেছে। অনেক ক্লান্ত, কিন্তু হুকুম না মানা ছাড়া উপায় নাই।
“জান-টান দিতে হবে না। শুধু একটা কাজ করে দিলেই হবে।”
“আপনে খালি হু-হুকুম করেন হুজুর। একটা ক্যা-ক্যান, হা-হাজারটা কাজ করে ফেলবো।”
“ভেতরে একখান লাশ আছে। বস্তায় বেঁধে পুঁতে ফেলবা। কাকপক্ষীও যেন টের না পায়।”
“কী যে ব-বলেন হুজুর। কাকপক্ষী তো দূ-দূরের ব্যাপার। আমিও নিজেই টের পা-পাবো না। হেহে।”
“হইছে, অত তেল মারা লাগবে না। আমার সাথে আসো।” বলে চেয়ারম্যান ঘরের ভেতরে ঢোকে। জাফরও তার পিছু পিছু যেতে থাকে।
চলতে চলতেই চেয়ারম্যান বলে ওঠে, “কও তো জাফর, একটা বোবাকে রেপ কইরা কী করতে হয়?”
“কী হুজুর?”
“আঙুল কাইটা দিতে হয়।”
জাফর কিছুটা অবাক হয়ে বলে, “ক্যা হুজুর?”
“যাতে সে কাউরে কইতে না পারে।” বলেই হো হো করে হাসতে থাকে চেয়ারম্যান।
জাফর ঠিকভাবে ধরতে না পারলেও সে তাল মেলাতে হোহো করে হাসতে থাকে। আলেয়ার কথা মনে যায়, সে হাত দিয়ে ইশারায় কথা বলে আর অর্থহীন গো গো আওয়াজ করে। এবার ব্যাপারটা বুঝে আরেকদফা হেসে নেয়।
একদম ভেতরের ঘরের বদ্ধ দরজার সামনে এসে চেয়ারম্যান দাঁড়ায়। এই বাড়িটায় চেয়ারম্যান আর তার সাঙ্গোপাঙ্গ ছাড়া আর কেউ থাকে না। এটা তাদের গোপন আস্তানা। গমসহ যত রকমের সরকারি অনুদান আসে সবকিছুর ঠাঁই হয় এখানে। অল্প কয়েকটা দানা ছিটানো হয় গ্রামে। সেই অল্প কয়েকটা দানায় যেসব মানুষ সন্তুষ্ট হয় না তাদের এখানে এনে ডলা দেওয়া হয়। বেশি ঝামেলা করলে আজকের মতো মেরে পুঁতে ফেলাও হয়। সে নিজেই দুইটাকে পুঁতেছে। একটাকে মেরেছিল বল্লম ছুঁড়ে। উঠানে এখনও সেই বল্লমটা রাখা আছে। তার নিজের সাহসের দ্যুতি ছড়ায় ওটা। আজকে সে আস্তানায় চেয়ারম্যানকে ছাড়া আর কাউকে দেখছেও না।
চেয়ারম্যান ধাক্কা দিয়ে কাঠের দরজাটা খুলতেই বোটকা একটা গন্ধ তার নাকে এসে লাগে। অন্ধকার রুম। চোখ সয়ে আসতেই চমকে ওঠে সে। জানত লাশ দেখবে, তারপরও নিজেকে সামলাতে পারলো না। চেয়ারম্যান লাইটের সুইচটা চাপ দিতেই ভয়ংকর দৃশ্যটার চোখে পড়লো।
চাপ চাপ রক্তে চারপাশ ভরে আছে। দেওয়াল ভরে গেছে রক্তের ছিটার দাগে। মেঝেতে ছড়িয়ে ছিটিয়ে আছে বেশ কটা কাটা আঙুল। আর লাশটা পড়ে আছে রুমের এককোণায় থাকা বিছানার ওপর। লাশটা একটা মেয়ের। উপুড় হয়ে আছে। কেবল দেহ নয়, তার প্রাণটাকেও উপভোগ করেছে চেয়ারম্যান।
একটা অজানা আশংকাকে পরখ করতে কিছুটা দৌড়ে গিয়ে লাশটা উলটায়। তার আশংকাকে সত্যি করে দেয় লাশটা। ওটা আলেয়ারই লাশ। লাশের গায়ে কাপড়ের বদলে আছে ক্ষতের পরত। জাফরের চারপাশটা যেন দুলে ওঠে। সে আলেয়ার লাশটাকে বুকে নেয়। চেপে ধরে। আলেয়ার মুখটাকে তার কানের কাছে নেয়। চিরচেনা সেই গো গো শব্দ যদি শোনা যায় এই আশায়।
চেয়ারম্যান খানিকটা বিস্মিত আর বিরক্তি নিয়ে বলে, “কী করতাছোস জাফর? গত পরশু ধইরা আনছিলাম। আইজ সকালের দিকেই মনে হয় মরছে। এখন তো সন্ধ্যা হয়ে গেছে। এখনও কি আর বাঁইচা আছে? মাগির কৈমাছের প্রাণ। খালি গোঁ-গোঁ শব্দ করতেছিল। চুইদা মজা পাই নাই। শীৎকার ছাড়া কী আর চুদে মজা আছে, বল? সেলিম আর রুবেল দুইটা একটা আস্ত বোকাচোদা। এইটারে ধইরা আনছে। যখন চুইদা মজা পাইতেছিলাম না তখন সেই কৌতুকটা একটু বাস্তব করার টেরাই (ট্রাই) করছিলাম এই আরকি। এইকারণে রুমটা একেবারে নোংরা হইয়া গেছে। বাকিদের বাড়িত পাঠায় দিয়া কেবল সেলিম আর রুবেলকে পাঠাইছি ঘর পরিষ্কার করার জিনিসপাতি আনতে। তুই যা পুঁতে দিয়ে আয়। কী রে? কথা কস না ক্যান? এখনও লাশটাকে চাইপা ধইরা আছোস ক্যা?”
চেয়ারম্যান কিছুটা অবাক হয়েই চুপ হয়ে যায়। পরক্ষণেই বলে ওঠে, “জানোস, সেলিম কি কামটা করছে?” বলে একটা রক্তমাখা লাটি হাতে নিয়ে বলে, “এইটা ওর ভোঁদায় ঢুকাই দিছিল। অ্যা-অ্যা কইরা সে কী চিক্কুর পারছে রে ভাই। বোবা তো, অত মজা পাওয়া যায় নাই। দুই হাত এক কইরা কতবার যে মাফ চাইছে কী আর বলবো। চোখ দিয়া গল গল কইরা জল ফেলাইছে, অই জল যদি ভোঁদা দিয়া ফেলাইতো, তাইলেই না বেশি মজা হইতো। এইসব দেইখা রুবেলও কি চুপ থাইকা পারে? সে লাঠিটা ভোঁদা থাইকা বাইর কইরা গোয়ায় ঢুকাইছে। তখন অবশ্য সেলিম ওরে চাইপা ধইরা ছিল। তখন যদি মাগিটার চোখগুলা দেখতিরে ভাই, রসগোল্লার মতো বড়ো হইয়া গেছিল। আমি অবশ্য ওদের এসব কীর্তি দেখার পর আঙুল কাটছিলাম। তুই থাকলে কী করতিরে জাফর...?”
জাফর গমগমে স্বরে বলে, “চুপ...চু-উ-প...আমার আলেয়া কিছু কইতেছে, তুই চু-চু-প হ।”
চেয়ারম্যান শামসুল খোশমেজাজে আছে, তাই তাৎক্ষণিক কোনো প্রতিক্রিয়া দেখালো না। তাই কৌতুকস্বরে বলল, “কী কইতেছে মুর্দা মাগিটা? আই লাব ইউ? হাহা।”
জাফর যেন শুনতে পায়, অনেক দূর থেকে আলেয়ার গোঁ-গোঁ আওয়াজ ভেসে আসছে। অর্থহীন আওয়াজগুলো আস্তে আস্তে অর্থবোধক হয়ে যাচ্ছে। এবার যেন সে বুঝতে পারছে আলেয়া কী বলতে চাচ্ছে...আলেয়া বলছে, “তোমার লগে ঘর বান্ধতে পারলাম না...”
