Anisul Hoque's Blog
March 20, 2014
বিমানের গুম, মানুষের গুম
মানুষের ক্ষমতার সীমা আমরা জানছি, যখন আস্ত একটা বিমান স্রেফ নাই হয়ে গেল। এতটা দিন পার হয়ে গেল, আমরা তার কোনো হদিসই করতে পারলাম না! মানুষ নাকি মঙ্গলে যাবে। লুলু ফেরদৌস নামের এক বাংলাদেশি আমেরিকান তরুণীও সেই দলে এখন পর্যন্ত আছেন। সেই যাত্রা নাকি হবে একমুখী। ফেরার পথ এখনো জানা যায়নি। ওখানে গিয়ে চাল-ডাল, পানি-অক্সিজেন জোগাড় করে নিজের মতো করে থাকতে হবে। তবু এঁরা যাওয়ার জন্য এক পায়ে খাড়া।
অন্যদিকে, স্টিফেন হকিং ভবিষ্যদ্বাণী করেছেন, চাঁদে মানুষ বসতি গড়বে ৫০ বছর পরে। সে ক্ষেত্রে আমাদের পত্রপত্রিকাগুলোয় বিজ্ঞাপন ছাপা শুরু হতে পারে: চাঁদে নিষ্কণ্টক জমি। রাজউক অনুমোদিত। নগদ দামে ৭০ শতাংশ ছাড়। সত্যি কথা বলতে কি, চাঁদে জমি বিক্রি শুরুও হয়ে গিয়েছিল। বাংলাদেশের ঠকবাজদের আগেই বিদেশের ঠকবাজেরা চাঁদের জমি রেজিস্ট্রি করে দেওয়া শুরু করেছিল। এবার হয়তো মঙ্গলের জমি বিক্রিতে আমরা বাংলাদেশিরা এগিয়ে আসতে পারি সবার আগে। ড্যাপের আওতামুক্ত বন্যামুক্ত এলাকা। কৃষিজমি নয়। এখনই বাড়ি করার উপযোগী। প্রবাসীদের জন্য অগ্রাধিকার। তিন কাঠা, পাঁচ কাঠা ও ১০ কাঠার প্লটের জন্য আবেদন করুন।
মানুষ চাঁদে বসত করবে, মঙ্গলে বাড়িঘর বানাবে, তবু মানুষের ক্ষমতার সীমাটাও আমরা নতুন করে জানলাম, যখন মালয়েশিয়া এয়ারলাইনসের একটা বিমান স্রেফ হাওয়া হয়ে গেল। হাওয়া হয়ে যাওয়াটাও কথার কথা। ওটা হাওয়া হয়ে গেছে, নাকি সমুদ্রে পানির নিচে গেছে, আকাশেই ছাই হয়ে গেছে, নাকি কোনো গোষ্ঠী বা দেশ সেটাকে কোথাও নামিয়ে গোপন করে রেখেছে, আমরা কেউ জানি না।
লুলু ফেরদৌসেরা যখন মঙ্গলে পাড়ি জমানোর জন্য নিজেদের প্রস্তুত করছেন, এবং প্রস্তুতির দলে যোগ দিয়েছেন, তখন আমি কিন্তু সেটা ভাবতে গিয়েই দম বন্ধ হওয়ার অস্বস্তি বোধ করছি। আমি উঁচু স্থান ভয় পাই। বদ্ধ স্থানও ভয় পাই। বিমানে চড়তে হবে শুনলেই আমার ভয় লাগতে থাকে। মালয়েশিয়ান বিমানটা নিখোঁজ হওয়ার পর আমি কলম্বো যাত্রা করেছি। বস্তুত এই লেখাটা কলম্বোর হোটেলে বসে লিখছি। আমি জানি না, ২০ মার্চ আমার বিমানটা গুম হয়ে যাবে কি না। আমি অবশ্য লেখাটা মেইল করে দেব। আশা করি, বিমান হারিয়ে গেলেও লেখা হারাবে না। বিমানে ওঠার আগে ঢাকায় দেখা একজন পাইলটের সঙ্গে। তিনি বলছেন, বাংলাদেশে বিমান চলাচলের জন্য খারাপ আবহাওয়া শুরু হয় ১৫ মার্চ থেকে, চলে জুন পর্যন্ত। আমি তাঁকে বললাম, ‘ভাই, আমি ১৬ মার্চ ফ্লাই করব, ২০ মার্চ ফিরব। আপনি কি খারাপ আবহাওয়াটা ২১ মার্চ থেকে শুরু করতে পারেন?’ তিনি বললেন, ‘আচ্ছা যান, আপনার জন্য এটা ২২ মার্চ করে দেওয়া হলো।’ শুনে স্বস্তি পেলাম। শুধু একটাই প্রশ্ন, খারাপ সময়টা পিছিয়ে দেওয়ার খবর আমি না-হয় জানলাম, আবহাওয়া নিজে জানে তো?