চেয়ারম্যান এবার বিরক্ত হয়ে জাফরকে ঝাঁকি দেয়। জাফরের যেন ঘোর ভেঙে যায়। ঝট করে উঠে দাঁড়ায়। ইতিউতি তাকায়। মেঝেতে পড়ে আছে লম্বা ছুরিটা। ওটা দিয়েই কেটে নিয়েছে আলেয়ার স্তন, পোঁচ দিয়েছে বাহুতে, তালুতে, বুকে, উরুতে—সবখানে। কেটে নিয়েছে হাতের সবকটা আঙুল।
ছুরি হাতে নিয়ে ঘুরে দাঁড়ায় চেয়ারম্যানের দিকে। অভিজ্ঞ শামসুল বুঝতে পারে অবস্থাটা ঠিক সুবিধার না। ধমকের সুরে কিন্তু ভীতকণ্ঠে বলে, “এই জাফর...তুই এমন করতাছোস ক্যা? তুই মজা নিতে পাস নাই তো কী হইছে? দ্যাশে কি মাইয়ার অভাব? পুঁতে রেখে আয়, কাল আরও মাইয়া আনবোনে। তুই একলাই চুদিস। মাথা গরম করিস না...”
জাফর পাগলের মতো ছুরি চালায়। চেয়ারম্যান হাত দিয়ে নিজেকে বাঁচাতে গেলে ডান হাতের তিনটা আঙুল ছুরির কোপে পড়ে যায়। চিৎকার দিয়ে ওঠে সে। জাফর আবার ছুরি চালায়, এবার বাম হাতের দুটো আঙুল পড়ে যায়। ভয়ে পেছাতে গিয়ে মেঝের রক্তে পিছলে পড়ে শামসুল। মরিয়া হয়ে আঙুল কাটা দিয়েই নিজেকে বাঁচানোর চেষ্টা করে। কিন্তু জাফরের মধ্যে ক্ষোভ যেন আগ্নেয়গিরি হয়ে ফুঁসে উঠছে। কিছুই তাকে আজকে থামাতে পারবে না। সে শামসুলের বুকের ওপর চেপে বসে। ডানহাতের কব্জি মেঝেতে চেপে ধরে বাকি দুটো আঙুলও ফেলে দেয়। যন্ত্রণায় জাফরকে সরিয়ে দিতে চায়। কিন্তু পারে না। এবার জাফর বাম হাত মেঝেতে চেপে তিনটা আঙুল একটা একটা করে তিন কোপে ফেলে দেয়। শামসুল এবার আর সহ্য করতে পারে না। চেতনা হারায়। জাফরের সেদিকে ভ্রূক্ষেপ নেই। সে দুহাত দিয়ে ছুরির হাতল চেপে ধরে সজোরে নামিয়ে আনে শামসুলের ঠিক হৃদপিণ্ড বরাবর। ধড়ফড় করে অচেতন দেহ। চেতনা লুপ্ত হলেও দেহটা ঠিকই সজাগ। কাটা মুরগির মতো কিছুক্ষণ সেটা দাপাদাপি করে। অচেতন অবস্থাতেই শামসুল তার পাপের প্রায়শ্চিত্ত করে।
এভাবে ঠিক কতক্ষণ কেটে গেছে জাফর তা মনে করতে পারে না। তার সংবিৎ ফেরে কারো ডাকে। ডাকটা খেয়াল করলে বুঝতে পারে, ডাকটা আসছে বাইরে থেকে আর সেটা সেলিমের। বের হবার আর ঢোকার রাস্তা একটাই হওয়ায় সেলিম ঘরে ঢোকার আগেই সে বের হতে যায়। তার শরীর রক্তমাখা, সেটা দেখে সেলিম কিছু বলতে গিয়েও থেমে গেল। ভাবলো, জাফর হয়তো রুমটা পরিষ্কার করছিল সেকারণে তার ওই অবস্থা। কিন্তু সে মোটেও খেয়াল করলো না যে জাফরের হাতে একটা রক্তাক্ত ছুরিও আছে।
পরের পর্ব : ক্লিক করুন
ম্যাচিউর কন্টেন্ট | ভায়োলেন্স | PG 18+
গত পর্ব : ক্লিক করুন
এতক্ষণে মজিদ মিয়ার খেয়াল হলো। মাটি থেকে বস্তাটা তুলে ছাদেকের দিকে বাড়িয়ে দিয়ে বলল, “পাষণ্ড জালালের মুণ্ডু।”
ছাদেক আঁতকে উঠে বলে, “কন কী? ওর মুণ্ডু কই পাইলেন?”
সব খুলে বলার পর মজিদ মিয়া বলল, “এইটা আর চরে থাকা লাশের বাকি অংশ নিয়া ময়নাতদন্ত করাবা। কোনো ক্লু পাও কিনা দেখো। কে খুন করছে এইটা জানা খুব দরকার।”
বিষাণদের নিজস্ব ল্যাব আছে। তাতে তারা নিজস্ব অস্ত্র বানায়। প্রয়োজনে ময়নাতদন্ত করে। গবেষণা করে বিভিন্ন বিষয়ে।
বস্তাটা নিতে নিতে ছাদেক বলে, “এইটা যে জালালের হেড সেটা বুঝলেন কেমনে? জানি আপনি তারে সবচেয়ে ভালো চেনেন, তাও...”
“কপালে লেইখা দিছে খুনি। আর চরে যে লাশটা খাইতে গেছিলাম সেইটা জালালের বডি আছিল। বুকের কাটা দাগ দেইখা বুঝছি। আর আঙুল তো কাটা ছিলই। আশেপাশে আরও লাশ থাকার কথা। ও তো একা একা চলাফেরা করতো না। পাও নাই?”
ছাদেক অবাক হয়ে বলল, “এইটা অদ্ভুত ব্যাপার। ভেরি স্ট্রেঞ্জ। আপনার দলের বাইরের আর কারো লাশ পাই নাই। জালাল একা একাই গেল?”
“কোথাও কিছু ঘাপলা আছে, যেইটা আমরা ধরতে পারতেছি না। তুমি এইটারে গুরুত্বসহকারে দেখো। বিষয়টা আমার কাছে কেমন যেন ঘোলাটে লাগতেছে। কিছু একটা ঠিক নাই। মিল খাইতেছে না। আর সবাইরে সাবধান কইরা দেও। জালাল মরায় তার দল এখন খুব ক্ষেইপা উঠবো। বাইড়া যাইবো আমাদের ওপর হামলার পরিমাণ।”
স্যালুট দেওয়ার ভঙ্গি করে ছাদেক বলে, “সেকেন্ড বস আদেশ দিয়েছেন, আমি অবশ্যই দেখবো। আর বাকিদের সাবধানও করে দেবো।”
এসময় আকাশ ডেকে উঠলো ভয়ানকভাবে। দুজনেই চমকে উঠলো।
নিজেকে সামলে নিয়ে মজিদ মিয়া বলল, “দেরি হইয়া যাইতেছে। সদাই কইরা ফিরতে হইবো। ছেলেটাকে একলা রাইখা আসছি। যাও অহন। অগ্রগতি জানাইয়ো। আর বসকে আমার সালাম দিও।”
“ইয়েস সেকেন্ড বস।” মুণ্ডুর বস্তাটা নিয়ে চলে যায় ছাদেক দফাদার।
দুজন আলাদা হতে না হতেই আকাশ কালো করে মুষলধারে বৃষ্টি পড়া শুরু হলো। সেইসাথে বজ্রপাত চলছে সমানতালে। চারদিক একদম অন্ধকার হয়ে এসেছে। তাই বজ্রপাতের আলোয় যেন ঝলসে উঠছে চারপাশ।
সদাই করে কাকভেজা হয়ে বাড়ির উঠানে পা রাখতেই চমকে উঠলো মজিদ মিয়া। পিছন ফিরে স্থির হয়ে দাঁড়িয়ে আছে ছেলেটা। ভিজে একদম চুপসে আছে। গায়ে লেপটে আছে কাপড়।
মাটিতে পড়ে আছে কেউ—যার বুকে আমূল বিঁধে আছে ছুরি। বৃষ্টির তোড়ে চারপাশ থই থই করছে পানিতে।
মাথা ঘুরিয়ে পিছনে তাকালো ছেলেটা। এসময় কড়কড় শব্দে বাজ পড়লো। আলোয় উদ্ভাসিত হলো চারপাশ। সেই আলোয় দেখা গেল সরলমনা হাসির ছেলেটার মুখে ঠোঁট বাঁকানো ক্রুর হাসি। গমগমে স্বরে বলল, “ওরে কইতো হইতো, ‘তুই বাইচা আছোস?’, কিন্তু কইছে ‘তুই মরস নাই?’...জা-ফর ...মী-র...মীর-জা-ফ-র...”
দুহাত ওপরে তুলে অট্টহাসিতে ফেটে পড়ে সে। বজ্রপাতের কড়কড় শব্দ ছাপিয়ে সেই শব্দ যেন হিম করে দেয় মজিদ মিয়ার হৃদপিণ্ড।
কাঠের ঘোড়ার গল্প
জাফরের গল্প
“জাফর, তোমাকে একটা গুরুত্বপূর্ণ দায়িত্ব দিতে চাই।” চেয়ারে গা এলিয়ে দিতে দিতে রাশভারী কণ্ঠের কেউ একজন বলল। ক্যাচ ক্যাচ শব্দে চেয়ার জানান দিল নিজের অস্তিত্বের। কংক্রিটের বিশাল রুমটায় আধখোলা জানালার কল্যাণে এক ভূতুড়ে আলোআঁধারি পরিবেশের সৃষ্টি করেছে।
পুরু গোঁফওয়ালা জাফর নাকের নিচটা ঘষতে ঘষতে বলল, “জি হুজুর, বলেন। আপনার জন্য জা-জান হা-হাজির।”
“জান-টান দিতে হবে না।” কণ্ঠস্বর নামিয়ে, “কিন্তু জান নিতে হবে।”
“আপনে খালি হু-হুকুম করেন হুজুর। জান নিতে নিতে সাগর রক্তে লালে লাল করে ফে-ফে-ফেলব।”
“সাগর লাল করতে হবে না। একটা নিতে হবে কেবল।”
“জি হুজুর, বলেন কার জা-জান নিতে হবে, আমি আপনার পায়ের তলায় এ-এ-এখনই এনে দি-দিচ্ছি।”
“আহ, তোষামোদি থামাও। বুদ্ধিকে কাজে লাগাও। যা যা বলি মনোযোগ দিয়ে শোনো। পরিকল্পনা একটু এদিকওদিক হলেই ভেস্তে যাবে। তাই বুদ্ধিটাকে ঠিকঠাকভাবে কাজে লাগাবা।”
“জি হুজুর, আপনার জন্য জান হা-হাজির।”
“তোমাকে যে দলে নেওয়া হয়েছে সেটা এখন পর্যন্ত আমি আর আমার কাছের অল্প কয়েকজন ছাড়া আর কেউ জানে না। যদি এই কাজটা করে দিতে পারো তাহলে তোমার জন্য উজ্জ্বল ভবিষ্যৎ অপেক্ষা করবে। তাই আবারও বলছি ধৈর্য ধরে ধীরেসুস্থে এগোবা। কাজটা যে-করেই হোক হওয়া চাই।”
“জি হুজুর, দ-দরকার হয় চল্লিশ ব-বছর ধৈর্য ধরব। তারপরও কাজটা সফল ক-ক-রেই ছাড়ব।”
এবার রাশভারী কণ্ঠের ব্যক্তিটি পিঠ টান টান করে বসলেন। নরম গদির চেয়ারটাও ক্যাচ ক্যাচ শব্দ করে তাকে অনুসরণ করলো। কাঠের টেবিলের ওপর বসানো কাচে প্রতিফলিত হচ্ছে তার প্রশস্ত কপালের চেহারা। সেই চেহারা বিরক্তিতে কুঁচকে আছে। তিক্ত স্বরে বললেন, “এত তোষামোদির তো কোনো কারণ দেখছি না। আমি শুধু চাচ্ছি কাজটা যাতে সফল হয়।” জাফর কিছু বলতে চাচ্ছিল, তাকে থামিয়ে দিয়ে বললেন, “আর কোনো কথা নয়, যাও কাজে নেমে পড়ো।”
অবস্থা বেগতিক দেখে জাফর আর কথা বাড়ায় না। সালাম ঠুকে বেরিয়ে আসে ঘরটা থেকে। বাইরে এসেই বুক ভরে শ্বাস নেয়। তার কাছে উজ্জ্বল ভবিষ্যৎ বলতে মাথার ওপর ঝুলে থাকা কেসটা থেকে রেহাই পেলেই হয়। রাস্তায় নেমে পিচিক করে মাটিতে একদলা থুতু ফেলেই হাঁটতে শুরু করে। প্রখর সূর্যের তাপে সেই থুতু ভেলকির মতো নিমেষেই গায়েব হয়ে যায়।
☠
হাশেম ভাইয়ের দলে ঢোকাটা জাফরের জন্য খুব কঠিনই ছিল। অচেনা এক আগন্তককে কেউই দলে ভেড়াতে চাইবে না। দেড় মাস ধরে জোঁকের মতো লেগে থাকার পর হাশেম ভাইয়ের আস্থা অর্জন করতে পারে সে। এরপর থেকেই তক্কে তক্কে থাকে। সুযোগ যেন হরিণী, আর সে যেন এক ক্ষুধার্ত বাঘ...অপেক্ষা কেবল একটু অসতর্কতার।
তাকে নেওয়া হয়েছে হাশেম ভাইয়ের গ্রুপে। তার ব্যক্তিগত ধারণা হাশেম ভাই সম্ভবত নিজে তাকে আগে ভালোভাবে পরখ করে নিতে চান। তার দিক পশ্চিম। সে আর হাশেম ভাই ছাড়াও গ্রুপে আছে চশমা পরা এক লোক, নাম হুমায়ূন। চশমার ফ্রেমটা গোল। কাচটা বেশ পুরু। সেকারণে চোখগুলো কেমন যেন অদ্ভুত ছোটো লাগে। ভয় লাগে। কাঁচাপাকা চুলের হুমায়ূনকে দেখে সে মনে করেছিল অনেক জ্ঞানী গোছের কেউ। কিন্তু কথাবার্তায় বুঝতে পারে আদতে সে গণ্ডমূর্খ। সোজা বাংলায় আবাল।
সে জানে আস্থা পাকাপোক্ত করতে আলাপের জুড়ি নেই। মুখ চেনাজানা হয়, নানান কথা আদানপ্রদান হয়, সম্পর্কটা মজবুত হয়। মজবুত সম্পর্ক এনে দেয় ‘আস্থা’। আর সে যে কাজ করতে এসেছে সেই কাজের জন্য আস্থা অর্জন করা খুব জরুরি। মৃত কেঁচো দেখিয়ে বড়শিতে মাছ ফাঁদা হয় সেটার প্রতি আস্থা অর্জন করার মাধ্যমেই। যে যত সহজে আস্থা অর্জন করতে পারে সে তত ভালো মাছ শিকারী।
আলাপের মাধ্যমে কারো আস্থা অর্জনের ক্ষেত্রে জাফরের ব্যক্তিগত মতামত হচ্ছে, আলাপের বিষয়বস্তু হতে হবে অপর ব্যক্তির অতীত আর সংসার। একমাত্র অতীতই অপরিবর্তনীয়। চাইলেও বদলানো যায় না। আর অতীত মানেই সেখানে থাকবে গোপন কিছু। জাতির গোপন অতীতের নাম হলো ‘পরাজিতদের ইতিহাস’, আর ব্যক্তিরটা ‘একান্ত ব্যক্তিগত’। আমরা যার যত বেশি ব্যক্তিগত অতীত জানতে পারি, সে আমাদের তত আপন হয়। আর যে আমাদের যত আপন, আমাদের প্রতি তার আস্থাও তত বেশি গাঢ়। যেমনটা দীঘির জল। যত বেশি গভীর জল তত বেশি কালো। আর সংসার হচ্ছে মানুষের সেই অংশ যাকে সে কখনো আলাদা করতে পারে না। আলাদা করতে পারে না বলেই, তার বেশিরভাগ ব্যক্তিগত ঘটনা এই সংসারকে ঘিরেই থাকে।