উঁচু ভবনও আমি খুব ভয় পাই। এফ আর খান সাহেবের নকশা করা সিয়ারস টাওয়ারের ওপরে ১০৫ থেকে ১০৬ তলার ছাদে একটা জায়গায় একটা কাচ আছে। সেটার ওপরে চড়লে নিচের মাটি দেখা যায়। আমি সেই কাচের আশপাশেও যাইনি। এ থেকে বুঝতে পারছেন, আমার উচ্চাভিলাষ কম। আমি বেশি ওপরে উঠতে পারব না।
সড়কপথেও তো খুব দুর্ঘটনা ঘটে। লঞ্চ ডুবে যায়। তবু মনে হয়, সড়কপথের দুর্ঘটনা বা লঞ্চের ডুবে যাওয়াও মেনে নিতে পারব। কিন্তু বিমান যদি দুর্ঘটনায় পড়ে?… আল্লাহ না করুন…
কথা হচ্ছিল বিমান হারিয়ে যাওয়া নিয়ে। আমেরিকানরা গবেষণা করছেন, প্রধানত যুদ্ধের প্রয়োজনে, শত্রুর যেকোনো যান বা সদস্যের অবস্থান তাঁরা সব সময় নিরূপণ করবেন। কত বিচিত্র বিষয়েই না গবেষণা হচ্ছে। শুধু মালয়েশিয়ার বিমানের খবর আমরা পাই না। একটা বিমান যখন গুম হয়ে যায়, পৃথিবীর মানুষ তা নিয়ে দুশ্চিন্তাগ্রস্ত হয়ে পড়ে। আজও দেখলাম, বিবিসি ও সিএনএন মালয়েশিয়ার কর্তৃপক্ষের সংবাদ সম্মেলন সরাসরি দেখাচ্ছে।
কিন্তু একজন ব্যক্তি যখন গুম হয়ে যায়, তখন? একজন ব্যক্তিকেও বাঁচিয়ে রাখা কত কঠিন, যখন ক্যানসারে আক্রান্ত কোনো তরুণের জন্য তহবিল সংগ্রহ করার কাজে যুক্ত হয়ে পড়ি, তখন কিছুটা বুঝি। কিন্তু কী অবলীলায় আমরা মানুষেরা মানুষকে গুম করে ফেলছি। ক্রসফায়ারে ফেলছি। মনে রাখতে হবে, মালয়েশিয়ান ওই বিমানের যাত্রীদের প্রত্যেকের আত্মীয়স্বজনের মনে যে উদ্বেগ, বাংলাদেশেও যেকোনো পরিবারের যেকোনো হারিয়ে যাওয়া ব্যক্তির স্বজনদের বুকেও একই উদ্বেগ।
মানুষের সীমাবদ্ধতার উদাহরণ হিসেবে রুশ সাবমেরিনের কথাটা আমি ভুলতে পারি না। একটা সাবমেরিনে ক্রুরা আটকা পড়লেন, তাঁরা বললেন, ‘আমরা বিপদে পড়েছি, আমাদের উদ্ধার করো।’ সারাটা পৃথিবী তা জানল, কিন্তু সেই উত্তাল সমুদ্রে তাঁদের কাছে উদ্ধারকারী ব্যক্তিরা পৌঁছাতেই পারলেন না। লোকগুলো আস্তে আস্তে নিশ্চিত মৃত্যুর কাছে সমর্পিত হলেন।
মানুষ মানুষকে ধ্বংস করার জন্য যত গবেষণা করেছে, যত বিনিয়োগ করেছে, যত মারণাস্ত্র বানিয়েছে, তার একাংশ যদি মানুষকে বাঁচানোর জন্যও করত, পৃথিবীটা সত্যি একটা মনোরম স্থানে পরিণত হতো।
মানুষের মৃত্যুও হয়তো মেনে নেওয়া যায়, কিন্তু একজন ব্যক্তি নিখোঁজ হয়ে যাবে, এটা তার আত্মীয়স্বজন মেনে নিতে পারে না। তারা সারা জীবন অপেক্ষা করে, একটা ক্ষীণ আশা থাকে—হয়তো ছেলে বা মেয়ে ফিরে আসবে।
আর গুম নিয়ে আমি তো একটা উপন্যাসই লিখেছি বছর দুয়েক আগে। ‘সেই গুমের পর’। প্রথম আলোতেই প্রকাশিত হয়েছিল গুম হয়ে যাওয়া ব্যক্তিদের স্বজনদের আহাজারি, এর চেয়ে ক্রসফায়ার ভালো ছিল। অন্তত লাশটা পাওয়া যায়।
গুম হওয়া ব্যক্তিদের স্বজনেরা কতগুলো বাস্তব সমস্যায়ও পড়ে। গুম হওয়া ব্যক্তির স্ত্রী বিয়ে করতে পারবেন না, তাঁর সম্পত্তির বিষয়েও সহজে ফয়সালা হবে না! কারণ, স্বামী তো মারা যাননি। যদি এখনই এসে হাজির হন!
গদ্যকার্টুন আসলে মন খারাপ করা বিষয় নিয়ে লিখতে চাই না। হাস্য-কৌতুক করতে চাই এই কলামে। কাজেই পুরোনো কৌতুকটাই আবার করি।
একটা বিমান দুর্ঘটনায় পড়েছে। সব যাত্রী মারা গেছে। শুধু এই বিমানের যাত্রী একটা বাঁদর বেঁচে আছে। তাকে বলা হলো, ‘বিমানটা যখন অ্যাক্সিডেন্ট করে, যাত্রীরা কী করছিল?’
বাঁদর দুই হাত বাঁ কানের কাছে জোড় করে ধরে মাথাটা কাত করে চোখ বন্ধ করে দেখাল: ঘুমাচ্ছিল।
‘তখন বিমানসেবকেরা কী করছিলেন?’
বাঁদর আবার দুই হাত বাঁ কানের কাছে জোড় করে ধরে মাথাটা কাত করে চোখ বন্ধ করে দেখাল: ঘুমাচ্ছিল।
‘চালকেরা কী করছিলেন?’
বাঁদর দেখাল: ঘুমাচ্ছিলেন।
‘তাহলে তুই বাঁদর কী করছিলি?’
বাঁদর ককপিটে বসে বিমানের যন্ত্রগুলো টেপাটেপি করল। অর্থাৎ সে বিমান চালাচ্ছিল!
আমরা সব সময় প্রার্থনা করব, আমাদের চালকেরা যেন ঘুমিয়ে না পড়েন। এবং যাঁদের ওপর দায়িত্ব, যাঁরা যে কাজের জন্য যোগ্য ও প্রশিক্ষিত, তাঁদের বদলে যেন বাঁদরেরা স্টিয়ারিং না ধরে।
March 18, 2014
Anisul Hoque.
” title=”মাইলস টু গো, বিফোর ইউ স্লিপ।”>
” title=”মাইলস টু গো, বিফোর ইউ স্লিপ।”>
এবং বাংলাদেশ
সন্তানের অমঙ্গল-আশঙ্কায় যেমন বাবা-মার অন্তর সব সময় কাঁপতে থাকে, বাংলাদেশ দলকে নিয়েও আমার মনটাও তেমন করে। নেপাল ১২০-এর বেশি করল, আমি ভয়েই মরে যাই। টি-টুয়েন্টিতে এটা কোনো রানই না, সেটা মনে থাকে না। মনে হয়, বাংলাদেশের ব্যাটসম্যানরা যদি হংকং-য়ের মতো শুরু করে। শুধু যাওয়া আর আসা। যাই হোক, এখন আমি জানি, ক্রিকেট যতই অনিশ্চয়তার খেলা হোক না, এই খেলায় বাংলাদেশকে নেপাল হারাতে পারবে না। উফ। জানের ওপর দিয়ে উঠে যায়। ছোট দলের সঙ্গে খেলা বলেই। বড় দলের সাথে খেলায় কেউ জিতবে কেউ হারবে। কিন্তু ছোট দলের সঙ্গে তো হারা যাবে না। আমার মতো দুর্বল হার্টের মানুষের খেলা দেখাই উচিত না।
যাই হোক, সুন্দর করে নেপালকে হারিয়ে বাংলাদেশ যেন হংকংকে নিয়ে কাজ করে। হংকংয়ের খেলোয়াড়রা বোধ হয় স্পিন ভালো খেলতে পারে না। আমি এক্সপার্ট নই, তাই কোনো পরামর্শ দেব না। শুধু বলব, হংকং প্রাকটিস ম্যাচে জিম্বাবুয়েকে হারিয়েছে। কাউকেই ছোট করে দেখা উচিত নয়। বি সিরিয়াস ম্যান। এন্ড মাইলস টু গো, বিফোর ইউ স্লিপ।
March 14, 2014
আপনি কি আগের মতোই বউ পেটান?
আনিসুল হক | আপডেট: ০১:১৯, মার্চ ১৪, ২০১৪ | প্রিন্ট সংস্করণ
আপনি কি আগের মতোই বউ পেটান? যে প্রশ্নের উত্তর ‘না’ দিয়ে করা যায় না, তার উদাহরণ হিসেবে এই বাক্যটি ব্যবহার করা হয়ে থাকে। আপনি যদি বলেন, ‘হ্যাঁ’, তাহলে তো জানাই গেল ব্যাপারটা। কিন্তু যদি বলেন, না, তাহলে কিন্তু আপনার হাত পরিষ্কার হয় না। মানেটা দাঁড়ায়, এখন পেটান না বটে, তবে আগে পেটাতেন। বা আগে বেশ জোরেশোরে পেটাতেন, এখন অতটা জোর নেই, বা আগের পদ্ধতির চেয়ে এখনকার পদ্ধতিটা খানিক বদলে ফেলেছেন। না, আমি কখনোই স্ত্রী নির্যাতন করিনি, শুধু ‘না’ দিয়ে এই প্রশ্নের সেই উত্তর দেওয়া যায় না।
এই শিরোনামটার জন্যও আমাকে ক্ষমা প্রার্থনা করে নিতে হবে। আমাদের ভাষা তো আমাদের সংস্কৃতি ও জীবনধারারই প্রতিচ্ছবি। বউ পেটানো কথাটার মধ্যে তাচ্ছিল্যের ভাব আছে, তুচ্ছতার ভাব আছে। যেন স্বীকার করেই নেওয়া হচ্ছে, স্ত্রীকে মারধর করাটা বেশ
একটা চল। বাংলায় প্রবাদ আছে, ‘ঢোল ও মেয়েমানুষ মাইরের ওপরেই রাখতে হয়!’ যেহেতু আমরা বাংলাদেশের পুরুষেরা বেশির ভাগই ঘরের মধ্যেই নারী-নির্যাতন করে থাকি, তাই আমাদের ভাষায় এ ধরনের বাগ্ধারা প্রচলিত হতে পেরেছে।
প্রথম আলোয় খবরটি বেরিয়েছিল ২০১৪ সালের ২৩ জানুয়ারি। ‘ভায়োলেন্স এগেইনস্ট উমেন ২০১১’ শিরোনামে জরিপ পরিচালনা করেছে বাংলাদেশ পরিসংখ্যান ব্যুরো। তাদের প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, বাংলাদেশে ৮৭ ভাগ নারী স্বামীর দ্বারা কোনো না কোনোভাবে কোনো না কোনো দিন নির্যাতিত হয়েছেন। পরিসংখ্যানটা বেশ উদ্বেগজনক। তার মানে, আমরা যদি ১০ জন বিবাহিত পুরুষকে দৈবচয়ন পদ্ধতিতে দাঁড় করাই, এর নয়জনই কোনো না কোনোভাবে স্ত্রী নির্যাতন করেছেন। বিবাহিত জীবনে নারী-পুরুষের ঝগড়াঝাঁটি-মনোমালিন্য হবে না, সে কথা কেউই বলবে না।
কিন্তু নারীদের যখন জিজ্ঞেস করা হয়েছিল, নিশ্চয় এই ৮৭ ভাগ নারীর মনে এই বেদনা ছিল যে তাঁদের স্বামীর আচরণটা নির্যাতনের পর্যায়েই পড়ে, তাই তাঁরা এটা বলেছেন। এই ৮৭ ভাগের মধ্যে শারীরিক, মানসিক, অর্থনৈতিক নির্যাতন আছে। আচ্ছা, তাহলে শারীরিকভাবে নির্যাতন করেছেন কতজন? সেই সংখ্যাটাও বেশ ভীতিকর। প্রায় ৬৫ ভাগ নারী বলেছেন, তাঁরা স্বামীর মাধ্যমে শারীরিক নির্যাতনের শিকার হয়েছেন। তার মানে, আপনি যদি এলোপাতাড়িভাবে তিনজন পুরুষকে দাঁড় করান, তাঁদের দুজন স্ত্রীকে শারীরিকভাবে নির্যাতন করেছেন।
এখানে আসে এই রচনার শিরোনামটা: আপনি কি আগের মতোই বউ পেটান? তিন ভাগের দুই ভাগ পুরুষকে বলতে হবে, ‘হ্যাঁ।’ শারীরিক নির্যাতনের মধ্যে ৪৫ ভাগ নারী স্বামীর চড় বা ঘুষিতে আহত হয়েছেন, ১৫ শতাংশ লাথি বা মারধরের শিকার হয়েছেন। এই সংখ্যাটিও ভয়াবহ উদ্বেগজনক।
পৃথিবীর অনেক দেশেই স্বামী কর্তৃক স্ত্রী নির্যাতনের ঘটনা ঘটে। প্রথম আলোর ২৩ জানুয়ারির মানসুরা হোসাইনের আলোচ্য প্রতিবেদনেই বলা হয়েছে, ইউরোপে চারজন নারীর মধ্যে একজন পারিবারিক নির্যাতনের শিকার হন। ভারতের একই জরিপে বলা হয়েছে, ৪৪ ভাগ নারী পারিবারিক নির্যাতনের শিকার। বাংলাদেশের পরিসংখ্যানটা বেশ ভয়াবহ। এবং লজ্জাজনক। অথচ আমরা মানবোন্নয়ন সূচকে নানা দিক থেকে ভালো করছি। শিশুমৃত্যুর হার, মাতৃমৃত্যুর হার কমিয়ে আনতে সক্ষম হচ্ছি। আমাদের নারী শিক্ষার ক্ষেত্রে উন্নতি বিস্ময়কর। নারীর ক্ষমতায়নে নানা দিক থেকে আমরা বেশ উজ্জ্বল উদাহরণ সৃষ্টি করছি। হয়তো আমাদের জরিপে যে এত বেশিসংখ্যক নারী সত্য উচ্চারণে এগিয়ে এসেছেন, সেটা সেই অগ্রগতিরই একটা লক্ষণ। নারীরা মুখ খুলছেন।
কিন্তু একজন পুরুষ হিসেবে গোটা পরিসংখ্যানটা আমার জন্য চরম লজ্জার। আমিই হলাম এ ক্ষেত্রে অপরাধী। দশজন পুরুষের নয়জনই যখন নির্যাতন করেন, তাঁদের মধ্যে আমিও আছি। পারিবারিক নির্যাতন এবং তা প্রতিরোধের আর্থিক হিসাব ও করণীয় সম্পর্কে সিপিডির একটা গবেষণাপত্র নিয়ে আলোচনা হয়েছিল, যা প্রকাশিত হয়েছে ২০০৯ সালের জানুয়ারিতে। সেই আলোচনায় বক্তারা খুব জোর দিয়েছেন এই বিষয়টির ওপরে যে আমাদের সমাজে পারিবারিক নির্যাতনকে গ্রহণযোগ্য হিসেবে মেনে নেওয়া হয়। একজন আলোচক এ-ও বলেছেন, সরকারি কোনো কমিটিতে পারিবারিক নির্যাতন নিয়ে কথা উঠলে এমনকি নারী সদস্যদেরও কেউ কেউ বলে থাকেন যে এটা তেমন কোনো সমস্যাই নয়। এ আর এমন কী! এই হলো সমাজের মনোভাব। প্রথম আলোয় ৮ মার্চ ২০১৪ প্রকাশিত আরেকটা প্রতিবেদনে উল্লিখিত হয়েছে আইসিডিডিআরবির গবেষণার ফল: দেশের ৮৯ ভাগ পুরুষ মনে করে, স্ত্রী অন্যায় করলে মার দেওয়া যায়!