তাই জাফর সুযোগ পেলেই হুমায়ূনের সাথে আলাপ জুড়ে দেয়। হুমায়ূনের সাথে সখ্যতা হয়ে গেলে, হুমায়ূনের সাথে যার বেশি সখ্যতা তার আস্থা অর্জন করা আরও বেশি সহজ হয়ে যাবে। এটা অবশ্য অচেনা মেয়েদের ক্ষেত্রে সম্পর্ক গড়তে অনেক কাজে দেয়। একটা মেয়ে কখনো কারো প্রতি সহজে আস্থা রাখতে পারে না, কিন্তু যখনই দেখে তার পরিচিত কেউ সেই ব্যক্তির প্রতি আস্থা রেখেছে, তখন খুব দ্রুতই বিশ্বাস করে ফেলে। যেমনটা করেছিল আলেয়া।
আলেয়ার কথা মনে হতেই লকলকে জিহ্বাটাকে গাড়ির উইন্ডশিল্ডের মতো করে নাড়িয়ে ঠোঁট ভিজিয়ে নিলো। যেন এখনও সে তার ঠোঁটে পাচ্ছে আলেয়ার স্তনের বোঁটার স্পর্শ। মাছের মতো হা করে খেয়ে ফেলছে তার নরম স্তন। আঙুলে পাচ্ছে তার পেলব শরীরের উষ্ণ স্পর্শ। কিন্তু আলেয়ার মুখের কোনো মধুর কথা তার স্মৃতিতে নেই, আছে কেবল কিছু অর্থহীন গোঙানি—কারণ সে ছিল বোবা।
আলেয়ার স্মৃতিকে একপাশে রেখে এগিয়ে যায় হুমায়ূনের কাছে। সে এখন একা। একা মানেই ‘একান্ত ব্যক্তিগত’ জানার একান্ত সময়। হাশেম ভাই কোথাও গেছে। তাদের দুজনকে রেখে গেছে একটা নির্জন নদীর ধারে। হুহু করে বাতাস বইছে। ছন্দে ছন্দে ছলাৎ ছলাৎ শব্দে তীরে এসে আত্মাহুতি দিচ্ছে স্রোতের দল। হুমায়ূন তীরে বসে থেকে একদৃষ্টিতে তা দেখছে।
তার পাশে বসেই জাফর বলে উঠলো, “জানো, আমার একখান পে-পে-পেমিকা (প্রেমিকা) আছিল। নাম আছিল আলেয়া। খুব সো-সোন্দর দেখতে।” সে জানে গোপন কথা জানতে নিজেরও কিছু গোপন কথা জানাতে হয়। আর আলাপ এগিয়ে নিতে যে যেমন তার সাথে সে সেই ভঙ্গিতেই কথা বলে।
হুমায়ূন তার পুরু কাচের ভেতর থেকে জিজ্ঞাসু দৃষ্টি মেলে বলে, “হেয় কই এখন? দেখতেছি না যে?”
“এইখানে তারে পা-পা-বা কেমনে? সে আমার...কী বলে যেন...এক্স... এক্স গালফেন্ড।”
“সেক্স গালফেন্ড কী?”
“আরে সেক্স না, সেক্স না, এক্স...এ...এ...ক্স। মানে হইলো...” মাথা চুলকায় জাফর। সে শুধু জানে এক্স ইংরেজির একটা বর্ণ, এটার মানে যে কী সে ঠিক খেয়াল করতে পারছে না। সে খেয়াল করেনি যে এই এক্স (ex) বর্ণ এক্স (x) নয়। “এই ম-মনে করো, মইরা যাওয়া পেমিকারে কয় এক্স গালফেন্ড।” বলেই মনে মনে কয়েকটা গালি দেয় হুমায়ূনকে। এই নিয়ে প্রায় মাসখানেক সময় এই লোকের পিছনে সে ব্যয় করেছে। তেমন কিছু জানতে পারেনি। আজকেও যে পারবে বলে মনে হচ্ছে না। সে তার পুরু গোঁফটা আঙুল দিয়ে খস খস শব্দ করে বারকয়েক ঘষে।
“ও, আইচ্চা। কেমনে মরলো? প্যাটে বেদনা হইছিল?”
“আরে ধ্যাত। বা-বা-বাদ দেও আলেয়ার কথা। তো-তোমার কতা কও। তোমার কো-কোনো এক্স গালফেন্ড ছিল না?”
হুমায়ূন কিছুটা লজ্জা পায়। চোখ নামিয়ে ফেলে। ডান হাত দিয়ে খোঁচা খোঁচা দাঁড়ি ভরা ডান গাল চুলকাতে চুলকাতে বলে, “ইয়ে মানে, একখান আছিল। তয় তারে কখনো মনের কতা কইতে পারি নাই।”
জাফর মনে মনে তাকে আবার আরও কয়েকটা গালি দিয়ে ভাবে, “মনের কথাই বলতে পারিস নাই, এক্স গালফেন্ড হইলো কেমনে?’” মুখে বলে, “কেমন আছিল দেখতে?”
“খুব সোন্দর। কুমড়া পাকলে যেমন সোন্দর লাগে তেমন।”
জাফর হাসতে গিয়েও হাসে না। এখন হুমায়ূনের মুড নষ্ট করা যাবে না। সে বলে, “আইচ্চা, তার ক-কতা থা-থাউক, তোমার কতা কও। এই দলে ঢু-ঢুকলা কেমনে?”
“সে তো অনেক লম্বা এতিহাস। প্যাটে বেদনা হইছিল। রাস্তায় নাকি পইরা আছিলাম। হাশেম ভাই তুইলা আনছে। তারপর থাইকা তার লগে আছি।”
জাফর মনে মনে বলে, “আসলেই ‘অনেক লম্বা এতিহাস’,” মুখে দুঃখভাব ফুটিয়ে বলে, “ক্যা, তোমার ফ্যামিলিতে কেউ নাই?”
মাথা তুলে কিছুটা বিস্ময় নিয়ে বলে, “চামেলি কী? ফুল না?”
“আরে, চামেলি না, ফ্যা-ফ্যামিলি মানে হইলো প-পরিবার—মা-বাবা, ভাই-বোন এরা মিইলা হয় ফ্যামিলি।”
“ও...ছিল। শুধু আম্মা-আব্বা। ভাই-বোন নাই। আমার আম্মা মইরা যাওয়ার পর আব্বা নতুন বিয়া করছিল। জানেন, আমার আম্মা মইরা গেছিল প্যাট খারাপ হইয়া। খুব বেদনা উঠছিল। সারা রাইত পেট চাইপা ধইরা কান্দছে। বিছানার এপাশ থাইকা ওইপাশ গড়াগড়ি খাইছে। ফযরের আজানের সময় বেদনা থামছে, আম্মাও মরছে। আমারও তো প্যাট খারাপ হইছিল। আমি তো মরলাম না, হেয় মরলো ক্যান? বারবার কইছিলাম, ‘আম্মা, দুধ খাইছ না, দুধ খাইছ না।’ দুধ খাইয়াই মরলো।”
“দু-দুধ খাইয়া ম-মরছিল মানে?” কিছুটা বিস্ময় নিয়ে বলে জাফর।
“নতুন আম্মা দুধ দিছিল। অবশ্য তখনও নতুন আম্মা হয় নাই। আমাদের বাড়িত থাকতো। আব্বার কেমন যেন আত্মীয় হয়। সেই দুধ খাইয়াই তো তার বেদনা উঠলো। আব্বা কইছিল, খাঁটি দুধ হওয়ায় সমস্যা হইছিল। আমি তাই দুধে পানি দিয়া দুধ ভেজাল বানাইয়া খাই।”
“দুধ খাইয়া মরছে, সেইটা কেমন বুঝলা?”