কাজেই, পারিবারিক নির্যাতন যদি প্রতিরোধ করতে হয়, এটাকে একটা সামাজিক আন্দোলন হিসেবে গ্রহণ করতে হবে। সবাই মিলে একযোগে আওয়াজ তুলতে হবে যে স্বামী কর্তৃক স্ত্রী নির্যাতন গ্রহণযোগ্য নয়। সেটা করতে হবে সমাজের সর্বস্তরে। যেমন গণমাধ্যমকে জনমত গড়ে তুলতে হবে, শিল্পে-সাহিত্যে-নাটকে-সংগীতে নারী নির্যাতন, পারিবারিক নির্যাতনের বিরুদ্ধে আওয়াজ তুলতে হবে, তেমনি সরকারকে, তেমনি সিভিল সমাজকে এই নিয়ে সরব, সোচ্চার, সক্রিয় হয়ে উঠতে হবে। সত্যি কথা বলতে কি, এখন পর্যন্ত বিষয়টা মনে হয় যেন দাতাদের মাথাব্যথার ব্যাপার। আমরা বউ পেটাই, তাঁর নীরব বা উচ্চ স্বরের কান্না যেন একমাত্র শুনতে পায় দাতারা, উন্নয়ন-সহযোগীরা, জাতিসংঘের প্রতিষ্ঠানগুলো, এনজিওরা। যেন এটা আমাদের ইস্যুই নয়। এই মনোভাবটার পরিবর্তন করা দরকার সবার আগে।
অবশ্য নিশ্চয়ই বলতে পারি, সবকিছুর জন্য দায়ী পিতৃতন্ত্র। ছোটবেলা থেকেই একটা ছেলে পুরুষ হয়ে ওঠে, আর সমাজ নারীকে নারী করে তোলে। সমাজের মনোভঙ্গির ভেতরেই থাকা নারী হলো ইতরতর, দুর্বল, সুতরাং নির্যাতনের যোগ্য। কাজেই পিতৃতন্ত্রের অবসান ঘটাতে হবে। কথাটা বলা সোজা, করা কঠিন। যুক্তরাষ্ট্র এখনো একজন নারী রাষ্ট্রপতি নির্বাচন করতে পারেনি। তারা নারীদের ভোটাধিকারই দিয়েছে মাত্র সেদিন।
সমাজের আগাগোড়া মানসিকতার পরিবর্তন ঘটানো দরকার। নারী ও পুরুষ যে সব দিক থেকে সমান, নারীর প্রতি এই সম্মানবোধটা সর্বক্ষেত্রে জাগিয়ে তোলা দরকার। সে কারণেই হয়তো এখন খুব করে বলা হচ্ছে নারীর অর্থনৈতিক অবদানের কথা। বলা হচ্ছে, যে নারীরা ঘরের বাইরে কাজ করেন, প্রধানমন্ত্রী থেকে শুরু করে আমাদের গার্মেন্টস-কর্মীরা, তাঁদের অবদান তো আছেই, কিন্তু আছে অনেক অস্বীকৃত অবদান। ঘরের মধ্যে নারী যে অবদান রাখছেন, তার কোনো অর্থনৈতিক স্বীকৃতি নেই। আমাদের কৃষক পরিবারগুলোয় নারীরা অনেক ক্ষেত্রে কাজ করেন, অনেক ক্ষেত্রে ধানমাড়াই থেকে শুরু করে ধান সেদ্ধ করা, শুকানো, বীজ সংরক্ষণ ইত্যাদি নানা কাজে সরাসরি অংশ নিলেও সেসবের কোনো আনুষ্ঠানিক স্বীকৃতি নেই। এই স্বীকৃতি না থাকা থেকেও নারীকে অধস্তন বলে ভাবনাটা চলে আসে।
৮ মার্চে প্রথম আলোর প্রথম পৃষ্ঠায় পরিসংখ্যান ব্যুরোর আরেকটা গবেষণাপত্রের সূত্র ধরে বলা হয়েছে, ‘বাংলাদেশে নারীদের গৃহস্থালির কাজের অর্থমূল্য হিসাব করা হয় না। এটা করা গেলে অর্থনীতিতে নারীর অবদান আড়ালে থেকে যেত না।’
কাজেই, আজ যে আওয়াজ উঠেছে, নারীকে ধন্যবাদ, কৃতজ্ঞতা ও শ্রদ্ধা জানাতে হবে, ঘরে-বাইরে তাঁর অপরিসীম অবদানের জন্য, আর তাঁর কাছে ক্ষমা চাইতে হবে, তাঁকে বলতে হবে, স্যরি, দুঃখিত। কারণ, তাঁর এই অবদানের স্বীকৃতি দিইনি আমরা এত দিন, সেই আওয়াজে আমাদের সব পুরুষকেই কণ্ঠ মেলাতে হবে।
নারীর সামনে নতজানু হয়ে করজোড়ে ক্ষমা প্রার্থনা করি। পরিসংখ্যান ব্যুরোর জরিপ যে চিত্র তুলে ধরেছে, তা দেখার পর নিজেদের অপরাধী ছাড়া আর কিছুই মনে হয় না। রাষ্ট্রের নিশ্চয় করণীয় আছে, আইনশৃঙ্খলার সঙ্গেও এসবের সম্পর্ক আছে, দৃষ্টান্তমূলক সাজাও অপরাধ কমিয়ে আনে। সব ঠিক, কিন্তু আমার নিজের ঘরে যদি নারী আমার দ্বারা নির্যাতিত হন, তাহলে তার দায় তো আমারই। আমি জানি না, ক্ষমা চাইলেই সেই অপরাধের দায় থেকে নিজেকে বাঁচাতে পারব কি না।
এই পরিসংখ্যানের আরেকটা দিক খুবই উদ্বেগজনক। ইচ্ছার বিরুদ্ধে নারীরা ১০ থেকে ১৪ বছর বয়সে ৪১ দশমিক ৮ ভাগ যৌনতার শিকার হয়, ১৫ থেকে ১৯ বছরে হয় আরও ৩৪ দশমিক ৩ ভাগ। তাহলে ৭৬ ভাগ নারী ১০ থেকে ১৯ বছরের মধ্যেই যৌন নির্যাতনের শিকার হন। কী ভয়াবহ তথ্য!
কাজেই, এই রচনাটার শিরোনামটিই আবার বলতে হয়। আপনি কি আগের মতোই নারী নির্যাতন করেন? আপনি কি আগের মতোই অনিচ্ছুক নারীর ওপরে বল প্রয়োগ করেন? এই প্রশ্ন অপ্রাসঙ্গিক নয়। হয়তো আপনি বলবেন, ‘না, আমি করি না, কখনোই করিনি।’ কিন্তু মনে রাখবেন, আপনার পাশে দাঁড়ানো আর নয়জন এই কাজ করেছেন। নারীর ওপরে যৌন নির্যাতন যদি ৮০ ভাগ ক্ষেত্রেই হয়ে থাকে, তার পেছনে নিশ্চয়ই ৮০ ভাগ পুরুষ জড়িত। কাজেই বলা যাবে, আপনার পাশে দাঁড়িয়ে থাকা পাঁচজন পুরুষের মধ্যে চারজনই এই কাজ করেছেন। কী বলব। লজ্জাই পাই শুধু।
সত্যি সত্যি, পারিবারিক নির্যাতনের সামাজিক গ্রহণযোগ্যতা একটা বড় বাধা। পুরুষবাদী মানসিকতা তো আছেই।
আমাদের এই গ্রহণযোগ্যতার বিরুদ্ধে সরব হতে হবে, বলতে হবে, ঘরের মধ্যে নারী নির্যাতন চলতে পারে না। এটা গ্রহণযোগ্য নয়। আমরা সবাই মিলে আওয়াজ তুলে বাংলাদেশের অনেক ক্ষেত্রে অনেক উন্নতিই তো ঘটাতে পেরেছি। এ ক্ষেত্রে না পারার কোনো কারণ দেখি না। একই কথা বলব বাল্যবিবাহ বা কৈশোরবিবাহের ক্ষেত্রে। আমাদের দেশে ৬৭ ভাগ মেয়েরই আইনি বয়সের আগেই বিয়ে হয়ে যায়। এর পেছনেও নিশ্চয়ই সামাজিক, অর্থনৈতিক, সাংস্কৃতিক অনেক কারণ রয়েছে। কিন্তু সচেতনতার অভাবও কিন্তু কম দায়ী নয়। আমরা সবাই মিলে আওয়াজ তুললে এই অপরিণত বয়সের বিয়েও আমরা রোধ করতে পারব। বাল্যবিবাহও কিন্তু পারিবারিক নির্যাতনের অন্যতম কারণ।

March 13, 2014
কী যে ভালো লাগল আজ আমার!
কিশোর আলোর চলতি সংখ্যাটা হাতে নিয়ে কী যে ভালো লাগল! ছাপা হওয়ার আগে দেখা আর ছাপার পর দেখা কত আলাদা। পুরো সংখ্যাটাই সুন্দর হয়েছে। প্রচ্ছদে রুমীর ছবি, প্রচ্ছদ কাহিনি হলো বীর রুমীর যুদ্ধ অভিযান। ভেতরের পাতাগুলোও খুব সুন্দর লাগল। কিশোর আলোর কর্মীবাহিনিকে ধন্যবাদ।
মুহম্মদ জাফর ইকবাল স্যারের সহযোগিতা পাচ্ছি। স্যার আমাদেরকে টুনটুনি ও ছোটাচ্চুর নতুন পর্ব দিয়েছেন। শেখ আবদুল হাকিমের সায়েন্স ফিকশনটা তো দুর্দান্ত। আইনস্টাইন নিয়ে লেখা আছে, টিটুয়েন্টি নিয়ে আছে। কত কী যে আছে।
দাম মাত্র ৫০ টাকা। মাত্র কেন বললাম। ধরা যাক, ফেব্রুয়ারি সংখ্যায় আমার জিনের বাদশা রহস্য/ বোকা গোয়েন্দা উপন্যাসটা বেরিয়েছিল। এটা বই হিসাবে কিনলে দিতে হবে ১০০ টাকা। আর কিশোর আলো কিনলে আরো কত কি সহ ৫০ টাকা। কাজেই কিশোর আলো কেনা লাভজনক। শুধু টাকার অঙ্কে নয়। একটা শিশু জীবনে সফল হবে তখনই যখন সে কেবল পড়ার বই পড়বে না, বিচিত্র বিষয়ে আগ্রহী হয়ে উঠবে। কিশোর আলো শিশু কিশোরদের দিগন্তটাকে বড় করবে। কাজেই বাড়িতে শিশু কিশোর থাকলে কিশোর আলো রাখা যেতে পারে।

আজ এ আর রহমানের কনসার্ট
এ আর রহমান বিশ্বখ্যাত। তারপরেও তার কনসার্টে যেতে খুব আগ্রহী নই, কারণটা ঝামেলা! তবে টিটুয়েন্ট বিশ্বকাপ বলে কথা। ইতিহাসের সাক্ষী থাকতে হবে না।

March 12, 2014
আপনি কি আগের মতোই বউ পেটান?