“মরার পর তার মুখ দিয়ে ফেনার মতো দুধ বাইর হইছিল তো। খাঁটি দুধ আছিল তো, তাই।”
“তোমারেও খাঁটি দুধ দিছিল?” ভ্রু কুঁচকে বলে জাফর।
“হ, কিন্তু আমি পানি দিয়া ভেজাল কইরা খাইছিলাম। তবুও প্যাটে বেদনা উঠছিল। মনে হয় অজ্ঞান হয়ে গেছিলাম। জ্ঞান ফেরার পর চোখের সামনে হাশেম ভাইকে দেখি। উনি ক্যান জানি আর যাইতে দেন নাই। আমার সব কতা শুইনা কইছে, গেলে আবার প্যাটে বেদনা উঠবো।”
সব শুনে জাফর কিছুক্ষণ হুমায়ূনের মোটা কাচের দিকে তাকিয়ে থাকে। একজন মানুষ কী করে এতটা সহজ-সরল আর বোকা হতে পারে? দুজন মানুষের পরকীয়ার বলি যে হয়ে গেছে তার মা, এমনকী হতে ধরেছিল সে নিজেও, তা হয়তো কখনোই ধরতে পারবে না।
হুমায়ূন বলতে থাকে, “আমার আম্মা, আমারে খুব ভালোবাসতো। কখনো আমার প্যাটে বেদনা উঠতে দেয় নাই। আমার জন্য রাখা খাঁটি দুধ নিজে খাইয়া ফেলছে। বিছানায় যখন বেদনায় মোচড়ামুচড়ি করছে, তখনও আমার মাথায় হাত বুলাইয়া দিচ্ছিল আর কইতেছিল, ‘বাপ আমার, পলাইয়া যা, পলাইয়া যা’।” বলেই সে নিজের মাথায় হাত বুলায়।
জাফর উঠে দাঁড়ায়। প্যান্টের বালি ঝাড়তে ঝাড়তে বলে, “তো-তোমার বাসা কই ছিল?”
হুমায়ূন বলতে যেতেই হাশেম ভাই এসে দাঁড়ান। হাঁপাচ্ছেন। ধপ করে হুমায়ূনের পাশে বসে বলেন, “ আলাল জানিয়ে গেল যে একটা টাটকা লাশ পাওয়া গেছে। এই নদী ধরে এগুলেই হবে। দ্রুত হাঁটতে হবে। বাকিরা প্রায় পৌঁছে গেছে।”
হুমায়ূন লাফ দিয়ে উঠে বলে, “কতদিন টাটকা লাশের অভাবে ঘিলু খাওয়া হয় না। আম্মা কইছিল ঘিলু খাইলে ঘিলু হয়।”
হাশেম ভাই বললেন, “শুনলাম, লাশটার মুণ্ডু নাই। ঘিলু পাইবা না।”
☠
রাতের চাদর মুড়ি দিয়ে সূর্য ঘুমিয়ে গেছে। এখন পাহারায় বসেছে পূর্ণ চাঁদ। সেই চাঁদের আলোয় দ্রুতপদে হাঁটছে পশ্চিম দলের হাশেম ভাই, হুমায়ূন আর জাফর...এগিয়ে যাচ্ছে গল্পের এক পরিণতির দিকে।
এই প্রথম হুমায়ূনকে ভালোভাবে খেয়াল করে জাফর। তার হাঁটাচলা ঠিক পূর্ণবয়স্ক কারো মতো নয়। ছোটোবাচ্চার মতো হেলেদুলে হাঁটে। মাঝেমধ্যেই চলতে চলতে এদিকওদিক চলে যাচ্ছে। হাশেম ভাই ধমক দিয়ে তার পিছনে নিয়ে আসছেন। সে এগিয়ে যায়। হাশেম ভাইয়ের পাশে পাশে হাঁটতে হাঁটতে বলে, “ভাই, হু-হুমায়ূনের বু-বুদ্ধিশুদ্ধি এত কম ক্যা?”
হাশেম ভাই ভ্রু কুঞ্চিত করে বলেন, “তা দিয়া তোমার কী কাম?”
জাফর বুঝতে পারে যে সে ভুল প্রশ্ন করে ফেলেছে। তাই চটপট বলে, “না মানে, ওর বাবা-মায়ের কতা ক-ক-কইতে ছিল তো তাই ব-বলতেছিলাম।”
এবার হাশেম ভাই হুমায়ূনের দিকে বিরক্তি নিয়ে তাকিয়ে বলেন, “এই হুমায়ূন, যা তো সামনে যা।”
হুমায়ূন কিছুটা দৌড় দিয়ে সামনে এগিয়ে যায়।
এবার হাশেম ভাই হাঁটতে হাঁটতে জাফরের দিকে তাকিয়ে বলে, “এত তাড়াতাড়ি ওর বাবা-মায়ের কথা তোমার জানা উচিত হয় নাই। কারো ব্যক্তিগত ব্যাপারে শবখাদকরা নাক গলায় না। তোমারও গলানো উচিত হয় নাই। এখন যখন গলাইয়েই ফেলাইছো, তাই কই, সহজে বোঝা যায় না যে ও একটা বুদ্ধিপ্রতিবন্ধী। কখন কী বলে, কী করে ঠিক নাই। ওরে যখন পাই তখন ও আধমরা। অনেক কষ্ট হইছে বাঁচাইতে। ওর বাপ যদি ওর খবর পায় তাহলে এবার আর আগের ভুল করবে না। মাইরাই ফেলবে। তাই আমি চাই না তুমি ওরে নিয়ে আর ঘাঁটাঘাঁটি করো। বুঝতে পারছো?”
ঢোঁক গেলে জাফর। সাপের গর্তে হাত দিয়ে ফেলেছে। বিগত কয়েক মাসের পরিশ্রম যে-কোনো সময় ভেস্তে যেতে পারে। সে ভীত চোখে মাথা ঝাঁকাতে ঝাঁকাতে বলে, “না, ভাই আ-আমি আর ঘাঁটাঘাঁটি করমু না, করমু না। একা একা ছিলাম, তাই আ-আলাপ ক-করতেছিলাম। এই আরকি। হেহে...” হেসে সে পরিবেশ হালকা করার চেষ্টা করে।
হাশেম ভাই কিছু বলে না, সামনে তাকায়। তার অনেক তাড়া।
জাফর মনে মনে ঠিক করে, যা করার আজকেই করবে। আর সময় নষ্ট করতে সে চায় না। তারও অনেক তাড়া।
☠
জাফর এসেই সুযোগ খুঁজছিল কীভাবে আলাদা হওয়া যায়। সুযোগ পেতে বেশি দেরি হয়নি। দলে নতুন হিসাবে তার ঘাড়ে চাপিয়ে দেওয়া হয়েছে বাজার-সদাই করার দায়িত্ব। সে-ও হাসিমুখে নিয়েছে। বাজারে যাওয়ার আগে সে হুমায়ূনের কাছে আরেকবার যায়, কিছু কথাবার্তা বলে বিদায় নেয়। যদি কাজ ঠিকঠাকমতো হয়, তাহলে এটাই জীবিত অবস্থায় তার সাথে শেষ দেখা।
বাজারে এসেই লুকিয়ে রাখা ফোনটা দিয়ে বিষাণদের দলকে ডেকে আনে। এই দলটার প্রধান ছাদেক দফাদারের চেহারায় বিরক্তি। সেটাই স্বাভাবিক। তার দলকে জাফর আর্জেন্ট কল দিয়ে ডেকে এনেছে।
যতটা পারা যায় অল্প কথায় সে ছাদেকের দলকে সব বুঝিয়ে বলে। অভিজ্ঞ ছাদেকের সব দ্রুত বুঝে নিতে কোনো সমস্যা হয় না। সে তার দলের বাকিদের দায়িত্ব ভাগ করে দেয়।
যখন তাদের কোনো স্পাই কোনো শবখাদকদের দলের খবর নিয়ে আসে তখন ফাঁদে ফেলে শিকার করাটা অনেক সহজ হয়ে যায়। একদম অচেনা কোনো শবখাদকদের দলকে শিকার করা খুব কঠিন। কে কখন কোনখানে ঘাপটি মেরে লুকিয়ে থাকে তা সহজে বের করা যায় না। সেক্ষেত্রে অনেক শবখাদক আঙুলের ফাঁক গলিয়ে পালিয়ে যায়। আর ফিরে আসে ঘাতক হয়ে। যেভাবে শিকারির গুলিতে আহত বাঘ ফেরে নরখাদক হয়ে।