আপনি কি আগের মতোই বউ পেটান? যে প্রশ্নের উত্তর ‘না’ দিয়ে করা যায় না, তার উদাহরণ হিসেবে এই বাক্যটি ব্যবহার করা হয়ে থাকে। আপনি যদি বলেন, ‘হ্যাঁ’, তাহলে তো জানাই গেল ব্যাপারটা। কিন্তু যদি বলেন, না, তাহলে কিন্তু আপনার হাত পরিষ্কার হয় না। মানেটা দাঁড়ায়, এখন পেটান না বটে, তবে আগে পেটাতেন। বা আগে বেশ জোরেশোরে পেটাতেন, এখন অতটা জোর নেই, বা আগের পদ্ধতির চেয়ে এখনকার পদ্ধতিটা খানিক বদলে ফেলেছেন। না, আমি কখনোই স্ত্রী নির্যাতন করিনি, শুধু ‘না’ দিয়ে এই প্রশ্নের সেই উত্তর দেওয়া যায় না।
এই শিরোনামটার জন্যও আমাকে ক্ষমা প্রার্থনা করে নিতে হবে। আমাদের ভাষা তো আমাদের সংস্কৃতি ও জীবনধারারই প্রতিচ্ছবি। বউ পেটানো কথাটার মধ্যে তাচ্ছিল্যের ভাব আছে, তুচ্ছতার ভাব আছে। যেন স্বীকার করেই নেওয়া হচ্ছে, স্ত্রীকে মারধর করাটা বেশ
একটা চল। বাংলায় প্রবাদ আছে, ‘ঢোল ও মেয়েমানুষ মাইরের ওপরেই রাখতে হয়!’ যেহেতু আমরা বাংলাদেশের পুরুষেরা বেশির ভাগই ঘরের মধ্যেই নারী-নির্যাতন করে থাকি, তাই আমাদের ভাষায় এ ধরনের বাগ্ধারা প্রচলিত হতে পেরেছে।
প্রথম আলোয় খবরটি বেরিয়েছিল ২০১৪ সালের ২৩ জানুয়ারি। ‘ভায়োলেন্স এগেইনস্ট উমেন ২০১১’ শিরোনামে জরিপ পরিচালনা করেছে বাংলাদেশ পরিসংখ্যান ব্যুরো। তাদের প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, বাংলাদেশে ৮৭ ভাগ নারী স্বামীর দ্বারা কোনো না কোনোভাবে কোনো না কোনো দিন নির্যাতিত হয়েছেন। পরিসংখ্যানটা বেশ উদ্বেগজনক। তার মানে, আমরা যদি ১০ জন বিবাহিত পুরুষকে দৈবচয়ন পদ্ধতিতে দাঁড় করাই, এর নয়জনই কোনো না কোনোভাবে স্ত্রী নির্যাতন করেছেন। বিবাহিত জীবনে নারী-পুরুষের ঝগড়াঝাঁটি-মনোমালিন্য হবে না, সে কথা কেউই বলবে না।
কিন্তু নারীদের যখন জিজ্ঞেস করা হয়েছিল, নিশ্চয় এই ৮৭ ভাগ নারীর মনে এই বেদনা ছিল যে তাঁদের স্বামীর আচরণটা নির্যাতনের পর্যায়েই পড়ে, তাই তাঁরা এটা বলেছেন। এই ৮৭ ভাগের মধ্যে শারীরিক, মানসিক, অর্থনৈতিক নির্যাতন আছে। আচ্ছা, তাহলে শারীরিকভাবে নির্যাতন করেছেন কতজন? সেই সংখ্যাটাও বেশ ভীতিকর। প্রায় ৬৫ ভাগ নারী বলেছেন, তাঁরা স্বামীর মাধ্যমে শারীরিক নির্যাতনের শিকার হয়েছেন। তার মানে, আপনি যদি এলোপাতাড়িভাবে তিনজন পুরুষকে দাঁড় করান, তাঁদের দুজন স্ত্রীকে শারীরিকভাবে নির্যাতন করেছেন।
এখানে আসে এই রচনার শিরোনামটা: আপনি কি আগের মতোই বউ পেটান? তিন ভাগের দুই ভাগ পুরুষকে বলতে হবে, ‘হ্যাঁ।’ শারীরিক নির্যাতনের মধ্যে ৪৫ ভাগ নারী স্বামীর চড় বা ঘুষিতে আহত হয়েছেন, ১৫ শতাংশ লাথি বা মারধরের শিকার হয়েছেন। এই সংখ্যাটিও ভয়াবহ উদ্বেগজনক।
পৃথিবীর অনেক দেশেই স্বামী কর্তৃক স্ত্রী নির্যাতনের ঘটনা ঘটে। প্রথম আলোর ২৩ জানুয়ারির মানসুরা হোসাইনের আলোচ্য প্রতিবেদনেই বলা হয়েছে, ইউরোপে চারজন নারীর মধ্যে একজন পারিবারিক নির্যাতনের শিকার হন। ভারতের একই জরিপে বলা হয়েছে, ৪৪ ভাগ নারী পারিবারিক নির্যাতনের শিকার। বাংলাদেশের পরিসংখ্যানটা বেশ ভয়াবহ। এবং লজ্জাজনক। অথচ আমরা মানবোন্নয়ন সূচকে নানা দিক থেকে ভালো করছি। শিশুমৃত্যুর হার, মাতৃমৃত্যুর হার কমিয়ে আনতে সক্ষম হচ্ছি। আমাদের নারী শিক্ষার ক্ষেত্রে উন্নতি বিস্ময়কর। নারীর ক্ষমতায়নে নানা দিক থেকে আমরা বেশ উজ্জ্বল উদাহরণ সৃষ্টি করছি। হয়তো আমাদের জরিপে যে এত বেশিসংখ্যক নারী সত্য উচ্চারণে এগিয়ে এসেছেন, সেটা সেই অগ্রগতিরই একটা লক্ষণ। নারীরা মুখ খুলছেন।
কিন্তু একজন পুরুষ হিসেবে গোটা পরিসংখ্যানটা আমার জন্য চরম লজ্জার। আমিই হলাম এ ক্ষেত্রে অপরাধী। দশজন পুরুষের নয়জনই যখন নির্যাতন করেন, তাঁদের মধ্যে আমিও আছি। পারিবারিক নির্যাতন এবং তা প্রতিরোধের আর্থিক হিসাব ও করণীয় সম্পর্কে সিপিডির একটা গবেষণাপত্র নিয়ে আলোচনা হয়েছিল, যা প্রকাশিত হয়েছে ২০০৯ সালের জানুয়ারিতে। সেই আলোচনায় বক্তারা খুব জোর দিয়েছেন এই বিষয়টির ওপরে যে আমাদের সমাজে পারিবারিক নির্যাতনকে গ্রহণযোগ্য হিসেবে মেনে নেওয়া হয়। একজন আলোচক এ-ও বলেছেন, সরকারি কোনো কমিটিতে পারিবারিক নির্যাতন নিয়ে কথা উঠলে এমনকি নারী সদস্যদেরও কেউ কেউ বলে থাকেন যে এটা তেমন কোনো সমস্যাই নয়। এ আর এমন কী! এই হলো সমাজের মনোভাব। প্রথম আলোয় ৮ মার্চ ২০১৪ প্রকাশিত আরেকটা প্রতিবেদনে উল্লিখিত হয়েছে আইসিডিডিআরবির গবেষণার ফল: দেশের ৮৯ ভাগ পুরুষ মনে করে, স্ত্রী অন্যায় করলে মার দেওয়া যায়!
কাজেই, পারিবারিক নির্যাতন যদি প্রতিরোধ করতে হয়, এটাকে একটা সামাজিক আন্দোলন হিসেবে গ্রহণ করতে হবে। সবাই মিলে একযোগে আওয়াজ তুলতে হবে যে স্বামী কর্তৃক স্ত্রী নির্যাতন গ্রহণযোগ্য নয়। সেটা করতে হবে সমাজের সর্বস্তরে। যেমন গণমাধ্যমকে জনমত গড়ে তুলতে হবে, শিল্পে-সাহিত্যে-নাটকে-সংগীতে নারী নির্যাতন, পারিবারিক নির্যাতনের বিরুদ্ধে আওয়াজ তুলতে হবে, তেমনি সরকারকে, তেমনি সিভিল সমাজকে এই নিয়ে সরব, সোচ্চার, সক্রিয় হয়ে উঠতে হবে। সত্যি কথা বলতে কি, এখন পর্যন্ত বিষয়টা মনে হয় যেন দাতাদের মাথাব্যথার ব্যাপার। আমরা বউ পেটাই, তাঁর নীরব বা উচ্চ স্বরের কান্না যেন একমাত্র শুনতে পায় দাতারা, উন্নয়ন-সহযোগীরা, জাতিসংঘের প্রতিষ্ঠানগুলো, এনজিওরা। যেন এটা আমাদের ইস্যুই নয়। এই মনোভাবটার পরিবর্তন করা দরকার সবার আগে।
অবশ্য নিশ্চয়ই বলতে পারি, সবকিছুর জন্য দায়ী পিতৃতন্ত্র। ছোটবেলা থেকেই একটা ছেলে পুরুষ হয়ে ওঠে, আর সমাজ নারীকে নারী করে তোলে। সমাজের মনোভঙ্গির ভেতরেই থাকা নারী হলো ইতরতর, দুর্বল, সুতরাং নির্যাতনের যোগ্য। কাজেই পিতৃতন্ত্রের অবসান ঘটাতে হবে। কথাটা বলা সোজা, করা কঠিন। যুক্তরাষ্ট্র এখনো একজন নারী রাষ্ট্রপতি নির্বাচন করতে পারেনি। তারা নারীদের ভোটাধিকারই দিয়েছে মাত্র সেদিন।
সমাজের আগাগোড়া মানসিকতার পরিবর্তন ঘটানো দরকার। নারী ও পুরুষ যে সব দিক থেকে সমান, নারীর প্রতি এই সম্মানবোধটা সর্বক্ষেত্রে জাগিয়ে তোলা দরকার। সে কারণেই হয়তো এখন খুব করে বলা হচ্ছে নারীর অর্থনৈতিক অবদানের কথা। বলা হচ্ছে, যে নারীরা ঘরের বাইরে কাজ করেন, প্রধানমন্ত্রী থেকে শুরু করে আমাদের গার্মেন্টস-কর্মীরা, তাঁদের অবদান তো আছেই, কিন্তু আছে অনেক অস্বীকৃত অবদান। ঘরের মধ্যে নারী যে অবদান রাখছেন, তার কোনো অর্থনৈতিক স্বীকৃতি নেই। আমাদের কৃষক পরিবারগুলোয় নারীরা অনেক ক্ষেত্রে কাজ করেন, অনেক ক্ষেত্রে ধানমাড়াই থেকে শুরু করে ধান সেদ্ধ করা, শুকানো, বীজ সংরক্ষণ ইত্যাদি নানা কাজে সরাসরি অংশ নিলেও সেসবের কোনো আনুষ্ঠানিক স্বীকৃতি নেই। এই স্বীকৃতি না থাকা থেকেও নারীকে অধস্তন বলে ভাবনাটা চলে আসে।
৮ মার্চে প্রথম আলোর প্রথম পৃষ্ঠায় পরিসংখ্যান ব্যুরোর আরেকটা গবেষণাপত্রের সূত্র ধরে বলা হয়েছে, ‘বাংলাদেশে নারীদের গৃহস্থালির কাজের অর্থমূল্য হিসাব করা হয় না। এটা করা গেলে অর্থনীতিতে নারীর অবদান আড়ালে থেকে যেত না।’
কাজেই, আজ যে আওয়াজ উঠেছে, নারীকে ধন্যবাদ, কৃতজ্ঞতা ও শ্রদ্ধা জানাতে হবে, ঘরে-বাইরে তাঁর অপরিসীম অবদানের জন্য, আর তাঁর কাছে ক্ষমা চাইতে হবে, তাঁকে বলতে হবে, স্যরি, দুঃখিত। কারণ, তাঁর এই অবদানের স্বীকৃতি দিইনি আমরা এত দিন, সেই আওয়াজে আমাদের সব পুরুষকেই কণ্ঠ মেলাতে হবে।
নারীর সামনে নতজানু হয়ে করজোড়ে ক্ষমা প্রার্থনা করি। পরিসংখ্যান ব্যুরোর জরিপ যে চিত্র তুলে ধরেছে, তা দেখার পর নিজেদের অপরাধী ছাড়া আর কিছুই মনে হয় না। রাষ্ট্রের নিশ্চয় করণীয় আছে, আইনশৃঙ্খলার সঙ্গেও এসবের সম্পর্ক আছে, দৃষ্টান্তমূলক সাজাও অপরাধ কমিয়ে আনে। সব ঠিক, কিন্তু আমার নিজের ঘরে যদি নারী আমার দ্বারা নির্যাতিত হন, তাহলে তার দায় তো আমারই। আমি জানি না, ক্ষমা চাইলেই সেই অপরাধের দায় থেকে নিজেকে বাঁচাতে পারব কি না।
এই পরিসংখ্যানের আরেকটা দিক খুবই উদ্বেগজনক। ইচ্ছার বিরুদ্ধে নারীরা ১০ থেকে ১৪ বছর বয়সে ৪১ দশমিক ৮ ভাগ যৌনতার শিকার হয়, ১৫ থেকে ১৯ বছরে হয় আরও ৩৪ দশমিক ৩ ভাগ। তাহলে ৭৬ ভাগ নারী ১০ থেকে ১৯ বছরের মধ্যেই যৌন নির্যাতনের শিকার হন। কী ভয়াবহ তথ্য!