দূর থেকে পুরো দলটার অবস্থান বুঝে নেয় ছাদেক। চাঁদের আলোয় দূর থেকে শবখাদকদের দলের সবাইকে তেমন বোঝা যাচ্ছে না। কেবল বোঝা যাচ্ছে তারা একটা গর্ত খুঁড়ছে। অল্প দূরত্বের মধ্যেই অবস্থান করছে সবাই। আর জাফর বলে দিয়েছে এই কজনের বাইরে আর কেউ নেই। বলা যায়, ব্যাপারটা অনেক সৌভাগ্যের।
জাফরকে নিজের সাথে নিয়ে বাকিদের বৃত্তাকারে ছড়িয়ে যেতে বলে ছাদেক। আর শিঙার কথা সবাইকে আবার মনে করিয়ে দেয়। সংকেত পেলেই কেবল আক্রমণ করতে হবে। ভুল যেন না হয় সে কথাটাও বুঝিয়ে দিতে থাকে বারবার। একটা গভীর শ্বাস নিয়ে এগিয়ে যাওয়া শুরু করে সে। আজকে একটা বড়ো দাঁও মারা হবে।
জাফর অনেক অস্থির হয়ে আছে। কেউ টের পাওয়ার আগেই তাকে তার কাজ শেষ করতে হবে। ভুল করা যাবে না। আজকের সফলতার ওপরেই নির্ভর করছে তার আগামীদিনের ভবিষ্যৎ। ডাঁট ছুড়ে মারার ব্লোপাইপটা মুঠোর মধ্যে শক্ত করে রেখেছে। এটাই এখন তার ভবিষ্যৎ লেখার কলম। নিখুঁত সই এখনও তার আয়ত্বে আসেনি, তবে মোটামুটি ঠিকভাবেই লক্ষ্যভেদ করতে পারে। প্রশিক্ষণ শেষে তার স্কোর ছিল দশে সাত।
সমস্যা হচ্ছে এখন সে কোনো প্রশিক্ষণের ডামি পুতুলের ওপর ডাঁট মারবে না, সে মারবে জ্যান্ত মানুষের ওপর। তার হৃদপিণ্ড দাপাদাপি শুরু করে দিয়েছে। বুক ফেঁড়ে বেরিয়ে আসতে চাইছে। বারবার হাতের মুঠো আলগা আর শক্ত করছে। যেন ওটাই হয়ে গেছে হৃদপিণ্ড। হাত ঘেমে যাচ্ছে। কপাল বেয়ে সাপের মতো একেবেঁকে নামছে ঘাম। কাশবনের মধ্য দিয়ে যতটা সম্ভব নিচু হয়ে চুপচাপ চলছে। এরইমধ্যে ছাদেক দফাদার দুবার পিছন ফিরে তাকে সাবধান করে দিয়েছে। ছাদেকের মতো তার মাথাতেও শোভা পাচ্ছে লাল কাপড়, তাতে আঁকা সাদা শিঙা। তবে বাকি বিষাণদের মতো তার হাতে কোনো শিঙা নেই। বিষাণরা বাড়তি শিঙা নিয়ে ঘোরে না। মাঝেমধ্যে প্রয়োজনে একাধিক ব্লোপাইপ রাখে। সেগুলোরই একটা তার হাতে শোভা পাচ্ছে।
ছাদেক ঠিক যখনই শিঙা ফুঁ দিলো ঠিক তখনই সে একটা ডাঁট ছুড়ে মারলো ছ’ফিট তিন ইঞ্চি লম্বা ঝাঁকড়া চুলের শবঘাতক সামাদকে লক্ষ্য করে। আজকের সবচেয়ে সহজ লক্ষ্য। সে যত শবখাদক মারবে ততগুলো সাফল্যের পালক তার মুকুটে জুড়বে। এই হিসাবটা সহজে করার জন্য প্রতিটা বিষাণের ডাঁটগুলো আলাদা আলাদা রঙের হয়। তার ডাঁটটা উজ্জ্বল সবুজ রঙের। চাঁদের সাদাকালো আলোয় সেটাকে দেখাচ্ছে হালকা ধূসর।
তার ডাঁট ছুড়ে মারা দেখে শিঙায় ফুঁ দেওয়া শেষে ছাদেক প্রচণ্ড বিরক্তি নিয়ে তাকালো। দুজন ইতোমধ্যে শুয়ে পড়েছে। ছাদেক ধারণা করলো, দলের মাথা ওদেরই কেউ একজন, আর ওই দুজনই বিষাণদের ব্যাপারে অভিজ্ঞ। আর দলের মাথাকে বিষ মাখা ডাঁট নয়, অজ্ঞান করার ডাঁট মারতে হয় যাতে জিজ্ঞাসাবাদের জন্য ধরা যায়। কিন্তু কথা হচ্ছে, আর্জেন্ট কল’র মাধ্যমে ওপর থেকে তাকে জানিয়ে দেওয়া হয়েছে আজকে কাউকেই পাকড়াও করা হবে না। সবাইকেই বিষমাখা ডাঁট মারতে হবে। সে জানে তার দলের বাকিরা ব্যাপারটা জানে। আজ এই দলের সব শবখাদকরা অতীত হয়ে যাবে।
বেশ কিছুক্ষণ হয়ে গেছে আক্রমণের। ক্রমে ক্রমে তারা বৃত্তটাকে ছোটো করে আনছে। জাফর এবার খুঁজছে তার আসল লক্ষ্যকে।
সমস্যা হচ্ছে ছাদেক তাকে কোনোভাবেই একা ছাড়ছে না। বুঝতে পারছে শুরুর ভুলের পুনরাবৃত্তি আবার সে চাচ্ছে না। তারওপর সবাইকে মারার আদেশ পেয়েছে। তাই একটাও যাতে পালিয়ে না যায় সেদিকেও তার খেয়াল রাখতে হচ্ছে।
সবকিছু হুট করে চুপচাপ হয়ে যাবার কিছুক্ষণ পর জাফর কিছু একটা নড়ে ওঠা দেখতে পেল। কাশবনের ভেতরে কেউ চক্রাকারে কিছু একটা ঘোরাচ্ছে। সে জানে একই দৃশ্য দেখছে ছাদেকও। আর দুজনেই জানে যে চক্রাকারে ঘোরাচ্ছে সে তাদের কী বোঝাতে চাইছে। কিন্তু দুজনের মধ্যে কেবল জাফর জানে কে ঘোরাচ্ছে, তার একমাত্র লক্ষ্য। তার হাতে এখন সুযোগ একটাই। ছাদেক তাকে থামিয়ে দেওয়ার আগেই সে ছুঁড়ে মারে ডাঁট তার একমাত্র লক্ষ্যের দিকে, যার জন্য এত পরিশ্রম—আর তার একমাত্র লক্ষ্য কোনো শবখাদক নয়, বরং শবখাদকদের ঘাতক মজিদ মিয়া।
দ্বিতীয় ডাঁট ছোঁড়ার আগেই ছাদেক তাকে থামিয়ে দেয়। বলে ওঠে, “ওইটা আমাদের লোক, আর ছুঁড়িস না।”
জাফর দাঁত চেপে নিজেকে সামলায়। এখন আর দ্বিতীয়বার ডাঁট ছোড়া যাবে না। নইলে সব ফাঁস হয়ে যাবে। তার মনে একটা ক্ষীণ আশা ছিল যে হয়তো ডাঁটটা মজিদ মিয়ার গায়ে লেগেছে। কিন্তু তার আশায় জল ঢেলে দিয়ে দুটি ছায়ামূর্তি প্রাণপণে দৌড়াতে থাকে কাশের ঝোপ দিয়ে।
এবার ছায়ামূর্তির একটাকে ছাদেক চিনতে পেরে নিচের ঠোঁট কামড়ে ধরে বিড়বিড় করে বলে, “ওস্তাদের কাছে মিসটেকের জন্য মাফি (ক্ষমা) চেয়ে নিতে হবে।” তবে সে দ্রুতই ভুলে গেল যে সে ছায়ামূর্তি একটা নয়, দুটোকে দেখেছে।
সবকটা লাশ পুঁতে ফেলার সময় জাফর হুমায়ূনের লাশের কাছে হাঁটু গেঁড়ে বসে। কিছু একটা বিড়বিড় করে বলতে বলতে পুরু কাচের চশমাটা নিজের বুকপকেটে রেখে দেয়।
ছাদেক তাকে ডেকে বলে, “কালকে অবশ্যই ওস্তাদ মজিদের কাছে যেয়ে মাফি চেয়ে নিবা। ওস্তাদের ঠিকানা হলো...”
জাফর আর দেরি করতে চায় না। দ্রুত ঠিকানা শুনে নেয়। তাকে এখনই রিপোর্ট করতে হবে। আরও একটা কাজ বাকি রয়ে গেছে। সেটা আজ রাতেই শেষ করতে হবে।
সে সবাইকে রেখে দূরে এসে কল করে ওপাশে সব জানায়। ওপাশ থেকে রাশভারী কণ্ঠটা বলে, “আমার বোঝা উচিত ছিল যে তুমি একটা আস্ত অপদার্থ। এখন কীভাবে এই পরিস্থিতি সামাল দেবে? আর কবেই বা পরের সুযোগ আসবে?”
জাফর জানে তোষামোদির সময় এখন আর নেই, এখন সময় মাফ চাওয়ার। ছোটো কিন্তু অনেক বড়ো একটা কাজ দেওয়া হয়েছিল তাকে। মজিদকে মেরে ফেলতে হবে। আর মারতে হবে এমনভাবে যেন সেটা একটা দুর্ঘটনা হয়। আর শবখাদকদের মারতে গিয়ে তাদের ভেতর লুকিয়ে থাকা একজন বিষাণ মারা যেতেই পারে। এটা বিশ্বাসযোগ্য দুর্ঘটনা। কিন্তু সেই সুযোগটা ফসকে গেছে। পাশে যদি ছাদেক দফাদার না থাকতো তাহলে ফসকে যাওয়ার কোনো সম্ভাবনা ছিল না।
সে মেকি কাঁদোকাঁদো সুরে ক্ষমা চায়। বলে পরেরবার এই ভুল কোনোভাবেই হবে না। ওপাশ থেকে আরও কিছু গরম বাক্য তার কানের পর্দা ভেদ করে মস্তিষ্ককে জ্বালিয়ে দিয়ে ক্ষান্ত হয়। মোবাইলটা রাখার পর ভাবে ক্ষমতা মানুষকে কোন পর্যায়ে নামিয়ে নিয়ে আসে। ক্ষমতা দখলের লড়াইয়ে এগিয়ে থাকতে বিষাণদের প্রধান তাকে ঠিক করেছে আরেক অঘোষিত প্রধানকে মেরে ফেলার জন্য। বিনিময়ে সে পাবে কেস থেকে মুক্তি। কেসের কথা মনে হতেই সে হারিয়ে যায় তার স্মৃতির সাগরে। আলেয়ার সাগরে...
☠
আলেয়াকে সে ঠিক ভালোবেসেছিল কিনা তা মনে করতে পারে না। একজন বোবা মেয়েকে কে ভালোবাসবে? সব মানুষই তার ভালোবাসার মানুষের কাছ থেকে মধুর বুলি শুনতে চায়। খুনসুটি করতে চায়। ঝগড়া করতে চায়। সে-ও হয়তো তাই চেয়েছিল। কিন্তু পারেনি। বোবা মেয়েটাকে নিয়েই জীবন সাগরে ভাসতে চেয়েছিল।
সে ছিল তার গ্রামের চেয়ারম্যানের খাসচামচা। আর বেশিরভাগ চেয়ারম্যানের মতোই তার চেয়ারম্যান শামসুলও ক্ষমতার অপব্যবহার করতে ভোলেনি।
তার এখনও মনে পড়ে সেই দিনটার কথা। চেয়ারম্যান তাকে ডেকে বলে, “জাফর, তুই তো জানিস আমি তোরে কতটা বিশ্বাস করি। তাই তোর ওপর একটি গুরুত্বপূর্ণ দায়িত্ব দিতে চাই।”
জাফর তার পুরু গোঁফের ঘষতে ঘষতে বলল, “জি হুজুর, বলেন। আপনার জন্য জা-জান হা-হাজির।” সে মাত্রই তিনদিনের যাত্রাপালা দেখে গ্রামে এসেছে। অনেক ক্লান্ত, কিন্তু হুকুম না মানা ছাড়া উপায় নাই।
“জান-টান দিতে হবে না। শুধু একটা কাজ করে দিলেই হবে।”
“আপনে খালি হু-হুকুম করেন হুজুর। একটা ক্যা-ক্যান, হা-হাজারটা কাজ করে ফেলবো।”
“ভেতরে একখান লাশ আছে। বস্তায় বেঁধে পুঁতে ফেলবা। কাকপক্ষীও যেন টের না পায়।”
“কী যে ব-বলেন হুজুর। কাকপক্ষী তো দূ-দূরের ব্যাপার। আমিও নিজেই টের পা-পাবো না। হেহে।”
“হইছে, অত তেল মারা লাগবে না। আমার সাথে আসো।” বলে চেয়ারম্যান ঘরের ভেতরে ঢোকে। জাফরও তার পিছু পিছু যেতে থাকে।
চলতে চলতেই চেয়ারম্যান বলে ওঠে, “কও তো জাফর, একটা বোবাকে রেপ কইরা কী করতে হয়?”
“কী হুজুর?”
“আঙুল কাইটা দিতে হয়।”
জাফর কিছুটা অবাক হয়ে বলে, “ক্যা হুজুর?”
“যাতে সে কাউরে কইতে না পারে।” বলেই হো হো করে হাসতে থাকে চেয়ারম্যান।
জাফর ঠিকভাবে ধরতে না পারলেও সে তাল মেলাতে হোহো করে হাসতে থাকে। আলেয়ার কথা মনে যায়, সে হাত দিয়ে ইশারায় কথা বলে আর অর্থহীন গো গো আওয়াজ করে। এবার ব্যাপারটা বুঝে আরেকদফা হেসে নেয়।
একদম ভেতরের ঘরের বদ্ধ দরজার সামনে এসে চেয়ারম্যান দাঁড়ায়। এই বাড়িটায় চেয়ারম্যান আর তার সাঙ্গোপাঙ্গ ছাড়া আর কেউ থাকে না। এটা তাদের গোপন আস্তানা। গমসহ যত রকমের সরকারি অনুদান আসে সবকিছুর ঠাঁই হয় এখানে। অল্প কয়েকটা দানা ছিটানো হয় গ্রামে। সেই অল্প কয়েকটা দানায় যেসব মানুষ সন্তুষ্ট হয় না তাদের এখানে এনে ডলা দেওয়া হয়। বেশি ঝামেলা করলে আজকের মতো মেরে পুঁতে ফেলাও হয়। সে নিজেই দুইটাকে পুঁতেছে। একটাকে মেরেছিল বল্লম ছুঁড়ে। উঠানে এখনও সেই বল্লমটা রাখা আছে। তার নিজের সাহসের দ্যুতি ছড়ায় ওটা। আজকে সে আস্তানায় চেয়ারম্যানকে ছাড়া আর কাউকে দেখছেও না।
চেয়ারম্যান ধাক্কা দিয়ে কাঠের দরজাটা খুলতেই বোটকা একটা গন্ধ তার নাকে এসে লাগে। অন্ধকার রুম। চোখ সয়ে আসতেই চমকে ওঠে সে। জানত লাশ দেখবে, তারপরও নিজেকে সামলাতে পারলো না। চেয়ারম্যান লাইটের সুইচটা চাপ দিতেই ভয়ংকর দৃশ্যটার চোখে পড়লো।
চাপ চাপ রক্তে চারপাশ ভরে আছে। দেওয়াল ভরে গেছে রক্তের ছিটার দাগে। মেঝেতে ছড়িয়ে ছিটিয়ে আছে বেশ কটা কাটা আঙুল। আর লাশটা পড়ে আছে রুমের এককোণায় থাকা বিছানার ওপর। লাশটা একটা মেয়ের। উপুড় হয়ে আছে। কেবল দেহ নয়, তার প্রাণটাকেও উপভোগ করেছে চেয়ারম্যান।
একটা অজানা আশংকাকে পরখ করতে কিছুটা দৌড়ে গিয়ে লাশটা উলটায়। তার আশংকাকে সত্যি করে দেয় লাশটা। ওটা আলেয়ারই লাশ। লাশের গায়ে কাপড়ের বদলে আছে ক্ষতের পরত। জাফরের চারপাশটা যেন দুলে ওঠে। সে আলেয়ার লাশটাকে বুকে নেয়। চেপে ধরে। আলেয়ার মুখটাকে তার কানের কাছে নেয়। চিরচেনা সেই গো গো শব্দ যদি শোনা যায় এই আশায়।
চেয়ারম্যান খানিকটা বিস্মিত আর বিরক্তি নিয়ে বলে, “কী করতাছোস জাফর? গত পরশু ধইরা আনছিলাম। আইজ সকালের দিকেই মনে হয় মরছে। এখন তো সন্ধ্যা হয়ে গেছে। এখনও কি আর বাঁইচা আছে? মাগির কৈমাছের প্রাণ। খালি গোঁ-গোঁ শব্দ করতেছিল। চুইদা মজা পাই নাই। শীৎকার ছাড়া কী আর চুদে মজা আছে, বল? সেলিম আর রুবেল দুইটা একটা আস্ত বোকাচোদা। এইটারে ধইরা আনছে। যখন চুইদা মজা পাইতেছিলাম না তখন সেই কৌতুকটা একটু বাস্তব করার টেরাই (ট্রাই) করছিলাম এই আরকি। এইকারণে রুমটা একেবারে নোংরা হইয়া গেছে। বাকিদের বাড়িত পাঠায় দিয়া কেবল সেলিম আর রুবেলকে পাঠাইছি ঘর পরিষ্কার করার জিনিসপাতি আনতে। তুই যা পুঁতে দিয়ে আয়। কী রে? কথা কস না ক্যান? এখনও লাশটাকে চাইপা ধইরা আছোস ক্যা?”