কাজেই, এই রচনাটার শিরোনামটিই আবার বলতে হয়। আপনি কি আগের মতোই নারী নির্যাতন করেন? আপনি কি আগের মতোই অনিচ্ছুক নারীর ওপরে বল প্রয়োগ করেন? এই প্রশ্ন অপ্রাসঙ্গিক নয়। হয়তো আপনি বলবেন, ‘না, আমি করি না, কখনোই করিনি।’ কিন্তু মনে রাখবেন, আপনার পাশে দাঁড়ানো আর নয়জন এই কাজ করেছেন। নারীর ওপরে যৌন নির্যাতন যদি ৮০ ভাগ ক্ষেত্রেই হয়ে থাকে, তার পেছনে নিশ্চয়ই ৮০ ভাগ পুরুষ জড়িত। কাজেই বলা যাবে, আপনার পাশে দাঁড়িয়ে থাকা পাঁচজন পুরুষের মধ্যে চারজনই এই কাজ করেছেন। কী বলব। লজ্জাই পাই শুধু।
সত্যি সত্যি, পারিবারিক নির্যাতনের সামাজিক গ্রহণযোগ্যতা একটা বড় বাধা। পুরুষবাদী মানসিকতা তো আছেই।
আমাদের এই গ্রহণযোগ্যতার বিরুদ্ধে সরব হতে হবে, বলতে হবে, ঘরের মধ্যে নারী নির্যাতন চলতে পারে না। এটা গ্রহণযোগ্য নয়। আমরা সবাই মিলে আওয়াজ তুলে বাংলাদেশের অনেক ক্ষেত্রে অনেক উন্নতিই তো ঘটাতে পেরেছি। এ ক্ষেত্রে না পারার কোনো কারণ দেখি না। একই কথা বলব বাল্যবিবাহ বা কৈশোরবিবাহের ক্ষেত্রে। আমাদের দেশে ৬৭ ভাগ মেয়েরই আইনি বয়সের আগেই বিয়ে হয়ে যায়। এর পেছনেও নিশ্চয়ই সামাজিক, অর্থনৈতিক, সাংস্কৃতিক অনেক কারণ রয়েছে। কিন্তু সচেতনতার অভাবও কিন্তু কম দায়ী নয়। আমরা সবাই মিলে আওয়াজ তুললে এই অপরিণত বয়সের বিয়েও আমরা রোধ করতে পারব। বাল্যবিবাহও কিন্তু পারিবারিক নির্যাতনের অন্যতম কারণ।

আমি জন্মগ্রহণ করিনি…
আমাদের ছোটবেলায় কোনো জন্মদিন ছিল না। ছোটবেলায় গল্প শুনেছি, একবার বড় ভাইয়ের একবার মেজভাইয়ের জন্মদিন নাকি তাদের ছোটবেলায় পালিত হয়েছিল। আমি চার নম্বর সন্তান। আমারটা কেউ মনে রাখেনি। আমার সার্টিফিকেট জন্মদিন ১লা জানুয়ারি। তো একবার ঢাকা থেকে রংপুর গিয়ে আব্বার ডায়েরিতে দেখলাম স্পষ্ট ইংরেজিতে লেখা, আনিসুল হকের জন্ম তারিখ ৪ মার্চ। সেটাও মনে রাখার প্রয়োজন মনে করিনি। অনেকদিন পরে মার্চ মাস এলো। বন্ধুরা বলল, তোমার জন্মদিন যেন কত মার্চ। আমি সংখ্যা বা নাম্বার মনে রাখতে পারি না, বললাম, ৩ মার্চ। ব্যস সেই থেকে ৩ মার্চ। বেশ বইয়ের পেছনে লিখে রাখলাম, তিন মার্চ। পরে আবার রংপুরে গিয়ে আব্বার ডায়েরি বের করে দেখি ৪ মার্চ। কাজেই আমার তিনটা জন্মদিন। ১ লা জানুয়ারি, ৩ মার্চ, ৪ মার্চ।
এবার ৪ মার্চে কিশোর আলোর ছেলেমেয়েরা বাসায় এসেছিল। এটা ছিল সারপ্রাইজ। কিন্তু ওদের একজন বিশ্বাসঘাতকতা করে আগের রাত ৯টায় আমাকে জানিয়ে দিল, আমরা কাল আসব। আমার মাথায় বজ্রপাত। কারণ তখনও কিশোর আলোর মার্চ সংখ্যার কাজ শেষ হয়নি। বাসায় আমাদের মূল কাজের সহকারিনী নাই। এবং বাসায় এক টুকরা বিস্কুট বা মিষ্টি বা অন্য কোনো খাবার কেনাও নাই। চুলায় যাক কিশোর আলো। আমি তাড়াতাড়ি বের হলাম। ড্রাইভারও ছিল না। রাহীদের গাড়ি ধার নিয়ে এ দোকানে যাই ও দোকানে যাই। যাই হোক। ওরা বাসায় আসায় মজাই হলো।
দুপুরেও বেশ মজাই হলো ওয়াইডব্লুসি স্কুলে। কিশোর আলোর লেখাজোকা অনুষ্ঠানে বাচ্চারা শুভেচ্ছা জানাল। ম্যাডামরা জানালেন।
এখন আমি বুঝেছি, মুহম্মদ জাফর ইকবাল স্যার কেন বলে থাকেন– কিশোরদের জন্যে লেখার মজাই আলাদা। কিশোর আলো করতে গিয়ে বুঝলাম, বাচ্চারা জেনুইন, তাদের সমালোচনাও জেনুইন, ভালোবাসাও জেনুইন। থ্যাংক ইউ কিশোর আলো বাহিনি, ধন্যবাদ ওয়াইডব্লুসিএ স্কুল।

March 11, 2014
এই ছবিটা ২০০৮ এর
আমরা গিয়েছিলাম উড়িষ্যা। ভুবনেশ্বর। কোনার্ক মন্দির। পুরির সমুদ্র। চিল্কা হ্রদ। উপলক্ষ মা বইয়ের উড়িয়া অনুবাদের প্রকাশনা উৎসব। আমাদের সঙ্গে ছিলেন সরোজিনী সাহুদিদি আর ছিলেন জগদীশদা। তার স্বামী। লেখক ও পণ্ডিত। সরোজ বাল ছিলেন প্রকাশক। সুরেশ বলবন্তরে অনুবাদক। আজ সবাই আছি। শুধু জগদীশ দা নাই। অন্য মনস্কভাবে রেল লাইন পার হতে গিয়ে ট্রেনে কাটা পড়ে সম্প্রতি লোকান্তরিত হয়েছেন।

Anisul Hoque's Blog
- Anisul Hoque's profile
- 167 followers