চেয়ারম্যান কিছুটা অবাক হয়েই চুপ হয়ে যায়। পরক্ষণেই বলে ওঠে, “জানোস, সেলিম কি কামটা করছে?” বলে একটা রক্তমাখা লাটি হাতে নিয়ে বলে, “এইটা ওর ভোঁদায় ঢুকাই দিছিল। অ্যা-অ্যা কইরা সে কী চিক্কুর পারছে রে ভাই। বোবা তো, অত মজা পাওয়া যায় নাই। দুই হাত এক কইরা কতবার যে মাফ চাইছে কী আর বলবো। চোখ দিয়া গল গল কইরা জল ফেলাইছে, অই জল যদি ভোঁদা দিয়া ফেলাইতো, তাইলেই না বেশি মজা হইতো। এইসব দেইখা রুবেলও কি চুপ থাইকা পারে? সে লাঠিটা ভোঁদা থাইকা বাইর কইরা গোয়ায় ঢুকাইছে। তখন অবশ্য সেলিম ওরে চাইপা ধইরা ছিল। তখন যদি মাগিটার চোখগুলা দেখতিরে ভাই, রসগোল্লার মতো বড়ো হইয়া গেছিল। আমি অবশ্য ওদের এসব কীর্তি দেখার পর আঙুল কাটছিলাম। তুই থাকলে কী করতিরে জাফর...?”
জাফর গমগমে স্বরে বলে, “চুপ...চু-উ-প...আমার আলেয়া কিছু কইতেছে, তুই চু-চু-প হ।”
চেয়ারম্যান শামসুল খোশমেজাজে আছে, তাই তাৎক্ষণিক কোনো প্রতিক্রিয়া দেখালো না। তাই কৌতুকস্বরে বলল, “কী কইতেছে মুর্দা মাগিটা? আই লাব ইউ? হাহা।”
জাফর যেন শুনতে পায়, অনেক দূর থেকে আলেয়ার গোঁ-গোঁ আওয়াজ ভেসে আসছে। অর্থহীন আওয়াজগুলো আস্তে আস্তে অর্থবোধক হয়ে যাচ্ছে। এবার যেন সে বুঝতে পারছে আলেয়া কী বলতে চাচ্ছে...আলেয়া বলছে, “তোমার লগে ঘর বান্ধতে পারলাম না...”
চেয়ারম্যান এবার বিরক্ত হয়ে জাফরকে ঝাঁকি দেয়। জাফরের যেন ঘোর ভেঙে যায়। ঝট করে উঠে দাঁড়ায়। ইতিউতি তাকায়। মেঝেতে পড়ে আছে লম্বা ছুরিটা। ওটা দিয়েই কেটে নিয়েছে আলেয়ার স্তন, পোঁচ দিয়েছে বাহুতে, তালুতে, বুকে, উরুতে—সবখানে। কেটে নিয়েছে হাতের সবকটা আঙুল।
ছুরি হাতে নিয়ে ঘুরে দাঁড়ায় চেয়ারম্যানের দিকে। অভিজ্ঞ শামসুল বুঝতে পারে অবস্থাটা ঠিক সুবিধার না। ধমকের সুরে কিন্তু ভীতকণ্ঠে বলে, “এই জাফর...তুই এমন করতাছোস ক্যা? তুই মজা নিতে পাস নাই তো কী হইছে? দ্যাশে কি মাইয়ার অভাব? পুঁতে রেখে আয়, কাল আরও মাইয়া আনবোনে। তুই একলাই চুদিস। মাথা গরম করিস না...”
জাফর পাগলের মতো ছুরি চালায়। চেয়ারম্যান হাত দিয়ে নিজেকে বাঁচাতে গেলে ডান হাতের তিনটা আঙুল ছুরির কোপে পড়ে যায়। চিৎকার দিয়ে ওঠে সে। জাফর আবার ছুরি চালায়, এবার বাম হাতের দুটো আঙুল পড়ে যায়। ভয়ে পেছাতে গিয়ে মেঝের রক্তে পিছলে পড়ে শামসুল। মরিয়া হয়ে আঙুল কাটা দিয়েই নিজেকে বাঁচানোর চেষ্টা করে। কিন্তু জাফরের মধ্যে ক্ষোভ যেন আগ্নেয়গিরি হয়ে ফুঁসে উঠছে। কিছুই তাকে আজকে থামাতে পারবে না। সে শামসুলের বুকের ওপর চেপে বসে। ডানহাতের কব্জি মেঝেতে চেপে ধরে বাকি দুটো আঙুলও ফেলে দেয়। যন্ত্রণায় জাফরকে সরিয়ে দিতে চায়। কিন্তু পারে না। এবার জাফর বাম হাত মেঝেতে চেপে তিনটা আঙুল একটা একটা করে তিন কোপে ফেলে দেয়। শামসুল এবার আর সহ্য করতে পারে না। চেতনা হারায়। জাফরের সেদিকে ভ্রূক্ষেপ নেই। সে দুহাত দিয়ে ছুরির হাতল চেপে ধরে সজোরে নামিয়ে আনে শামসুলের ঠিক হৃদপিণ্ড বরাবর। ধড়ফড় করে অচেতন দেহ। চেতনা লুপ্ত হলেও দেহটা ঠিকই সজাগ। কাটা মুরগির মতো কিছুক্ষণ সেটা দাপাদাপি করে। অচেতন অবস্থাতেই শামসুল তার পাপের প্রায়শ্চিত্ত করে।
এভাবে ঠিক কতক্ষণ কেটে গেছে জাফর তা মনে করতে পারে না। তার সংবিৎ ফেরে কারো ডাকে। ডাকটা খেয়াল করলে বুঝতে পারে, ডাকটা আসছে বাইরে থেকে আর সেটা সেলিমের। বের হবার আর ঢোকার রাস্তা একটাই হওয়ায় সেলিম ঘরে ঢোকার আগেই সে বের হতে যায়। তার শরীর রক্তমাখা, সেটা দেখে সেলিম কিছু বলতে গিয়েও থেমে গেল। ভাবলো, জাফর হয়তো রুমটা পরিষ্কার করছিল সেকারণে তার ওই অবস্থা। কিন্তু সে মোটেও খেয়াল করলো না যে জাফরের হাতে একটা রক্তাক্ত ছুরিও আছে।
পরের পর্ব : ক্লিক করুন
Published on November 18, 2021 10:09
•
Tags:
adult, bengali, crime-fiction, dark, fiction, mystery, preview, suspense-thriller, thriller
No comments have been added yet.